Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উবু দশ কুড়ি……

অনির্বাণ মুখার্জ্জী

 

উচ্চমাধ্যমিকের পর বেশ ল্যাদ খাচ্ছি মানে মোটামুটি বুঝে গেছি যা পরীক্ষা দিয়েছি তাতে রেজাল্ট বেরোলে ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার একটা ভালোরকম সম্ভাবনা আছে। এহেন পরিস্থিতিতে আসরে অবতীর্ণ হলেন আমার এক কাকা। এই পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন এবং কালবিলম্ব না করে আই. এস. আই. এন্ট্রান্সের একটি ফর্ম তুলে আনলেন। যথারীতি জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে বেশি সময় নিল না।
এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে আই. এস. আই. এর ফর্ম-ই কেন? সে ব্যাপারে অবশ্য আমি নিজেই কালপ্রিট। ‘দুচোক্ষের’ র বিষ বায়োলজিকে উৎখাত করতে ফোর্থ সাবজেক্ট হিসেবে স্ট্যাটিসটিক্স নিয়েছি। এদিকে আমার পাস্ট রেকর্ড আবার বাঁধিয়ে রাখার মত। ক্লাস এইট পর্যন্ত অঙ্কে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বর ৪৫। ক্লাস নাইনে ঐ একই কারণে আর দুঃসাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ঐচ্ছিক বিষয় আবার অঙ্ক। ফল হাফ ইয়ার্লিতে ৫০-এ ০!! আমার থেকেও আমার কাকার দুঃসাহসের কথা ভাবলে এখনও আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।
যাইহোক অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। শ্যামবাজারে মণীন্দ্র চন্দ্র কলেজে সিট পড়েছে। তার ভৌগলিক অবস্থান সরল করে বুঝিয়ে দিলেন সে কাকা – ‘নেতাজীর ঘোড়ার ল্যাজ যেদিকে সেই রাস্তায় খানিকটা গিয়েই দেখতে পাবি…’ পেলাম-ও। বাড়ি থেকে চারাপোনার পাতলা ঝোল আর ভাত খেয়ে প্রায় দেড়ঘন্টা আগে অকুস্থলে পৌঁছলাম। রাস্তার পাশে একটা ভাঙ্গা রোডরোলারের ওপর চড়ে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছি কলেজের গেটে। আস্তে আস্তে জনসমাগম ঘটতে লাগল। পরীক্ষার্থীদের সমাগমে আমি হংসমাঝে বক যথা!! রোডরোলার থেকে নেমে তিননম্বর বিড়িটা সবে ধরিয়েছি, একটা লালটুকটুকে গাড়ি থেকে আমার স্বপ্নেও অদেখা রাজকন্যে নামলেন। মুহুর্তের মধ্যে জাগতিক সব কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল, ভরদুপুর হয়ে গেল কুয়াশামাখা গোধুলি। নিজের অজান্তেই হাতের বিড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আমার দিকে অপাঙ্গে দৃষ্টি হেনে রাজকন্যে এগিয়ে গেলেন কলেজের গেটের দিকে। অবশ বিবশ হয়ে যাওয়া আমি আর আমার আবোদা মফস্বলি চোখের সামনে ভেসে রইল অপসৃয়মান এভিস জীন্সের একজোড়া ব্যাকপকেট।
