কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
তীব্র আলো। প্রচণ্ড আলো। একটা সূর্য যেন চোখের ওপর জ্বলছে। কয়েক মুহূর্ত চোখের পাতায় সূর্যের আঁচ গ্রহণ করার পর তিনি চোখ খুললেন। কিছু দেখা যায় না, সব ধোঁয়াধোঁয়া। একটা ক্ষীণ শব্দ হচ্ছে কোথাও। ঢেউয়ের শব্দ। উঠছে, ভাঙছে। অন্ধের মতো ধ্বনিতরঙ্গের উৎসের দিকে দু’পা এগিয়ে গেলেন রত্নাকর। শব্দটা এখন ফাঁকা মন্দিরের গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনির মতো শোনাচ্ছে। ঘষটে ঘষটে আরও দু’পা এগোলেন রত্নাকর পত্রনবীশ। আলোয় তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। না, ঢেউ নয়, ঘণ্টাও নয়। সহস্র পূজারীর সমবেত মন্ত্রোচ্চারণ। কান খাড়া করলেন রত্নাকর। সেভেনে সংস্কৃতে ভালো নম্বর ছিল। কিন্তু এ কী, এ যে পরিষ্কার বাংলা। আলোর নিচে তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার অনেক নিচে, সুনামির ঢেউয়ের মতো একটাই কলরোল তাঁরই উদ্দেশে উঠছে, নামছে, তাঁকে ছুঁতে চাইছে, না পেরে ভাঙছে, আবার মাথা তুলছে।
কো-ও-ও-ও-বি-ই-ই-ই… কো-ও-ও-ও-বি-ই-ই-ই… কো-ও-ও-ও-বি-ই-ই-ই…
শব্দটায় ভালো করে স্নান করবেন বলে চোখ বন্ধ করতে যাবেন রত্নাকর, এমন সময় দেখলেন সামনের দিক থেকে কে যেন আসছে, প্রায় ধেয়েই, দু’হাত সামনের দিকে বাড়ানো। আলোয় ভালো করে ঠাহর হয় না, কোনদিকে দৌড়বেন, কীসের আড়ালে লুকোবেন ভেবে পাচ্ছেন না রত্নাকর, এমন সময় লোকটা একেবারে তাঁর ঘাড়ের কাছে এসে পড়ল। টাক মাথা, ছাগলদাড়ি, এ কী! এঁকে তো চেনেন রত্নাকর, বাংলার শ্রেষ্ঠতম কবি… আর… আর… ইনি যে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন… আর… আর… এঁর দুই হাতে যে কুন্দফুলের মালা! ইনি কী করে জানলেন রত্নাকরের প্রিয় ফুলের নাম? অ্যাবাউট-এ লেখা ছিল নাকি?
বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি হাসিহাসি মুখে শুভ্র মালাখানি রত্নাকরের গলায় পরিয়ে দিলেন। সেটা করতে গিয়েই রত্নাকর কবির মাথার কাছাকাছি এসে গেলেন আর লক্ষ করলেন, কবিকে তিনি যে রকম দেখতে ভেবেছিলেন, ইনি আসলে তেমন দেখতে নন। রত্নাকর চমকালেন, আবার চমকালেনও না। ছবিতে মানুষকে আসল মানুষের মতো দেখায় না। রত্নাকরের মতো ফিট মানুষকেও মোটা দেখায়।
তাই বলে এত আলাদা? কবির সেই রাজকীয় ছাগলদাড়ি, এত মিহি? এ তো প্রায় না থাকারই মতো। আর চশমা? চশমা কোথায় গেল? এক্ষুণি তো ছিল! রত্নাকরের বিস্ফারিত চোখের সামনে বাংলার শ্রেষ্ঠ কবির চশমা খসে গেল, সর খাওয়া হুলোর মতো রাজকীয় গাল ভেঙে উপোসী পাঁঠার গাল হয়ে গেল, টাকের জায়গায় মাথাভরা কালো চুল, হাত থেকে মালা খসে গিয়ে সে জায়গায় রান্নাঘরের ন্যাতা। এদিকে মন্ত্রোচ্চারণেও ছন্দপতন ঘটেছে, সুরের মধ্যে একখানা বেসুর অসুরের মতো প্রকাণ্ড হয়ে উঠে বাকি সুরটাকে ঢেকে ফেলছে, ‘কবি’ ‘কবি’ কলরোল নিভে গিয়ে কবির মুখের বদলে অন্য একটা মুখ রত্নাকরের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলছে, ‘শুনছ? শুনছ?’
