অভী আচার্য
রানিকুঠির বেসরকারি বিদ্যালয়ে চতুর্বষীয়া শিশুকন্যাটিকে যৌন নিগ্রহের ঘটনা সপ্তাহ পার না-হইতেই প্রত্যাশিতভাবে সংবাদপত্রের প্রথম পাতা হইতে অপসৃত হইবার পর, আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুই পুনরায় স্থিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। অভিভাবকদিগের সপ্তাহব্যাপী অবস্থান-আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে স্কুল-কর্তৃপক্ষ এক পা পিছাইয়া দু’পা আগাইবার সিদ্ধান্ত নিয়াছেন – আপনার মন্ত্রী খোয়াইয়া প্রতিপক্ষের জোড়া নৌকো গিলিয়া লইবার পরিচিত কৌশলে প্রধান শিক্ষিকাকে সাময়িকভাবে অপসারণ করিয়া পুনর্বার বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চালু করিয়া দেওয়া গিয়াছে, অভিভাবকরা ইহাকে আপনাদিগের জয় বলিয়া ধরিয়া যৎপরোনাস্তি হৃষ্টচিত্তে গৃহে ফিরিয়া গিয়াছেন, প্রথম শ্রেণির দৈনিক সংবাদপত্রে সপ্তাহকাল-পর ফুটফুটে ছাত্রীদিগের সহাস্যমুখ স্কুল-গমনের আলোকচিত্র ছাপিয়া দেওয়া গিয়াছে – অতএব ধরিয়া লওয়া চলে যে, জিডি বিড়লা-কাণ্ডে সব পক্ষকেই সন্তুষ্ট করিয়া একপ্রকার সম্মানজনক রফায় পৌঁছানো সম্ভব হইয়াছে। রফাসূত্র মিলিয়া গেলে সর্বত্রই যাহা হয়, এ-ক্ষেত্রেও তদ্রূপ সব অতি দ্রুত স্থিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। সংবাদমাধ্যম শিশুনিগ্রহ-সংক্রান্ত খবরকে প্রথম পাতা ও প্রাইম টাইম হইতে সরাইয়া ফের অন্যান্য খবর লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে, অভিভাবকেরা কয়েকদিবস ক্যাজুয়াল লিভ কাটাইয়া নিত্যকার আপিশের রুটিনে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করিয়াছেন, চায়ের দোকান হইতে ডেলি-প্যাসেঞ্জারের কামরায় পকসো আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারা ও তাহার কূট ব্যাখ্যা লইয়া আলোচনার অতি গভীর ঘূর্ণাবর্ত ক্রমে তীব্রতা হারাইয়া ঘ্যানঘেনে নিম্নচাপের ন্যায় স্তিমিতপ্রায় – ফলে বাস আবার বাসের পথে চলিতে শুরু করিয়াছে, ট্রাম ট্রামের পথে চলিতে শুরু করিয়াছে, আইন আইনের পথে চলিতে শুরু করিয়াছে।
বলা বাহুল্য প্রভাতে নিদ্রা ভাঙিয়া সংবাদপত্রে নেতিবাচক খবর না-পড়িতেই আমাদিগের অধিকাংশের ভাল লাগে, টেলিভিশনের সুবেশ সঞ্চালকও বীভৎসরসাত্মক সংবাদ পরিবেশনকালে কণ্ঠ খাদে নামাইয়া সংবৃত স্বরে বলেন “এমন খবর আপনাদের দেখাতে না-হলেই বেশি ভাল লাগত”, কিন্তু তাহার পরেও এইপ্রকার খবরের মুখোমুখি আমাদিগের, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও, হইতেই হয়। ফলে, যদি রানিকুঠির অভিজাত বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রীর যৌন-নিগ্রহের খবর কাগজে আর প্রকাশিত না-হয়, তাহাতে আমাদিগের দুঃখের কিছুমাত্র কারণ ঘটার কথা নহে, পরন্তু তদ্রূপ নারকীয় ঘটনা আর ঘটিতেছে না ভাবিয়া যৎপরোনাস্তি সুখবোধ হওয়ার কথা। কিন্তু, বস্তুতই কি তাহা ঘটে? মাসকয় আগে হরিয়ানার গুরুগ্রামে রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভয়াবহ ঘটনা যখন প্রকাশ্যে আসে, শিহরিত হইয়া উঠিয়া আমরা ভাবিয়াছিলাম, ঈশ্বর, এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা যেন আর কোনও পিতামাতার কপালে না-ঘটে। জিডি বিড়লা স্কুলের ঘটনার পর, বলা বাহুল্য, অসার বুঝিয়াও পুনরায় সে-প্রার্থনাই করিতে হইতেছে।
