অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও, অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনও প্রকট নয়। এই জায়গাতেই আমেরিকার দুর্ধর্ষ কূটনীতির নির্লজ্জ আধিপত্যবাদের উদাহরণ। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে স্বল্পমেয়াদে বীভৎস যুদ্ধের ফল অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যার সমতুল হতে পারে। এর বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদে লাগাতার সংগ্রাম জারি রাখতে পারলে অস্ত্রব্যবসায়ীদেরই লাভ। লাভ মার্কিনি ডলারে পুষ্ট, পেট্রো-অর্থনীতির কৃপাধন্য অন্যান্য পুঁজিপতিদের সবার। যে-কোনও অঞ্চলকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থির, অস্বস্তিপূর্ণ করে রাখতে পারলেই, বড়দাদাদের সেখানে অনুপ্রবেশ সহজতর হয়। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে একাধিকবার আমরা এই কৌশলের বাস্তবায়ন দেখেছি
যুদ্ধ নয়, সংঘর্ষ। ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের বিষয়ে, অথবা পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত বর্তমান সঙ্কটের বিষয়ে বোধ করি এই প্রাথমিক ধারণাটিই সর্বাগ্রে স্মরণে রাখা উচিত। পৃথিবীর কোথাও এই মুহূর্তে যুদ্ধ-পরিস্থিতি নেই। যা রয়েছে তা হল আদতে সঙ্কট, সংঘর্ষ অথবা সংঘাত— অর্থাৎ war নয়, conflict। এই আপ্তবাক্যকেই আমাদের প্রথম হৃদয়ঙ্গম করা জরুরি।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন কোনও এক নিবন্ধে বলেছিলেন, আধুনিক পৃথিবীতে গোটাগুটি দুর্ভিক্ষ এখন প্রায় হয় না বললেই চলে। অর্থাৎ, প্রকট, প্রবলতর দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরির আগেই (যে দুর্ভিক্ষে স্বল্পমেয়াদে বড় সংখ্যায় প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে) জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক নানা সাহায্য ঘোষণার মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে স্বল্পমেয়াদে পূর্ণ অনাহারের বদলে তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদে, দীর্ঘস্থায়ী অর্ধাহার ও অপুষ্টির অবস্থা। আন্তর্জাতিক সাহায্যে ভর করেই তখন দুর্বল অর্থনীতিগুলিকে কব্জায় আনা চলে।
পশ্চিম এশিয়া তথা সারা বিশ্বের সশস্ত্র সংঘাতের চরিত্রগুলি ক্রমশই একইরকমে এমন দীর্ঘমেয়াদি ছদ্ম-সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। এর ফলে সংঘাত জারি থাকছে যেমন, স্বল্পমেয়াদে অধিক প্রাণহানি না হওয়ার কারণে গড়পড়তা সংবাদমাধ্যমে ক্রমশই সেই সংঘাতগুলির সংবাদমূল্য কমে আসতে পারছে। বিশ্বের গড়পড়তা সাধারণ জনগণ, তাঁরাও দীর্ঘমেয়াদের এই সংঘাত-পরিস্থিতিগুলির সঙ্গে নিজেদের মনস্তত্ত্বকে মানিয়ে নিতে পারছেন। লাগাতার স্বল্পমাত্রায় হিংসার ঘটনা তাঁদের মনে আর দাগ কাটছে না। ইউক্রেনের সংঘাত যেমন ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে শুরু হয়ে আজ অবধি সমাধানের কোনও দূর-বিন্দুতেও নেই। তেমনই গত অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সংঘাত আজ বছর পেরিয়ে ইরানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ক্রমশই এক বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হতে চলেছে। কিন্তু আবারও মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এই সংঘাতকে যুদ্ধের আখ্যা দেওয়া চলবে না কোনওভাবেই। মার্কিনি রাজনীতিকদের তাতে আপত্তি ঘোর।
