Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

তিনটি কবিতা

 

সংলাপ

তোমাকে কী বলব আজ ভোররাতে সে কথাও লিখে গেছে কেউ কোনোদিন?
আমাকে কী দেবে তুমি, দেবে কি দেবে না তাও
লেখা আছে অনাদ্য পুঁথিতে?

ভাবি– মানব না, ছুঁড়ে ফেলে দেব ফরমান
পর্দা সরিয়ে চোখে চোখ,সোজা– কে তুমি?
দেখি সুরে আঁকা মিনতি আর সুর্মায়
ত্রস্ত, মলিন, লাজে নিভু নিভু এ-ভূমি!

কী বলব তাকে, কীভাবে বলব
ভাবতে ভাবতে আকাশ আমার মাথার ভেতরে শুনশান

ভেঙে চুরমার হল মাটির ঢেলাটি
যা-কিছু কঠিন গলে জল হল, আঁজলা ছাপিয়ে গড়িয়ে গেল যে কোথায়

আমি জবুথবু বসে আছি এই হলুদ চেয়ার
সন্ধের লাল মেঘ এসে দেখে শূন্য কেদারা
তবু বসে আছি, বসে থাকা ছাড়া কি আছে আমার

কী আছে কে আছে কে কোথায় আছে বন্ধু স্বজন?
দূরে নিম গাছে কচি পাতাগুলি বাতাসে দুলছে
বাতাস কি তেতো? পুবালি হাওয়ায় ঝোড়ো গর্জন?

 

এ সব হবেই জানি তবু যে কীভাবে ভেঙে যায়
আমাদের ডিমগুলি, অলস সমুদ্র থেকে নোনা বাতাসেরা উড়ে আসে
আমাদের বিবাহবাসর থেকে সেই যে আমরা বুকে হেঁটে বেরিয়ে এলাম,
সেই যেদিন ঢাকিদের ঢাকে ঢাকে হাহা কান্না ছড়াল বাতাসে
বেজে উঠল পাড় ভাঙার বোল,
সেই যেদিন মাটি ছেড়ে জলের সুঘ্রাণ ছেড়ে কংক্রিটে ভাসলাম

সেদিনও কি পাহাড়তলির গাঁয়ে নাচ হল? যুবকেরা বাজাল মাদল?
সেদিনও সপ্তর্ষি দেখে মনে হল কাকে যেন শ্মশানঘাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে
অল্প ক’টি শোকার্ত স্বজন…

ভূমিহীন চাষিদের পাট্টা বিলি করছে আর কে যেন কোথায় হাহা হেসে উঠল নির্ভুল কৌতুকে
হেসে উঠল গোগাবুরু, কাঁসাই নদীর ঝুরো বালি।
ঝরিয়া কোলফিল্ড থেকে হোহো হাহা ছুটে আসছে বেহেড মাতাল বনমালী
আভূমি প্রণাম সেরে থুথু ফেলছে পার্টি অফিসের বারান্দায়
সেদিনও বিভ্রান্ত আমি থুথু না প্রণাম, কিংবা কেন কান্না কে কাকে কাঁদায়
কিছুটা বুঝেছি আর বাকিটা হারিয়ে গেছে না-বোঝা কথার ঘোলাজলে
পড়িনি সেদিন– দেয়ালের লেখাগুলো? দেখিনি সন্ধ্যার কাক ফিরে আসছে
রুটি-রুজি-ঠিকানা হারিয়ে? কিশোর তো গাইলেন, কত কি রয়েছে লেখা অনিশ্চিত
কাজলে কাজলে।

সেই সব হিজিবিজি সেই সব জোনাকির আলো
ক্রমে কি মান্যতা পেল? ক্রমে তার মালিন্য হারাল ?
ঘিরে রাখল চারিদিক অবিশ্বাসে সন্দেহে ঘৃণায়–
পাশের মানুষটি ঠিক অপরাধী, কেমন একটা দেখতে যেন ,
জঙ্গি-যোগ? নাকি আই এস আই

তুমিও তো বন্দি সেই কবে থেকে–- কন্যাভ্রূণ বালিকা ইস্কুল থেকে আজো
সবই তো করেছ মায় উঞ্ছবৃত্তি, বিপত্তারিণী ব্রত, সন্ধ্যার নামাজও
কী কী পেলে এ অবধি– অপবাদ অপমান ছাড়া?
এখনও দুঃস্বপ্ন দেখো– হরিণ মারার দল আগুন দিয়েছে বনে
ছোট হয়ে আসছে বৃত্ত, জহ্লাদেরা বাজায় নাকাড়া…

আমিও তো দুঃস্বপ্নের ভিতর ঢুকেছি আর বেশবাস কী যে কী মলিন
যেন এক মজা নদী– হারিয়েছে নাম বহুদিন
হারিয়েছে স্রোত, ঢেউ, ভাঙা ভাঙা আকাশের ছবি
তবু কি আশ্চর্য দেখ– আরক্ত করবী
আজও বুক জুড়ে রঙ ছড়ায়
দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে আমি তোমার প্রাচীন নামে ডাকিডাক যতদূর যায়

