Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্মৃতিপরব: পর্ব ৫

নীহারকান্তি হাজরা

 

সানুদেশের দিন

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪

সেকালের শেভ্রোলে

এরপর একদিন পেট্রোলের আকাল এল, পরিবহনের ক্ষেত্রেও একটা বিকল্প ব্যবস্থা এল। সে-সময় যে বাসগুলি চলত সেগুলি লম্বামুখ শেভ্রোলে গাড়ি। নির্দেশ ছিল চব্বিশজন বসবার। বাসের পিছনে যেখানে ছাদে ওঠার সিঁড়ি, তার পাশেই থাকত কাঠকয়লা বোঝাই একটা বড় ড্রাম। এর উপর রাখা হত ঢাকা দেওয়া আর একটা বড় জলের ড্রাম। ওপরের ড্রাম থেকে একটা পাইপ ছাদের উপর দিয়ে চলে যেত ইঞ্জিনে। কাঠকয়লার আগুনে জলের বাষ্প তৈরি হয়ে ইঞ্জিনে পৌঁছত। স্টার্ট করার পরে এটার সাহায্যে পিস্টন ওঠানামা করত। কিন্তু স্টার্ট করার জন্য প্রয়োজন পড়ত সামান্য পেট্রোলের। এটার জন্য ড্রাইভারের বাঁদিকে একটা গ্লাকসোর কৌটোয় সামান্য পেট্রোল রাখা হত। কিন্তু তার আগে হ্যান্ডল ঘুরিয়ে স্টার্ট। হ্যান্ডেলটা ছিল একটা Z-এর আকারে লোহার দণ্ড। হেল্পার ঠিক সামনের বাম্পারের উপরে একটা ফুটোয় এটা ঢুকিয়ে বেশ কয়েকবার ঘোরাবার পর পিস্টনের ওঠানামা টের পেলেই ড্রাইভার পেট্রোল ছেড়ে দিত। এবার চালু হত ইঞ্জিন। এটা ঘোরানো ছিল খুব পরিশ্রমসাধ্য। এটা বাঁদিকে প্রবল বেগে ঘুরে এলে হেল্পারের পা ফেটে যেত। পনেরো মাইল যাওয়ার পরই যাত্রীদের নামিয়ে কয়লার ছাই ঝেড়ে দিয়ে প্রয়োজন পড়ত নতুন কয়লার জোগান আর জল। আবার বাষ্প তৈরি হলে ইঞ্জিন স্টার্ট করে যাত্রা শুরু হত। পিছনের আসনগুলো গরম হয়ে যেত। বাধ্য না হলে কেউ ওখানে বসত না। শুনেছি সে-সময় পেট্রোলের গ্যালন ছিল চার আনা। এখনকার ৩.৭ লিটার সমান এক গ্যালন।

সে-সময় ড্রাইভার আর হেল্পারদের বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখা হত। কোনও কোনও সময় গাড়ির তাবৎ সরঞ্জাম রেডি করে ড্রাইভারকে ঘুম থেকে তুলে আনতে হত। তখন ছাড়ার সময় বহুক্ষণ পার হয়ে গেছে। জনপদে দুজন মালিকের বাস জেলাসদর পর্যন্ত যেত। চৌধুরিদের বাস। আর একজন মুসলমান মালিকের বাস, নাম ছিল হেলাল। বাইরে লেখা ছিল ‘‘গরীব নওয়াজ”, আর ভিতরে “এ্যায়সা দিন নেহি রহেগা”। ‘গরীব নওয়াজ’ ইসলামে খুবই প্রচলিত শব্দবন্ধ— বিশেষ করে সুফি সাধক হজরত মইনউদ্দিন চিস্তি এই নামে পরিচিত। বাংলা করলে দাঁড়ায়— দীনবন্ধু। কিন্তু ভিতরে পরের বাক্যটি— এমন দিন রইবে না— কেন লেখা থাকত তা আজও জানি না।

