শুভ্রদীপ চৌধুরী
রাক্ষসের মতো মেঘ ঘিরে ফেলেছে শহরের আকাশ। থম মেরে আছে বিকেল। বৃষ্টি নামবে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসায়। তাড়াহুড়ো করে খুদি খুদি মানুষের দল ছুটছে।
আটতলার জানালা থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে সোহাগীর মা ডাকতে লাগল, চই– চই— চই– । যেন গেল বড় বানে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় হাঁসগুলো ফিরে আসবে।
সন্ধে হল, বৃষ্টি এল না। মনমরা একটা চাঁদ ঝুলতে লাগল আকাশে।
সোহাগীর মা ঝটপট বাসন মেজে, রান্না সেরে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিস করে বলে, চই– চই— চই— চই– ।
দাদাবাবু, দিদিমণিরা ফিরেছে।
ধীরেধীরে চাঁদ সরে যায়। দাদাবাবুদের খাবার সময় হয়। মনে মনে বিড়বিড় করেই যায়, চই— চই–।
একদিন মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে গেল প্যাঁক, প্যাঁক শব্দে। রান্নাঘরের মেঝের বিছানার চারদিকে যেন ঘুরছে, কালি, ধলা, হলদা, নীলারা। তার চারটে হাঁস। কাউকে অবশ্য দেখতে পেল না। সে চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেল, স্পষ্ট, তার গ্রাম। বানের আগের গ্রাম। হেলতে দুলতে ফিরছে চারটে হাঁস।
সোহাগীর মা বলল, তোরা এখন থাকিস কোথায়?
সে জানত ধলা উত্তর দেবে, ঠিক তাই হল।
ধলা বলল, জায়গার নাম কওয়া পারব না। কোনও টাউনের কাছেপিঠে হবে। তিন বার মালিক বদল হইচে।
সোহাগীর মা : তাই! আমারও এটা চার নম্বর বাড়ি। তোদের এখনকার জায়গাটা ভাল?
ধলা : আগের মতো না। তবে মানায়ে নিছি। চারজন যে একসাথে আছি এটাই অনেক!
সোহাগীর মা : আমার অবস্থাও তেমন রে। মানে নিছি, কপালে কপালে যা আছে তা খণ্ডাবে কে। সোহাগীর খবর পালে দিস।
ধলা : তা তোমাক কওয়া লাগবে না। একদিন তোমার মাতাল বরটাকে দেখেছিলাম। চোখে চশমা। পায়ে বুট। খটখট করে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছিল।
সোহাগীর মা : সাথে ওই মুখপুড়ী মাগীটা ছিল না? ছাওয়াল, পাওয়াল ছিল?
ধলা : না, না। একাই ছিল।
সোহাগীর মা : আগের থেকে ভালোই আছে তালে।
ধলা : মনে তো হল না। দড়ির মতো হয়ে গেছে।
সোহাগীর মা : কস্ কী! ঠিকমতো খায় না নাকি?
ধলা : তোমার তাতে কী? সে তো তোমারে ভাত দিবে না বলে পালাইচে ডাঁসা মেয়েছেলের হাত ধরে।
সোহাগীর মা : চুপ যা ধলা। বড় বড় কথা শিখিচিস! সারাদিন খোঁয়াড়ে আটকে রাখপ কয়ে দিলাম। খালি উল্টাপাল্টা কথা। যা, যা কচ্ছি সামনে থেকে।
ধলা : রাগ করলা? রাগ কইরো না। আমরা চারজন তোমাকে আর আলাদা ভাবি না। আমরা জানি পাঁচজন হাঁস।
সোহাগীর মা : চুপ যা। চুপ যা। আয়, কোলে আয়।
প্যাঁক প্যাঁক শব্দে ভরে উঠল ঘর, যেন ঘর নয় আস্ত একটা খোয়াড়।