কিন্তু যাঁহারা সংবাদ রাখেন, জানেন, এমন ঘটনা ঘটিতেই থাকে। স্থাননাম পালটাইয়া যায়, শিক্ষায়তনের নাম পালটাইয়া যায়, অভিযুক্ত ও আক্রান্তের নাম পালটাইয়া যায়, হয়তো অপরাধের বহিরঙ্গের রূপও ক্ষেত্রবিশেষে পালটাইয়া যায় – পালটায় না কেবল অপরাধের চরিত্র। পালটায় না অপরাধের পর বিদ্যালয়ে-কর্তৃপক্ষের দায় এড়াইয়া যাওয়ার প্রবণতাও। গুরুগ্রাম ও রানিকুঠির ঘটনার পরমুহূর্তে একনিশ্বাসে মনে না-পড়িয়া পারে না অতি সম্প্রতি তেলঙ্গানার সঙ্গারেড্ডি জেলার এক বেসরকারি স্কুলে ইউনিফর্ম না-পরিয়া আসার শাস্তিস্বরূপ ক্লাস ফাইভ-এর এক ছাত্রীকে তাহার সহপাঠী ছাত্রদের শৌচাগারের সম্মুখে দাঁড় করিয়া রাখার ঘটনা। কিংবা বুলন্দশহরে এক বিদ্যালয়ে – যেখানে চারিবর্ষীয় এক মানবককে স্কুলছুটির ঘণ্টা বাজিয়া যাইবার পরও বেশ খানিকক্ষণ ক্লাসে আটকাইয়া রাখা হইয়াছিল কেবল তাহার কয়েকমাস স্কুলের মাহিনা বাকি পড়িবার কারণে। স্মৃতিপথে আরও কিয়ৎকাল পশ্চাদ্গমন করিলে স্মরণে আসিবে, বৎসরকয় পূর্বে ওডিশার এক গ্রামের স্কুলে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনরন্ধনের ফুটন্ত কটাহে পড়িয়া অষ্টমবর্ষীয়া বনিতা কানহারের জীবন্ত দগ্ধ হইয়া মারা যাইবার ঘটনা। অথবা একেবারে সাম্প্রতিকে, জিডি বিড়লার ঘটনার মাত্রই দু’দিবস পূর্বে ইটানগরের কস্তুরবা গান্ধি বিদ্যালয়ে ক্লাসরুমের দেওয়ালে ‘গ্রাফিতি’ অঙ্কনের অপরাধে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির অষ্টআশিজন ছাত্রীকে পোশাক খুলাইয়া অন্য ছাত্রীদের সম্মুখে বিবস্ত্র দাঁড় করাইয়া রাখিবার বৃত্তান্ত। একই সঙ্গে পাঠকদিগের মনে পড়িবে সম্প্রতি সংবাদ-শিরোনামে আসা সেই ভিডিও ক্লিপের কথা, যেখানে এক ক্রন্দনরত শিশুকে গৃহশিক্ষিকার ‘থার্ড ডিগ্রি’-সহযোগে শিক্ষাদানের বিস্ময়কর তরিকা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়াছিল সারা দেশ। ইহারই পার্শ্বে যদি রাখা যায় গত কয়েক বৎসর ধরিয়া সারা দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, নিমেষে স্পষ্ট হইয়া আসিবে যে রায়ান বা রানিকুঠি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এক দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধির কালোত্তীর্ণ চিত্র মাত্র।
কালোত্তীর্ণই বটে। সরকারি তথ্যপঞ্জী সম্প্রতি উদ্ঘাটন করিয়াছে, গত একদশকে দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বাড়িয়াছে পাঁচশত গুণ – কার্যত জ্যামিতিক অগ্রগমনের হারে। ২০০৬ সালে যেখানে শিশুদের বিরুদ্ধে মোট নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল উনিশ হাজারের সামান্য কম, সেখানে ২০১৬-তে সেই সংখ্যাটি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে প্রায় এক লক্ষ সাত হাজারে – বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা অগ্রগতির এক গৌরবজনক বিজ্ঞাপন বটে। আরও গভীর নিরীক্ষা জানাইবে, এই বিপুল সংখ্যাবৃদ্ধির সিংহভাগই ঘটিয়াছে গত চার-পাঁচ বৎসরে – যাহার বড় অংশ জুড়িয়া, হয়তো বা সমাপতনই যে – দেশের শাসনভার ন্যস্ত রহিয়াছে বিজেপি-র হাতে। শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যার নিরিখে প্রথম তিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশেও যে বিজেপি-রই শাসন – তাহাও বোধ করি বিচিত্রতর সমাপতনজনিতই হইবে। কিন্তু ইহা হইতে কোনও অতিসরলীকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছিবার পূর্বে অবশ্যই স্মরণে রাখিতে হইবে, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের মতো অবিজেপি রাজ্যও বিলক্ষণ রহিয়াছে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের নিরিখে তালিকার প্রথম পাঁচে।