আমাদের পাড়ার শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে অক্লেশে এঁর চাকরানী হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করে আমিও এগোলাম গেটের দিকে। ভীড় একটু পাতলা হওয়ার পর ঢুকলাম ক্লাসরুমে। নির্ধারিত বেঞ্চের সামনে এসে দেখি ঊড়িত্তারা!!! রাজকন্যে আমারই বেঞ্চে, মিস্টি হেসে আমাকে পাশে বসালেন। এভিসের ব্যাকপকেট অদৃশ্য হয়ে গেলেও হোয়াইট টপ এখন প্রবল ভাবে দৃশ্যমান, ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। এদিকে আবার অল্প অল্প বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছি যে আমার ভবিষ্যতও যথেষ্ট উজ্জ্বল হতে চলেছে। সেই বিশ্বাসে পটাপট তিনটে প্রব্লেম সল্ভ-ও করে ফেললাম। ও.এম.আর. আন্সার শিটে পুটকিও মেরে দিয়েছি… গোল বাঁধল এরপর। হঠাত দেখি… মানে শুনি বেঞ্চে ‘টকটক’ আওয়াজ। চোখ তুলতেই দেখি তিনি পেন্সিলের উল্টোদিক দিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছেন মানে বেঞ্চে আওয়াজ করে। ফিসফিস করে জিগাইলেন – ইলেভেনটা সি না ডি হবে? ঐ ফিসফিসানিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমিও ফিসফিসাতে গিয়ে দেখলাম গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। ঘড়ঘড়ে স্বরে কোনমতে বলতে পারলাম – ওটা এখনও করিনি। মুখে নিরাশার ছায়া দেখে ভীমবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম এগার নম্বরে। দেখি একটা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, জমির সমতল থেকে তার সূতোর কৌণিক মাপ ৬০ ডিগ্রী হলে বাতাসের গতিবেগ কত এই জাতীয় কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে। আরও কীসব তথ্যাদি ছিল, অতশত মাথা না ঘামিয়ে দেখলাম সি আর ডি-এর মধ্যে সি এর উত্তরটাকেই কিউট দেখতে। মাথা না তুলেই মিনমিন করে বললাম সি টাই হবে। ফিসফিসিয়ে থ্যাঙ্কস এল। আবার গায়ে কাঁটা। কুতিয়ে কাতিয়ে দেখলাম এরপর প্রশ্নের সিংহভাগই আমার কাছে হিব্রু বা ল্যাটিন আর তার উত্তরগুলো ততোধিক কদর্য দেখতে। এবার ও রাস্তা ছেড়ে উবু দশ কুড়ি গুনতে শুরু করলাম, কখনও এ থেকে শুরু করছি তো কখনও সি থেকে ক্লকওয়াইজ বা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ, যে চোর হচ্ছে তার পুটকি মেরে দিচ্ছি। এইভাবেই প্রথম ভাগ শেষ হল।
আধঘন্টা বাদে দ্বিতীয়ভাগ শুরু হবে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে এলাম। একটু কোনের দিকে এসে বিড়ি ধরানো উচিত হবে কিনা ভাবছি মানে রাজকন্যে যদি এসে পড়ে। ভাবতে ভাবতেই তার আবির্ভাব। এই কেমন হল? এবারে আর ফিসফিসানি নয় বেশ তরতাজা প্রাণবন্ত ভাবে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করে উঠল। অম্বল হল নাকি? সেই সাতসকালে দুটো গালে দিয়ে এসেছি, হতেই পারে। রাজকন্যে ঠিক বুঝতে পেরেছে, ব্যাগ থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে আমার দিকে দুটো বাড়িয়ে দিল। নিতে গিয়ে আঙ্গুলে ছুঁয়ে গেল কি আঙ্গুল? জন্তুর মত বিস্কুট চিবুচ্ছি। দেখলাম একটা চা-ওয়ালাকে ঢুকতে দিয়েছে ভিতরে। দু ভাঁড় চা নিলাম। আবার একপ্রস্থ আঙ্গুলে ছোঁয়াছুঁয়ি। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম ভাল হয়নি তবে ১০০% উত্তর করেছি। রাজকন্যে সুন্দর করে অবাক হল। (উফফ্!!!) তালে তো তোমার পাক্কা…… উবু দশ কুড়ি গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসছিল, কোঁত করে গিলে নিলাম। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মাথা নীচু। পা ছাড়া আর কিছুই দেখব না স্থির করেছি। একজোড়া ফর্সা পা, নেল এনামেল হীন অল্প নোখ সুন্দর করে কাটা তার সামনে এক জোড়া পা, বুড়ো আঙ্গুলে কালো ময়লা জমা বড় নোখ। পায়ের পাতায় লিউকোপ্লাস্ট উঠে গিয়ে আঠার দাগ শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। এবারে উবু দশ কুড়ি গলা দিয়ে বেড়িয়ে এল।
