আকৃতি হান্ডা
এই লেখায় আমরা হরিয়ানার দলিত ভোট নিয়ে একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করব। দেখব, কেন এবং কীভাবে এই দলিত ভোট ভাগ হয়ে গেল, এবং যে-সব এসসি ভোটাররা মাত্র চার মাস আগের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন তাঁরা কেন এই বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে ভোট দিলেন
“কংগ্রেস আমাদের গুরুত্ব দেয়নি, অবহেলা করেছে। তাই আমরা বিজেপির পক্ষ নিয়েছি”— বলছিলেন দেবীদাস বাল্মীকি— হরিয়ানা ডিপ্রাইভড শিডিউলড কাস্ট সঙ্ঘ-এর প্রধান।
সদ্যোসমাপ্ত হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের অপ্রত্যাশিত পরাজয় এবং বিজেপির চমকপ্রদ জয়ের অন্যতম কারণ দলিত ভোটের পক্ষ পরিবর্তন করা।[1] এর পেছনে রয়েছে ভোটের দিন ঘোষণার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে গত ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়। ওই রায়ে সর্বোচ্চ আদালত রাজ্য সরকারগুলিকে তফসিলি জাতিগুলির (এসসি) মধ্যে সংরক্ষণের জন্য সাব-কোটা ব্যবস্থা চালু করার অনুমতি দেয়।
কার্যকরীভাবে এর অর্থ হল, দলিতদের মধ্যে যে-সব জাতগুলির জনসংখ্যা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষা, চাকরি বা রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধিত্ব নামমাত্র— অর্থাৎ ডিপ্রাইভড শিডিউলড কাস্ট বা ডিএসসি— কোনও রাজ্য সরকার চাইলে এসসি-দের জন্য নির্ধারিত কোটার মধ্যেই তাদের জন্য সাব-কোটা ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় বিশেষ করে প্রাধান্যকারী এসসি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
একদিকে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এবং চন্দ্রশেখর আজাদের আজাদ সমাজ পার্টি (এএসপি) সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে এবং ২১ আগস্ট ভারত বন্ধ-এর ডাক দেয়। অন্যদিকে, হরিয়ানার নয়াব সিং সাইনির বিজেপি সরকার ১৮ আগস্ট ঘোষণা করে যে নির্বাচনের পরে তারা সরকারি চাকরিতে দলিতদের জন্য যে ২০ শতাংশ সংরক্ষণ আছে, তার অর্ধেক ডিএসসি-দের জন্য সংরক্ষিত করবে।
এই লেখায় আমরা হরিয়ানার দলিত ভোট নিয়ে একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করব। দেখব, কেন এবং কীভাবে এই দলিত ভোট ভাগ হয়ে গেল, এবং যে-সব এসসি ভোটাররা মাত্র চার মাস আগের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন তাঁরা কেন এই বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে ভোট দিলেন।
হরিয়ানার ডিপ্রাইভড শিডিউলড কাস্ট সম্প্রদায় কংগ্রেসের পক্ষ নিল না কেন
“কংগ্রেসের প্রতি ডিএসসি-দের বীতরাগ দীর্ঘদিনের, আর বর্তমান তাঁদের সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম সেলজা”— বলছিলেন হিসারের সমাজকর্মী কমল ভাঁওরি। কমল হরিয়ানার ডিএসসি, ডিনোটিফায়েড যাযাবর এবং আধা-যাযাবর মানুষদের মধ্যে কাজ করেন।
তিনি দ্য কুইন্ট-কে বলছিলেন ১৯৬৬ সালে যখন হরিয়ানা পাঞ্জাব থেকে আলাদা হয়, তখন থেকেই ডিএসসি-রা প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন। ১৯৯৩ সালে হরিয়ানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল বিভিন্ন এসসি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সংরক্ষণের সুবিধার বণ্টন কেমন হচ্ছে তা দেখার জন্য একটি রিপোর্ট চেয়েছিলেন।
কমল জানান, “১৯৯৪ সালে গুরনাম সিং কমিশনের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় উপকৃত এসসি-দের মধ্যে ৭৪ শতাংশই চামড়ার কাজে যুক্ত। যেমন— চামার, রেহগর, রামদাসি, রবিদাসি, জাতব, মুচি ইত্যাদি সম্প্রদায়। আর বাকি ২৬ শতাংশ বাল্মীকি, খটিক, ধনক ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ।”
যাই হোক, হরিয়ানার চামার মহাসভার গজে সিং মুওয়াল এই নোটিফিকেশনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন এবং ২০০৬ সালে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট এটি বাতিল করে।