আমাদের জনপদে সে-সময় আর কোনও ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি ছিল না। কিন্তু একটা ছুঁচলো-মুখ কাপড়ের হুড দেওয়া গাড়ি জেলা সদর থেকে জনপদের পসারি উকিল অরবিন্দ ঘোষের বাড়িতে আসত। তারপর সেখান থেকে চলে যেত পিছনে লাল ধুলোর মেঘ রেখে রেখে জনপদের শেষ সীমা ছাড়িয়ে লেদি পাহাড় ছাড়িয়ে কোথায় কে জানে। জনপদের কিশোরেরা সাধ্যমতো এটার পিছু নিত। চোখ বন্ধ করে দৌড়লেও কান আর নাক বন্ধ হয়ে যেত লাল ধুলোয়। এরকম একটা দিনে সকলের সঙ্গে আমিও পিছু নিয়েছি চোখ বন্ধ করে। লাল ধুলো, বন্ধ চোখ আর একটা অপসৃয়মান যান্ত্রিক বেগের পিছনে আর এক অপটু বেগের নেশা যখন থেমেছে বুকের প্রবল ওঠা-নামায়, আমি তখন একা। পিছনে কখন সঙ্গীরা থেমে গেছে জানা নেই। ঘোর কাটলে দেখছি লেদি পাহাড় পার হয়ে একটা উঁচু টিলার মাথায় লাল ধুলো মাখা গাড়িটা দাঁড়িয়ে। তার পিছন থেকে নীল ধোঁয়া বার হয়ে ডানদিকে ঢালু উঁচুনিচু ডুংরির মাথা ছুঁয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা লোক গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বালতি হাতে। কখন গাড়িটার পিছনে দাঁড়িয়েছি খেয়াল নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়া গাড়ির মুখের থেকে বেরোচ্ছে গরম বাষ্পের সঙ্গে ফুটন্ত জল। বালতি থেকে মগে করে যখন ইঞ্জিনে জল ঢালার কাজ চলছে পিছন ফিরে দেখি আমার ফেলে আসা ঘরে ফেরার পথ রৌদ্রের তাপে বেগুনি বাষ্পে হারিয়ে গেছে। এবার ভয়। চারপাশের অসীম শূন্যতায় আমি ছাড়া আমার কেউ নেই। ঘরে ফেরার ব্যাকুলতায় কান্নার শক্তিও চাপা পড়ে গেছে। জীবনে যতবার আমার অস্তিত্বের সঙ্কট ঘটেছে এটিই তার প্রথম।

গাড়ির মধ্যেটা ভর্তি। ড্রাইভারের বাঁদিকে একটা লোক এসে বসল। এবার ড্রাইভার। এমন সময় ভিতর থেকে একজনা খুব কালো, পাকাচুল আর হলদে চোখের ভদ্রলোক ড্রাইভারকে বললেন আমাকে তুলে নিতে— “ও তো আর একা ফিরতে পারবে না। আমরা যখন ফিরব তখন ফিরবে। শাস্তি পাক।” আমার স্থান হল সামনের বাঁদিকের চাকার মাডগার্ডের পিছনে চওড়া ফুটবোর্ডের উপর। আমার ধরবার জায়গাটা হল সামনের পুরু কাচ আধখানা তুলে দেওয়ার ফলে তার ফ্রেমের বাঁদিক। ঢেউ খেলানো মাডগার্ডের নিচে সামনের চাকার তলা দিয়ে রাস্তাটা ক্রমাগত শূন্যে গুটিয়ে চলেছে। সেই গরমের দুপুরে চারপাশের উঁচুনিচু পাহাড় প্রান্তর ভেদ করে চলা একটা অপসৃয়মান বেগ আবরণহীন আমাকে এমনই একটা মসৃণ অপার আনন্দ দিয়ে গেল— আজও তা সেইভাবেই মনে আছে। জীবনে এই প্রথম আমার ছোট গাড়ি চড়া। সেই কৃষ্ণকায় মানুষটির স্মৃতি আমাকে ছেড়ে যায়নি। পরে জেনেছি এঁর নাম বিভূতি ঘোষ। জেলাসদরের লালবাজারে বাড়ি। তিনি একটা খড়িমাটির পাহাড় কিনেছিলেন। জেলাশহরে প্রথম তিনি চুনের ব্যবসা শুরু করেন— কাটনি লাইম।

