Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এই গণবিক্ষোভ কার্যতই একটি দ্রোহকালের ছবি এঁকে দিয়েছে

সাগরিকা শূর

 


ফলাফলের দিকে তাকালে আশাব্যঞ্জক দিন এখনও কিছু দেরি বলেই মনে হয়। তবু এই গণবিক্ষোভ যে কার্যতই একটি দ্রোহকালের ছবি এঁকে দিতে সমর্থ হয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় প্রাপ্তি। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে দু-মাস ধরে পথে নামতে সামিল করানোর কাজটিও বড় সহজ কথা নয়। সহজ কথা নয় গণস্মৃতির অস্থায়িত্বকে দীর্ঘ সময় ধরে চ্যালেঞ্জ করে জনগণমনের সার্বিক স্মৃতিতে উৎসবমুখর পরিবেশেও একটি আন্দোলনের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা। এতদিন ধরে সেই প্রজ্জ্বলনের কাজটি যাঁরা সম্মুখসারিতে থেকে নিরলসভাবে করলেন ও করছেন কোনও কৃতজ্ঞতাই তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রশাসনের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে যেসব জুনিয়র ডাক্তার নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য উপেক্ষা করে এখনও অনশনরত, যে-সব সহনাগরিক শাসকের উল্লাস, শহরজোড়া উদযাপনের জোয়ারে গা না-ভাসিয়ে, ব্যান্ডওয়াগন এফেক্টকে অস্বীকার করে সামিল হলেন প্রতিবাদের উদযাপনে কুর্নিশ তাঁদেরও। এ-ক্ষেত্রেও এই গণজাগরণ নিজস্ব মহিমায় স্বতন্ত্র

 

৯ আগস্ট, ২০২৪। পশ্চিমবঙ্গবাসী ও সমগ্র কলকাতা শহর সাক্ষী রইল একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ডের। দু-মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে ঘটনার বিবরণ অপ্রয়োজনীয়। বরং এই মাস দুয়েক সময়কালকে একটু কালানুক্রমে ফিরে দেখা যাক।

এই ঘটনার পরই ১৪ আগস্ট শুরু হয় ‘রাত দখল’-এর ডাক। প্রাথমিকভাবে কলকাতাকেন্দ্রিক, বিশেষত কলকাতার তিনটি অঞ্চলে রাতদখলের আহ্বান এলেও অচিরেই এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে মফস্বল পেরিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরেও। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে আমরা দেখলাম প্রায় আচম্বিতেই কীভাবে ঘটে গেল এক গণজাগরণ, যেখানে আদৌ কত মানুষ জড়ো হবে এ-সংশয় ছিল গোড়া থেকেই, সেখানে স্বাধীনতা দিবসের মধ্যযামিনীতে রাস্তায় ভিড় জমাল হাজারে হাজারে আবালবৃদ্ধবনিতা, এবং তাদের সহযোগী হয়ে এগিয়ে এল পুরুষ সহনাগিরকেরাও৷ ব্যক্তিগতভাবে সে-রাতে সোদপুর অঞ্চলের রাতদখল অভিযানে থাকার সুবাদে জানি কয়েক লক্ষ লোক (লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে) এসে জমা হন, হঠাৎ দেখলে মহাষ্টমীর রাতে শ্রীভূমির ভিড় মনে হওয়া আশ্চর্যের নয়। সে ছবিও পরদিন কাগজ ও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এবং সবচেয়ে আশার কথা এ-দৃশ্য শুধু কলকাতা বা সোদপুরের নয়, শহর ও শহরের উপকণ্ঠের অন্যান্য প্রান্ত ও গ্রামাঞ্চলেরও। তারও চেয়ে আশার কথা এই গণবিক্ষোভ শুধু ১৪ আগস্টেই থেমে থাকেনি (যে আশঙ্কা অনেকেরই মনে এসেছিল প্রাথমিকভাবে), এরপর থেকেই একের পর এক কর্মসূচি গৃহীত হতে থাকে। কখনও ডাক্তারদের পক্ষে, কখনও নাগরিক সমাজের পক্ষে, কখনও রাতদখল-এর উদ্যোক্তাদের পক্ষে, কখনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেও। সর্বশেষ উদ্যোক্তাদের প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি শাসক দল নিজেই এ-সময় একাধিক মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেছে, কখনও ন্যায়বিচারের দাবিতে, কখনও অপরাধীর ফাঁসির দাবিতে। বিষয়টি আপাত হাস্যকর ও চটকদার হলেও একটি কথা এ-ক্ষেত্রেও অনস্বীকার্য যে শাসক কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড সেই ভয়েরই প্রকাশ, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির বোধহয় বিরল যেখানে সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেদের হাতে থাকা সত্ত্বেও শাসক নিজের বিরুদ্ধেই পথে নেমেছে। তবে এই পথে নামার অপর একটি উদ্দেশ্য হয়তো ছিল সাধারণ মানুষকে এ-কথা বোঝানো যে শাসক তার পক্ষেই আছে বা দোষ আদতে শাসকের নয়, এ নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ কিন্তু এ-ক্ষেত্রেও প্রায় শাসককে ধূলিসাৎ করে সাধারণ মানুষ প্রমাণ করে দেয় যে এবারের লড়াই বেশ শক্ত। ১৪ আগস্ট থেকে ক্রমাগত বিভিন্ন স্তরে দফায় দফায় মিছিল, বিক্ষোভ, প্রতিবাদসভা গণজাগরণ ও আন্দোলনকে তীব্রতর করেছে, শাসককে করেছে দুর্বল। এইটিই হয়তো এ-যাবৎ এ-বিক্ষোভের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। যদিও প্রাপ্তির তালিকা দীর্ঘ অন্যত্রও। গত কয়েক দশকে এ-দেশে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে কোনও সামাজিক কারণেই এভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান-নির্বিশেষে, লিঙ্গ ও বয়স-নির্বিশেষে প্রতিবাদে সামিল হতে পারেনি।

