অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দেখা গিয়েছে, বিশেষ একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক অনীহা ক্রমশই প্রকট ও স্পষ্ট আকার ধারণ করেছে। অবিচার শব্দটি এখানে লিখছি না, কারণ ‘সমাজগত অনীহা’ বিষয়টি অভিঘাতের দিক থেকে দেখলে সাধারণ একেকটি রাজনৈতিক বা সামাজিক অবিচারের ঘটনার চেয়ে অনেকগুণে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৪-পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট প্রচার-পরিকল্পনার মাধ্যমে সার্বিক সমাজে মুসলিম জনসংখ্যার যে সামগ্রিক ‘অপরায়ন’ সম্ভব হয়েছে, এমন প্রতিটি সমীক্ষায় সেই অঙ্কই উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ উচ্চারণ বিপদের আশঙ্কা বাড়ায়। চারপাশে কেবলই ভ্রূকুঞ্চিত মুখ, অথবা সরাসরি প্রশ্ন— প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘু নিপীড়ন বিষয়ে কই মতামত দিচ্ছ না যে বড়! প্রথমত সংখ্যালঘু, অর্থে সংখ্যার নিরিখে যারা দুর্বল, সব দেশে সব কালে তাঁদের উপরে হওয়া সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিপীড়নের সোচ্চার বিরোধিতা প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশের ঘটনা যেমন আমাদের নিন্দার্হ হওয়া উচিত, তেমনই স্বদেশে যেন আমাদেরই সহনাগরিক-পরিজনকে একই অবস্থায় পড়তে না হয়— তা সুনিশ্চিত করাটাও আমাদের কর্তব্য। তাই দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষত সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী মানুষদের অবস্থা কেমন, সেই নিয়ে আলোচনা জরুরি।
তথ্য বলছে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের হিসেব অনুযায়ী সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শিখ ধর্মের মানুষদের বেকারত্বের হার সর্বাধিক। ২০২২-২৩ সালে যেখানে শিখ জনসংখ্যায় বেকারত্বের হার ছিল ৫.১ শতাংশ, চলতি বছরের নিরিখে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৮ শতাংশে। এরপরেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের অবস্থান। অথচ বিগত এক বছরে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মুসলিমদের ক্ষেত্রে, ২.৪ শতাংশ থেকে তা বেড়ে হয়েছে ৩.২ শতাংশ— আট শতাংশ পয়েন্টের বৃদ্ধি। হিন্দুদের ক্ষেত্রে অবশ্য বেকারত্বের হার ০.১ শতাংশ হলেও কমেছে। সামগ্রিকভাবে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ, অর্থাৎ কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় সব ধর্ম বা বিশ্বাসের মানুষের ক্ষেত্রেই বেকারত্বের হার গোটা দেশে কমেছে। আশার কথা বলতে গেলে কেবল এই। উল্লেখযোগ্য হল, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের হিসেব অনুযায়ী সংখ্যালঘু জনসংখ্যার নিরিখে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের ক্ষেত্রেই বেকারত্বের হার ছিল সর্বাধিক।
এখন শিখ অথবা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের ক্ষেত্রে এই বেকারত্বের হার বৃদ্ধির ঘটনাকে সাদা চোখে অনুধাবন করলে আশঙ্কার কারণ রয়েছে। কারণ দারিদ্র্যসীমার নিরিখে দেশের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যাই এখনও ধর্মের নিরিখে সবচেয়ে গরিব। অনগ্রসর জাতি বা জনজাতিকে এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০০৪-০৫ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুসারে দেশের ২২.৭ শতাংশ মানুষকে দরিদ্র বলে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে দলিত ও জনজাতি জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ ও মুসলিম জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ মানুষকে দরিদ্র বলে জানানো হয়। কুড়ি বছর পেরিয়েও এর সামগ্রিক বিন্যাসে তেমন একটা বদল আসেনি। কাজেই অর্থনৈতিকভাবে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের অনগ্রসরতা সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানের মাধ্যমেই স্পষ্ট। তাহলে কেন শিখ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি?
