অর্ক
সোভিয়েত ইউনিয়ন গুঁড়িয়ে গিয়েছে অনেকদিন। একের পর এক স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে উঠছে সাবেক গণচীনে। বার্লিনের পাঁচিল ভেঙে গিয়েছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের শৈত্য ঝেড়ে ফেলে আরও স্মার্ট হয়ে উঠছে একমেরু পৃথিবী। গোটা দুনিয়া জুড়ে কার্যত নেই হয়ে গিয়েছে কমিউনিস্টরা। আমেরিকা পেয়ে গিয়েছে তার নতুন দুশমন— ইসলাম। এর মধ্যেই এক লোলচর্ম বৃদ্ধ বলছেন— সমাজতন্ত্র অথবা মৃত্যু, মাঝামাঝি কিছু নেই। একবিংশ শতাব্দীর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশ শতকের প্রতিনিধি। ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো। এই শতকের ডন কিহোতে।
কাস্ত্রো যখন জন্মাচ্ছেন, তখন সবেমাত্র এক পা দু’পা করে হাঁটতে শিখেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কৃষকদের খাজনা বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছেন মধ্য ত্রিশের মাও সে তুং। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রে মধ্যগগনে গান্ধী। কাস্ত্রোর জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে যোগ দিতে মিছিল করে পার্ক সার্কাস ময়দানে আসবেন শ্রমিকেরা। সেই মিছিল আটকে দেবেন জিওসি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর ভলান্টিয়ার বাহিনীকে ব্যঙ্গ করে বলা হবে, পার্ক সার্কাসের সার্কাস। কাস্ত্রোর বেড়ে ওঠার বছরগুলো জুড়ে থাকবে বোমার দল, সূর্য সেন, স্বদেশী, অসহযোগ, ফাঁসি, আন্দামান। আসবে ১৯৪৭। ভিটেমাটি ছেড়ে, পুকুরঘাট ছেড়ে, মাটির দাওয়া আর কুয়োতলা ছেড়ে ঝুলতে ঝুলতে কাঁটাতার পেরবে বাবার বাবা আর তার বন্ধুরা। মান্টো দেখবেন মরা মেয়েমানুষের যোনিতে ঢুকছে জ্যান্ত লিঙ্গ। দেশ ভাগ হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হচ্ছে। জওহরলাল প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। গান্ধী বলছেন, হে রাম। গুলির শব্দ। বাসন ভাঙার শব্দ। কাঁচের চুড়ি ভাঙার শব্দ। আমাদের দাদু-ঠাকুর্দারা মরতে মরতে বেঁচে থাকছেন চুরমার হওয়া অতীতে। কলোনি গড়ে উঠছে। পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। দাঙ্গা। রক্ত। মৃত্যু। তার মধ্যেই আগুনের মতো ঝলমলে ২৯ জুলাই। কলকাতা শহরে এতদিন ভাড়াটিয়ার কদর ছিল বেশি। এখন আর ভাড়া মিলছে না। থাকার জায়গা নেই। বাঁচার জায়গা নেই। মাথা তুলছে কমিউনিস্ট পার্টি। ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। ইউসিআরসি। কাস্ত্রো আর তাঁর প্রাণের বন্ধু গার্সিয়া মার্কেজ তখন হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন রাফায়েল ট্রুসিলোর বিরুদ্ধে। এরপর কলম্বিয়া। হুয়ান পেরনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। কাস্ত্রো তখনও মার্কসবাদী নন, সেই সময়ের সব সৎ মানুষের মতোই কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একরোখা।
বি টি রনদিভের লাইন ভুল, ততদিনে প্রমাণিত। এরপর বাহান্ন সাল। প্রথম নির্বাচন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এল কংগ্রেস। প্রধান বিরোধী কমিউনিস্ট পার্টি। বাংলা বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। ওপার থেকে ছিটকে এল বাংলা ভাষার রক্ত। পরের বছর শিক্ষক আন্দোলন। কলকাতা তখন দুঃস্বপ্নের নগরী। বাহান্ন সালে কাস্ত্রো আক্রমন করলেন হাভানার সেনা ব্যারাক। ব্যর্থ প্রচেষ্টা। গ্রেফতারি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মেক্সিকো। ’৫৬ সাল। সঙ্গী একঝাঁক গেরিলা কমরেড। ততদিনে জীবনে জুটে গিয়েছে নতুন বন্ধু— আর্নেস্তো। নতুন করে শুরু হল গেরিলা যুদ্ধ। বাতিস্তার সরকারও পাল্টা আঘাত হানল। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ফিদেলকে খুঁজে বের করতে চলছে নিয়মিত বিমানহানা। মোট ৪১ জন সঙ্গীর মধ্যে বেঁচে রয়েছেন মাত্র ১৯ জন। হাতে গোনা ওই ক’জনই একটা গোটা আর্মি। সেনাছাউনিতে হামলা চালাচ্ছেন, জমিদারদের আক্রমণ করছেন। একের পর এক এলাকায় সাধারণ মানুষকে নিয়ে গড়ে তুলছেন মুক্তাঞ্চল। হাজারে হাজারে জনতা এসে দাঁড়াচ্ছে লম্বাটে ফিদেল আর হাঁপের রোগী চে গেভারার পাশে। দখল নেওয়া এলাকায় গড়ে উঠছে স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল। ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছেন কাস্ত্রো। প্রতিদিন নতুন নতুন ভূখণ্ডের দখল নিচ্ছেন। ১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। হাভানার রাস্তায় মুক্তিমার্চ শুরু হল। দেশ ছেড়ে পালালেন বাতিস্তা। অভিনন্দন জানাল সোভিয়েত। স্বাগত জানাল গণচীন। আমেরিকার নাকের ডগায় সমাজতন্ত্রের লাল ঝাণ্ডা তুলে দিলেন ফিদেল।
পাঁচের দশক থেকেই পার্টির মধ্যে বিতর্ক বাড়ছিল। বাষট্টি সালে চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সেই ফাটল আরও তীব্র হল। পাশাপাশি, দেশজুড়ে শুরু হল কমিউনিস্টবিরোধী গণউন্মাদনা। কলকাতায় রাস্তায় পোড়ানো হল বামপন্থী সাহিত্য। বই জ্বলছিল, সেই সঙ্গে পুড়ছিল বিশ্বাস, পুড়ছিল আস্থা। আগের বছর এপ্রিল মাসে কাস্ত্রোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বড়সড় উদ্যোগ নিল অ্যামেরিকা। সিআইএ’র জন্য বরাদ্দ হল কোটি কোটি ডলার। হাভানার কাছে বে অফ পিগসে উড়ে এল স্যাম চাচার বিমান। লাভ হল না। সোভিয়েতের সাহায্য নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন ফিদেল। গোট দশক জুড়ে তাঁকে হত্যার একের পর চক্রান্ত ব্যর্থ করলেন কিউবার জনতা। ক্রমশ বাড়ল উত্তেজনা। ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রভাব বাড়াকমার অঙ্কের হিসাব কষে হাভানায় মিসাইল বসানোর প্রস্তাব দিলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। অবশ্যম্ভাবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতীক্ষা শুরু করল গোটা দুনিয়া। একদিকে আমেরিকা, অন্যদিকে পুঁচকে কিউবার দাড়িওয়ালা বিপ্লবীরা। বহুদূর থেকে সমর্থন করছে সোভিয়েত। চোখের পলক ফেললেন না ফিদেল। মাথা নত করলেন না। অক্টোবরের ২৮ তারিখে দু’পক্ষের বোঝাপড়া হল। সেই সঙ্গে জন্ম হল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মিথের— ফিদেল কাস্ত্রো।
চৌষট্টি সালে প্রথমবার পার্টি ভাঙল। সাতষট্টিতে ক্ষমতায় এল যুক্তফ্রন্ট। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। নতুন সরকার ঘোষণা করলেন ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ চলবে না। সুবোধ ব্যানার্জির নাম হয়ে গেল ঘেরাও মন্ত্রী। কথা রাখল না সরকার। নকশালবাড়িতে গুলি চলল। বেমক্কা ফানুসের মতো আকাশে উড়ল আট দলিল। ঘৃণা করুন, চিহ্নিত করুন, ধ্বংস করুন মধ্যপন্থীদের। দেওয়ালগুলো সেজে উঠল খ্যাঁদা নাকের স্টেনসিলে। তোমায় আমায় দিচ্ছে নাড়া, মাও সে তুঙের চিন্তাধারা। চারপাশের ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিচ্ছিল সেই সময়টা। যুবকদের কাছে নীল আর্মস্ট্রংয়ের চেয়ে জরুরি হয়ে উঠছিলেন জেনারেল গিয়াপ। এরপর কাশীপুর-বরাহনগর। বারাসত, বহরমপুর জেল। নব কংগ্রেস। বাহাত্তর। জরুরি অবস্থা। কিউবার সমাজতন্ত্র ততদিনে শিকড় পৌঁছে দিয়েছে মাটির অনেকটা নীচে। খানিক থিতু হয়েছেন ফিদেল। বেশ কয়েক বছর হল চে গেভারার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখে নিয়েছে বিশ্ব।
