Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আত্মঘাতী ইঁদুর কিংবা জীবনরক্ষাকারী বৈঠক

রোমেল রহমান

 

নিউজটা ছিল এ বছর সংঘটিত তুলকালাম বন্যার জন্য দায়ী ইঁদুর! ইঁদুরেরা বন্যা রক্ষা বাঁধ কেটে দিয়েছে তাই হুড়মুড় করে জল ঢুকে এলাকার পর এলাকা তলিয়ে গেছে! এরকম একটা ডাহা গাঁজাখুঁজে অপবাদের তীব্র প্রতিবাদ এবং বন্যাগ্রস্ত ইঁদুর সম্প্রদায়ের জন্য করণীয় ও ত্রাণ বিষয়ক জরুরি বৈঠকের ডাক দেন ইঁদুর সমাজের প্রধান ধেড়ে ইঁদুর! এবারই প্রথম প্রজাতিগত জাতীয়তার উপর আঘাত পড়ায় ইঁদুর সমাজের সকল দল উপদল গোত্র থেকে প্রতিনিধিরা একত্র হয়েছেন ইঁদুরদের এই আঞ্চলিক সভ্যতা রক্ষার তাগাদায়! যথারীতি যথাসময়ের কয়েক মিনিট পর সভার সূচনা হয়েছে! সূচনাতে আচানক বন্যায় ডুবে মরা হাজারো ইঁদুরদের জন্য শোক প্রস্তাব গ্রহণ এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে। অতঃপর মানবজাতির এহেন দুঃসাহস যে ইঁদুরদের উপর তারা বন্যা সংঘটনের দায় দিয়ে নিজেদের প্রজাতি রক্ষা করার কৌশল নেয়ার এই দুর্বল রাজনৈতিক বালখিল্যতায় তীব্র নিন্দাজ্ঞাপন করা হয়! নিন্দা প্রস্তাব আনেন দুর্গত এলাকা থেকে জানে বেঁচে ফেরা নেংটি ইঁদুর!

অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক মিনিট পর এসে পৌঁছায় প্রতিবেশী দেশের কয়েকজন ইঁদুর, তাদের আগমনকে এই দুর্যোগঘন দিনেও করতালির মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। তাদেরকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং কুশল বিনিময়ের সময় জানতে চাওয়া হয়, পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে তাদের সঙ্গে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো মশকরা করেছে কিনা! উত্তরে তারা বিরক্ত হয়ে জানান যে, তারা ওপারের বানের জলে ভেসে এপারে এসেছেন! এবং তাদের এই হালফিল বিষয়ে এপারের কতৃপক্ষ ওয়াকিবহল না হওয়ায় তারা বিস্মিত এবং তীব্র ব্যথা জ্ঞাপন করেন! ফলে পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করার জন্য বর্তমান সময়ের ক্রেজ খ্যাত এক ইন্দুরি বিদেশি বন্ধুদের পিক করেন, এবং তাদের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সেবা দিয়ে ভুলিয়ে দেন নিজেদের তথ্যগত ব্যর্থতা! কিন্তু উত্তেজনার শেষ এখানেই না, ঠিক এই সময়ে একটা হাউকাউ শোনা যায় মিটিংয়ের এক পাশ থেকে। ব্যাপারটার দিকে যখন সকলেই নজর আনেন তখন জানা যায়, আসন নিয়ে দুই গ্রুপের ফোঁড়ন কাটাকাটি তাত্ত্বিক টানাটানি ডিঙিয়ে হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।  ফলে মিটিঙে যিনি স্বঘোষিত সভাপতি তিনি হাত উঁচু করে বলেন, ‘কাহিনী কি ওইখানের?’ তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, একদল বেপরোয়া ইঁদুর ও একদল মারমুখী ছুঁচোর মধ্যে কে আগে বসবে এই নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হয়! সেখানে তারা জাতি থেকে প্রজাতি এবং প্রজাতির বিশুদ্ধতা নিয়ে একটি ঐতিহাসিক বিবর্তনগত তর্কের পর যখন ডিসকোর্সটি সমাধানের দিকে আগাতে ব্যর্থ হয় তখন তারা উভয়ে ধাক্কাধাক্কি থেকে মারামারির উচ্চতায় উঠে যায়! ব্যাপারটা সভায় উপস্থিত এক সিনিয়র নেতা শোনার পর বিমর্ষ মুখে বলে বসেন, ‘এই জন্যেই হালায় আমরা আগাইতে পারলাম না, মাইনষেরা আগায় গেলো!’ তখন এক খ্যাপাটে ইঁদুর বলে বসে, ‘নেতা আপনে কিন্তু দোষ আমাগোর কান্ধে ফেলায়া, ঐ গায়ে গোন্ধ ছুঁচাগো পক্ষ নিতেছেন!’ ফলে সিনিয়র নেতা আরও বিমর্ষ মুখে বলেন, ‘আমি কারও পক্ষই নিচ্ছি না আমি আসলে বুঝাইতে চাইতেছিলাম যে, প্রথমে আমাগোর সবাইর… মনে রাখতে হইব যে,… সংকটের বিহ্বলতা…!’ পিছন থেকে এক ছুঁচো বলে ওঠে, ‘জান বাঁচানো মিটিঙে কাব্য জাহির করবেন না! জলদি মিটিং শ্যাষ করেন বারিত যামুগা! এই বালের ইন্দুরগো লগে এক পাতে বইয়া তাগোর রোয়াব দেখবার রাজি নাইক্কা! আমাগোর ইজ্জতের তাফালিং হইব আর মুরুব্বীরা চিৎ হইয়া দাঁত খিলাল করবেন?!’ তখন এক ধেড়ে ইঁদুর বলে বসেন, ‘শালার যাগর পাশে বহা যায় না গোন্দের গুতায়, হেগরে আবার ইজ্জদ দিমু কিহের!?’ সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল শুরু হয়ে যায়! সভায় উপস্থিত সেই হার্টথ্রব ইন্দুরি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘প্লীজ সবাই থামুন, দয়া করে মানুষদের মতো আচরণ করবেন না! মনে রাখবেন, আমরা ইঁদুর; আর ছুঁচোরা আমাদের ভাই! দুর্যোগে যদি আমরা এক না হতে পারি তাহলে কোনওদিন ইঁদুর সভ্যতা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পাবে না! নির্দয় মানুষদের আমরা আমাদের শাসনে আনতে সক্ষম হব না!’ ক্রেজ ইন্দুরির কথায় কাজ হয়, তার লাস্যময়ী মুখের ভাষণে মিটিং কক্ষে নীরবতা নামে! তখন সভাপতি বলেন, ‘তাইলে আমরা আমাদের লাইনে ফিরে আসি! আলোচ্য বিষয়ে কথাবার্তা দ্রুত শেষ করা দরকার, বেশি গেঞ্জাম হলে; এই মিটিং স্থলের উপর মানবজাতির হামলা হতে পারে!’ তখন ছুঁচোদের এক সিনিয়র নেতা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘কথা তো আপনেরাই সব কইতেছেন, আমাগোরে আর ডাকচেন ক্যালা? নিজেরা নিজেরা বিয়া বইসা কিতকিত খেলতেছেন, আমরা তো হুদাই!’ ব্যাপারটা উপস্থিত সবার গোত্রগত কোন্দল মনে করিয়ে দেয়। ফলে এই অবস্থায় গ্র্যান্ড ইন্দুর তার জুবুথুবু জবান খুলে বলেন, ‘হিসসস!’ ফলে সবাই চুপ করে যায়! কেননা গ্র্যান্ড ইন্দুর হচ্ছেন সবার মহামান্যবর! তার উপরে কেউ কথা বললে তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করে দেয়ার শাস্তি বিধান আছে। কেননা গ্র্যান্ড এর অপর নাম, পূর্ণ শান্তি! তাকে নির্বাচিত করা হয়, ইঁদুর সমাজের সবচেয়ে প্রবীণ প্রাজ্ঞ এবং (অবশ্যই) অনুগত ইঁদুরদের ভেতর থেকে। এবং তিনি সকল বিষয়ে উপস্থিত থাকার ক্ষমতা রাখেন। তবে তার জন্য নির্ধারিত একটিই মাত্র শব্দ এবং সেটা হচ্ছে, ‘হিসসস!’ অর্থাৎ তিনি ‘হিসসস’ উচ্চারণ করা মাত্রই সবাই চুপ করে যেতে বাধ্য! অর্থাৎ তিনি অসীম ক্ষমতাধর একটামাত্র শব্দের ভেতর!