রত্নাকর চমকে চোখ খুললেন। সূর্যটা নিভে গেছে। তাঁকে ঘিরে এখন আশেপাশের ফ্ল্যাটের দেওয়াল, শ্যাওলাধরা জলের পাইপের জালের পাহারা পেরিয়ে, পশ্চিমমুখো জানালার গ্রিল গলে ঢোকা মরা সকালের আলো। উপোসী পাঁঠার মুখ রত্নাকরের মুখের সামনে থেকে সরে গেছে। এগোচ্ছে ঘরের দরজার দিকে।
‘সাড়ে আটটা বেজে গেছে।’ বেরোনোর আগে বলে গেল।
বুকের ভেতর ধড়ফড়ানিটা শান্ত হওয়া পর্যন্ত শুয়ে রইলেন রত্নাকর পত্রনবীশ। প্রতিদিন এই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। পালাবার পথ নেই। এইটুকু প্রত্যাশা করাও কি তাঁর পাপ? ‘শুনছ’ শব্দটার মধ্যে কি আরেকটু মায়া ঢেলে দেওয়া যায় না? প্রতিটি দিন এই কর্কশতার মধ্যে শুরু হলে যে তাঁর মতো সংবেদনশীল মানুষের সারাদিনটা মাটি হয় সেটা আর কতবার বললে কেউ বুঝবে, জানেন না রত্নাকর।
মুখভর্তি কোলগেটের ফেনা নিয়ে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলেন রত্নাকর পত্রনবীশ। চাপা রঙ, থ্যাবড়া নাকে একটা অদ্ভুত সেনসিটিভিটি মাখামাখি হয়ে আছে, যেটা ফ্র্যাংকলি, শেষ কবে অন্য কারও মুখে দেখেছেন, মনে করতে পারলেন না তিনি। কিন্তু এগুলোর কোনওটাই তাঁর বেস্ট অ্যাট্রিবিউট নয়। তাঁর আত্মা, তাঁর প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে তাঁর ওই চোখদুটিতে। কুলকুচি করে, মুখ তুলে আয়নার দিকে ঝুঁকে পড়লেন রত্নাকর পত্রনবীশ। অদ্ভুত। অবিশ্বাস্য। কোনও মানুষের দু’চোখে একই সঙ্গে কী করে এত প্রেম আর এত আগুন ধরা থাকে, কোনওদিনই ভেবে পান না রত্নাকর, আজও পেলেন না।
‘প্রেম আর আগুন’, ‘প্রেম আর আগুন’, শব্দবন্ধদুটো বেশ পছন্দ হল রত্নাকরের। মাথার মধ্যে ওদের নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, এমন সময় ভাতের থালা সামনে এসে নামল আর সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা শব্দ।
‘দুধের টাকা চাইতে এসেছিল সকালে।’
রত্নাকর তৈরি ছিলেন। এই সময়টাই তাঁর সারাদিনের খারাপতম সময়। এই ক’টা মুহূর্তে, ডাইনিং টেবিলের এপারে তাঁর সংবেদনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তিনি একা, আর উল্টোদিকে সংসার, দুধের টাকা, মুদির লিস্ট, কলের জলের ছ্যারছ্যার, হাঁড়ির কালি, কাজের মাসির কামাই, এমনকি খাড়া চুল আর ফোকলা দাঁত আর গোল গোল চোখ নিয়ে টোস্ট চিবোচ্ছে যে দশ বছরের বুলু, সেও। গোটা সংসার তাঁর বিপক্ষে। আর এই বিপক্ষদলের সেনাপতি হচ্ছেন ইনি, যিনি এই মুহূর্তে কথা বলছেন।
‘বলছিল, আর ওয়েট করতে পারবে না।’