কার্যত ও আক্ষরিক অর্থেই আট থেকে আশি বারংবার পা মিলিয়েছে এই গণবিক্ষোভে। বহু অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, তেমনই দেখা গিয়েছে একাধিক কচিকাচাদের। সোশাল মিডিয়ায় সে-সব ছবি ভাইরাল হয়েছে বারবার, এও নিঃসন্দেহে এই দ্রোহকালেরই প্রাপ্তি।

তবু এতসব স্বীকার করে নিয়েও এখনও কিছু কথা উঠে আসেই, উঠে আসে কিছু সঙ্গত প্রশ্নও। এ-সময় যেমন নতুন করে শেখাচ্ছে জীবনের মানে, আঘাত করছে মানুষের চেতনাকে, একপ্রকার জড়ভরত হয়ে পড়া সমাজকে স্থবির থেকে করে তুলেছে জঙ্গম, তবু এ-কথা ভুললে চলবে না যে ন্যায়বিচার এখনও অধরা। স্কেপগোট হিসেবে একমাত্র যার বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট পেশ করেছে সেই সঞ্জয় রায়ই যে একমাত্র দোষী নয়, এ ধরনের একটি নৃশংস হত্যা যে শুধুমাত্র এক ব্যক্তির পক্ষে (ভীম বা হারকিউলিস হলেও) সম্ভবপর নয়, তা বারংবার বিভিন্ন মহলের কথাবার্তায় উঠে এলেও প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা কেউই এখনও এই অন্যায়ের প্রতিকারে সক্ষম হয়নি এবং বারবার মিছিল ও অন্যান্য অবস্থানে প্রশাসনের দমনমূলক অবস্থান থেকে এ-কথা বলাই যায় কার্যত প্রশাসন ও আন্দোলনকারী এই দুটি স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়ে গিয়েছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আন্দোলন ও অবস্থান সম্পর্কে কুণাল ঘোষ-সহ শাসকদলের কিছু প্রতিনিধিদের একাধিকবার কটূক্তি, এই চূড়ান্ত দুঃসময়েও মাননীয়ার জনগণকে “উৎসবে ফিরুন” বলবার মতো অসংবেদনশীল ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য এবং অবশ্যই সপ্তমীর দিন “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” স্লোগান তোলার কারণে ত্রিধারার মণ্ডপ থেকে সাধারণ দর্শনার্থীদের গ্রেফতার। এই প্রত্যেকটি পদক্ষেপই এই হত্যাকাণ্ড ও আন্দোলনে শাসকের ভূমিকা যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেয়।

