সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
এমন একটা ঘটনা কেন ঘটল? সবটাই কি প্রকৃতির রোষ? নাকি তার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে বিধাতার বরপুত্র হোমো স্যাপিয়েন্সরা? এমনিতেই মানুষের অত্যাচার সইতে সইতে সর্বংসহা ধরিত্রী নিঃশেষিত। অপরিণামদর্শী মানুষী ক্রিয়াকলাপ আরও একবার প্রকৃতির রুদ্ররোষ হয়ে ধারাবাহিকভাবে বিপন্ন করল ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মানুষজনকে। ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের মূল হোতা। সম্মেলনের পর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি আর প্রতিজ্ঞার ফানুস উড়ছে অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বিপর্যয়ের অভিঘাতে মানুষ বিপন্ন হচ্ছে
ডানা আছে বলেই পাখি ও পতঙ্গদের অধিকাংশই উড়ে বেড়াতে পারে। মানুষও উড়তে পারে নিজের তৈরি ডানাযন্ত্রের দৌলতে। ডানা কেবলমাত্র পাখিদের উড়তে সাহায্য করেই নিশ্চল হয়ে থাকে এমনটাও নয়। আক্রান্ত হলে ডানা বা পক্ষাঘাতের সাহায্যে শত্রুকে বিব্রত করতেও তার জুড়ি মেলা ভার। সীতাকে ছল করে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় জটায়ু তার পক্ষবিক্রমে নাস্তানাবুদ করেছিল রক্ষরাজ রাবণকে। বিপদ বুঝে রাবণ জটায়ুর ডানা কেটে ফেললেন। ডানার দাপট লোপ পেল আকস্মিক আঘাতে। মায়ের দ্বারা পরিত্যক্ত দুধের বাছা শকুন্তলাকে মাতৃস্নেহে ডানা মেলে আগলে রেখেছিল একদল শকুন। এইসব বৃত্তান্ত থেকে ডানার কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা একটা বিষয় হয়তো খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারি— ডানা হল এক অর্থে নিরাপত্তার প্রতীক।
তবে সব ডানাই কি একধরনের নিরাপত্তায় ঘিরে রাখে আমাদের? সব ডানার ঝাপটের শব্দেই কি থাকে নিঃসীম নীলাকাশে চড়ে বেড়ানোর ইঙ্গিত? বোধহয় না। আমাদের খুব সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সব ডানা-স্মৃতি সুখকর নয়। কখনও কখনও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভয়াল ভয়ঙ্কর পরিণতি। ভাষার পার্থক্য অনেক সময় আমাদের অতি চেনা শব্দের পরিচিত সোজাসাপ্টা অর্থটাকেই বিলকুল বদলে ফেলে। বাংলায় ডানা শব্দের অর্থ পাখা হলে আরবি ভাষায় সেই একই শব্দের মানে generosity বা ঔদার্য। আরবি ভাষায় অবশ্য এই শব্দটির অন্যতর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। ডানা অথবা ডানহা হল সঠিক আকৃতির, মূল্যবান এবং অপরূপ সুন্দর মুক্তা।
এখানেই শেষ নয়। স্প্যানিশ ভাষায় আবার ‘ডানা’ শব্দের একাধিক অর্থ ব্যঞ্জনা রয়েছে, যেমন মুক্তা, জ্ঞানী, সালিশি, উদার ইত্যাদি। তবে যে অর্থেই তার প্রয়োগ হোক না কেন, আমাদের একদম টাটকা অভিজ্ঞতায় ডানা শব্দের সঙ্গে কিছু দুঃস্বপ্নের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। খুব সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী ওড়িশার মানুষজনের কাছে ডানা মানেই হল এক ভয়ঙ্কর চেহারার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় যা এই দুই রাজ্যের মানুষজনকে দিনকয়েকের জন্য অজানা বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ত্রস্ত রেখে অবশেষে ওড়িশা রাজ্যের ভিতরকণিকার কাছে আছড়ে পড়ল। কিছু কাঁচামাটির বাড়ি ভেঙে পড়ল, প্রবল বাত্যাঘাতে গাছপালা উপড়ে গেল, পরিণত পাকা ফসলের ক্ষয়ক্ষতিতে সাধারণ কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ চওড়া হয়ে উঠল, রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সারারাত কন্ট্রোল রুম আগলে ঝঞ্ঝা পরিস্থিতির মনিটরিং করলেন, টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর এক্সক্লুসিভ আঁখো দেখা ঝড়ের রিপোর্টাজ দেখতে দেখতে টিভিসেটগুলো একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল, কিছু নতুন জায়গার নাম— যেমন ধামরা, ভিতরকণিকা শোনা হল, ঝড়ের বেগ কমতেই আমজনতার আবেগ, উত্তেজনার পারদ থিতু হয়ে গেল, সবাই ফিরে গেলেন দৈনন্দিন জীবনের উৎসবে। ব্যস্ এইটুকুই। তবে ধরিত্রীর লীলাখেলার সমাপ্তি ঘটল এমনটা কিন্তু মোটেই নয়।