দ্বিতীয়ভাগ শুরু হল। এবারে দেখি হিব্রু বা ল্যাটিন নয়,একেবারে প্রস্তর যুগের শিলালিপি। আড়চোখে মেপে নিলাম রাজকন্যেকে। ভয়টা কমে এসেছে। দেখলাম তথৈবচ অবস্থা। চোখ পড়তেই বোকার মত হাসি। আমি চালাকের হাসি ফেরত দিলাম। এবারে ঠোঁট কামড়ে চোখ উলটে হাসি। শুরু হয়ে গেল উবু দশ কুড়ি। নেগেটিভ মার্কিং আছে কিনা ইত্যাদি প্রভৃতি সব বাস্তবিক টানাপোড়েন খড়কুটোর মত উড়ে গেল ঐ অনাবিল হাসির সামনে।
দ্বিতীয়ভাগে বোধহয় খানকুড়ি প্রশ্ন ছিল, তার মধ্যে দু তিনটেতে দাঁত ফোটাতে পেরেছিলাম। বাকি উবু দশ কুড়ি গুণতে আধঘন্টাও লাগল না। এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম আমার আর রাজকন্যের মত অনেকেই আছে। একটা গম্ভীর জ্যেঠু টাইপের ছেলে নিবিষ্টমনে আঁক কষে যাচ্ছে। ততক্ষণে তার কপালের চন্দনের ফোঁটা থেকে চাল নাকে নেমে এসেছে। এদের মত ছেলেরা যে দেশের ভবিষ্যত হতে চলেছে সেই ভেবে খানিক মূহ্যমাণ হয়ে রইলাম। মরুক গে যাক। ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে খাতায় মনোনিবেশ করলাম। এবারেও ১০০% উত্তর হয়ে গেছে। উঠে চলে যাব কিনা ভাবছি কিন্তু পিছুটান যে পাশে রয়েই গেছে.

ভয়টা অনেক কমে এসেছে। এবারে সরাসরি তাকালাম বাঁ পাশে। হাইবেঞ্চে কনুইয়ে ভর রেখে বাঁ হাতের চেটোতে থুতনি রাখায় মুখের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। বলদের মত চেয়ে আছি। বুঝতে পেরেছে বোধহয়। মেয়েরা বোঝে। ঐ অবস্থাতেই চোখ উচিয়ে তাকাল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নেড়ে মুখ সরিয়ে নিয়েছি কিন্তু মুচকি হাসিটা চোখ এড়ায় নি। বেগুনি আমি স্থানু। প্রাণপণে ক্যালকুলাসের একটা প্রবলেমের দিকে তাকিয়ে আছি। মিনিট দুয়েক ঐ অবস্থায় থেকে ঘাড় কটকট করতে শুরু করেছে। বিরক্তি কেটে এবার নিজের ওপর রাগ হতে শুরু করল। দুত্তেরি। দুম করে উঠে দাঁড়ালাম। খাতা জমা দিয়ে কোনোদিকে আর না তাকিয়ে সোজা ক্লাসরুমের বাইরে। বেজায় পেচ্ছাপ পেয়েছে। টয়লেটে গিয়ে হালকা হয়ে একটা বিড়ি ধরালাম। পরপর চার পাঁচ টান মেরে বিড়িটা পায়ে পিষে নেভালাম। রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ হচ্ছে। কিন্তু কেন সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। হনহন করে সিঁড়ির দিকে এগোলাম। ল্যান্ডিং-এ নেমে বাঁক খেতেই নীচের খোলা চত্তরের দিকে নজর গেল। কোমরের নীচের থেকে এভিস জিন্সে ঢাকা দুটো পা একজায়গায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক পাক খাচ্ছে। আমি পলকে স্থানু। এবার টের পেলাম বুকে হাতুড়ি পিটছে। এক পা দু পা করে নেমে এলাম। নীচে কেউ নেই। মেনগেট বন্ধ। দাড়োয়ানটাও গেটের সামনে নেই। খোলা চত্তরে এসে আমার সামনে রাজকন্যে পিছন ফিরে। আমি এক পা এগোতেই অ্যাবাউট টার্ন। আবার মুখোমুখি। এবারের মধ্যের দূরত্বটা অনেক কম মনে হল। সহজ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ‘…বেড়িয়ে এলে?’ খ্যাক করে আমার আমি বেড়িয়ে এল ‘…তো কী করব আর?’ মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে দাড়োয়ানটাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। মুখ নীচু করে নিয়েছে টের পেলাম। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। ‘…এ-মা কেন?’ হাসির সুরটা কেমন মেকি মনে হল। সপাটে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালাম, কী জবাব দেব? বেশ করেছি চেপে গিয়ে দাঁত চিপে বললাম ‘…কি কেন?’ উত্তরের প্রত্যাশা না করেই দ্বিতীয় খ্যাক ‘ … তা তুমি বেড়োলে কেন?’ সোজা চোখে চোখ রেখে গম্ভীরভাবে ‘…আমার উবু দশ কুড়ি শেষ হয়ে গেল…তাই…সিম্পল’ বলেই সজোরে হাসি।
একেই এসব পরিস্থিতি জীবনে সামনা করতে হয়নি মানে তেমন সুযোগই হয়নি। তার উপর আবার টপ, জিন্সের সামনে আমার মফস্বলি মনন, চেতনা কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। রাতে বিছানায় শুয়ে ভেবে দেখেছি আমার রাগ হওয়ার একমাত্র কারন এটাই। আমি নৈহাটি না হয়ে দক্ষিন কোলকাতা বা মছলন্দপুর হলেও আমার এই দশা হয় না। যাইহোক সমাজতত্বের এমন সাইকোলজিকাল অ্যাঙ্গেল খুঁজে বের করা আমি ছাড়া বোধহয় আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
এখন কি করি? মুখের দিকে তাকালে রাগটা আবার কমে আসছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আড্ডা মারতে যাব, সকালের এই ভাবনাটাও ফিকে হয়ে আসছে। ধুরশালা!! কি ছাইপাঁশ ভাবছি। আরে আবার নাম জানতে চাওয়ার ইচ্ছেটা কোথা থেকে উদয় হল? ভাবতে ভাবতেই ‘… কি হল? কি ভাবছ? আরে যা হওয়ার হয়েছে। ছাড়। নাম কি তোমার? কোথায় থাক?’ চমকে উঠলাম ‘…না মানে ইয়ে অ…অনির্বাণ’ কোথায় থাকি বলার আগেই ‘…আমি…… । জান আমার না ইংলিশ অনার্স নেওয়ার ইচ্ছে কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। দূর ভাল্লাগে না।’ আমি মনে মনে ‘…ন্যাকা!! ইংরেজি পড়বে তো এইচ এসে সায়েন্স নেওয়া কেন বাপ’ আরও কতকিছু… অনর্গল বলেই চলেছে, আদ্দেক কানে ঢুকছে। মরমে মরে যাচ্ছি, শালা সকালে পেছন থেকে এভিস দেখেছি। পরে সামনে থেকে টপ… মানে ‘সব পুরুষ-ই যেমন হয়, আমি-ও আলাদা নয়’ টাইপ আর কি!! জন্তুটার অবয়ব কেমন যেন আস্তে আস্তে মানুষের মত হয়ে যাচ্ছে… পাশাপাশি হাঁটছি, পাঁচমাথা ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এসেছি, কোনদিকে খেয়াল নেই। চটক ভাঙ্গল ‘এবার আসি… বাস ধরব’ তে। রোদ্দুর পরে এসেছে। বাস এল। উঠে পড়ল রাজকন্যে… না না ‘……’। আমিও উঠতেই পারতাম। বাসটা শিয়ালদা হয়েই যায়। বিধাতা অলক্ষ্যে মুচকি হাসলেন।