দেখি দীর্ঘ অন্তরায় পার হয়ে পাশ ফিরল রাই
তারপর? অনন্ত আশনাই।

 

 

না

জীবন তোলপাড় করে খুঁজে দেখি তুমি ছাড়া কিছু নেই আর
আমি নেই, তুমি নেই, কিছু নেই তোমার আমার

না মানে একটি অন্তহীন সম্ভাবনা অন্ধকারের মতো আদিম, উর্বর তোমাকে ধানক্ষেতের পাশে
দাঁড় করিয়ে রেখে সেই যে আমি চলে এসেছি, তারপর এতগুলো শতাব্দী কেটে গেছে, আমার
মনে পড়েনি তোমার কথা। তোমার কি মনে ছিল ? বাতাস ভারী করে উড়ে এসেছে
শ্যামাপোকারা, শ্মশানপথের শীতল হরিধ্বনি ছুঁয়ে গেছে তোমাকে

না মানে একটি আকুল সম্ভাবনা। অন্ধকারের মতো আদিম, উর্বর

কোথাও কোনো নদীর তীরে ঘর
বাঁধব বলে চোখে তাকাই, এ কী!
খোলা আকাশ তোমার খোলা চুলে
আছড়ে পড়ে আমার কালবোশেখি

আছড়ে পড়ে সেই মেয়েটির ভ্রূণ
যে মেয়ে আর চোখ মেলল না
সোনার দেশে সোনার নবারুণ
উঠলো, তুমি কোটি বীরাঙ্গনা।

সে তো খুব ছোট্ট ছিল, না গো?
খুদে খুদে আঙ্গুল, খুদে পা–
লজ্জা তার জন্মে, পরাজয়ে
মুখ ঢাকল, সেই তো পরমা

তাহলে জন্মেরও আগে থেকেই তুমিই নিশানায় হায়নাদের?
অথবা কথকতা বৃন্দ্যগান সে-সবই অস্ত্রের রকমফের!
এবং দলে দলে ঘোড়সওয়ার সেনা দখল নিল এই মৃত্তিকার
দখল শস্যের, শ্যামলিমার, যদিও দিকে দিকে প্রতীক্ষা:

এসো শ্যামল সুন্দরো

এসো ঝর্ণা কলমে অবিরল গীতি-পদ্য
এসো তৃষিত অন্তরে
ওগো ঘরে ঘরে যারা জন্মালে সদ্য
এসো নিভৃত বন্দরে
যারা হাল ভেঙে পাল ছিঁড়ে দিক্‌ভ্রান্ত

তবুও কাহিনি থাকে। থাকিয়া যায় এমন ভাষা এখনও শিখি নাই যাহা এই সকল কাহিনির
চিতা হইতে পারে। কাহিনি পুড়িল না মরিল না। কাহিনির মৃত্যু নাই

কাহিনির মৃত্যু নেই, জন্ম আর হাহাকার আছে
কেউটে কালাচের মতো আনাচে কানাচে
ফুঁসে উঠছে ফুলে উঠছে ঘিরে রাখছে বিক্ষত জীবন
ইতিহাস নেই আর, দিকে দিকে কাহিনির বন।

তুমিও কাহিনি তবে? একদিন সূর্যাস্তরঙিন
মৃত তুষারের গায়ে লেপ্টে ছিলে– চিদাকাশে চাঁদ
আলো ফুটবে আলো ফুটবে বলতে বলতে দিগন্তে বিলীন
যত পাখি, যত হাওয়া– যেন আমি ব্যর্থ, ভীত, ক্ষুধার্ত নিষাদ

যেন আমি কদলীর দেশে গিয়ে ভুলে গেছি পতাকার রঙ
ভুলে গেছি তোমাকেও, যে-তুমি কর্তাল আর হৃৎপিণ্ডে বাজালে কায়া সাধ
যে-তুমি আমার কাছে কায়া হয়ে এলে আর সাধনা স্বয়ং

ভুলে গেছি? এ-ই তবে ভুল?
নিজেকে নিজের চেয়ে শক্তিশালী ভেবে এই ব্রহ্মশির তুলেছি আমূল
বিঁধেছি নিজেকে, না কি নিজেরই অস্ফুট ভবিষ্যৎ–
রক্তে রক্তে চেনা হল– এই আমি, এই আমার ক্ষত।
চেনা হল দেশ, কাল, পারাপারহীন এ জীবন
জানালার কাছে এসে কতবার থেমে গেছে চেনা বা অচেনা উজ্জীবন
জানলা বন্ধ আজ, সব ক’টি পরিসর জেল–
শাহবাগ, ছত্রধর, রাজা সরখেল
সকলেই পরাজিত? সকলেই না?
বলতে চাই ভালোবাসি, বলতে চাই বনজোছনা…

 

 

কর্ণকে: কুন্তী

না হয় নই, ঋতুও থেমেছে, বাধা আছে, তাই বলে–
একটিবারও ডাকবি না মা বলে?