কে করতে বলেছে? মনে মনে গজরালেন রত্নাকর পত্রনবীশ। হ্যাঁ, দুধের টাকার কথা হচ্ছিল বটে গত সপ্তাহ থেকেই, এক কথা একবার বলে থেমে যাওয়া সেনাপতির স্বভাব নয়, কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে একটা কবিতার ছায়াও তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিল। ননক্রিয়েটিভ লোকদের যেটা বোঝানো যায় না সেটা হচ্ছে, ইনস্পিরেশনের লেজ একবার হাত ফসকে বেরিয়ে গেলে তাকে ফেরৎ আনা শিবের বাবার কম্ম নয়। দুধের বিল এ সপ্তাহেও মেটানো যাবে কিন্তু আগের সপ্তাহের কবিতাটা এ সপ্তাহে লেখা যাবে না।
থালার দিকে নজর দিলেন রত্নাকর পত্রনবীশ। ধপধপে সাদা কুন্দফুলের পাপড়ির ঢিবির মতো ভাতের ওপর দানাদার ঘি চকচক করছে। প্রেম আর আগুনকে মাথা থেকে বারো মিনিটের জন্য সরিয়ে রেখে কাঁপা কাঁপা হাতে সেই ঘিয়ের চুড়ো স্পর্শ করলেন রত্নাকর পত্রনবীশ। আহ্। জীবনে যে ক’টা জিনিসের ক্ষেত্রে পারফেকশন তাঁর কাছে ম্যাটার করে, শুধু ম্যাটার নয়, না হলে চলে না, তার মধ্যে একটা হচ্ছে এই ভাত। দলাদলা না, চালচাল না। প্রতিটি শস্যদানা কুন্দফুলের একেকটি পাপড়ির মতো সাদা, স্বতন্ত্র এবং প্রস্ফুটিত হতে হবে। ভাত সম্পর্কে সেনসিটিভিটিটা তাঁর রক্তে। গল্প শুনেছেন রত্নাকর, তাঁর ঠাকুরদা নাকি ভাত মনের মতো না হলে থালা তুলে ছুঁড়ে ফেলতেন। নিজের চোখে দেখেছেন বাবাকে। গ্রামের বাড়ির রান্নাঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে খেতে বসতেন তিনি আর তাঁর বাবা। কতটুকু তিনি তখন, এই বুলুর মতো, তবু স্পষ্ট মনে আছে। পাশে লন্ঠন, সামনে মায়ের লালসাদা চুড়ি পরা হাত ধীরে ধীরে হাতপাখা নাড়ছে। বাবা এক দলা ভাত তুলে থালা থেকে বেশ খানিকটা ওপরে তুলে ধরেছেন, ভাত পড়ছে থালার ওপর, কুন্দফুলের পাপড়ির মতো মসৃণ ঝরে নয়, বর্ষাকালের বস্তার নুনের মতো ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে। কেউ কোনও কথা বলছে না, মায়ের হাতের পাখার গতি ধীর হয়ে এসেছে, লন্ঠনের আলোতেই বাবার কপালের দুটো শিরার দপদপানি দেখতে পাচ্ছেন দশ বছরর রত্নাকর। তাঁর গলা খটখট করছে, মায়ের কাছে জল চাইবেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
জোর করে দৃশ্যটা থেকে নিজেকে বার করে আনলেন প্রাপ্তবয়স্ক রত্নাকর। তিনি তাঁর ঠাকুরদা কিংবা বাবার মতো দানব নন, তিনি সংবেদনশীল কবি। হ্যাঁ, কুন্দফুলের পাপড়ির মতো ভাত খেতে পাওয়াটা তিনি নিজের ফান্ডামেন্টাল রাইট হিসেবে গণ্য করেন কিন্তু সে রাইট আদায় করার জন্য কোনওরকম হিংস্রতার আশ্রয় নেননি তিনি। হাতে ধরে শিখিয়েছেন। সময় লেগেছে, কিন্তু কম্প্রোমাইজ করেননি। কম হয়েছে, ভুল ধরেছেন, বেশি হয়েছে, ভুল ধরেছেন। একবারও ধৈর্য হারাননি। গ্রেট শিক্ষক হওয়ার মালমশলা তাঁর মধ্যে ছিল, এটা চিরকালই মনে হয়েছে রত্নাকরের। সেই শিক্ষকসুলভ ধৈর্য এবং লেগে থাকা অবশেষে কাজে দিয়েছে, বিয়ের বারো বছর পর অবশেষে সেনাপতি ভাত রাঁধতে শিখেছেন। কুন্দফুলের একেকটি পাপড়ির মতো একেকটি ভাত, প্রতিবার।
তবে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যে বীণা আর তারের মতো সেটা রত্নাকর জানেন। তাঁর শিক্ষা বিফলেও যেতে পারত যদি না ছাত্র সহযোগিতা করত। রত্নাকর মুখ তুলে ছাত্রের মুখের দিকে তাকালেন। ভাঙা গাল, ঘামে কপালে সেঁটে যাওয়া কুচো চুল, ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুর, নতচোখে অবিশ্বাস্য দীর্ঘ পল্লব। শুধু চিবুকের জায়গাটা, রত্নাকর ভাবলন, অন্যরকম হলে ভালো হত। তাঁর নিজের চিবুক নেই, অবশ্য দাড়িতে ঢাকা বলে চোখে পড়ে না, এদিকেসেনাপতির চিবুক যেন একটু বেশিই দৃঢ়। প্রত্যয়ী। বাকি মুখের লালিমা ওই চিবুকে এসে ঝট করে খানিকটা ম্লান হয়ে যায়। সেই প্রত্যয় অগ্রাহ্য করে নিখুঁত ভাত রান্নার পুরস্কার হিসেবে কয়েকটা ভালো ভালো কথা বলবেন বলে হাঁ করলেন রত্নাকর…
…আর অমনি ভেঁপু বাজল।
বুলুর গাড়ি এল, বুলুকে নিয়ে গেল। কাজের মাসি এল, ‘কাল আসোনি কেন’ জিজ্ঞাসা করায় ঝমঝম করে ঝগড়া করল, ঢংঢং করে গ্যাসের সিলিন্ডার এল, পিঁ পিঁ বাঁশি বাজিয়ে আগের দিনের জঞ্জাল নিয়ে গেল। এই চক্করে রত্নাকরের বিউলির ডাল আর পোস্তর মাঝখানে দু’মিনিটের গ্যাপ পড়ে গেল। শেষপাতের চাটনিটাও সবে উনুন থেকে নেমেছে, এখনও গরম। বিরক্তমুখে খাওয়া ছেড়ে উঠলেন রত্নাকর। ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরোলেন। সেনাপতি এসে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। ঘামে সারা মুখ জবজব করছে, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দুই হাতে ঢকঢকে শাঁখার খাঁজে খাঁজে মালিন্য। চোখের কোলে, না, দীর্ঘপল্লবের ছায়া নয়, ওটা কালিই।
তিনি যে রকম সেনসিটিভ, তাতে তাঁর মায়া হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু রত্নাকর নিজেকে নরম হতে অ্যালাউ করলেন না। তিনি সেনসিটিভ, বোকা নন। ক্লাস সেভেনের সংস্কৃতর নম্বরটা মনে করালেন তিনি নিজেকে। এই দৌড়োদৌড়ি, ঘামাঘামি, সম্পূর্ণ নিজের দোষে। হ্যাঁ, প্রথম ক’বছর ছিল না, কিন্তু পে কমিশনের পর এখন তাঁদের রান্নার লোক রাখার অবস্থা হয়েছে। রাখা হয়েওছিল। পরপর তিনজন। একজনও টেঁকেনি। একজনও কুন্দফুলের মতো ভাত রাঁধতে পারে না।
‘পারে না বললেই হবে? তোমাকে শিখিয়ে নিতে হবে তো?’ সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরও যখন প্রথমজন এবং দ্বিতীয়জনও কুন্দফুলের মতো ভাত রাঁধতে পারল না তখন রত্নাকর বুঝে গেলেন, সবাই তাঁর মতো বর্ন-শিক্ষক হয়ে জন্মায় না। তিননম্বর জনকে তাই তিনি নিজেই শেখাতে গিয়েছিলেন। অফিস লেট অগ্রাহ্য করে, শার্টের হাতা গুটিয়ে, গ্যাসের পাশে অ্যালার্ম ক্লক সেট করে। পরদিন থেকে মহিলা আর আসেনি।
রত্নাকর তারপর থেকে অনেকবার বলেছেন, আরেকবার চান্স নেওয়ার কথা। এই এতগুলো এজেন্সি গিজগিজ করছে চারদিকে, এরা একজনও রান্নার লোক জোগাড় করে দিতে পারবে না যে কুন্দফুলের মতো ভাত রাঁধতে পারে?