এর পরের দৃশ্য বছর সাতেক বাদে। বিলাসপুর স্টেশনে আমেদাবাদ এক্সপ্রেস ঢুকেছে। নন এসি ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে আমেদাবাদ থেকে আমি আর সুরাট থেকে এক গুজ্জুভাই। ট্রলিব্যাগ আর একটা ডাফেল ব্যাগ নিয়ে কুলি, পিছনে…………।
পার্স থেকে টাকা বের করে কুলিকে মেটানোর মধ্যেই ভালভাবে জরিপ করে নিলাম। হ্যাঁ তিনিই। সাত বছরে পরিবর্তনের কোন চিহ্নই নেই, কিশোরী থেকে তরুণী ছাড়া। গুজ্জুভায়ের বার্থ ছিল আমার উপরে, সামনের দুটো বার্থই খালি দেখে তিনি নীচেরটিতে শয্যা নিয়েছেন। চনমনে বেলা হয়ে যাওয়াতেও তার নিদ্রা ভাঙ্গার কোন লক্ষনই নেই। অগত্যা মধুসূদন। ‘… মে আই?’ ‘…শিওর’। তখনও খেয়াল করেন নি, অবশ্য খেয়াল করলেও চিনতে পারার কথা নয়। কারণ নাকের নীচে পুরুষ্টু গোঁফ। কলেবরের যথেষ্ট বৃদ্ধি। সর্বোপরি একটা আলগা পালিশ লেগেছে চেহারায়। কেলানে-কেষ্ট ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে। যাইহোক।
গুছিয়ে বসে হাতব্যাগ থেকে একটা পেপারব্যাক বের করে তাতে মনোনিবেশ করেছেন। আমি পা তুলে বাবু হয়ে জানালার দিকে চেপে বসে আছি। ব্যাকরেস্ট টা নামানো থাকায় বেশ চওড়া সিট। খানিকবাদে তিনিও জুতো ছেড়ে পা উঠিয়ে বসলেন। আমিও নির্বাক। এইভাবে আরও কিছুক্ষণ কাটল। এবারে একটু সন্দেহ মাথাচাড়া দিচ্ছে। তিনিই তো?? এতটা ভুল হবে আমার?? নাঃ, এতগুলো বছর……… যাক গে। নামটা বেশ জোরে উচ্চারণ করলাম। জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়ে নয় আবার ডাকার মত করেও নয়। স্রেফ উচ্চারণ। সঙ্গে সঙ্গেই মুখটা জানালার দিকে ইচ্ছে করেই ফিরিয়ে নিয়েছি। সিটে একটা নড়াচড়া টের পেলাম। ট্রেনের আওয়াজ ছাড়া অখন্ড নিস্তব্ধতা ক্যূপ জুড়ে। এক একটা সেকেন্ড এক যুগের সমান মনে হচ্ছে। এবারে মুখ ফিরিয়ে সরাসরি তাকালাম চোখের দিকে। তর্জনীর মধ্যে বইটা বন্ধ অবস্থায় বুকের কাছে ধরা। শুধু মুখ নয়, গোটা শরীর টা ঘুরে গেছে আমার দিকে। চোখের তারা থেকে মুখের প্রত্যেকটা রেখা খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে। বোজা ঠোঁট দুটো খুলে আসছে…… ‘অনির্বাআআআআআণ!!!!!!!’
আমিই চমকে গেছি। ঐ চিৎকারে গুজ্জুভাই মাথাটা তুলে হাঁ করে জুলজুল করে চেয়ে আছে আমার দিকে। চোখের ঈশারায় ‘…নাও ঠ্যালা সামলাও’ গোছের বলে দিলাম। পেটের ভিতর থেকে হাসি বুড়বুড়ি পাকিয়ে উঠে আসছে। না গুজ্জুভায়ের এক্সপ্রেশানে নয়…কেন কে জানে ভীষন হাসি পাচ্ছে… একটা অদ্ভূত আনন্দ থেকে, অনেকদিন বাদে চেনা কারোকে দেখতে পেলে যেমন হয় তেমনটা নয় স্রেফ আমার নামটা কেউ মনে রেখেছে সাতবছর বাদেও। পরিস্কার কাটাকাটা উচ্চারণে চিৎকার করছে আমার নাম ধরে।