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাত নিয়ে সময়ে-সময়েই বহুল আলোচনা হয়েছে। বাইবেল-বর্ণিত এক কাল্পনিক ভূখণ্ডের অজুহাতকে যে কেমনভাবে সার্বিক সামরিক আগ্রাসনের অজুহাত হিসেবেও ব্যবহার করা চলে, রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েল তার সার্থক উদাহরণ দেখিয়েছে। অন্যদিকে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ ও প্যালেস্তিনীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হামাস, এই দুই গোষ্ঠীর পারস্পরিক চরম নৃশংসতার মূল্য গুণে চলেছে গাজা ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষ। হামাসের জঙ্গি আক্রমণের প্রতিবাদে অক্টোবর, ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া লাগাতার ইজরায়েলি আগ্রাসন গাজা ভূখণ্ডকে সবদিক থেকেই এক চরম মানবিক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই সঙ্কটের আবারও নতুন করে বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। গাজা ভূখণ্ডের প্রত্যেক নাগরিক আজ যে চরম অমানবিক ও হৃদয়বিদারক এক পরিস্থিতিতে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, সেই খবর দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সমস্ত সংবাদ-বিবরণেই বারংবার প্রকাশিত হয়েছে। অথচ মার্কিনভূমের স্যামচাচাদেরই একেকজনের অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে, পৃথিবীর কোনও দেশ, বা আন্তর্জাতিক কোনও গোষ্ঠীই এই সঙ্কট সমাধানের পথে সদর্থকভাবে এগিয়ে আসেনি। শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আগ্রাসক ইজরায়েলের সপক্ষে থেকেছে। কোনও অন্যথা হয়নি তার।
এমতাবস্থায় ইসলামের দোহাই দিয়ে প্যালেস্তাইনের সপক্ষে দাঁড়িয়েছে ইরান ও তার হেজবোল্লাহ জঙ্গিদল। মোল্লাতন্ত্র-পরিচালিত ইরান দীর্ঘসময় যাবৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল হয়ে থেকেছে, তদুপরি আন্তর্জাতিক সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে তারা নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। সম্প্রতি ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের মাধ্যমেই এই সমৃদ্ধিকরণের অবাক প্রতিফল দেখা গিয়েছে। প্রতিরক্ষা-ক্ষেত্রে খাতায়-কলমে অনেক এগিয়ে থাকা ইজরায়েলকেও প্রথমদিকে রীতিমতো বেগ দিয়ে চলেছিল হেজবোল্লাহের আক্রমণ। এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইজরায়েল লাগাতার পালটা-আক্রমণে যেতেই ক্রমশ আঞ্চলিক সংঘাতের ভয়াবহ চেহারাটি প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
একদিকে সরাসরি মোল্লাতন্ত্র-অধ্যুষিত ইরান প্যালেস্তাইনের সমর্থনে সশস্ত্র সংগ্রামে নামায় পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি সরাসরি সেই সংঘাতে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করছে। ফলত আন্তর্জাতিক মহলে প্যালেস্তাইনের সপক্ষেও সরাসরি আঞ্চলিক সমর্থন খানিক হলেও কমতে পেরেছে। এর ফলে ইজরায়েলি আগ্রাসন আরওই অনিয়ন্ত্রিতভাবে এগিয়ে চলেছে। কূটনৈতিকভাবে আরওই পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে প্যালেস্তাইনের মানবিক সঙ্কট। অন্যদিকে সরাসরি হেজবোল্লাহ ও ইয়েমেনের হাউথি জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে (যাদের সঙ্গেও হেজবোল্লাহের সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ), আকাশপথে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে মার্কিনি যুদ্ধ-বিমান। পাশাপাশি ইজরায়েলের তরফে হামলা হয়েছে লেবাননের বেইরুটেও। প্যালেস্তাইন-সহ পশ্চিম এশিয়ার অন্ততপক্ষে পাঁচটি দেশ এই মুহূর্তে নিয়মিত একে-অপরের ক্ষেপণাস্ত্র-হানার সম্মুখীন।
তবুও একে সঙ্কট বলাই বাঞ্ছনীয়। যুদ্ধের দামামা এখনও শোনা যাচ্ছে না।
“অন্ততপক্ষে মেরিবাবার দেশ তেমনটাই মনে করছে আজ”