এমন জমজমাট ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে যাঁরা এখনও সংবাদপত্রের পাতায় মুখ রেখে নিয়মিত দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ঘটমান ঘটনার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে ভালবাসেন তাঁদের অনেকেই হয়তো দেখে থাকবেন ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপের অন্যতম রাষ্ট্র স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া বন্দর শহর ডানার ঝাপটে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। এই মুহূর্তে খবর পেলাম স্পেনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্সিলোনা অঞ্চল-সহ ক্যাটালোনিয়া প্রদেশেও প্রবল বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ডানা বা Depresion Aislada en Niveles Altos (DANA)-এর প্রভাবে। সংবাদে প্রকাশ যে গত ২৯ অক্টোবর ভ্যালেন্সিয়ায় মাত্র কয়েক ঘণ্টায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা ওই প্রদেশের গোটা বছরের বৃষ্টিপাতের সমান। আবহাওয়া দফতর-সূত্রে জানা গেছে যে ওই দিন প্রায় ২০ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছে। এই ধরনের আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত পরিমাণের বৃষ্টিপাত ও তার প্রতিফল হিসেবে যে বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে তাকে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষজন DANA বলে চিহ্নিত করে থাকেন। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার দশক আগে ১৯৮২ সালে Pantanada de tous নামে যে প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটেছিল, এবারের বিপর্যয় তাকেও ছাপিয়ে গেছে।
নামে এক হলেও দুই ডানার চরিত্রে যেমন রয়েছে ফারাক, তেমনি রয়েছে বেশ কিছু মিল। আগে বরং মিল নিয়ে দু-কথা বলে নিই। দুটো ক্ষেত্রেই গন্ডগোলের সূত্রপাত লাগোয়া সমুদ্রের জলভাগ থেকে। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই আমাদের নাগাড়ে সাবধান করে চলেছেন— ‘বাপু হে! সমুদ্রের জল যেভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে তাতে যে-কোনও মুহূর্তে একটা বড় আবহিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।’ তবে সেসবে তেমন হুঁশ নেই আমাদের। বানভাসি মানুষের প্রতি কিছু সহানুভূতি মাখানো কথাবার্তা বলেই দায় মেটাচ্ছি। ভাবছি এ তো আমাদের এলাকার ঘটনা নয়, তাই মাথাব্যথা বিলকুল নেই। এখানে একটা কথা বলা খুব জরুরি যে গোটা পৃথিবীর তাপীয় ভারসাম্যের পেছনে স্থলভাগ ও জলভাগ দুয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দূরের উদাহরণ ছেড়ে আমাদের ভারতের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। এতে করে বিষয়টি বুঝতে হয়তো কিছু সুবিধা হবে। প্রাকৃতিক কারণেই গ্রীষ্মকালে স্থলভাগ অনেক বেশি গরম হয়ে ওঠে সংলগ্ন জলভাগ বা সমুদ্রের তুলনায়। এর ফলে তৈরি হয় সমুদ্র থেকে স্থলভাগ-অভিমুখী সমুদ্রবায়ু। কিন্তু শীতকালে ব্যাপারটা উল্টে যাওয়ার ফলে স্থল থেকে জলের দিকে বায়ু বইতে থাকে। বায়ুমাধ্যমে তাপের এমন সঞ্চালন তাপীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এই সহজ-সরল তাপীয় ভারসাম্য বজায় রাখার প্রাকৃতিক প্রকৌশল তন্ত্রটিই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। আর এর ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষজনকে। পৃথিবীর জলচক্রের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন হওয়ায় বৃষ্টিপাতের চরিত্র একদম বদলে গেছে। স্পেনের কোনও কোনও অঞ্চলে ডানার প্রভাবে মাত্র ১ বর্গমিটার পরিমিত অংশে ৩০০ থেকে ৫০০ লিটার বৃষ্টি হয়েছে! ভাবা যায়!