এরকম অবস্থায় সভাপতি নীরবতা ভঙ্গ করে বলেন, ‘উপস্থিত ইঁদুর ও ছুঁচো সমাজের নেতানেত্রীগণ, অতিরিক্ত তর্কের সুযোগ বা সময় আমাদের হাতে নেই। কেননা আমরা জানতে পেয়েছি মানবজাতি আমাদের বিরুদ্ধে এক নিদারুণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, যদিও সর্বদাই তারা আমাদের হত্যা করার জন্য বিবিধ বিষ এবং ফাঁদ আবিষ্কার করেই চলেছে, এমনকি তারা তাদের সাহিত্যে ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’র মতো গল্প লিখে আমাদের প্রতি তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতার মূর্তি প্রকাশ করেছে! এবং তারা এতটাই অকৃতজ্ঞ এক জাতি যারা তাদের সভ্যতা বিনির্মাণে আমাদের ঋণকে এক ফোঁটাও স্বীকার করতে রাজি নয় এবং তারা এটাও মানতে রাজি নয় যে আমরা তথাকথিত যেই ক্ষতিসাধন করি তাদের শস্য এবং মালের অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আমরা যা করে থাকি যা তাদের ভাষায় ক্ষতিসাধন সেই তথাকথিত ক্ষতি যে তাদের অর্থনীতির ঘূর্ণায়মান চাকাকে ক্রমাগত ঘুল্লি দিচ্ছে সেটার ব্যাপারে তারা একবিন্দু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। এমন এক বেইমান জাতি সমগ্র প্রাণীকুলে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। তবু আমরা স্বপ্ন দেখি যেরকম স্বপ্ন দেখেছিল মানুষের আদিম ভাইয়েরা একদিন পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব প্রচণ্ড হবে। কেননা আমাদের মনে রাখতে হবে বন্ধুগণ, একদিন পৃথিবীতে ডায়নোসরের মতো প্রকাণ্ড প্রাণীদের অস্তিত্ব ছিল আজ যারা নিশ্চিহ্ন! তাই বন্ধুগণ স্বপ্নটাকে জিইয়েই রাখতে হবে আর তার জন্য প্রয়োজন চর্চা। কেননা আমরা জানি আমরা না পারলেও আমাদের সন্তানেরা দখল নেবে, তারা পৃথিবীর তখতে আসীন হবে। কেননা…’

পেছন থেকে এক ছুঁচো বলে বসে, শুধু আপনারা নন নেতা, আমাদের কথাও বলুন। এটা তো মানতেই হবে যে, আপনারা কিছুটা লুটেরা প্রবণ সম্প্রদায়। আপনারা চৌর্যবৃত্তি বা ছিনিয়ে নেবার থিওরিতে বিশ্বাসী সে ক্ষেত্রে আমরা অর্থাৎ ছুঁচো সমাজ একেবারে নিরুপদ্রব এবং সন্ন্যাস টাইপ, কেননা আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাদ্য থেকে নিজেদের অন্ন সংগ্রহ করি। কেননা আমরা জানি মানবজাতি যতটা ভোগ করে তার অনেকটাই অপচয় করে। আমরা ‘উচ্ছিষ্টে বেঁধেছি প্রাণ’ থিওরিতে বিশ্বাসী।  ফলে আমাদের ঋণ সম্ভবত মানবসভ্যতার টিকে থাকার পেছনে আপনাদের থেকেও বেশি! সঙ্গে সঙ্গে পুরো মিটিঙে যেন একটা বোমা পড়ল। ধেঁড়ে ইদুরেরা হই হই করে হল্লা শুরু করে দিল।  চিৎকার চ্যাঁচামেচি কিচ্‌ কাচ্‌ চিঁ চিঁহিঁতে পুরো কক্ষ ভরে উঠল। এক ছুঁচোনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘বাঁচাও বাঁচাও… আমার লেজ কামড় দিয়েছে আমারে লেজে কামড় দিয়েছে!’ এই আর্তস্বরে মুহূর্তে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! মিটিঙের মধ্যে কাউকে এবিউজ করার সাহস কার? ফলে তখন মহামান্যবর গ্র্যান্ড ইঁদুর আবার মুখ খুলে বললেন, ‘হিসসস’। ফলে সকলে থমথমে হতে গেল! তখন ছুঁচোদের এক দুর্ধর্ষ নেতা বলল, ‘আপনারা আপনাদের মিটিং জারি রাখুন, আমরা বিদায় নিচ্ছি! তবে এটাও জেনে রাখুন আগামীতে আপনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এবং সহায়তার দুয়ার আমরা বন্ধ করে দেব! আসলে ক্ষমতাবানেরা যে ‘ব্রাত্যজনের সখা’ হতে পারেন না সেটাই আজ আবারও প্রমাণিত হল। আজ যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হল আমাদের মতো নির্বিরোধ ব্রাত্যদের এটা আমাদের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে! আমরা আর আপনাদের সঙ্গে নেই!’ ইঁদুরদের এক নেতা বলে উঠল, ‘চলে যাবার জন্য বা আমাদের সঙ্গে জোট না বাঁধার জন্য আপনারা অন্য কোনও পথ নিতে পারতেন বন্ধুরা, কিন্তু আপনারা একেবারে ছ্যাবলামি করে ফেললেন, একজন নারীকে দিয়ে চিৎকার ঘটিয়ে বোঝালেন তার লেজে হাত বা দাঁত দেয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে! বিনা তদন্তে আপনারা চলে যেতে যাচ্ছেন অর্থাৎ ঘটনাটার ভেতর ঘাপলা আছে নিশ্চয়ই!?’ ছুঁচোদের নেতা বলল, ‘তার মানে কি আমাদের নেত্রীর লেজে আবার আপনারা হাতাহাতি করতে চাইছেন? এই সুযোগ আমরা দিচ্ছি না আমরা সভা ত্যাগ করলাম!’ ইঁদুরদের অন্য এক নেতা বলে ওঠেন, ‘যাদের গায়ে বীভৎস দুর্গন্ধ তাদের লেজ কামড়াবার মতন অত নিচুতে ইঁদুররা নামেনি!’ ছুঁচোদের এক বুদ্ধিজীবী বলে বসে, ‘শরীরে এই গন্ধ আমাদের আত্মরক্ষার বর্ম যা আপনারা ভালো করেই জানেন। কেননা এই প্রাকৃতিক অযোগ্যতার জন্যই বোধহয় আপনারা ইঁদুর মারার কলে পড়ে নিহত হন, আর বোকার মতন বিষ খেয়ে মরতে হয় আপনাদের অতিরিক্ত লোভের জন্য?’ ফলে ইদুরেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়! তখন এক চতুর ইঁদুর বলে বসে, ‘তা হতে পারে ওটা বর্ম, কিন্তু কোনও দিন শুনেছেন যে কোনও মানুষ ছুঁচো পালে? নাহ শোনেননি! কিন্তু দেখুন আমাদের বিলাতি ইন্দুরদের মানবজাতি খাঁচায় করে পোষে, খাবার দেয়, সেলফি তুলে পোস্ট করে! কিন্তু আপনাদের মতন ছুঁচোদের তারা ছুঁয়েও দেখে না!’ এই বাক্য বলামাত্র ইঁদুরদের এক বুদ্ধিজীবী ফিসফিস করে বলে ওঠে, ‘শালা গাধা নাকি? কী বলতে কী বলছে?’ ফলে ইঁদুরেরা কেউ চতুর ইঁদুরের কথায় সাড়া বা হাততালি দেয় না! ফলে ছুঁচোদের সিনিয়র লিডার তার হোঁৎকা পেট পাছা তুলতে তুলতে গ্র্যান্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাদের এই অপারগতাকে ক্ষমা করবেন যে আমরা স্বয়ং আপনার উপস্থিতিতেও মিটিঙে থাকতে পারলাম না! আমাদের যেভাবে হেয় করা হচ্ছে আপনার সামনে, আমরা দুঃখিত যে আপনার সামনে আমাদের এইসব শুনতে হচ্ছে এবং আমাদের দেখতে হচ্ছে যে আপনি নির্বাক হয়ে শুনছেন সব! এতটা নীরব থাকাটা কি বাঞ্ছনীয় মহামান্যবর? উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই! আমরা চলে যাচ্ছি, তবে বলে যাচ্ছি মাথার উপর একজন কেউ মুরুব্বী থাকতে হয়, নিরপেক্ষ একজন কেউ না থাকলে সিস্টেমটায় পচন ধরে, সংঘাত শুরু হয়! কাউকে না কাউকে মানতেই হয়।  কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনি পক্ষপাতদুষ্ট! আমরা বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি আজ থেকে আমাদের সম্প্রদায় আপনাকে এবং আপনার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে চালিত এই সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করছে! আমরা আমাদের সকল সহায়তা এবং সহাবস্থান ছিন্ন করছি আপনাদের সঙ্গে! জয় ছুঁচোর জয়!’ এই বলে ছুঁচোদের দলটি বেরিয়ে যায়! আর তখন তাদের বেরিয়ে যাওয়া পায়ের শব্দে এবং হইচইয়ে গ্র্যান্ড ইন্দুরের ঘুম ভাঙে, তিনি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন চোখে মেলে!