ইজরায়েলের তরফে গত ২৭ সেপ্টেম্বর, হেজবোল্লাহের প্রধান হাসান নাসারাল্লাহের হত্যার পরবর্তীতে সঙ্কটের তীব্রতা অন্য মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। তবু সেই ঘটনার এক মাস পরবর্তীতেও, লাগাতার আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও, অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনও প্রকট নয়। এই জায়গাতেই মেরিবাবাদের দুর্ধর্ষ কূটনীতির নির্লজ্জ আধিপত্যবাদের উদাহরণ। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে স্বল্পমেয়াদে বীভৎস যুদ্ধের ফল অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যার সমতুল হতে পারে। এর বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদে লাগাতার সংগ্রাম জারি রাখতে পারলে অস্ত্রব্যবসায়ীদেরই লাভ। লাভ মার্কিনি ডলারে পুষ্ট, পেট্রো-অর্থনীতির কৃপাধন্য অন্যান্য পুঁজিপতিদের সবার। যে-কোনও অঞ্চলকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থির, অস্বস্তিপূর্ণ করে রাখতে পারলেই, বড়দাদাদের সেখানে অনুপ্রবেশ সহজতর হয়। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে একাধিকবার আমরা এই কৌশলের বাস্তবায়ন দেখেছি। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আমরা তাই এইটিই দেখেছি— আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়াতে লাগাতার দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট জারি রাখার প্রচেষ্টা ক্রমবর্ধমান।
অথচ ঠাকুরঘরে গা ঢাকা দেওয়া, এই ঢাকঢাক-গুড়গুড় নীতিকে গড়পড়তা মার্কিন জনগণও পছন্দ করেনি বোধহয়। করেনি বলেই তারা পিছন থেকে, কূটনৈতিক কায়দাতে সেই ইজরায়েলকেই পরোক্ষ মদত জুগিয়ে আসা, (অথচ মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো) ডেমোক্র্যাটিক দলকে নির্বাচনী ভোটবাক্সে রীতিমতো ‘সবক’ শিখিয়েছে। অন্যদিকে জিতিয়ে এনেছে প্রকাশ্যে যুদ্ধকে সমর্থন করা, উচ্চাকাঙ্খী, অপ্রকৃতিস্থ, প্রবল আধিপত্যবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর কনজারভেটিভ দলের প্রতিনিধিদের। মানুষ এখন সরাসরি সত্যিটা দেখতে চায়। একদিকে দীর্ঘমেয়াদে রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে, অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে মার্কিনি জনগণের যে বিরূপ মনোভাব— তা কার্যত তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় যিনি পুতিনের সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটবেন, ও পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দেশগুলিকেও একইসঙ্গে ‘সবক’ শেখাবেন এমন মানুষকেই রাষ্ট্রপতি পদে বেছে নিয়েছেন মার্কিনভূমের মানুষ। নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেপরেই ভাবী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গেও একাধিকবার দূরভাষে যোগাযোগ করেছেন। পশ্চিম এশিয়ার ‘সঙ্কট’-এর বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। ‘সন্ত্রাসবাদ’ নির্মূলের লড়াইতে ট্রাম্পের তরফে নেতানিয়াহুকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তিগত ধারণা থেকে এটুকু বলতে পারি, সামগ্রিক সশস্ত্র যুদ্ধের পথ ধরে এখনই এই সঙ্কট থেকে মুক্তির কোনও বাস্তব সম্ভাবনা নেই। অচলাবস্থা ও অরাজকতা বজায় রাখলে দীর্ঘমেয়াদে যে পশ্চিমি পুঁজিপতিদেরই লাভ, সেই বোধ সেই পুঁজিপতিদের মজ্জায় আরোপিত। কাজেই সমাধান নয়, পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এখন যে সার্বিক অরাজকতার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে রয়েছে, সেই পরিস্থিতিকে বজায় রাখতেই পশ্চিমি-জোটের সবরকম প্রচেষ্টা জারি থাকবে। সেই অরাজকতাতেই নিহিত থাকবে সামগ্রিক অস্ত্রবাজারের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ।
*মতামত ব্যক্তিগত