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হল? আবহবিজ্ঞানীদের মতে এমন নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে পোলার অথবা সাব-ট্রপিক্যাল জেটস্ট্রিমের প্রভাবে বায়ুর উচ্চস্তরীয় অবস্থানে। বলাবাহুল্য যে, সমুদ্রের ওপর সাধারণ নিম্নচাপ সৃষ্টির তুলনায় এই ধারাটি সম্পূর্ণভাবে আলাদা। ভূমধ্যসাগরের উষ্ণ জলরাশির ওপর দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে যাওয়ার কারণে জলভাগের ওপরে থাকা উষ্ণ বায়ু দ্রুত ওপরে উঠে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে জলে ভরা গভীর মেঘের সৃষ্টি করে। এমন ভারী মেঘ কখনও কখনও একই জায়গায় থিতু হয়ে থাকে বেশ কিছুদিন ধরে। ফলে বেড়ে যায় তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। জলভারে ভারাক্রান্ত এমন বিপুল আকৃতির মেঘ থেকে কখনও প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত হওয়ার পাশাপাশি সৃষ্টি হতে পারে টর্নেডোর। স্পেনে ঠিক এমনটাই ঘটেছে বলে অভিমত আবহবিজ্ঞানীদের। তাঁদের মতে ১৯৬৭ সালের পর এমন ভয়ঙ্কর বিপর্যয় স্পেন-সহ সমগ্র ইউরোপ মহাদেশে আর কখনও ঘটেনি। এবারের বন্যা-পরিস্থিতির প্রভাব কেবলমাত্র ভ্যালেন্সিয়াতেই থমকে নেই, বার্সেলোনা-সহ গোটা ক্যাটালোনিয়া অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ এই মুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
এমনিতেই স্পেনের দক্ষিণ ও পূর্বভাগের অংশটি আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থানের কারণে অন্যান্য স্পেনীয় অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি আবহিক বিরূপতার শিকার। পর্বতসঙ্কুল এই অঞ্চলে দুই বিপরীতমুখী ও বিপরীতধর্মী বায়ুপুঞ্জ পরস্পর মুখোমুখি মিলিত হয় সীমান্তরেখা (front) বরাবর। শীতল বায়ুপুঞ্জের ওপর ভর করে উষ্ণ বায়ু দ্রুত ওপরে উঠতে থাকে। পর্বতের অবস্থান এই প্রক্রিয়াকে প্রয়োজনীয় ইন্ধন জোগায়। মেঘবর্ষণের ফলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা হড়পা বান সব কিছু তছনছ করে দেয় নিমেষে। ভ্যালেন্সিয়ায় এমনই ঘটেছে বলে অভিমত আবহবিজ্ঞানীদের।
সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের ফলে ভ্যালেন্সিয়া প্রদেশে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। ঠিক কী কারণে এমনটা হল তা নিয়ে বিস্তারিত কাটাছেঁড়ার কাজ চলছে এই মুহূর্তে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পার্থিব জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলেই এমন বিপর্যয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি আরও অপেক্ষা করে আছে স্পেনের ভাগ্যে। ২০০০ সাল থেকে ডানা শব্দটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন বিপর্যয়কে চিহ্নিত করতে। এর আগে এমন ঘটনাকে বলা হত gota fria বা cold drop নামে। তবে এখন ডানা নামটিই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এবারের বিপর্যয়ের পেছনে তথাকথিত cold drop-এর তত্ত্ব কতটা কার্যকর তা খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা ভাবছেন ভাবুন, এই অবসরে আমরা ভ্যালেন্সিয়ার হালহকিকত জেনে নিই।