 

গালা

সরস্বতী মেলা থেকে কিছুটা দূরে ছিল হালদারপাড়া। এখানের একটি ছেলে বাণী হালদার আমার সঙ্গে পড়ত। লাজুক মিষ্টি স্বভাবের এই ছেলেটিকে আজও আমার মনে পড়ে। একদিন ওর সঙ্গে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। বহু মহলের এই বাড়িটার একটা অংশে ছিল ওদের গালার কারখানা। দেখেছিলাম একটা বিস্তৃত বাঁধানো উঠোনে গাঢ় খয়েরি লাল বস্তুগুলো রোদে শুকোচ্ছে। তার পাশেই থাকা অসংখ্য ভর্তি বস্তা থেকে ঢালা হচ্ছে ওই বস্তুগুলো। রোদ-খাওয়াগুলো পা দিয়ে জড়ো করা আর মেলে দেওয়ার কাজটা করছে মহিলারা। আর যেগুলো নতুন ঢালা হল, সেগুলো মেলে মহিলারা বসে গেল তাদের ভিতরের আটকে থাকা গাছের ডাল-পাতা বাছার কাজে। লাক্ষা। বনভূমির বিস্তীর্ণ পরিসরে নানা উপযুক্ত গাছ— প্রধানত কুলগাছে ধরিয়ে দেওয়া হত লাক্ষার কীট। সাধারণত শরতের শেষে কীটগুলি বাঁচিয়ে রেখে লাক্ষা সংগ্রহ করা হত। একটা প্রশস্ত ঘরে স্তূপাকার লাক্ষা। এখানে ছিল এখনকার আটা চাক্কির মতো হলার আর কনভেয়ার বেল্ট লাগানো একটা যন্ত্র। এটার কাজ ছিল লাক্ষাগুলোকে গুঁড়ো করা। সেগুলি ঢেলে দেওয়া হত একটা কাঠকয়লার বয়লারের উপরে চাপানো একটা বড় পাত্রে। লাক্ষার গলন শুরু হলেই এটা চলে যেত পাইপের ভিতর দিয়ে অন্য একটা পাত্রে। এখানে অন্তত সব মিলিয়ে জনা চারেক দক্ষ লোক। একজন পরীক্ষা করত গলন্ত লাক্ষার রং। এটা কালচে গাঢ় হয়ে গেলে বয়লারের তাপ কমাতে হত। তারপর সঠিক মাত্রায় তাপ এনে লাক্ষার গলন চলত। এর পরে এই গলা লাক্ষা চলে আসত একটা পাইপে যার মুখটা ছিল ক্যানভাসের। এর প্রান্তটা ধরে একজন লোক মসৃণ ছোট ছোট স্টিলের পাতের উপর নিখুঁত মাপের ওই গলন্ত লাক্ষা ফেলত। আর সেটা পড়েই নিখুঁত গোল পাটালির মতো হয়ে যেত। এটা সরিয়ে নিয়ে পর পর এগুলি জুগিয়ে চলত মহিলা কর্মীরা। ঠান্ডা হওয়ার আগেই মহিলারা হাতের কাছে রাখা তেলে মুছে একটা পিতলের শিল বসিয়ে দিত টিকলির উপর। এতে কী লেখা থাকত আব্জ আর মনে নেই। ঠান্ডা হলেই এগুলো শব্দতোলা টাকার মতো আলাদা হয়ে যেত। এগুলির প্রায় সবগুলি সমান মাপের সমান ওজনের হত। মহিলারা বসত বাছাইয়ের কাজে রঙের মাত্রা মিলিয়ে। রংই ছিল এগুলির অর্থমূল্যের সূচক। এগুলি ব্যবহারের প্রধান ক্ষেত্র কাঠের উপর পালিশ দেওয়া। অনেক অনেক পরে এই টিকলি গালা সিলমোহর করার প্রয়োজনে মিলল স্যাঁকরার দোকানে। গয়নার কাজে গালার ব্যবহার ঘটে এটাও জেনেছিলাম অনেক পরে।

 

[ক্রমশ]