কিন্তু বিশুষ্ক তথ্যপঞ্জী ও তাহা লইয়া কণ্ডুয়ন সর্বদাই যে কোনও বৃহত্তর সত্যে পৌঁছাইয়া দেয় এমন নহে, পরন্তু গুরুগ্রামের প্রদ্যুম্ন বা জিডি বিড়লার এখনও-গুটি-কাটিয়া-প্রজাপতি-না-হইয়া-উঠা প্রাণকণিকাটির পিতামাতাদিগের এই তথ্যে কিছু যায়-আসে না। তাঁহাদের এই অপূরণীয় ক্ষতির শূন্যতাবোধের মধ্যে কেবল জাগিয়া থাকে ঘটনার পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের অমানবিক মুখ – যেভাবে তাঁহারা তাঁহাদিগের সমস্ত দায় এড়াইয়া ঘটনাগুলিকে লঘু করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন, অভিভাবকদিগের ক্ষতস্থানে সহমর্মিতার প্রলেপ দিবার তিলমাত্র চেষ্টা না-করিয়া নিষ্ঠুর মূঢ়তায় ও ঔদাসীন্যে নিজেদের সরাইয়া লইতে চাহিয়াছেন – সেই প্রস্তরবৎ নির্লিপ্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্রূরতাই অভিভাবকদিগের মনে সর্বাপেক্ষা অধিক বাজিয়াছে। বিদ্যালয়কে সচরাচর মনে করা হয় গৃহের বাহিরে শিশুর পক্ষে নিরাপদতম পরিসর – দুর্ভাগ্য যে, না রায়ান, না জিডি বিড়লা, কোথাওই স্কুল-কর্তৃপক্ষ আপনাদিগকে সেই সম্মানজনক অভিধার যোগ্য করিয়া তুলিতে ন্যূনতম চেষ্টাটুকুও করেন নাই। অভিভাবকদের মর্মবেদনা অতএব কালক্রমে জনরোষে পরিণত হইয়াছে, এবং পরিণামে জিডি বিড়লার প্রধান শিক্ষিকাকে পদ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইতে হইয়াছে।
কিন্তু ইহার পরেও আরও দুইটি কথা বাকি থাকে। প্রথম কথাটি এই – যদিচ বিচারাধীন বিষয় বলিয়া তাহা লইয়া মুখ খুলিতে দ্বিধা হয়, তথাপি দিনাবসানে হৃদয়ে এই বিপন্নতার বোধ রহিয়া যায় যে, জনস্মৃতি যেহেতু অতীব ক্ষণস্থায়ী ও দুর্বল, অতএব অতীতের অসংখ্য ঘটনার ন্যায় জিডি বিড়লার ঘটনাও অনতিবিলম্বে কালের হস্তাবলেপে মিলাইয়া যাইবে। স্কুল খুলিয়াছে, ইহাকেই অন্তিম জয় ভাবিয়া অভিভাবকেরা গৃহগত হইয়াছেন, বস্তুত স্কুল-কর্তৃপক্ষও তাহাই চাহিয়াছিলেন – অতএব তাঁহাদের মনোবাঞ্ছাও যথাযথ পূরণ হইয়াছে। যতদিন না আবার কোনও ঘটনা ঘটে, ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিন্ত থাকা যাইবে।
দ্বিতীয় কথাটি আরও অনেক বেশি জরুরি। নির্যাতিত চতুর্বষীয়া বালিকাটি কীভাবে এই নিদারুণ স্মৃতিভার কাটাইয়া উঠিবে, কীভাবে তাহাকে এই পৈশাচিক ঘটনার রেশ অতিক্রম করাইয়া আবার স্বাভাবিক শিশুজীবনে ফিরাইয়া আনা যাইবে, সর্বোপরি তাহার মনে বিদ্যালয়ের যে মর্মান্তিক অভিধা আঁকা হইয়া গেল সেই কালো দাগ মুছাইয়া কীভাবে আবার তাহাকে স্কুলমুখী করিয়া তোলা সম্ভব হইবে, সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎ বলিবে। আপাতত আফশোস এই যে, যেক্ষণে আমাদিগের সব মনোযোগ এই বিষয়টিতে নিবদ্ধ হইবার কথা ছিল, সেই স্থলে আমরা ঘটনাটিকে কেন্দ্র করিয়া কেবল উত্তুঙ্গ নাটকীয়তা সৃজনে মনোনিবেশ করিলাম ও টিআরপি-শাসিত রৌপ্যমুদ্রাঝনৎকারের সম্মোহনে ভুলিয়া মানবিকতার মূল শর্তটি হইতে বিচ্যুত হইলাম।