ভ্যালেন্সিয়া এখন এক সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বন্দর শহর। এই নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিখোঁজ মানুষের হিসাব এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। সমস্যা এতটাই গভীর যে সেনাবাহিনিকে উদ্ধারের কাজে লাগাতে বাধ্য হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন তথা স্পেনের সরকার। এমন বিপদের দিনে চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে বসে নেই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষজন। হাজারে হাজারে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ঝাঁটা আর বালতি হাতে নিয়ে নেমে পড়েছে শহর পরিষ্কারের কাজে। গোটা শহর ঢেকেছে ধ্বংসস্তূপ আর কাদাগোলা জলে। বাড়িঘর, অফিসকাছারি, দোকানবাজার, শপিংমল সব ভরে গেছে জলে। কতদিনের মধ্যে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে তা জানেন না কেউই। এখনও সম্পূর্ণ স্তব্ধ স্বাভাবিক জীবনযাপন। প্রবল বন্যায় ভেসে গিয়েছে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা শত সহস্র গাড়ি। ভাসমান গাড়ির বহর এক সময়ের দুর্ধর্ষ স্পেনীয় আর্মাডার গৌরবময় ইতিহাসকে যেন ব্যঙ্গ করছে। গোটা শহর ডুবে গিয়েছিল প্রায় ৭ মিটার জলের তলায়। বিপন্ন, বিধ্বস্ত মানুষজন এতটাই উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে গেছে যে, স্পেনের রাজা বিপর্যয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে গিয়ে প্রতিবাদী মানুষদের মুখে পড়েছেন এবং ক্রুদ্ধ জনতা রাজার গায়ে নোংরা কাদা ছুড়ে মারতেও সামান্য দ্বিধা করেনি। তবে এখন ধীরে ধীরে জল নামছে। আর এই পরিস্থিতি জাগিয়ে তুলেছে ব্যাপক মহামারির আশঙ্কা।
কথায় বলে বিপদ কখনও একা আসে না। স্পেনের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই ঘটেছে। প্রথমে ভ্যালেন্সিয়া, তারপর বার্সিলোনা এবং সবার শেষে ক্যাটালোনিয়া প্রদেশে মহা বর্ষণ বিপর্যয়ের অভিশাপ নেমে এসেছে। এত বৃষ্টি, এত জল! মানুষজন বাইবেলের নোয়ার কথা মনে করছে। এমন প্রলয়, এমন প্লাবন আগে কখনও কেউ দেখেনি স্পেন-সহ সমগ্র পৃথিবীর মানুষ। ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে অসংখ্য ভিডিও। সেগুলো দেখলে রীতিমতো ভয় ধরে মনে। বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই আইবেরীয় উপদ্বীপের দুই দেশ স্পেন ও পর্তুগালকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের epicenter হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে এ তো ট্রেলার, আসলি কহানি আভি ভি বহুত বাকি হায়!