‘…… স্যরি আঙ্কেল!! আপ সো যাইয়ে’। আঙ্কেল বিড়বিড় করতে করতে ওপাশ ফিরলেন। আমরা মুখোমুখি হলাম। আনন্দ, অবিশ্বাস, হাসি, অভিমান সব একসঙ্গে খেলা করে চলেছে ওর মুখের মধ্যে। কেউই কোন কথা বলতে পারছি না। কথা বলতে গেলেই দুজনেই একসাথে বলে উঠছি, ফলে একটা আওয়াজ ছাড়া কিছুই বেরোচ্ছে না। এরকম বার দুয়েক হল। হেসে ফেলেছি দুজনেই। এবারেও আমার শুরু করা হল না। উলটোদিক থেকে ‘……তারপর’। আমি ততদিনে শ্রাগ করতে শিখে গেছি। খুঁটিয়ে দেখছে আমায় ‘……অনেক পালটে গেছ’। নিজে কিন্তু আগের মতই…অবিশ্রাম গতিতে মুখ চলছে, চোখের উপর ঝামরে পরা চুল সরাচ্ছে, আলগা হওয়া হেয়ার ব্যান্ড শক্ত করে বাঁধছে। আমি বেশিরভাগ সময়েই শ্রোতা। এর মাঝে আঙ্কেল কখন উঠে ফ্রেস হয়ে এসেছেন। চা-ওয়ালা ধরে এনেছেন। তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়েছেন আমাদের তুমুল আপত্তি স্বত্তেও। বেটা-ফেটা বলে আমাদের ম্যানেজ করেছেন।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর পেরিয়ে গেছে। রবার্ট লুডলুম ব্যাগে ঢুকে পরোটা বের করেছেন। ‘…… আমি করে এনেছি, খেয়ে দেখ’। ঢাকনায় রেখে এগিয়ে দিল। ঘিয়ের গন্ধ পেলাম। নিঁখুত তিনকোনা পরোটা, গোলাকার চাপাটি নয়। সব গোছগাছ করে আবার স্বমহিমায়। বেশিরভাগই কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত। এর মধ্যে সিগারেট ফুঁকতে টয়লেট গেছি ফিরে এসে দেখি জানালার দিকে সরে বসেছে, বাইরে দৃষ্টি। সূর্য ডুবছে। আমি ক্যূপের দরজায়। তাকিয়ে আছি। বাঁকানের নীচে গালে কালো তিল। ভ্রুতে ছোট কাটার দাগ। এসব টুকিটাকি এতক্ষনে মুখস্থ। তাও দেখছি। পা মুড়িয়ে কাত হয়ে বসে। একটা হাত গালে। অন্যটা কোলের ওপর। আঙ্কেল পিছনে এসে কি একটা বললেন। কখন বাইরে গেছিলেন। অন্য কূপে বিরাদর খুঁজে পেয়েছেন। আঙ্কেলের গলায় এদিকে ফিরল। আমি ভিতরে ঢুকে এলাম। আঙ্কেল কি একটা নিয়ে আবার বেড়িয়ে গেলেন। ‘……সরে এসো, বসব’। ‘…..কেন ওখানে বস’। ‘……না ওখানেই বসব’। ‘……অদ্ভূত জেদ’। দুম করে বলে বসলাম ‘……ওখানে বসলে তুমি জানালা দিয়ে বাইরেই চেয়ে থাকবে, তোমায় দেখতে পাব না’ হাসতে গিয়েও মাথা নামিয়ে নিল…… গাল অস্তরাগে রাঙ্গা। নিঃশব্দে মাথা নীচু করে ক্যূপের বাইরে বেড়িয়ে গেল।
আমার বুকে সহস্র ঢাকী। জানালার ধারের জায়গা ছেড়ে দিয়ে এপাশেই বসেছি। কারোকে এভাবে কোনদিন বলিনি। হাত ঘামছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। ক্যুপের আলোটা জ্বলে উঠল। চলে এসেছে। মুখে জলের বিন্দু। ভিজে কপালে চুল লেপ্টে আছে। ব্যাগ থেকে ছোট তোয়ালে বের করে মুখ মুছছে চেপে চেপে। নিশ্চুপ। আমি অপরাধীর মত বসে আছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মুখ মুছে কি একটা ব্যাগ থেকে বের করে গালে মাখল। আবার সে-সব গুছিয়ে রেখে আমার সামনে এসে খানিকক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে করে আমার চুলটা ঘেঁটে দিয়ে ‘……পাগল একটা’। কি হল আমার, আমি খপ করে ওর দুটো হাত চেপে ধরলাম। মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। হাতের চাপটা বেড়ে যাচ্ছে। অস্ফূটে বলল ‘……আমার লাগছে’। হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নি। আমি চমকে হাতদুটো ছেড়ে দিলাম। স্পষ্ট দেখলাম লাল হয়ে গেছে জায়গাটা।