অর্থনীতির অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডু, যিনি সাচার-পরবর্তী অর্থনৈতিক সমীক্ষাগুলিতেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, তাঁর মত অনুসারে শিখ অথবা খ্রিস্টানদের বেকারত্বকে এভাবে সরাসরি সংখ্যার নিরিখেও দেখা উচিত নয়। অর্থনীতির তত্ত্ব-অনুসারেই ‘পশ্চাদপসরণের ধারণা’ বা ‘উইথড্রয়াল এফেক্ট’ বলে একটি বিষয় রয়েছে। যে তত্ত্ব অনুসারে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে থাকা গোষ্ঠী অনেক সময়েই মন্দার প্রভাব দেখলে নিজেরাই কিছু সময়ের জন্য বাজার-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। পরিস্থিতি অনুকূলে ফিরলে আবারও তারা মূলস্রোতের প্রতিযোগিতায় ফিরে আসে। তাদের সুস্থিত আর্থ-সামাজিক অবস্থানই তাদের এই পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে। ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিচারে শিখ বা খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে এই ‘পশ্চাদপসরণের’ সুযোগ নেওয়ার অবস্থা রয়েছে। তাই তাদের বেকারত্ব-বৃদ্ধি নতুন করে কোনও অতিরিক্ত আশঙ্কা বা দারিদ্র্যের প্রাদুর্ভাবের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে না। যত না চিন্তায় ফেলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নকরণের ঘটনা।
আদর্শ ব্যবস্থায়, নূন্যতম মজুরি অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মদিবসের নিশ্চয়তা না থাকলে— এমন কোনও পেশা বা আয়ের উৎসকে ভিত্তি করে কোনও মানুষকে বেকার অথবা বেকার নয় এমনটা বলা চলে না। এই কারণেই শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার অধিক। কারণ শহরে অনেক মানুষ একান্তভাবেই সংসার চালাতে না পেরে কোনও না কোনও কাজে, যা মজুরি দূরে থাক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেও আয় সুনিশ্চিত করে না— এমন উপায়কে বেছে নিতে বাধ্য হয়। কাজেই তারা নিজেদের বেকার বলতে অস্বীকার করে। এই কারণেই সমীক্ষা বলছে, শহরাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যার ভিতরেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম। অথচ দারিদ্র্যের নিরিখে তাদের অবস্থান আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
দারিদ্র্য, অথবা বেকারত্বের নির্ণয়-পদ্ধতিতে আরেকটি সাংখ্যমান গুরুত্ব সহকারে বিচার করা উচিত। তা হল জনসংখ্যার যে অংশ নিজেদের বেকার বলতে অস্বীকার করছে, তাদের মধ্যে বেতনভুক কর্মচারীর সংখ্যা। বিগত পাঁচ বছরের তথ্য বলছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির প্রতিটির ক্ষেত্রেই বেতনভুক নাগরিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, এবং— এই হ্রাসের পরিমাণ শিখেদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম, মুসলিমদের ক্ষেত্রে সর্বাধিক।
২০১৯-২০ অর্থবর্ষের হিসেব অনুযায়ী কর্মরত মুসলিম জনসংখ্যার ২১.৫ শতাংশ যেখানে নিজেদের বেতনভুক বলে চিহ্নিত করেছিলেন, ২০২৩-২৪-এ সেই মানই এসে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। একই সময়ে কর্মরত খ্রিস্টান জনসংখ্যায় বেতনভুক কর্মচারীর হার ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের ২৯.৯ শতাংশের তুলনায় চলতি অর্থবর্ষে কমে দাঁড়িয়েছে ২৭.৬ শতাংশে। শিখেদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের ২৭.৪ শতাংশের তুলনায় চলতি অর্থবর্ষে ২৬.৭ শতাংশে। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই হ্রাসের হার ২২.৭ শতাংশ থেকে ২১.৭ শতাংশ। কাজেই দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রান্তিকীকরণের হার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি বলে দেখা যাচ্ছে। সাক্ষরতার হার বা অন্যান্য বিষয়ও নিশ্চিতভাবে এই পরিসংখ্যানকে প্রভাবিত করে। ঠিক যে কারণেই মেয়েদের কর্মসংস্থানের নিরিখে মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েরা এই মুহূর্তে সকলের তলায় রয়েছে।