‘দরকার নেই। আমি পারব।’ সুঠাম চিবুক নেড়ে স্রেফ এটুকু বলে চুপ করে গিয়েছিল সেনাপতি। রত্নাকর আর ঘাঁটাননি।
মনের কোণে জন্ম নিতে থাকা সহানুভূতির বুদবুদটাকে টোকা মেরে ফাটিয়ে দিলেন রত্নাকর।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আরেকটা বাধা। সামনে ফোন কানে প্রতিবেশী দত্ত নামছে। রত্নাকরের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে থাকে। রত্নাকর এই লোকটিকে দেখতে পারেন না। সাধারণত তাঁর কবিতা তিনি যাকে তাঁকে শোনান না, দত্তকে দেখে বুদ্ধিশুদ্ধি আছে মনে হয়েছিল, লক্ষ্মীপুজোর দিন বাড়িতে প্রসাদ খেতে এসেছিল যখন বসিয়ে খাতা থেকে দু’কলি কবিতা শুনিয়েছিলেন। সেই থেকে রত্নাকরকে দেখেই ‘কবি’ ‘কবি’ বলে চিল্লিয়ে ডাকে। বড় চাকরি করে বলে সোসাইটির পুজোয় মারাত্মক মাতব্বরি ফলায় এদিকে প-এ র-ফলা উচ্চারণ করতে পারে না। ‘বিজয়ার শুভ লগ্নে ছোটদের পিতি, শুভেচ্ছা আর বড়দের পোণাম।’ দত্তর গলা নকল করে সেনাপতিকে কতবার যে শুনিয়েছেন রত্নাকর আর নিজেই হেসে গড়াগড়ি খেয়েছেন, মনে পড়ে তার আবার হাসি পেয়ে গেল।
স্পিড কমিয়ে বাড়িয়ে দত্তকে অ্যাভয়েড করে ওলা ডাকলেন রত্নাকর। দত্তও ওলাতেই অফিস যাবে, রত্নাকরের পাড়াতেই অফিস, দেখলেই পুল করার জন্য ডাকাডাকি করবে। রত্নাকর ওর মধ্যে নেই। তিনি নিজস্ব ওলা নেন। হ্যাঁ, খরচ বেশি পড়ে, কিন্তু একলা থাকা যায়। রত্নাকর মনে করেন তাঁর মতো সৃষ্টিশীল মানুষের অ্যাবসলিউট নেসেসারি হচ্ছে একাকীত্ব। সলিটিউড। তিনি বড়লোক বাপের ঘরে জন্মাননি কিংবা সাপোর্টিভ পার্টনারও পাওয়ার মতো কপাল করেও আসেননি যে সে সংসারের হাল ধরবে আর তিনি নিরালায় বসে সরস্বতীর সাধনায় জীবন কাটাবেন। দশটা পাঁচটা চাকরি তাঁকে করতেই হবে। সংসারের জোয়ালও ঠেলতেই হবে। এর মাঝে নিজস্ব সময় বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা এই যাতায়াতের সময়টুকু। এই সময়টুকুতে তিনি আর কারও হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে দত্তর মতো ইরিটেটিং লোকেদের, বরদাস্ত করবেন না।
ট্যাক্সিতে বসে, এসিটা জোর করে দিতে বলে পকেট থেকে স্মার্টফোনটা বার করলেন রত্নাকর। কবি হওয়ার কেরিয়ারে রত্নাকরের সবথেকে জরুরি ইনভেস্টমেন্ট। আজকাল সৃষ্টির সংজ্ঞা বদলে গেছে। একটা কবিতা লেখা যতটা ইম্পরট্যান্ট, লেখার পর সেটা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করা আরও বেশি ইম্পরট্যান্ট। জন্ম দেওয়ার পর সন্তানের প্রতি মা বাবার দায়িত্ব যেমন ফুরোয় না, একটা কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পরও তার প্রতি কবির দায় তেমনি ফুরোয় না। সে কবিতাকে লক্ষ লক্ষ অনুরাগীর কাছে পৌঁছে দেওয়া, তার প্রাপ্য প্রশংসা, হাততালি, লাইক, শেয়ার তাকে পাইয়ে দেওয়ার দায়িত্বও কবিরই।