সরে গিয়ে জানালার কাছে বসে পড়ল। অপরাধীর মত বসে আছি। সাত বছর আগের সেই পুরোন রাগটা ফেরৎ আসছে। ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাকপ্যাক থেকে লিমকার বোতলটা টেনে বের করলাম। অর্দ্ধেক মত পড়ে আছে। ‘…… আমাকে একটু দাও না’। বোতলটা পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে দুমদুম করে বেড়িয়ে গেলাম ক্যূপ থেকে। বাইরের দরজার খোলা, এক উর্দিধারী উদাস হয়ে খৈনি ডলছে। পাশ কাটিয়ে দরজার মুখের হাতলদুটো ধরে দাঁড়ালাম। অন্ধকার চিরে ট্রেন ছুটে চলেছে। হাওয়ায় মাথার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যত চাইছি হাতের স্পর্শটাও উড়ে চলে যাক হাওয়ার সাথে, তত যেন চেপে বসছে নার্ভের গভীরে। ‘…… আপকো বুলা রহি হে’ পিঠে টোকা আমার। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি ‘…… অ্যাই… কি এটা?…… কী বিচ্ছিরি খেতে!!!’ বেড়িয়ে এসেছে। একহাতে লিমকার খোলা বোতল, অন্যহাতে ছিপি। মাঁড় গারিয়েছে!!! সম্ভাব্য নানাবিধ বিপদের কথা দ্রুত চিন্তা করে হাতটা ধরে প্রায় টানতে টানতে ক্যূপে ঢুকিয়েছি। উল্টোদিক থেকে আঙ্কেল আসছিলেন। কি ভেবে আবার ফিরে গেলেন। ক্যুপে ঢুকে শাটার টা টেনে দিয়েই ঝাঁজিয়ে উঠলাম ‘……গাড়ল জানোনা এটা কি?’ হাতটা ঝাঁকিয়ে ছাড়িয়ে নিল ‘……এমন করছ কেন তুমি?’
অনেকটা সময় কেটে গেছে। সেই যে থমথমে মুখে জানালার ধারে গিয়ে বসেছে, একবারের জন্যও মুখ ফেরায়নি। এইরকম পরিস্থিতিও একদম আমার অচেনা। আমিও মাথার পিছনে দুহাত রেখে পিছনে ঠেস দিয়ে শিবনেত্তর হয়ে বসে আছি। আঙ্কেল আবার ফিরে এসেছেন। দুপুরের আবহাওয়ার সাথে এখন কিছুই মেলাতে পারছেন না। চুপ করে আমাদের দুজনকে বার কয়েক মেপে নিলেন। ব্যাগ থেকে দু তিনটে বড়, মেজ, সেজ ডিব্বা বের করেছেন। ইতস্তত করছেন। ‘……আপলোগ কুছ খাওগে নেহী বেটে?’ ওপ্রান্ত থেকে কোন উত্তর এল না। আমি হাসির নামে মুখ ভেংচে মাথা ঝাঁকালাম, যার উত্তর হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে। ডিব্বা হাতে গুটিগুটি তিনি বাইরের দিকে পা বাড়ালেন।
বুঝতে পারলাম রাতে কপালে হরিমটর ছাড়া কিছুই লেখা নেই। যদিও আমার ব্যাগে কেক, চিপস জাতীয় কিছু আছে। কিন্তু সেসব বের করার সাহস বুকের দুরূহ কোনেও স্থান দিতে পারছিনা। ঘড়ির কাঁটা এগারটা ছাড়িয়ে গেছে। আঙ্কেলও ফিরে এসে শোওয়ার তোরজোড় শুরু করেছেন। ওপ্রান্ত এখনও রদাঁর- দ্য থিঙ্কার। আরও খানিকক্ষন ওভাবেই কাটালাম। আঙ্কেলের চোখের ওপরে হাত দেখে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ থেকে বেডশিট আর এয়ারপিলোটা বের করলাম। চাদরটা আপার বার্থে রেখে পিলোটা ফোলাচ্ছি, এমন সময় তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ডাফেল ব্যাগটা ওপরে তুলে আমার চাদরটা সজোরে লোয়ার বার্থে ছুঁড়ে ফেলে হাতব্যাগটা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন। মাথাফাথা চুলকে আমিও চটপট শবাসনে। দরজার শাটার টানার আওয়াজে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। হঠাৎ ঝড়াস করে মাথার নীচের এয়ারপিলোটা সরে গেল আর আলোটা নিভে গেল। মাথার নীচে হাতই সম্বল করতে হল। ট্রেনের চাকার আওয়াজ আর আঙ্কেলের হালকা নাসিকাগর্জনের মধ্যে কখন চোখটা লেগে এসেছে। শীত শীত করছে। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারলাম বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলাম। গুটিসুটি মেরে পাশ ফিরলাম। ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারলাম একটা ছায়ামূর্ত্তি আমার গায়ে চাদর টেনে দিচ্ছে।
জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা থেমে যাওয়াতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কোথায় একটা মাঠঘাটের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। ভোর হচ্ছে। পাশ ফিরে দেখলাম আঙ্কেলের বার্থ খালি। রৌরকেল্লা না টাটানগর কোথায় যেন নামার কথা ছিল। তার মানে প্রায় চলে এসেছি। উঠে পড়লাম। উপরে তাকালাম। ঘুমন্ত দুটোহাতের ভিতর বুকের মাঝে আমার এয়ারপিলো।
খড়গপুর ছাড়িয়ে গেছে। বার্থসাইড টেবিলে রেখে দেওয়া ভাঁড়ে চা আর সেই সাত বছর আগের একই ব্র্যান্ডের বিস্কুট অনেকক্ষন শেষ হয়ে গেছে। বার্থের নীচ থেকে জুতোটা বের করছি, এমন সময়ে উলটো দিকের বার্থ থেকে দীর্ঘ নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে ‘…… অনির্বাণ তোমায় একটা কথা বলা হয়নি, আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়েই পড়েছি, বাবা শেষপর্যন্ত মেনে নিয়েছিল। মাস্টার্সটা যদিও করা হয়ে ওঠেনি। তোমার মনে আছে অনির্বাণ তুমি সেই একজ্যামের ব্রেকে আমায় চা খাইয়েছিলে, খুচরো পয়সা মেটাতে গিয়ে তোমার ট্রেনের টিকিটটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। আমি তুলে দিয়েছিলাম। নৈহাটী-শিয়ালদার একটা রিটার্ন টিকিট। এটা তোমার মনে থাকার কথা নয়। ফেরার সময় আমি ইচ্ছা করেই গল্প করতে করতে একটা স্টপেজ এগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বাস আসতে আমি হঠাত করে উঠে গিয়েছিলাম। ঐ বাসটা শিয়ালদা হয়েই যায়। দেখতে চাইছিলাম তুমি ওঠ কিনা, কিন্তু না তুমি ওঠ নি। মনে হয়েছিল তোমার ঐ চত্তরটা হয়ত ততোটা চেনা নয়। আমি সেদিনই দুটো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। বাড়ি এসে বাবাকে সব বলেছিলাম, তোমার কথা, তোমার উবু দশ কুড়ি গোনার কথা। বাবা সব শুনে আমার একটা সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল আর একটা সিদ্ধান্তে তোমার উবু দশ কুড়ি খেলেছিল’।
ট্রেন হাওড়া প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। করিডোরের দিকে প্ল্যাটফর্ম। উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার সামনে এসে আমার মাথার পিছনের চুলের মুঠি ধরে আমার ঠোঁটে…………। খানিক বাদে ছেড়ে দিয়ে আমার চোখে চোখ। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে। চোখ দুটো লাল। হাঁফাতে হাঁফাতে ‘…… তোমাদের স্কুলের ফিজিক্সের বি.এন. আমার বন্ধুর কাকা, আর কি করে জানব বল উবু দশ কুড়ি গোনা, বাবা অনির্বাণ থেকে না শুরু করে শমিত থেকে শুরু করবে?’
(শেষ)