Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সুদানের ভয়ানক দুর্দিন

বর্ণিল ভট্টাচার্য

 


সুদানের জনগণ নিজেদের নেতাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকার তো বটেই, সেই সঙ্গে এমন একটি বিশ্বের হতভাগ্য বাসিন্দা যে দুনিয়ার একদম সময় বা ইচ্ছা নেই এতগুলি মানুষের অসীম দুর্ভোগের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার। সুদানের সাধারণ মানুষ এইরকম এক চরম অসহায়তা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা জানেন না আগামীদিনে তাঁদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে

 

হুসনা আব্দুল কাদের নিজের পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ইদানীং বাস করছেন লোহিত সাগরের তীরে, পোর্ট সুদানে। গত ষোলো মাসে কতবার যে তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন, তার হিসাব রাখা সহজ নয়। প্রথমবার ঘর ছাড়তে হয়েছিল ২০২৩ সালের এপ্রিলে, যখন সুদানের রাজধানী খার্টুমে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। তিনি তখন আশ্রয় নিয়েছিলেন সুদানের পূর্বদিকের শহর গেদারেফ-এ। সেখান থেকে ফের পালাতে হয়, যখন ড্রোন হামলায় বসবাস অসম্ভব হয়ে ওঠে। শেষবারে তাঁকে ছেড়ে আসতে হয়েছে তাঁর পৈতৃক গ্রাম, যখন ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’-এর (আরএসএফ) সৈন্যরা মোটরসাইকেলে চড়ে এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। এখন পোর্ট সুদানে তাঁর সম্বল বলতে শুধুমাত্র তাঁর চটিজোড়া। বাকি সব কিছু হয় ফেলে এসেছেন, নয়তো লুট হয়ে গেছে।

এমন কাহিনি সুদানের প্রতিটি প্রান্ত থেকে শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই। ১৫ এপ্রিল, ২০২৩ সুদানের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। তারপর থেকে প্রায় এক কোটি মানুষ— সুদানের বাসিন্দাদের পাঁচজনের একজন— বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইতিমধ্যেই এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্ত সঙ্কট বলে চিহ্নিত হয়েছে। সেই সঙ্গে চলছে গণহত্যা। অস্থায়ী কবর তৈরি হয়েছে। সেখানে একের পর এক মৃতদেহ জমা হচ্ছে, যা মহাকাশ থেকেও দেখা যায়। কৃষিজমি পড়ে আছে, চাষ হচ্ছে না। ব্যাঙ্কগুলো দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের ছায়া প্রতি মাসে আরও গাঢ় হচ্ছে।

 

অথচ সুদানের এই ভয়ানক বিপর্যয় সেভাবে বিশ্বের মানুষের নজর আকর্ষণ করতে পারেনি। ইউক্রেন বা গাজার যুদ্ধের তুলনায় খুব কম মনোযোগ পেয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে যে ২০২৪ সাল শেষ হওয়ার আগেই সুদানে ৬০ লক্ষ থেকে ১ কোটি মানুষ অনাহার ও রোগে মারা যেতে পারে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে চিনের দুর্ভিক্ষের পর সব চাইতে মারাত্মক বলে গণ্য হতে পারে সুদানের দুর্ভিক্ষ।

দেশের মধ্যে এই বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল দুই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। এক দিকে রয়েছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, যিনি সুদান সশস্ত্র বাহিনির (এসএএফ) কমান্ডার। অন্যদিকে রয়েছেন তাঁর প্রাক্তন সহকর্মী মুহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি ‘হেমেতি’ নামে পরিচিত। তিনি আধাসামরিক বাহিনি আরএসএফ-এর নেতা। এই বাহিনিটি কুখ্যাত ‘জানজাউইদ মিলিশিয়া’ থেকে তৈরি হয়েছে। দু-পক্ষের আধিপত্যের লড়াই এখন অগণিত সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের জাতিবিদ্বেষ যোগ হয়ে উত্তেজনার আগুন পুনরায় জ্বলে উঠেছে। সুদান তার ভৌগোলিক অবস্থান ও খনিজ সম্পদের জন্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশগুলি নিজেদের কূটনৈতিক ও সামরিক স্বার্থরক্ষায় নানা কৌশল অবলম্বন করছে। ফলে সুদানে স্থিতাবস্থা ফেরানোর চাইতে, অন্যান্য দেশগুলি সুদানে যুদ্ধরত দু-পক্ষের কোনও একটা পক্ষ নিচ্ছে, সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।