আশার কথা হল সামগ্রিকভাবে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৭.৬ শতাংশ থেকে ২.১ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ৭৯.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। মুসলিমদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৭.৬ শতাংশ। হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে ৭৭.৭ শতাংশ থেকে ৭৯.৬ শতাংশ। শিখেদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ, ৭৯.১ শতাংশ থেকে ৮২.৮ শতাংশ, কাছাকাছিই রয়েছেন খ্রিস্টানেরা— তাঁদের সাক্ষরতার হার ৮৪.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৭.৬ শতাংশ।
অর্থাৎ ধর্ম-নির্বিশেষে শিক্ষার হার বেড়েছে। (যদিও সেই বৃদ্ধির হার সংখ্যাগুরুদের ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন বলে উঠে এসেছে।) শিক্ষা বা সাক্ষরতার হার বাড়লে কাজ করার ক্ষমতা বাড়ে। সেই বৃদ্ধির হার সমানুপাতিক নয়। তবু শিক্ষা বা সাক্ষরতার বিস্তার দেশের পক্ষে সবসময়েই মঙ্গলকর।
এতদসত্ত্বেও এর পাশাপাশিই দেখা গিয়েছে, বিশেষ একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক অনীহা ক্রমশই প্রকট ও স্পষ্ট আকার ধারণ করেছে। অবিচার শব্দটি এখানে লিখছি না, কারণ ‘সমাজগত অনীহা’ বিষয়টি অভিঘাতের দিক থেকে দেখলে সাধারণ একেকটি রাজনৈতিক বা সামাজিক অবিচারের ঘটনার চেয়ে অনেকগুণে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৪-পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট প্রচার-পরিকল্পনার মাধ্যমে সার্বিক সমাজে মুসলিম জনসংখ্যার যে সামগ্রিক ‘অপরায়ন’ সম্ভব হয়েছে, এমন প্রতিটি সমীক্ষায় সেই অঙ্কই উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষার বিস্তারে ঠিক যেমন প্রত্যেক সম্প্রদায়কেই নিজস্ব দায়িত্ব নিতে হবে, তেমনই রাজনৈতিক বক্তৃতায় ক্রমাগত বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও অপরায়নের মনোভাব যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন দর্পণে নিজেদেরই প্রত্যক্ষ করা উচিত। সকলের সমানাধিকার, সকলের সমান সুযোগ, অথবা সাম্যবাদের ফাঁকা তত্ত্ব আউড়িয়েই কেবল এই সূত্রে পার পাওয়া যাবে না। খতিয়ে দেখতে হবে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কেনই বা এই বিশেষ সম্প্রদায় লাগাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে, কোণঠাসা হয়ে চলেছে।
দেশের অর্থনীতি যে অনেক বছর যাবৎই ‘খতরে মেঁ’ গিয়েছে, সেই তথ্যও সকলের কাছে উপলব্ধ। এখন সেই অর্থনীতির মন্দ-ভাব, কীভাবে তার প্রভাবের অভিঘাত সম্প্রদায়-ভিত্তিতেও কমিয়ে-বাড়িয়ে অনুভূত হচ্ছে সেই বিষয়েই সুনির্দিষ্ট চর্চা প্রয়োজন। নচেৎ বহুত্ববাদের বেঁধে বেঁধে থাকার যে আদর্শ তা ভুলে গিয়ে আমরা ক্রমশই অনুর্বর একমুখিতার দিকে এগোব।
সূত্র: Minority report: Unemployment rate among religious minorities up in 2023-24. Business Standard. Oct 12, 2024.