অন্যদিকে এ-সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ জুনিয়র ডাক্তারদের দফায় দফায় আমরণ অনশন। একদিকে সারা শহর ও রাজ্য যখন উৎসবের সাঁজোয়া-মুকুটে সেজে উঠেছে, তখনই গত ৫ অক্টোবর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ধর্না ও অনশন করে চলেছেন জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। স্নিগ্ধা হাজরা, অনিকেত মাহাতো, তনয়া পাঁজা, সায়ন্তনী ঘোষ, পুলস্ত্য আচার্য, অর্ণব মুখোপাধ্যায়, সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাস্তবিকই হয়ে উঠেছেন আন্দোলনকারী সমস্ত সমাজের প্রতিভূ। এমনকি অনিকেত মাহাতো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও আন্দোলনকারীদের মনোবল এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে। শেষ কবে এমন অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধ এই শহর দেখেছে তা সত্যিই ভেবে দেখবার মতো। উৎসবের পরিবেশে ও উৎসবের দিনেও পথচলতি সাধারণ মানুষ সামিল হয়েছে ধর্নামঞ্চে। এমনকি ‘উৎসবে ফিরুন’ নির্দেশকে উপেক্ষা করে মহাষ্টমী/মহানবমীর বিকেলে বিপুল জনতা একত্রিত হয়েছে অনশনরত ডাক্তারদের মনোবলবৃদ্ধিতে। এ-চিত্রও এই শহরে বিরল। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব ও তার সমস্ত উদযাপন, জৌলুসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও এ-কথা বলতেই হয় এমনভাবে একই শহরে উৎসব ও প্রতিবাদের উৎসব পালিত হতে এ-শহর বোধহয় আগে কখনও দেখেনি।

এই আন্দোলনকে পশ্চিমের বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে কিছু অ্যাকাডেমিক প্রতর্ক উত্থাপন করাই যায়। কিন্তু, ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় এ-আন্দোলন ও এই দ্রোহকাল তার নিজস্ব স্বকীয়তাতেই উজ্জ্বল। পশ্চিমের অধিকাংশ আন্দোলনই (বিশেষত নারীবাদী আন্দোলন) শুরু হয়েছে কোনও-না-কোনও নারীবাদী দাবিকে কেন্দ্র করে, কখনও তা শ্রমভিত্তিক, কখনও অর্থনৈতিক, কখনও সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনই রাজনৈতিক। আরজিকর হত্যাকাণ্ডের নিরিখে আন্দোলন প্রথমদিকে সাধারণ মানুষের চোখে (ও কিছু গোষ্ঠী দ্বারা প্রচারিত হয়ে) ‘অরাজনৈতিক’ বলে ঘোষিত হলেও বস্তুত পুরো বিষয়টিই আসলে রাজনৈতিক, কারণ “personal is political”। এবং আশার কথা, মানুষ দেরিতে হলেও সে কথাটি অনেকাংশেই অনুধাবন করেছে৷ আসলে ‘দলীয়’ ও ‘রাজনৈতিক’ কথাদুটির ভিত্তি যে আলাদা এই বিষয়টি অনুধাবনেরও বোধহয় সময় এসেছে। এ-প্রসঙ্গে বের্টোল্ট ব্রেশটের একটি উক্তি বিশেষভাবে স্মরণীয়:

The worst illiterate is the political illiterate, he doesn’t hear, doesn’t speak, nor participates in the political events. He doesn’t know the cost of life, the price of the bean, of the fish, of the flour, of the rent, of the shoes and of the medicine, all depends on political decisions. The political illiterate is so stupid that he is proud and swells his chest saying that he hates politics. The imbecile doesn’t know that, from his political ignorance is born the prostitute, the abandoned child, and the worst thieves of all, the bad politician, corrupted and flunky of the national and multinational companies.