সব কিছুর পরও হাতে থাকে একটা জীবন, যা একটা দাবাগ্নির জন্য অপেক্ষা করছে
তোমাকে ফেরানো যাবে না জানতাম। আর হয়তো জানতাম বলেই শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে
আসা সম্ভব হল।
সব রাজনীতি সব সম্পর্কের পরও পড়ে থাকে একজন মানুষ

শুধুই মানুষ থাকবে? পাখিরা থাকবে না?
বলতে বলতে উড়ে গেল ধূসর পালকগুলি ফেলে রেখে
সেই পাখি দুটি। একজন নিহত ও অন্য জন অবরুদ্ধ শোকে।
কাহিনির পাখি ওরা– মৃত্যুর পরেও তাই অনবদ্যভাবে বেঁচে থাকে,
উড়ে যায় জন্মমৃত্যু পার হয়ে প্রবাহিত জীবনের স্রোতে
সহমরণের সেই অতিনাটকীয় দরজা দিয়ে হেঁটে এসে মিশে গেছে
                             সহজীবনের খাতে – কবে যেন আঁধারে আলোতে

 

আমিও কি নারী নই? রানি শুধু,
রানি – রাজমাতা?  
শ্রেষ্ঠা শুধু সকল দেশের? আমি বরাভয় দেব শুধু, পঞ্চমুখে অন্নের যোগান?
ত্রাণ ত্রাণ ত্রাণ শুধু দিয়ে যাব স্তনবৃন্ত থেকে অবিরাম?
উত্তর পাব না কিছু? আশা করব না?
কে চেয়েছে পূজা? আমি দেবী নই, এখনও জীবিতা।
দেবতার দ্যুতি নয়, মানুষের স্পর্শ চেয়ে, নখ দাঁত লালা ও সোহাগ চেয়ে
বুকে হেঁটে এসেছি এতটা দূর আজও ক্লান্তিহীন–
ফিরে যাব, শূন্য হাত, সুখ স্বপ্ন আকাশে বিলীন
কেউ জানবে না আজ কোন গূঢ় সঞ্চয়ের স্বাদ
জীবনে প্রথমবার–- পুত্র তোর সূর্যের আস্বাদ


কাল তোর মৃত্যু তোর রক্ত তোর শেষ আর্তনাদ
বুক পেতে নিতে হবে, জানি, আমি, গোপন জহ্লাদ
অর্জুনের মা, নাকি পঞ্চদেবতার উপাসিকা?
সংখ্যাগরিষ্ঠের পথে ভেসে যায় আমার শিবিকা

যেন আমি আজীবন স্বয়ংবর সভা থেকে বেরোতে পারিনি
যেন একটি মণিহার হাতে এই এতটা জীবন আমি পুরুষ খুঁজলাম..
সংখ্যায়, সম্পদে, শৌর্যে– যে যেখানে গরীয়ান আমি তার অঙ্কশায়িনী…

কে আমাকে ভালবাসে? হস্তিনানগরী কিংবা পাণ্ডু ও পাণ্ডব?
জানে, কাকে বলে ভালোবাসা?
চেনে এই হৃত্স্পন্দন? জননীর জঠরের ভাষা?
নারীকে কি জানে?
মানুষকে?
ধর্ম-ভাষা-বিত্তের বলয় থেকে দূরে অভিযানে
যে চলেছে নিরন্তর আনন্দে, অশোকে?
খান্ডবদাহন শেষে কোন শমীবৃক্ষ আর বাকি থাকে বলো—
অস্ত্রহীন, শঙ্কাহীন? মানুষের স্বপ্ন স্মৃতি স্বেচ্ছার দখলও
নিতে চায় ছলে বলে দর্শনে আইনে

 

আমিও বন্দিনী আজ, পরাধীন। আপন সন্তান
লোভের লাভের অঙ্কে প্রতিদিন বানাচ্ছে শ্মশান
আমার হৃদয়ভূমি। আমি নির্বিচার
নদীদের গতিপথে দেয়াল তুলেছি বার বার
জতুঘরে আশ্রিত সে ব্যাধ পরিবারটির ঘুম
আমাকে নির্মম করে তাদের পুড়িয়ে ফের
আগুন লাগাই বনে, বস্তিতে বাজারে—
বরিশাল নোয়াখালি থেকে আরও আগুনের ফুলকি, জ্বলে ট্রেন
গোধরায়, গুজরাতে… শিশুপুত্রদুটি সহ মিশনারি স্টেইন
মরে, আর কাহিনির পাখি হয়ে যায়

মৃত পাখি জীবন্ত পাখিনি
উড়ে যায় আজও তার ধূসর পালক ফেলে
নীলে নীল অনন্ত নিখিলে
ক্ষমা আর অন্তিম প্রশান্তি নিয়ে বুকে
পুত্র আয়, চলে যাই যে পথ সম্মুখে