সুদানে এই সংঘাতের বীজ রোপিত হয়েছিল ২০১৯ সালে, যখন জনগণের এক বিশাল বিক্ষোভের ফলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ওমর আল-বশিরের তিন দশকের একনায়কতন্ত্রের অবসান হয়। কিন্তু জনতার যা দাবি ছিল— অসামরিক সরকারের শাসন— তা মেনে নেওয়ার পরিবর্তে বুরহান ও হেমেতির নেতৃত্বে সেনাবাহিনি ক্ষমতা দখল করে। জনতার বিক্ষোভ চলতে থাকায় ওই দুই সেনানায়ক অসামরিক নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি হয়। কথা ছিল, ২০২১ সালে অসামরিক শাসকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে। সেই সময়সীমা এগিয়ে আসতেই দুই জেনারেল মিলে আর একটি অভ্যুত্থান ঘটায়।

২০২৩ সালের গোড়ায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে হেমেতিকে তাঁর আধাসামরিক বাহিনি আরএসএফ-কে নিয়মিত সেনাবাহিনির সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু কোনও আপসে পৌঁছনোর পরিবর্তে সেই আলোচনা যুদ্ধে পরিণত হয়। আরএসএফ প্রথম আঘাত হানে খার্টুম শহরে অবস্থানরত সেনাবাহিনির উপর আক্রমণ চালিয়ে। খার্টুম, যা এক সময়ে ৬০ লাখ মানুষের একটি ব্যস্ত মহানগরী ছিল, তা এখন এক যুদ্ধক্ষেত্র। নগরের পথে পথে মুখোমুখি সংঘর্ষ, ড্রোন হামলা, লুটপাট চলছে অবাধে।

“আমার পরিচিত লোকেরা সবাই এখন পালিয়ে গিয়েছে,” সাংবাদিকদের বলেছেন ওয়ালিদ আদম। আরএসএফ সৈন্যরা তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে হানা দেওয়ার পর জুলাই মাসে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁরা প্রতিদিন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। মহিলাদের বাধ্য করা হচ্ছে তাঁদের বাড়ি দখল করে থাকা আরএসএফ যোদ্ধাদের জন্য রান্না করতে। হাসপাতালগুলি বোমায় বিধ্বস্ত। ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ। পানীয় জল, খাবার, দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে। খার্টুমের বেশিরভাগ অংশ এখন আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং রাষ্ট্রপতির প্রাসাদও রয়েছে। কিন্তু তাদের এই জয়ের জন্য শহরটিকে ভয়ানক মূল্য চোকাতে হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। খার্টুমের সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলির একটি, গ্রেটার নাইল পেট্রোলিয়াম অপারেটিং কোম্পানির একটি টাওয়ার, আগুনে পুড়ে গেছে। গোটা এলাকা ভস্মস্তূপে পরিণত হয়েছে।

খার্টুমের দুর্দশা যদি তীব্র হয়, তবে দারফুর-এর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বিশ বছর আগে এখানকার ভয়ানক গণহত্যার সংবাদ জেনে শিউরে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। এখন তারই নিখুঁত, নির্মম পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আরএসএফ এবং আরবদের নানা সামরিক গোষ্ঠী উঠে পড়ে লেগেছে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিকেশ করতে। পশ্চিম দারফুরের রাজধানী এল-জেনেইনায়, ২০২৩ সালের জুন মাসে আরএসএফ যোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের মহিলাদের থেকে আলাদা করে, পুরুষদের সেখানেই হত্যা করে। উপগ্রহ চিত্রে গণকবর দেখা গিয়েছে। গত নভেম্বরে আরদামাতা শহরে একটি সেনাঘাঁটি দখলের পরে আরএসএফ ও আরবের নানা অসরকারি সামরিক গোষ্ঠীর সৈন্যরা মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর কয়েকশো নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা করে। তাদের মৃতদেহগুলি রাস্তায় ফেলে রাখা হয়, পরে রাতের অন্ধকারে দ্রুত কবর দেওয়া হয়।

 