১৯৭৬ সাল। সমাজতান্ত্রিক কিউবার প্রেসিডেন্ট হলেন ফিদেল। পরের বছর ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট। জোয়ারের জল আসে, সরে যায়। বালিতে জলের দাগ থাকে। ক্রমশ দরজা খুলতে শুরু করল সোভিয়েত। দেঙ বললেন, বেড়ালের রঙ দেখার দরকার নেই। সন্তোষ রাণা বিধায়ক হলেন। ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করল দুনিয়া। থিতু হতে শুরু করল যেন।।
আশির দশকের শেষ থেকেই ধীরে ধীরে পিছু হঠতে শুরু করল বিংশ শতাব্দী। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন সোভিয়েত-প্রধান। এক এক করে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে বাতি দেওয়ার লোক থাকল না কেউ। তারপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল আস্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন। গোটা বিশ্ব হাঁ করে দেখল ক্রেমলিনের ছাদ থেকে নামানো হচ্ছে ভূপাল পাণ্ডা, কংসারি হালদারদের লাল নিশান। কলেজ স্ট্রিটের, গোলপার্কের সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের বাজারে রাদুগা প্রকাশনীর বইয়ের ঢল। দুনিয়া বদলে যাচ্ছে, কমরেড। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের শতাব্দী চিতেয় উঠছে ধীরে ধীরে।
ফিদেল কিন্তু ছিলেন। আগের মতোই একরোখা, টানটান। কমিউনিস্ট। সোভিয়েতের পতনের পর কিউবায় শুরু হল চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকট। দলে দলে মানুষ কিউবা ছেড়ে পাড়ি দিলেন আমেরিকার দিকে। ফিদেল জানালেন, আর কাউকে আটকাবেন না তিনি। ১৯৯২ সালে দেখা দিল চরম দুর্ভিক্ষ। ভারত দশ হাজার টন খাদ্যশস্য পাঠাল কিউবায়। ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে জড়িয়ে ধরে অপ্রস্তুতে ফেলেছিলেন, ১৯৯২ সালে ভারতের সাহায্য পেয়ে আপ্লুত ফিদেল জানালেন, তাঁর দেশের প্রতিটি মানুষ অন্তত একটি রুটি খেতে পারবেন।
শতাব্দী শেষ হয়ে গেল। কথা ছিল বিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই দুনিয়া জুড়ে মানুষ গা সেঁকবেন মুক্তিসূর্যে। হয়নি। কার্যত রিঙের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছেন কমিউনিস্টরা। নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকা পেয়ে গিয়েছে তার নতুন শত্রু। ইরাকে যুদ্ধ হয়েছে, আফগানিস্তানের যুদ্ধ হয়েছে। ফিদেল দেখেছেন। ২০১১ সালে সরে দাঁড়ালেন রাজনীতি থেকে। ক্রমশ নিভে আসা অপরাহ্নে তিনি যেন তখন বিষন্ন ডন কিহোতে। রেজিনান্তে সমাজতন্ত্রের পিঠে চড়ে শতাব্দীভর ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। এবার বিশ্রাম।
হোয়াটসঅ্যাপের দুনিয়ায় ফিদেল বেশ কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন, সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রতিনিধি হয়ে। তাঁর মৃত্যুতে ওই শতাব্দীটির অবসান হয়েছে মাত্র। কারণ ‘সুন্দর আগামীকালে’র যে স্বপ্ন, তার কোনও মৃত্যু নেই। গোটা দুনিয়া জুড়ে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর ফিদেলরা। গত শতকের সঙ্গে তাদের মিল খুঁজতে যাওয়া বৃথা।