আচমকা ঘটে যাওয়া এরকম একটা ঘটনায় পুরো ইঁদুর সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটা অস্বস্তি নেমে আসে।  মিটিঙের এক পাস থেকে সেই নেংটি ইঁদুরটি চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘হেঁজিপেঁজির মধ্যে কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে, মূল বিষয় থেকে মিটিং বারবার বিবিধ বিষয়ে গোঁত্তা খাচ্ছে!’ ফলে সবাই নড়ে চড়ে বসেন। সভাপতি বলেন, ‘আসলে নেংটি ইঁদুর নেতাকে আমি বলব কোনও বিষয়ই হেঁজিপেঁজি না। প্রত্যেকটা বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ! আপনাকে বুঝতে হবে যে, যৌক্তিক তর্কের সুতো বেয়ে আমাদের চাঁদে পৌঁছাতে হবে!’ এক হেঁদো বোকা ইঁদুর বলে বসেন, ‘চান্দে কি আমাগোর শাখা খোলা হইছে? লাইকা নামক কুত্তা গেছিল শুনছিলাম, ইঁন্দুররাও তাইলে পৌঁছাইছে?’ তার কথায় সবাই মুখ টিপে গা দুলিয়ে হাসতে থাকে। এক ইঁদুরাধিকার নেত্রী তার সুললিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আমি নেংটি ইঁদুরের পক্ষে রায় দিচ্ছি, আসলে এই ব্যস্ত সময়ে আমরা যথারীতি একঘেয়ে এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় করছি, মিটিঙের মূল এজেন্ডা এগোচ্ছে না!’ পেছন থেকে এক বিখ্যাত ইঁদুর নেতা যিনি সাতবার ইঁদুর মারার কলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন এবং চারবার ইঁদুর মারার বিষ খেয়েও নিজেকে বাঁচাতে পেরেছেন, সেই কিংবদন্তীতুল্য নেতা তার কালো মিশমিশে চেহারার মধ্যে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘মিটিং আগাবে কী কইরে? উনাগের কথাবার্তা শুইনে তো মনে হতিছে উনারা মনুষ্য সমাজের বি টিম হয়ে খেলতি নামিছে! কিরাম জানি সব বিষয়ে পুতুপুতু লাইন!’ তখন সভাপতি বলেন, ‘না না আপনি ভুল বলছেন বন্ধু, আপনাকে প্রথমে পুরো ব্যাপারটা আপদমস্তক বুঝতে হবে। তারপর ব্যাপারটা নিয়ে আমরা একটা ডিসকোর্সে যেতে পারি, তারপর একটা সিদ্ধান্ত আসলেও আসতে পারে! তার আগে আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই আমাদের মহান সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘সংঘাত নয় সংবেদ’ অর্থাৎ আমাদের সহ্য করতে হবে। এবং গ্র্যান্ড যা রায় দেন তাই মেনে নিতে হবে! কিংবদন্তীতুল্য নেতা পাল্টা উত্তরে বলে বসেন, ‘আপনি কিন্তুক লাইন বাদ দিয়ে বলতিছেন, আপনি পুরো বাক্য কননি! সংবিধানের ‘তিন স’ নীতিতে কয়া হইছে; ‘সংঘাত নয় সংবেদ, তবে; পরিস্থিতি বিবেচনায় সংঘর্ষ!’ অর্থাৎ যুদ্ধ! এবং এইটেরে আমরা অন্তত প্রতি হরফে হরফে মাইনে চলি। আপনাগের মতো রাজধানীতে এসি অফিসি বইসে তেলমালিশ কইরে জানলার পাশে বইসে রইদ পোহায়ে বড় বড় লেকচার মারাই না! কারণ আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ‘হয় পায়ে হাটপো নাইলে ডানায় ওড়ব, ঐ বাদুরের মতো মাঝামাঝি ঝুইলে থাকা লাইনে আমি বিশ্বাসী না!’’ কিংবদন্তীতুল্য নেতার শেষ বাক্যগুলোয় পুরো মিটিংটির মাজায় একটা লাথি মেরে আউলে ফেলে দেয়। ফলে একটা সূক্ষ্ম গুঞ্জন ওঠে যা কেন্দ্রের বিপক্ষে বা প্রান্ত থেকে আসা সদস্যদের পক্ষে বা ক্ষুদ্র দলগুলোর পক্ষে যায়। ফলে স্বঘোষিত সভাপতি গ্র্যান্ড ইন্দুরের দিকে তাকান কিংবা ঘুমিয়ে পরা গ্র্যান্ড ইন্দুরের পেটে খোঁচা দিতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করেই বলেন, ‘হিসসস!’ ফলে সবাই চুপ করে যায়। নেংটি ইঁদুরটি বলে বসে, ‘বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে আমাদের ইঁদুর সমাজ বিলুপ্তির পথে আর আমরা এইখানে বসে কানে আঙুল দিয়ে চুলকাচ্ছি! আপনারা কেউ মাঠে যেতে রাজি নন, এখানে বসে দূরবীণে চোখ রাখেন! একবার চুবনি খেয়ে আসেন বুঝবেন কেমন লাগে!’ তখন সিস্টেমের খুদখাওয়া এক বুদ্ধিজীবী ইঁদুর বলে, ‘উত্তেজনা আমাদের আলোচনাকে আগাতে দেবে না, আগে আপনাদের একটা সুখবর দিতে চাই!’ পেছন থেকে বন্যাদুর্গত এলাকার এক বুড়ো ইঁদুর বলেন, ‘সুখবর টবর বাদ দেন, মিটিঙে এখন কেউ একবার বন্যাদুর্গত ইঁদুরদের ত্রাণের কথা কিন্তু কলেন না! সবাই খালি মাথার উপর দিয়ে এরোপ্লেন ছুড়তিছেন!’ সঙ্গে সঙ্গে পুরো মিটিঙে একটা ঠিক ঠিক টাইপের গুঞ্জন বয়ে যায়! তখন বুদ্ধিজীবী বলে, ‘আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি বন্ধু তার আগে সুখবরটা দেই সেটা হচ্ছে, আমরা এই দুর্যোগকে চাই! কেননা আমরা মনে করি, এই দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে আমাদের মতো মানব সমাজ বিপন্ন হয়ে পড়বে, আর আমাদের একটা বৃহৎ পরিকল্পনা আছে অনেক দিনের সেটাও খোলসা করি, আমরা চাই প্লেগের মতো মানব সভ্যতা ধ্বংসকারী আমাদের ঐতিহ্যবাহী কালজয়ী সেই ব্যাধিকে আবার মানব সভ্যতায় বিস্তার ঘটাতে! যার মধ্যে দিয়ে আমরা তাদেরকে কুপোকাত করে ফেলব!’ পেছন থেকে এক দুর্ধর্ষ নারীনেত্রী বলে বসেন, ‘এ জাতীয় মিটিঙে আসার আগে পানি একটু কম খেয়ে আসবেন! এইসব হাবিজাবি না বলে, সরাসরি বলেন বন্যার্তদের রক্ষায় কি ব্যবস্থা নেবেন? আগে জানে বাঁচেন তারপর প্লেগ নামক যুদ্ধের কথা ভাব্বেন!’ আবার মিটিঙে একটা ঠিক ঠিক টাইপের গুঞ্জন বয়ে যায়! বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘সে বিষয়ে জানাবেন আমাদের মান্যবর সভাপতি আমি শুধু জানাতে চাই আমার ‘এক ভেলা থিওরি!’ যেটা হচ্ছে এরকম যে, এই প্লাবনের মধ্যে দিয়ে মানুষ এবং ইঁদুরেরা এক ভেলায় ভেসে উঠবে এবং আমরা আরও কাছ থেকে জানতে পারব মানুষদের দুর্বলতা! হতে পারে একটা যোগসূত্র তৈরি হবে আমাদের সঙ্গে তাদের এবং তাদেরই কেউ কেউ আমাদের এই সংগ্রামকে সমর্থন করবে! আর ত্রাণ বিষয়ে আমার বক্তব্য হল, এই প্লাবনের পর ভূমিতে প্রচুর ফলন হবে, যা আগামীতে ইঁদুরদেরই ভোগ্য হবে!’ এক বুড়ি ইঁদুর বলে বসেন, ‘শালা নির্বোধ, ইঁদুরই যদি না বাঁচে ফসল কাটবে তোর বাপ?’ সঙ্গে সঙ্গে সারা মিটিঙে হই হই করে হাসির রোল পড়ে যায়। বিব্রত বুদ্ধিজীবী চুপসে যান। তখন সভাপতি বলেন, ‘ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়! বুদ্ধিজীবীর কথাটা মিথ্যে নয়! আমাদের মহাপরিকল্পনার কথা আপনাদের বোঝা উচিৎ! আপনাদের আরও বোঝা উচিৎ বৃহৎ স্বার্থের জন্যে ক্ষুদ্র মৃত্যুকে বরণ করে নেয়াটাই রাজনীতি!’ সঙ্গে সঙ্গে এক তরুণী ইন্দুরি বলে বসেন, ‘ইঁদুরের মৃত্যু একটি তুচ্ছ ব্যাপার? আমার মনে হয় আমরা পুরো ব্যাপারটাকে সঙ্কুচিত করে ফেলছি, ক্ষমতার লোভ আপনাদেরকে গ্রাস করে ফেলছে! আপনারা রাজধানীতে বসে গ্রামগুলোর লোকদের মৃত্যুকে তুচ্ছ করছেন। অথচ আমাদের সংগ্রহ করা শস্যের উপরেই আপনারা খেয়ে পড়ে হাতির মতন মোটা হচ্ছেন! আমার মনে হয় আমি আপনাদের সঙ্গে বসে ভুল করছি, এর চেয়ে ইঁদুরতাবাদীদের সঙ্গে ত্রাণ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ!’ সঙ্গে সঙ্গে সরকার পক্ষের একজন বলে বসেন, ‘গ্র্যান্ড ইন্দুরের সামনে আপনি কিন্তু গোস্তাখি করছেন, আপনার ইন্দুরত্ব বাতিল করা হতে পারে! আপনাকে বহিষ্কার করা হতে পারে দল থেকে!’ তরুণী ইন্দুরিটি বলে বসে, ‘আমি নিজেই নিজেকে বহিষ্কার ঘোষণা করছি। যারা দুর্গত ইঁদুরগণের পক্ষে নেই তাদের সঙ্গে আমি সঙ্ঘ করতে নারাজ।’ এই কথা বলেই তরুণী ইন্দুরনি বেরিয়ে যান। ফলে সেই কিংবদন্তীতুল্য ইঁদুরটি লাফিয়ে উঠে বলে, ‘ভায়েরা, আমিও এই সভা ত্যাগ করতিছি! এবং আমার সঙ্গে যারা উঠতি চান তারা আসেন। আমরা আমাগের দুর্গত ভাইগের জন্যি কাজ করব!’ সভাপতি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘থামুন, এভাবে বেরিয়ে যাওয়াটা শাস্ত্রবিরোধী, আপনারা মহামান্যবর গ্র্যান্ড ইন্দুরকে অবমাননা করছে, আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মিডিয়ার বা তথাকথিত নির্বোধদের প্রচারণায় সাড়া দিয়ে আপনারা লম্ফঝম্ফ করছেন।’ কিংবদন্তীতুল্য ইঁদুরটি বলে, ‘যেই গ্র্যান্ড ইঁন্দুর একটা মাত্র শব্দের মধ্যি আইটকে গেছে, যারে আপনারা আপনাগের পক্ষের লোক না হলি নির্বাচিত করেন না তারে মান্য করাডা বোকামি! তারচাইয়ে আমরা নতুন দল গড়ব। সামনের নির্বাচনে দেইখে নেব আপনাগের।’ বলেই তিনি বেরিয়ে যান এবং তার সঙ্গে তার অনুসারীদের একটা বড় দল। ফলে প্রায় ফাঁকা মিটিং ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে হাওয়া কুলকুল শব্দে আসা যাওয়া করছিল আর গ্র্যান্ড ইঁদুর বয়সজনিত কারণে ঘুমাচ্ছিলেন।  তখন বিমর্ষ মিটিং ঘরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। বাইরের থেকে প্রহরী ইঁদুরদের কয়েকজন হুড়মুড় করে ঢুকে বলে, ‘আপনারা এই মুহূর্তে গ্রেফতার! আপনাদের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করছি। কারও সঙ্গে অস্ত্র থাকলে সামনে নামিয়ে রাখুন। বেশি হেঁজিপেঁজি করলে সরাসরি যে যেখানে আছেন সেখানেই মারা পড়বেন!’ ফলে সভাকক্ষে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সভাসদেরা হতভম্ব হয়ে যায়। আর তখনই একটা বিশেষ শব্দ শোনা যেতে থাকে। বাইরে থেকে দুজন বিদ্রোহী ইঁদুর ব্যস্ত হয়ে এসে বলে, ‘জলদি পালান, সময় হাতে কম, বন্যার জল ঢুকে পড়েছে রাজধানীতে! মানুষদের এক গভীর ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছি আমরা। আমাদের এখানে মিটিং করাবার পেছনে তাদের ষড়যন্ত্র আছে নির্ঘাত। জলদি পালান। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তলিয়ে যাব।’

মিটিং ঘরে জুবুথুবু গ্র্যান্ড ঘুমুচ্ছেন। তিনি জানেনই না কী হতে চলেছে। মূল দল এবং বিদ্রোহী উভয় পক্ষের লোকেরা এক সঙ্গে পালাচ্ছে। দূর থেকে সেই কিংবদন্তীতুল্য ইঁদুর, সেই তরুণী ইঁদুরনি এবং নেংটি ইঁদুরটি তাকিয়ে দেখে সেই সহদৌড়! তারা হাসে। বিজয়ের হাসি! কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ওৎ পেতে থাকা একটা বিড়াল ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে! বিড়ালটা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেছে তিনজন ইঁদুরের মধ্যে কাকে ধরাশায়ী করলে কাজ হবে? ধেড়ে ইঁদুরটি সাইজে এতই বড় যেন তার সমান, ফলে সংঘর্ষ নির্ঘাত! নেংটি ইঁদুরটি সাইজে এতই ছোট যে ফসকে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি। তরুণীটি মাঝারি কিন্তু তার প্রতি ধেড়ে ইঁদুরটির একটা বিশেষ পক্ষপাত আছে! কিন্তু বিড়ালটা থামে না, এগিয়ে যেতে থাকে! ইঁদুর ধরতে না পারার দায়ে তাকে তার মনিব বের করে দিয়েছে। ক্ষুধা নিবারণ এবং দক্ষতা প্রমাণের এটাই সুযোগ! তার বুক টিমটিম করে উত্তেজনায়। বন্যার ভয়ে পালাতে থাকা ইঁদুরেরা দৌড়াতে দৌড়াতে একজন কেউ বলল, ‘বিপদের সময় দৌড় দেয়া বিষয়ে আমাদের সংবিধানে কী বলা হয়েছে নেতা?’ উত্তরে নেতা বলল, ‘আগে জান বাঁচাও পরে ধারাটা খুঁজে দেখা যাবে!’

 

২৫ আগস্ট ২০১৭