সোশ্যাল মিডিয়ায় লগ ইন করলেন রত্নাকর। একটা অদ্ভুত জিনিস তিনি খেয়াল করেছেন, বাস্তবে একটা লোক যত নিড়বিড়েই হোক না কেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খুললেই তার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের জ্ঞান টনটনে, রসবোধ তীক্ষ্ণ, সাহিত্যসংস্কৃতির বোধ সুগভীর। রত্নাকর এমনিতে রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গ টানা আধঘণ্টার বেশি সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু এই স্মার্টফোনের দুনিয়ায় তাঁর বন্ধুসংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে গত মাসে। এদের মধ্যে গোটা সাতশো কবি, শ’দুয়েক কবি+সম্পাদক আর বাকিরা এখনও পাঠক, কবি হওয়ার জন্য হাত পাকাচ্ছে। আধপাকা সেই সব কবিতার স্যাম্পল রত্নাকরের ফোনে এসে জমে থাকে সারারাত, এই সময়টা ট্যাক্সিতে বসে রত্নাকর সে সব কবিতা পড়েন, নিজের পাঠপ্রতিক্রিয়া দেন। যে সব সম্পাদকরা তাঁর কবিতার জন্য ঝুলোঝুলি করছেন তাঁদের কবিতার নিচে দু’কলি প্রশংসা লেখেন আর বাকিদের গুরুত্ব বুঝে লাভ কিংবা লাইক। এই সব শেষ হতে হতে অফিস পৌঁছোনোর আর যে সাত মিনিট বাকি থাকে, তাতে তিনি একটি পাঁচ লাইনের মৌলিক কবিতা ভাবেন এবং পাবলিশ করেন।
সকালটা বিবিধ বিঘ্নের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছ বলেই বোধহয়, আজকের কি-ওয়ার্ড দুটো জানা থাকা সত্ত্বেও, (আগুন আর প্রেম,) সাত মিনিটে রত্নাকর পত্রনবীশ পাঁচ কেন, এক লাইনও কবিতা ভেবে বার করতে পারলেন না।
অফিসের প্রথম দু’ঘণ্টা চলে গেল, বেরোল না। এদিকে তাঁর অনুপস্থিতিতে ইনবক্সে, চ্যাটে প্রশ্ন জমতে শুরু করেছে, ‘সব ঠিক আছে তো কবি? ভালো আছেন তো কবি?’ তাঁর কবিতার জন্য পাঠকের এই অপেক্ষা রত্নাকরকে উদ্বেলিত করল, মথিত করল, এবং তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারার বেদনা তাঁকে ব্যথিত করল। কবিতার খোঁজে তিনি পর পর তিন কাপ ক্যানটিনের বিশ্রী চা খেয়ে ফেললেন, অম্বল হল, অম্বলের চোটে কাজে অন্যদিনের থেকে বেশি ভুল হল। ম্যানেজারের কাছে তিনি অন্যদিনের থেকে বেশি বকুনি খেলেন।
রত্নাকর মেজাজ খারাপ করে কয়েকটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেললেন। বেশ কয়েকটা কবিতার গ্রুপে তাঁর যাতায়াত আছে, একটা গ্রুপে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার দশ দিক নিয়ে চাপানউতোর চলছিল অনেকদিন থেকেই। রত্নাকর ঘাপটি মেরে ছিলেন, আজ নিজেকে সামলাতে পারলেন না, অপছন্দের লোকদের ‘বিজ্ঞ আঁতেল’ বলে গাল পেড়ে এলেন। কথায় কথা বাড়ল, বাংলা অনার্স পড়া এবং কবিতাকে পৈতৃক সম্পত্তি বলে মনে করা কবিরা একজোট হয়ে ‘বাংলা সাহিত্য একগাদা অশিক্ষিতের হাতে পড়ে আজ বাংলা সাহিত্যের এই দশা হয়েছে’ মর্মে হাহুতাশ করতে