Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্রীড়নক কর্মকর্তাদের সৌজন্যে বাংলা ফুটবলের আবার এক কালো দিন

অনির্বাণ সরকার

 


যে-খেলায় একদিন বাংলার একাধিপত্য ছিল অনেকটা ঘরোয়া ক্রিকেটে মুম্বাইয়ের মতোই, যে-খেলায় জাতীয় দলের আশি থেকে নব্বই শতাংশ ফুটবলার থাকত এই রাজ্য থেকে, সেই ফুটবলে এই রাজ্যের গরিমা দীর্ঘদিন ধরেই অস্তমিত। বাঙালি এখন 'খেলা হবে'র মরণখেলায় মত্ত। শুধু অতীত আর বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বেঁচে ছিল মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল মহামেডান। মেরুদণ্ডহীন, শাসকদলের ক্রীড়নক কর্মকর্তারা গদি বাঁচানোর ক্ষুদ্র স্বার্থে সেটুকুও বেচে দিলেন

 

৭২-৭৭, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রীর নাম ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়। শোনা যায়, ওই সময়কালে কলকাতা ময়দানে লিগে মোহনবাগানের কোনও ম্যাচ থাকলে, সেদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুপস্থিত থাকতেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এ-বিষয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীরও নাকি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল।

আমি নিজে যবে থেকে মোহনবাগান মাঠে যাওয়া শুরু করি, সেই আটের দশকের মধ্যভাগে, অর্থাৎ ভরা বাম জমানায়, সদস্য গ্যালারিতে তখন বিরোধী নেতা সুব্রতবাবুর একেবারে পাশে বসে খেলা দেখতে দেখেছি একাধিক বাম নেতা-মন্ত্রীদের। কখনও মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দ, কখনও ফরওয়ার্ড ব্লকের কমল গুহ, আবার কখনও আরএসপি-র দেবব্রত বিশ্বাস। আর যতীন চক্রবর্তী (জ্যাকিদা) এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তো মোহনবাগান কর্মসমিতির সদস্যই ছিলেন। ময়দানি দলবদলে জ্যাকিদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন অনেক অনেকবার। তেমনই, ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায়‌ আইনজীবী হিসেবে সোমনাথবাবুর অবদান ভোলা যায় না। আমি এবং আমার পরিবার মোহনবাগানি বলে মোহনবাগানের খবর একটু বেশিই রাখি, তা বলে ইস্টবেঙ্গল বা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অভ্যন্তরীণ মেঠো রাজনীতির খবর একেবারে জানি না, তা নয়। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবেও রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা ছিল। সিপিআইএম-এর বালিগঞ্জ অঞ্চলের নেতা শচীন সেন বা বেলঘরিয়া এলাকার মানস মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ওই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ভোটে লড়েছেন, দল গড়েছেন, পদ সামলেছেন। সিপিআইএম-এর মানস মুখোপাধ্যায় আর মধ্য কলকাতার ‘ছোড়দা’ অর্থাৎ কংগ্রেসি নেতা সোমেন মিত্রর অনুগামী জীবন-পল্টু (ময়দানের জীপ) তো একসঙ্গে, একই কর্মসমিতির সদস্য‌‌‌ হিসেবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে কাজ করেছেন। বাম জমানার অবিসংবাদিত নেতা তথা ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী আর পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য ছিলেন, মাঠের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসতেন। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্মকর্তা মীর মহম্মদ ওমরও একদা কংগ্রেসি নেতাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অর্থাৎ, ময়দানি সংস্কৃতিতে বা মেঠো রাজনীতিতে রাজ্য-রাজনীতির সরকারি বা বিরোধী নেতাদের যাতায়াত নতুন কিছু নয়।

আবার এর ঠিক বিপরীত পথে হেঁটে বিভিন্ন প্রাক্তন ফুটবলারদের বিবিধ দলের নেতাদের হয়ে ভোটপ্রচার করতেও আমরা বহুবার দেখেছি। ময়দানের মেঠো রাজনীতিতে বারেবারেই রাজ্য-রাজনীতির রং মিশে গিয়েছে এবং ভাইসি ভার্সা।

