আর্কাদি গাইদার
রাজ্যে রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক চর্চার তো অভাব নেই। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, বিপ্লব, সাব-অলটার্ন, মুক্তবাজার, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, নারীবাদ, সব কিছু নিয়েই কত তর্ক, বিতর্ক, লড়াই। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কেউ একটা শব্দও খরচা করে না। নির্বাচনী ইস্তেহারগুলোর এক কোণে এক প্যারাগ্রাফ বরাদ্দ করা থাকে পরিবেশগত এজেন্ডার জন্যে। কেমন যেন নম নম করে ছুঁয়ে যাওয়া। অথচ এই রাজ্যের রাজধানীর মানুষ প্রতিদিন বিষাক্ত হাওয়ায় তিলে তিলে মরছে। শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যায় এগিয়ে বাংলা। পৃথিবীর সমস্ত উন্নত শহরে সরকারি পলিসির অভিমুখ হল প্রাইভেট গাড়ি কমিয়ে জনপরিবহনব্যবস্থার উন্নতি করা। বেশি সংখ্যায় মানুষকে জনপরিবহনের আওয়ায় আনা। সাইকেলের জন্যে পরিকাঠামো তৈরি করা। আমাদের দেশের সরকার এবং নাগরিক এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, দুজনে একই পথের পথিক। আমরা চাই আরও গাড়ি, বড় বড় তেলখোর SUV. সাইকেল তো গাইঁয়ারা চালায়, তাই শহরের রাস্তায় সাইকেলকেই আমরা বেআইনি করে দিয়েছি। এই বিষয়ে মোটামুটি সব সরকারের পলিসি একই থেকেছে। প্রকৃতি ধ্বংস করে ‘উন্নয়ন’-এর দেবতার বাম বা ডান, কোনও মতবাদেই পরিসর তৈরি করে নিতে অসুবিধে হয়নি।
ইস্ট কোলকাতা ওয়েটল্যান্ডস নিজেই একটি গোটা ইকোসিস্টেম। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, পোকা, জন্তু এবং পাখি, বিশেষ করে পরিযায়ী পাখি এই ইকোসিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল। এরা বহুদিন ধরেই একটু একটু করে পিছু হটছে, হারিয়ে যাচ্ছে। ১০ বছর আগেও বৈকাল হৃদ বা সাইবেরিয়া এবং তাইগার থেকে যে পাখিরা এখানে আসত, তারা এখন আর আসে না। জলাভূমি এবং সবুজ ক্ষেতের মাঝখানে হঠাৎ করে ক্যান্সারের টিউমারের মতন গজিয়ে উঠেছে কমপ্পেক্স, অফিসের স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোন, সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। আর শুধু পশুপাখি নয়, একটু একটু করে পিছু হটেছে এখানকার মানুষ। যারা বহু শতাব্দী ধরে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে বেঁচেছিলেন, তাদেরকে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি তারা বর্তমান সময়ের জন্যে যথেষ্ট উন্নত নন। তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছি।
কলকাতা লন্ডন হওয়ার অনেক আগে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে হয়তো কলকাতা আর লন্ডন দুই জলের তলায় ডুবে যাবে। লন্ডন তবু চেষ্টা করছে, আমাদের ওসব বালাই নেই। কলকাতার আশেপাশের জলাজমি বুজিয়ে ফ্ল্যাট, অফিস, বহুতল, মল তৈরি হচ্ছে। এই জলাজমি ছাড়া কলকাতা ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যাবে। কলকাতার নিজস্ব প্রাকৃতিক natural waste management system, যা আবার একইসাথে flood control mechanism. এবং কলকাতার রাস্তায় এখনও দেশের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায় খাদ্য পাওয়া যাওয়ার পেছনে যার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তবে আমাদের খিদে তো সর্বগ্রাসী। যেটুকু জলাজমি বাকি আছে তা আমাদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। ওই জায়গাতেই আমাদের বানাতে হবে ফ্ল্যাট, মল, ব্যাঙ্কোয়েট হল। এবং এই বিষয়ে হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কেউ চিন্তিত না। হিন্দু-মুসলিমের লড়াই, শ্রমিক-বুর্জোয়ার লড়াই, কোনওটাই হবে না যদি মানুষই না বেঁচে থাকে। এক বুক কার্বন ডাইঅক্সাইড, এক ঢোক তেজস্ক্রিয় পানীয় জল, এক গরাস বিষাক্ত সবজি, এই দিয়ে না বাঁচবে হিন্দু, না বাঁচবে মুসলিম, না শ্রমিক, না বুর্জোয়া। মন্দির, মসজিদ, নবান্ন, সাউথ সিটি মল, লেনিনমূর্তি দাঁড়িয়ে থাকবে ভূতের মতন এক মৃত শহরের ওপর। তাও আমাদের খিদে মিটবে না। এরপর আমরা বে অফ বেংগল বুজিয়ে ফ্ল্যাট বানাব।
‘When the last fields has been farmed, and the last river has been fished, only then will be realise that we cannot eat money.’
আর্কাদি গাইদার লেখকের ছদ্মনাম। প্রখ্যাত রুশ লেখক আর্কাদি গাইদারের সঙ্গে বর্তমান লেখকের কোনও সম্পর্ক নেই।