কমল আরও জানালেন, “এর মধ্যেই ২০০২ সালে মীরা কুমার প্রস্তাব দিলেন যে, যে-সমস্ত সম্প্রদায়গুলি চামড়ার কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা যেন তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেটে চামার লেখে। এর ফলে সমস্ত প্রাধান্যকারী এসসি সম্প্রদায়গুলি এক ছাতার নিচে চলে এল, এবং রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে তাদের পাণিপ্রার্থনা করা সহজতর হয়ে গেল।”
২০০৫-এ যখন ভূপিন্দার সিং হুডা হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী, তখন তিনি দলিতদের উপ-বিভাগিকরণ বাতিল করেন এবং সবাইকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসেন। প্রাধান্যকারী চামার সম্প্রদায় থেকে আসা সেলজা তখন আম্বালার সাংসদ এবং অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি (এআইসিসি)-র সদস্য।
“ডিএসসি-দের নেতা হিসেবে সেলজার গ্রহণযোগ্যতা ২০০৫ থেকেই হ্রাস পেতে থাকে। কংগ্রেস যে এইবার আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে পাশে সরিয়ে রাখল, তার কোনও প্রভাব ডিএসসি ভোটের ওপর পড়েনি”— বলছিলেন কমল।
চাকরি এবং রাজনীতিতে ডিএসসি-দের সঙ্কুচিত প্রতিনিধিত্বের অভিযোগ
হরিয়ানার জনসংখ্যার ২২.৫ শতাংশ হল তফসিলি জাতি— যার মধ্যে চামার-সম্পর্কিত সম্প্রদায়গুলি ৮ শতাংশ এবং বাকি ১৪.৫ শতাংশ ডিএসসি সম্প্রদায়গুলি। হরিয়ানায় সাপেরা, বাজিগর, ইত্যাদির মতো ডিনোটিফায়েড ট্রাইবগুলিকেও ডিএসসি-দের মধ্যেই ধরা হয়।
সংখ্যার দিক দিয়ে চামার-সম্পর্কিত সম্প্রদায়গুলির জনসংখ্যা ৩০ লাখের কিছু বেশি, এবং ডিএসসি-দের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। গত ৯ আগস্ট এই পরিসংখ্যান দিয়েছে হরিয়ানা স্টেট কমিশন ফর শিডিউলড কাস্ট।
কমল বলছিলেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বা রাজনীতিতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব এখনও খুব কম। ডিএসসি সম্প্রদায়ের ৮৭ শতাংশ মানুষের পাকা বাড়ি নেই, ৩০ শতাংশ এখনও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। হামারে লিয়ে আজাদি হোনা ইয়া না হোনা— এক হি বাত হ্যায়।”
নিচের সারণীতে দেখা যাবে হরিয়ানার সরকারি চাকরিগুলি প্রাধান্যকারী (চামার এবং সম্পর্কিত) এবং বঞ্চিত (ডিপ্রাইভড— অ-চামার) এসসি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে কেমনভাবে বণ্টিত হয়েছে। গ্রুপ-এ এবং গ্রুপ-বি চাকরিতে প্রাধান্যকারী সম্প্রদায়গুলির অংশগ্রহণ অনেক বেশি। আর সুইপার, হেলপার ইত্যাদির মতো গ্রুপ-ডি পোস্টের চাকরিগুলিতে ডিএসসি-দের অংশগ্রহণ বেশি। এই পদগুলির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কম লাগে।
হরিয়ানার সংরক্ষিত ১৭টি বিধানসভা আসনে এবারের নির্বাচিত বিধায়কদের মধ্যে ১১ জনই চামার সম্প্রদায়ের, আর বাকি ৬ জন ডিএসসি সম্প্রদায়ের। সংরক্ষিত ২টি লোকসভা আসনে নির্বাচিত দুজন সাংসদই চামার সম্প্রদায়ের।
২০০৬ সালে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট যে এসসি-দের মধ্যে উপবিভাগ বাতিল করা নিয়ে রায় দেয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করে সন্ত কবীর মহাসভা হরিয়ানা এবং বাল্মীকি মহাসভা হরিয়ানা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে।
দ্য কুইন্ট-কে দেবীদাস বললেন, “আমরা এই লড়াইটা চালাচ্ছি ১৮ বছর ধরে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলাকালীন বা সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পরে— যে-রায়ে সাব-কোটাকে অনুমোদন দেওয়া হয়— কোনও সময়েই কংগ্রেস কোনও আগ্রহ দেখায়নি। ফল তো এখন সবাই দেখতেই পাচ্ছে।”
লোকনীতি-সিএসডিএস-এর করা একটি ভোট-পরবর্তী সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০২৪-এর হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ ডিএসসি সম্প্রদায়ের মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। অন্যদিকে চামার জাতিগুলি বেশিরভাগই ভোট দিয়েছে কংগ্রেসকে।
দলিত ভোটাররা লোকসভা থেকে বিধানসভা ভোটে আনুগত্য বদলালেন কেন?
বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের হার অপ্রত্যাশিত। আরও বিশেষ করে লোকসভা ভোটে তাদের চমকপ্রদ পারফরমেন্সের পরে। লোকসভা ভোটে তারা হরিয়ানার মোট ১০টার মধ্যে ৫টা আসন বিজেপির থেকে কেড়ে নেয়, যার মধ্যে ২টি এসসি-দের জন্য সংরক্ষিত।
কমল বলছিলেন, “লোকসভা ভোটের সময় অন্তত ১৯ জন বিজেপি প্রার্থী দাবি করেছিলেন যে তাঁরা সংবিধান পরিবর্তন করবেন। যার ফলে দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়।”
গত সপ্তাহে দ্য কুইন্ট রিপোর্ট করেছে ১৭টি সংরক্ষিত বিধানসভা আসনের অন্তত ৪টিতে দলিত ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন যাঁরা লোকসভা ভোটে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন।[2]
লোকসভা ভোটের পরে মাসগুলিতে হরিয়ানা জুড়ে ডিএসসি সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে পৌঁছনোর জন্য অসংখ্য প্রোগ্রাম হয়েছে। কমল যেমন বলছিলেন তিনি ২৬৬৭টি পাবলিক মিটিং করেছেন এবং ডিএসসি সম্প্রদায়ের প্রায় ২২০০০ মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন। দেবীদাস বলছিলেন তিনি গত এপ্রিল থেকে ৯টি ‘মহাসম্মেলন’ আয়োজন করেছেন।
কমল বলছিলেন প্রতিটি পাবলিক মিটিঙে হাজার-হাজার জন অংশ নিয়েছেন। মিটিংগুলি হয়েছে পানিপথ, কইথাল, রোহতক, হিসার-এ। সর্বশেষটি হয় এই বছর ২২ সেপ্টেম্বর।
‘বিজেপিকে শেষ লাইফলাইনটা দিয়েছে ডিএসসি-রাই’
“কংগ্রেস যখন আমাদের গুরুত্ব দিল না, তখন আমরা অনেকবার বিজেপি নেতাদের কাছে গেছি। ২০১৪ এবং ২০১৯ বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে বিজেপি সাব-কোটার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও সে নিয়ে বেশি কিছু করেনি— বলেছিল বিষয়টা বিচারাধীন। এইবার, বিজেপিকে আমরা শেষ লাইফলাইনটা দিলাম”— বলছিলেন দেবীদাস।
তিনি আরও বলেন, “ডিএসসি-দের পক্ষে বিজেপি কিছু পদক্ষেপ অন্তত নিয়েছে।” মনে করিয়ে দেন, ২০২০-তে হরিয়ানা মন্ত্রীসভা শিক্ষায় এসসি-দের জন্য নির্ধারিত সংরক্ষণকে প্রাধান্যকারী এবং বঞ্চিতদের মধ্যে ভাগ করার জন্য একটি বিল পাশ করে।
নয়াব সিং সাইনি ১৭ অক্টোবর শপথ নেবেন, বাল্মীকি জয়ন্তীর দিন, যে দিনটি পালিত হয় রামায়ণ-রচনাকার বাল্মীকির জন্মবার্ষিকীতে।
“৫৮ বছরে এই প্রথমবারের জন্য ডিএসসি-সম্প্রদায়গুলি তাদের উপস্থিতি বোঝাতে পেরেছে। এ-বছর আমরা দুবার বাল্মীকি জয়ন্তী পালন করব। ১৭ অক্টোবর, আর যেদিন সাব-কোটা ব্যবস্থা কার্যকরী হবে সে-দিন,” জানালেন দেবীদাস।
*নিবন্ধটি দ্য কুইন্ট-এ গত ১৭ অক্টোবর ইংরেজিতে প্রকাশিত।
[1] Handa, Aakriti. Did the Dalit vote cost Congress its expected victory? The Quint. Oct 11, 2024.
[2] পূর্বোক্ত।