এমন একটা ঘটনা কেন ঘটল? সবটাই কি প্রকৃতির রোষ? নাকি তার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে বিধাতার বরপুত্র হোমো স্যাপিয়েন্সরা? এমনিতেই মানুষের অত্যাচার সইতে সইতে সর্বংসহা ধরিত্রী নিঃশেষিত। অপরিণামদর্শী মানুষী ক্রিয়াকলাপ আরও একবার প্রকৃতির রুদ্ররোষ হয়ে ধারাবাহিকভাবে বিপন্ন করল ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মানুষজনকে। ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের মূল হোতা। সম্মেলনের পর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি আর প্রতিজ্ঞার ফানুস উড়ছে অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বিপর্যয়ের অভিঘাতে মানুষ বিপন্ন হচ্ছে। আগে একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে কয়েক দশকের ফারাকে এমন ঘটনা ঘটেছে, আর আজ তেমন ঘটনা ঘটছে এক বা দু-বছর অন্তর। আজারবাইজানের বাকু শহরের সদ্যোসমাপ্ত Cop-29 সম্মেলনেও প্রতিনিধিদের তরফে আওয়াজ উঠেছে অবিলম্বে ফসিল ফুয়েল-সহ সমস্ত রকমের দহনকে কমিয়ে আনতে। ধরিত্রী মা রুষ্ট হয়েছেন। তাঁকে শান্ত করতে হলে এর কোনও বিকল্প আমাদের সামনে নেই। আমরা কি শুনব সে-কথা?
পুনশ্চ:
লেখাটা শেষ করেও মনে হল মহা দ্রোহের সব কথা হয়তো বলা হল না। এই মুহূর্তে ধরিত্রীদোহের আন্দোলন শুরু হয়েছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে। আগাম সতর্কবার্তা জারি করার ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক অনেক কার্যকরী ভূমিকা নেওয়ায় জীবনহানির ঘটনাকে অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে এতেও বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই। মানুষের জীবনের ন্যূনতম অবলম্বনগুলো বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে প্রতিনিয়ত। উন্নয়নের আস্ফালন আজ ভূলুণ্ঠিত। এই মুহূর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বন্যা, ভূমিধস, ভূমিকম্প, দাবানল, তুষারপাতের ঘটনা ঘটে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
স্পেনের সাম্প্রতিক হড়পা বানের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি প্রদেশেও বন্যায় বানভাসি হয়েছে বহু সংখ্যক মানুষ। বঙ্গোপসাগরের ডানার মতো ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় রাফায়েল এবং ইনঝিং আছড়ে পড়েছে যথাক্রমে পশ্চিম কিউবা ও ফিলিপাইনের ওপর। ভেঙে পড়েছে এ দুই অঞ্চলের নাগরিক পরিষেবা ব্যবস্থা। বন্যার কারণে গৃহহীন হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের।
আকস্মিকভাবে জেগে উঠেছে নানা প্রান্তের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি। বিপুল পরিমাণ আগ্নেয় ছাই আর ভষ্মে ঢেকে গিয়েছে আকাশ। ত্রস্ত মানুষেরা দলবেঁধে চলেছে নতুন ঠাঁইয়ের সন্ধানে। আফ্রিকার পশ্চিম ও মধ্যভাগে চোদ্দটি দেশের প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ এই মুহূর্তে বাস্তুচ্যুত। নাইজেরিয়া, মালি, নাইজারের মানুষজন এক ঐতিহাসিক বন্যায় সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত। খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের শিকড়হীন জীবন। সুবিচারের আশায় কোন্ আদালতের দ্বারস্থ হবে তাঁরা?
সাহারার বুকে বন্যা অথবা আরবের মরুভূমির ওপর তুষারপাতের কার্যকারণের ব্যাখ্যা দেবেন কোন্ ভূগোলবিদ?
গত দুদিন ধরে আকস্মিক দাবানলে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার ভেঞ্চুরা প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চল। বাড়িঘর, পরিষেবা পরিকাঠামোর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আজ হুতাশনের করাল গ্রাসে গ্রস্ত। এক অসহনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আপামর ধরিত্রীবাসীকে। এই পৃথিবীর সমস্ত স্বয়ংক্রিয় প্রাণদায়ী তন্ত্র আজ আমাদের কাছে একটু শৃঙ্খলা দাবি করছে। আমরা কি তা ফিরিয়ে আনতে পারি না?
এটাই যে হবে তিলোত্তমা ধরিত্রীর জন্য সেরা জাস্টিস।