অর্থাৎ পৃথিবীতে কোনও ঘটনাই রাজনীতি-ব্যতীত নয়, বরং ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক সমস্ত পরিসরেই ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রে থাকে কোনও-না-কোনও রাজনীতি। একটু ভাল করে লক্ষ করলেই দেখা যাবে আমাদের চারপাশের প্রতিটি সমীকরণই কোনও-না-কোনও রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, গার্হস্থ্য থেকে বহির্বিশ্ব, তামাম দুনিয়া এই রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত, এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি রাজনৈতিক সমীকরণ থাকে৷ এবং এ-ক্ষেত্রেই ‘দলীয়’ ও ‘রাজনৈতিক’ শব্দ দুটির পার্থক্য। দলীয় অর্থে কোনও-না-কোনও দলকেন্দ্রিক (বহুলাংশেই রাজনৈতিক দল) উদ্যোগ, রাজনৈতিক সর্বাংশে তা নয় কখনওই, বরং তা ক্ষমতার দুদিকে থাকা পক্ষ ও প্রতিপক্ষের টানাপোড়েন ও সম্পর্কের সমীকরণকেই নির্দেশ করে অনেকক্ষেত্রেই। এই আন্দোলন সর্বতোভাবেই দলীয় রাজনীতিকে পরিহার করতে পেরেছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দল স্ব-স্ব উদ্যোগে মিছিল ও জনসভা আয়োজন করলেও নাগরিক জমায়েত, মিছিল ও প্রতিবাদসভার প্রত্যেকটিতেই রাজনৈতিক পতাকা বা দলীয় স্লোগানের প্রতি প্রথম থেকেই জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সেদিক থেকে এই গণজাগরণ বিশেষভাবে দৃষ্টান্তমূলক। এভাবে কোনও রাজনৈতিক পতাকা বা দলের আশ্রয় ছাড়া সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন সাধারণ মানুষেরই নেতৃত্বে এত দীর্ঘ সময় ধরে পথে নামতে এ-রাজ্যের মানুষ শেষ কবে দেখেছে বা আদৌ দেখেছে কিনা এইটিই একটি গুরুতর প্রশ্ন। কার্যতই ক্ষমতার আস্ফালনকে চিনে নিতে শিখেছে, শিখছে মানুষ, এ-সময় সাধারণ মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই করে তুলছে রাজনীতিসচেতন। জনগণমনের ক্ষমতা ও প্রতিস্পর্ধা প্রতিভাত করছে এই দ্রোহকাল।

অন্যদিকে এ-আন্দোলন শুধুই একটি নারীবাদী আন্দোলন নয়৷ নারীহত্যা, ধর্ষণ ও নারীসুরক্ষার চরমতম অবনমনকে কেন্দ্র করে এই গণবিক্ষোভ সঙ্ঘটিত হলেও এ-কথা ভুললে চলবে না যে আরজিকরের হত্যাকাণ্ড একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা এবং তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কর্মস্থলে আজও নারী ঠিক কতখানি অসুরক্ষিত। অর্থাৎ জেন্ডার রোলের ঊর্ধ্বে উঠে এ-আন্দোলন চিরাচরিত শাসক ও শোষকের সমীকরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা অর্থাৎ নিরাপত্তাপ্রদানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকেই প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে৷ এখানেও এ-আন্দোলন পশ্চিমের অন্যান্য নারীবাদী আন্দোলনের তুলনায় কিছুটা হলেও ভিন্ন বলেই মনে হয়।