কিন্তু আরজিকর-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আসন্ন উপনির্বাচনে নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সনৎ দে-র প্রচারে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা ময়দানে অভূতপূর্ব। এর আগে কংগ্রেস বা বাম আমলে ব্যক্তি-রাজনৈতিক নেতা ময়দানের কোনও ক্লাবের যেমন কর্তা হয়েছেন, তেমনই ব্যক্তি-ফুটবলাররা রাজ্য-রাজনীতির কোনও কোনও নেতার হয়ে ভোটপ্রচারের অংশ হয়েছেন। কিন্তু সরাসরি প্রতিষ্ঠানগতভাবে তিন প্রধান ক্লাব এবং তাদের সর্বোচ্চ কর্তারা সরকারি ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রার্থীর হয়ে সেই দলের সোশাল মিডিয়ার হ্যান্ডল থেকে কখনও ভোটপ্রার্থনা করতে বেরোননি। আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে বঙ্গ ফুটবলের পেরেন্ট বডি আইএফএ-র সর্বময় কর্তাও ওই প্রার্থীর হয়ে ক্রীড়াপ্রেমী, ফুটবলদরদি সমস্ত মানুষকে ভোট দিতে অনুরোধ করেছেন।

কারণ? কারণ, ওই ব্যক্তি সনৎ দে নাকি এক অসাধারণ ক্রীড়া সংগঠক এবং ফুটবল-নিবেদিত প্রাণ। নৈহাটি ফুটবল মাঠে খেলা বা প্র্যাকটিসের জন্য কখনও কোনও কারণে বড় দলের কর্তারা দরবার করলে এই মহান ক্রীড়া সংগঠক নাকি কখনও তাঁদের খালি হাতে ফেরাননি!!

আসলে, এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণটা বুঝতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে সেই ঘটনাবহুল আগস্ট মাসে। আরজিকর মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ, খুন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ছিল ডুরান্ড কাপের ডার্বি ম্যাচ। আরজিকর-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাচটি বাতিল করে রাজ্য প্রশাসন। কদর্য ঘটনায় প্রতিবাদের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিলই, ডার্বি বাতিলের সিদ্ধান্তে সেই আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য তথা দেশ এমনকি বিদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে। বাতিল ডার্বির দিন বাইপাস-সংলগ্ন এলাকা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এমনকি মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থকরা পর্যন্ত চলে আসে পতাকা হাতে, জার্সি গায়ে দল, মত, রং-নির্বিশেষে স্বৈরাচারী সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে। শুধু ওই একদিনই নয়, সেই বিকেল থেকে আজ পর্যন্ত একাধিকবার, একাধিক জায়গায় এই তিন প্রধানের সদস্য-সমর্থকরা হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। আর তাতেই টনক নড়ে যায় সরকারের। ২০১১-র পরিবর্তনের পর থেকে সর্বগ্রাসী এই সরকার অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতোই ময়দানের প্রতিটি সংস্থায় তাদের পেটোয়া বাহিনি ঢুকিয়েছে। বিগত তেরো-চোদ্দো বছরের শাসনকালে হাজারো অপরাধের পরেও এই সরকারের বিরুদ্ধে এমন সর্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দল পৃথক দাবিতে, ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে আন্দোলন সংগঠিত করলেও প্রবল পরাক্রমশালী শাসক এবং তার সর্বময় কর্ত্রীর সেই আন্দোলনগুলিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে কোনও বেগ পেতে হয়নি। এই প্রথম ধর্ম, বর্ণ, মত, পতাকা-নির্বিশেষে সমাজের সমস্ত অংশের মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং এখনও জানাচ্ছেন। গণ আন্দোলন প্রতিদিন নিত্যনতুন ভাষ্য তৈরি করছে। আন্দোলন বিভিন্ন ধারায়, ভিন্ন ভিন্ন খাতে বইছে। ময়দানের তিন প্রধান ক্লাবের সদস্য-সমর্থকরাও তারই অঙ্গ হয়েছেন। আর তাই, সমর্থকদের এই একজোট হওয়ার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সরকারি দল তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হওয়া ময়দানি ক্লাব ও ক্লাবের কর্মকর্তাদের একজোট করেছে নিজের দলের প্রার্থীর সপক্ষে।

 

যে-খেলায় একদিন বাংলার একাধিপত্য ছিল অনেকটা ঘরোয়া ক্রিকেটে মুম্বাইয়ের মতোই, যে-খেলায় জাতীয় দলের আশি থেকে নব্বই শতাংশ ফুটবলার থাকত এই রাজ্য থেকে, সেই ফুটবলে এই রাজ্যের গরিমা দীর্ঘদিন ধরেই অস্তমিত। বাঙালি এখন ‘খেলা হবে’র মরণখেলায় মত্ত। শুধু অতীত আর বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বেঁচে ছিল মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল মহামেডান। মেরুদণ্ডহীন, শাসকদলের ক্রীড়নক কর্মকর্তারা গদি বাঁচানোর ক্ষুদ্র স্বার্থে সেটুকুও বেচে দিলেন।

এক সাধারণ ফুটবলপ্রেমী হিসেবে এ আক্ষেপ কোথায় রাখি??


*মতামত ব্যক্তিগত