লাগল, কার কবিতায় কোথায় হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ-র গোলযোগ, ণত্বষত্বদোষ, ছন্দপতন, মাত্রাচ্যুতি, উদাহরণ দিয়ে দিয়ে দেখাতে লাগল। যাদের কবিতা থেকে উদাহরণ তোলা হল, তারাও চুপ করে বসে রইল না, মারমার করে এসে পড়ল। রত্নাকর এমনিতে মারামারি এড়িয়ে চলেন, কিন্তু যেহেতু ঝগড়ার শুরুটা তিনিই করেছেন, লোকে তাঁকেও ছাড়ল না, তাঁর কবিতা নিয়েও কাটাছেঁড়া শুরু হল। রত্নাকর যতক্ষণ পারলেন ফাইট দিলেন, তারপর যখন ঝগড়া চরমে পৌঁছল, এবং পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বাংলাদেশ এবং আরও দামি দামি দেশের বাংলা কবিরা শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়ে একে অপরকে নেক্সট বইমেলা বা বঙ্গমেলায় সামনে পেলে হাতের সুখ করে নেওয়ার হুমকি দিতে লাগল, তখন ভয় পেয়ে রত্নাকর লগ আউট করে ফোন বন্ধ করে বসে রইলেন।
বাড়ি ফেরার পথে সাহসে বুক বেঁধে রত্নাকর ট্যাক্সিতে বসে অ্যাকাউন্টে ঢুকলেন এবং তাঁর হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। দুশো সাতানব্বইটা নতুন মেসেজ জমা হয়েছে ইনবক্সে। রত্নাকর একবার ভাবলেন সব ডিলিট করে একবারে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অবসর নেবেন কি না, কিন্তু শেষপর্যন্ত পুরুষকার তাঁকে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে আটকাল। এক এক করে মেসেজ খুলে পড়তে লাগলেন তিনি, আর প্রতি মেসেজের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেজাজ ধাপে ধাপে ফুরফুরে হতে লাগল।
ঘটনার শুরু থেকেই দু’পক্ষের লোকেরাই বাংলার রোলমডেল কবিকে ট্যাগ করে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, রত্নাকর যে সময়টা ফোন বন্ধ করে বসে ছিলেন তিনি আসরে নেমেছেন এবং ঘোষণা করেছেন, যে বাংলা কবিতায় বানান, ছন্দ, মাত্রা, ইত্যাদি নিয়ে এতদিন ধরে যে অচলায়তন সৃষ্টি হয়েছে, সে সব চুলোর দোরে দেওয়ার সময় হয়েছে। এই অচলায়তন ভাঙার জন্য এখন একটি পুরোদস্তুর আন্দোলন চাই আর… আর… রত্নাকর পত্রনবীশের চোখ গোল, ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠল… এই আন্দোলনের পুরোধা হওয়ার যোগ্যতা যদি কারও থেকে থাকে তবে তা একমাত্র নতুন যুগের কবি রত্নাকর পত্রনবীশের। বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি রত্নাকরকে তাঁর মেসেজে আহ্বান জানিয়েছেন, এই আন্দোলনের ঋত্বিক হয়ে যা কিছু জীর্ণ তা যজ্ঞের আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার।
বাংলার শ্রেষ্ঠ কবির এই আহ্বান সাড়ে তিন হাজার বার শেয়ার হয়েছে।
শুধু এইতেই ক্ষান্ত দেননি বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি। রত্নাকরকে একটি ব্যক্তিগত মেসেজে তিনি জানিয়েছেন, তিনি বহুদিন ধরে রত্নাকরের কবিতা অনুসরণ করছেন, এবার তিনি বন্ধুতা প্রার্থনা করেন।