তবে আবারও ফলাফলের দিকে ফিরে তাকালে আশাব্যঞ্জক দিন এখনও কিছু দেরি বলেই মনে হয়। কারণ বিচারব্যবস্থার দিক থেকে দিল্লি দূর অস্ত্। তবু এই গণবিক্ষোভ যে কার্যতই একটি দ্রোহকালের ছবি এঁকে দিতে সমর্থ হয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় প্রাপ্তি। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে (কারণ ও উদ্দেশ্য যাইই হোক) দু-মাস ধরে পথে নামতে সামিল করানোর কাজটিও বড় সহজ কথা নয়। সহজ কথা নয় পাবলিক মেমোরি বা গণস্মৃতির অস্থায়িত্বকে দীর্ঘ সময় ধরে চ্যালেঞ্জ করে জনগণমনের সার্বিক স্মৃতিতে উৎসবমুখর পরিবেশেও একটি আন্দোলনের দীপশিখাকে প্রজ্জ্বলিত করে রাখা। এতদিন ধরে সেই প্রজ্জ্বলনের কাজটি যাঁরা সম্মুখসারিতে থেকে নিরলসভাবে করলেন ও করছেন কোনও কৃতজ্ঞতাই তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রশাসনের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে যেসব জুনিয়র ডাক্তার নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য উপেক্ষা করে এখনও অনশনরত, যে-সব সহনাগরিক শাসকের উল্লাস, শহরজোড়া উদযাপনের জোয়ারে গা না-ভাসিয়ে, ব্যান্ডওয়াগন এফেক্টকে অস্বীকার করে সামিল হলেন প্রতিবাদের উদযাপনে কুর্নিশ তাঁদেরও। এ-ক্ষেত্রেও এই গণজাগরণ নিজস্ব মহিমায় স্বতন্ত্র। এ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘উদ্দেশ্য সংক্ষেপ ও কর্তব্যবিস্তার’ প্রবন্ধাংশ ও তৎসহ চিরাচরিত চাণক্যবাণীও মনে পড়ে যায়:

কেবল ইহাই নয়— দেশের রোগনিবারণ, শিক্ষাবিস্তার, ধনবৃদ্ধি, শান্তিরক্ষা, অন্যায়প্রতিকার প্রভৃতি সমস্ত কাজে ঢের বেশি তন্ন তন্ন করিয়া মনোযোগ দেওয়া যাইতে পারে। গবর্মেন্টকে কর্তব্যশিক্ষা দান করিবার বিস্তৃত আয়োজনে সমস্ত উদ্যম নিয়োগ না করিয়া নিজেদের অদূরবর্তী কর্তব্যপালনের জন্য কিছু অবশিষ্ট রাখা একান্ত আবশ্যক হইয়াছে।

উৎসবে ব্যসনেচৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।

দারিদ্র্যে, দুর্ভিক্ষে রাজদ্বারে আমরা আপন দেশের লোকের সাহায্যে আপনারা উপস্থিত থাকিয়া স্বজাতিই স্বজাতির সর্বপ্রধান বান্ধব ইহাই প্রমাণ করা আমাদের প্রধান কাজ। পার্লামেন্টের সহিত বন্ধুত্বস্থাপনের চেষ্টাও মন্দ কাজ নহে— কিন্তু দেশের লোকের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ন্যায় ফল তাহাতে পাইব না।

এই আন্দোলনের অন্যতম ভূমিকা বোধহয় সঠিক মানুষ চিনতে শেখাতেও। পক্ষপাতহীনতা ছেড়ে কে কোন পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন তা দিয়ে নিয়তই চিনে নেওয়া যাচ্ছে অনেককিছুই— ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্ত স্তরেই। বস্তুতই এ এক অদ্ভুত সময়। আশা রাখব এই সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই সময়ের শিক্ষা মনে রাখবে জনগণ ও শাসক, আশা রাখব এই আন্দোলন যেভাবে ডাক্তারদের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না থেকে বস্তুত গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে, সামিল হয়েছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, অন্যান্য সামাজিক সমস্যাতেও একইভাবে এই জনসচেতনতা ও জনসমর্থন (সর্বস্তরে) দেখবে আগামী। এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে দিতে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তুলতে, চিনে নেওয়ার পাঠ নিতে নিতেই হাঁটতে হবে আরও অনেক মাইল, অনেক মিছিল।

পথ যে এখনও অনেক বাকি!


*মতামত ব্যক্তিগত