সুদান রক্তাক্ত হচ্ছে, আর নানা ভৌগোলিক অঞ্চলের শক্তিগুলি চলেছে স্বার্থ ধরে। জানা যাচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী আরএসএফকে অস্ত্র ও ড্রোন সরবরাহ করে চলেছে চাড-এর মাধ্যমে, যদিও বাইরে তারা সে-কথা অস্বীকার করছে। এই অস্ত্র সহায়তার ফলে আরএসএফ নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে পারছে। মিশর সুদানের মূল সেনাবাহিনিকে সমর্থন করে, কিন্তু সে দেশটি নিজের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ উভয় পক্ষের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাদের নজর সুদানের সোনার খনির দিকে। লোহিত সাগরে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরির সুযোগও তারা হাতছাড়া করতে চায় না।

আমেরিকা এবং পশ্চিমের অন্যান্য শক্তিগুলি ব্যস্ত হয়েছে ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ নিয়ে। সুদানের পরিস্থিতি তারা প্রধানত দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের অনুপস্থিতি যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, তা পূরণ করতে যারা এগিয়ে এসেছে যারা গণতন্ত্র বা মানবাধিকারে মোটেই আগ্রহী নয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাথানিয়েল রেমন্ড বলেন, “সুদান মৃত, কেউ তার জন্য শোকসংবাদও লেখেনি।”

যুদ্ধ সুদানের অর্থনীতিকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। যে সামান্য শিল্প উৎপাদন ছিল তা মিশরে, আরব দেশগুলিতে বা ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। খার্টুমে, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে অত্যাবশ্যক খাদ্যসামগ্রীর দাম গড়ে ১৩৮ শতাংশ বেড়েছে। জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ অনাহারের দোরগোড়ায়।

এই ধ্বংসের মধ্যেও কেউ কেউ মুনাফা খুঁজছে। প্রতি সপ্তাহে, পশুর চামড়া বোঝাই ট্রাক নাইজেরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সুদান থেকে সৌদি আরবে পশু রফতানি ২০২৩ সালে ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। এটা সাধারণ বাণিজ্য নয়, এ হল যুদ্ধকালীন মুনাফাবাজি— দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠীগুলি পরস্পর প্রতিযোগিতা করে দেশের অবশিষ্ট সম্পদ লুট করছে এমন সময়ে, যখন তাদের দেশবাসী অনাহারে মরছে।

২০২৪ সালের মে মাসে আশার একটি ক্ষীণ আলো দেখা গিয়েছিল যখন সুদানের অসামরিক নেতারা ইথিওপিয়ার অন্যতম প্রধান শহর আদ্দিস আবাবায় একত্রিত হন। সুদানের ১৮টি রাজ্যের সবগুলি থেকে প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিদেশ থেকে সমর্থনপ্রাপ্ত, সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এ-ধরনের গণতান্ত্রিক উদ্যোগ কতটুকুই বা সফল হতে পারে? ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ড চলছে, ক্ষুধা আরও তীব্র হচ্ছে। একটি জাতি, যা একসময় গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল, তা আরও গভীর অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।

হুসনা আব্দুল কাদের এবং তাঁর মতো লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন আশাবাদী হওয়া চলে না। তাঁরা বাড়িঘর, সম্পত্তি এবং প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশটি যেন সকলকে সতর্ক করছে— কত দ্রুত শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে, কীভাবে বিশ্বের মনোযোগের পরিসর সঙ্কুচিত হয়েছে, এবং শক্তিশালী দেশগুলি মুখ ঘুরিয়ে থাকলে ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়গুলির কেমন করে পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

সুদানের এই ভাঙন তার সীমানার বাইরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এর পতন ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’, অর্থাৎ পূর্বতম অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে, ইউরোপের দিকে শরণার্থীদের নতুন ঢেউ পাঠাতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলিকে বিপন্ন করতে পারে। তবে এই মুহূর্তে সুদানের মানুষের দুর্দশা বিশ্বে তেমন মনোযোগও পাচ্ছে না। সুদানের জনগণ নিজেদের নেতাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকার তো বটেই, সেই সঙ্গে এমন একটি বিশ্বের হতভাগ্য বাসিন্দা যে দুনিয়ার একদম সময় বা ইচ্ছা নেই এতগুলি মানুষের অসীম দুর্ভোগের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার। সুদানের সাধারণ মানুষ এইরকম এক চরম অসহায়তা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা জানেন না আগামীদিনে তাঁদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে।


*মতামত ব্যক্তিগত