রত্নাকরের চোখ জলে ভরে এল, স্ক্রিনের অক্ষরগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে গেল, ট্যাক্সির ভেতরের দুর্বল এসির ঘরঘর ছাপিয়ে কোটি কোটি কণ্ঠ সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগল,
কো-ও-ও-ও-বি-ই-ই-ই… কো-ও-ও-ও-বি-ই-ই-ই… কো-ও-ও-ও-বি-ই-ই-ই…
*****
গত কয়েক ঘণ্টায় তার সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম কবিতে রূপান্তরিত হওয়াতে, কবিতা লিখে নয়, স্রেফ সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে, নিজের সংসারে তাঁর উপস্থিতিতে যে কোনওরকম তফাৎ ঘটবে সেটা আশা করেননি রত্নাকর পত্রনবীশ, কারণ সেনাপতি সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই, থাকলেও কবিতা এবং কবিতাসংক্রান্ত জগতে কোনও আগ্রহ নেই। সেটা একদিক থেকে ভালোই, মনে করেন রত্নাকর। বাইরের জগত এবং ভেতরের জগতের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট লাইন টেনে রাখাই চিরদিন প্রেফার করে এসেছেন তিনি।
বুলু খেলা থেকে টিউশন হয়ে ফিরবে, তাই বোধহয় সামনের দরজাটা খোলা। ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন রত্নাকর। টিভিতে সিরিয়াল চলছে, উল্টোদিকের চেয়ারে পা তুলে বসে চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে সেনাপতি। ঘুমের শান্তি সেনাপতির মুখের ওপর একটা মাধুর্যের চাদর জড়িয়ে দিয়েছে, সকালের ওই রণক্লান্ত চেহারার বদলে এখন টানটান করে বাঁধা চুল, জ্বলজ্বলে নিটোল টিপ, নিথর আঁখিপল্লব। এমনকি চিবুকের দৃঢ়তাও যেন অনেকটা নরম। মা মেয়ে দেখে এসে বলেছিলেন, ‘দুর্গাপ্রতিমার মতো,’ ওই মুহূর্তে ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সেই দেবীপ্রতিমাকে এক যুগ পরে নতুন করে দেখলেন রত্নাকর।
মায়া হল রত্নাকরের, ভীষণ মায়া। চব্বিশ ঘণ্টা, বারো মাস এক ছাদের তলায় একসঙ্গে থেকেও একটা মানুষ যে তাঁর বিরাটত্বকে কোনওদিন মাপতে পারবে না, এইটা উপলব্ধি করে সেনাপতির প্রতি করুণায় রত্নাকরের সংবেদনশীল হৃদয় দ্রব হয়ে এল।
বহুদিন পর সেনাপতির পায়ের কাছে গিয়ে বসলেন তিনি। দু’হাত হাতের মুঠোয় তুলে নিলেন। ঘুমের ভেতর সামান্য নড়ল সেনাপতি, হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। রত্নাকর ছাড়লেন না। অবশেষে তাঁর কাছে ধরা দেওয়া আগুন আর প্রেম নিয়ে মৌলিক পাঁচ লাইনের কবিতাখানি সোশ্যাল মিডিয়ায় না ছেপে, সেনাপতির কানে কানে উচ্চারণ করলেন।
অবশ্য এত গৌরবের মর্যাদা সেনাপতি রাখতে পারল না, চোখ খুলে তাকে দেখে চমকে এমন চেঁচিয়ে উঠল যে সিরিয়ালের কান্না ছাপিয়ে পড়শিদের কানে সে চিৎকার গিয়ে পৌঁছল।
(Katherine Mansfield-এর Mr. Reginald Peacock’s Day-এর ছায়া অবলম্বনে)