কাজল সেনগুপ্ত
গত হপ্তা তিনেক ধরে, কাজকম্মের মধ্যে, অন্তত যেটুকুও ভান করি কাজের, তার মধ্যে মধ্যেই চমকে উঠছি।
টিনের তলোয়ারের শুরুতে, ‘ছেড়ে কলকাতা’ গানটা শেষ হওয়ার পরে, ওই যে প্রায়-আর্তনাদ, ‘এডিটর’ ‘এডিটর’, বলে, থেকেই থেকেই আমি মাথার মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপরেই, বোধহয় সত্য বন্দোপাধ্যায়ের অমোঘ ডায়ালগ, ‘প্রেতাত্মার পার্ট তাহলে কে করছে?’- ‘…জানি, ও পার্ট আমার’ — এটা কেমন মনে হচ্ছিল আমার জন্যই বরাদ্দ।
আপনাদের যাদের পিছনে, লেখার সুপারি নিয়ে, সোমেন লেগেছে, তাঁরা বোধহয় এই অভিজ্ঞতা টের পেয়েছেন। সোমেন এখনও যাঁদের পিছনে লাগেননি, তাঁদের জন্য, শুভেচ্ছা।
দোষের মধ্যে, কয়েক বছর ধরে, আমরা একটা কাজ করার চেষ্টা করছি। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে। বেশ কয়েক বছর ধরেই লেগে আছি। স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেলিং আর সোশ্যাল সায়েন্স-এর প্রায়োগিক ক্ষেত্র হিসেবে, কয়েকজন মিলে ঠিক করেছিলাম, পলিসি রিসার্চ-এ স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেলিং-এর প্রায়োগিক সম্ভাবনাটা পরখ করে দেখব। প্রথম বিশ্বে, একটা গালভরা নাম আছে এভিডেন্স বেস্ড পলিসি রিসার্চ। এই পোস্টকলোনির অ্যাকাডেমিয়া কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগ সময়েই, ফুটনোট লেখে। বেশ কিছু বছর আগে, আমরা ঠিক করেছিলাম, ফুটনোট নয়, আস্ত পরিচ্ছেদই লিখব। বেশ একটা ইকোসিস্টেম ম্যানেজমেন্ট মডেল তৈরি হবে। কিছু বাহবা কুড়োব।
কিন্তু ‘আমরা ক-জনা’ বলে রিসার্চ করার রেওয়াজ নেই। তাহলে? আমাদের মধ্যে যারা কর্পোরেটে কাজ করতেন, যাঁরা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁদের ছাড়াও আর একদল ছিলেন। যাঁরা এনজিওতে কাজ করে পয়সা পাননি, রিসার্চ গ্রান্টের টাকায় ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হতে দেখেছেন। তাই এনজিও করা যাবে না। আমরা নিজেদেরকে একটা নাম দিলাম, ‘কমন্স রিসার্চ কালেক্টিভ’, মূলত কমন্স প্রপার্টি বা পাবলিক গুডস নিয়ে আমাদের কাজ, এরকম একটা ভাবনা মাথায় রেখে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল রিসার্চ কালেক্টিভ ব্যাপারটা খায় না মাথায় দ্যায়, সেটাই বেশিরভাগ মানুষ, মূলত সরকারি আধিকারিকেরা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই থুতু গিলে, একটা সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন করতে হল। কলকাতা কমন্স সেন্টার ফর ইন্টারডিসিপ্লিনারি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালেটিক্স, সংক্ষেপে সিরা (CIRA), কেউ কেউ অবশ্য কলকাতা কমন্স নামটা বেশি পছন্দ করলেন। রেজিস্ট্রেশন তো হল, কিন্তু সঙ্গে ঠিক হল, যতদিন নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটা একটা ঠিকঠাক জায়গায় না পৌঁছচ্ছে, ততদিন কোনওরকম ফান্ডিং নেওয়া হবে না। গাঁটের কড়ি খরচ করেই গোটা কাজটা করা হবে, আমাদের সকলেরই ততদিনে কমবেশি ফান্ডিং নির্ভর রিসার্চে কত বড় অশ্বডিম্ব প্রসব হতে পারে সেসম্পর্কে একটা আইডিয়া তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের এক শুভানুধ্যায়ী বলে দিয়েছিলেন, ইকো-ঠিকো যা করার গ্রামের দিকেই করুন, কর্পোরেশন এরিয়াতে এসব নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। পঞ্চায়েত এলাকায় ইকো বলেও মার খেয়ে বেঁচে যেতে পারেন, কর্পোরেশন এলাকায় বেঘোরে মারা পড়বেন। সে পরামর্শ আমরা তখন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছি। এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের আগেই অবশ্য জলাভূমি অঞ্চলের সাতটি পঞ্চায়েতে আমাদের যাতায়াত শুরু হয়েছে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে, পঞ্চায়েতের সদস্য, প্রধান, কখনও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের সঙ্গেও কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা চলছে।
তবে এবার যেহেতু আমাদের একটা গালভরা নাম হয়েছে, এবং একটা আইনি সীলমোহর পড়েছে, তাই, আমরা জামা গুঁজে, জুতো পড়ে সরকারি অফিসগুলোয় যাতায়াত শুরু করলাম। জলাভূমি নিয়ে কথা বলতে শুরু করতেই কেউ কেউ শুরুতেই এমন সমব্যথী সহানুভূতি সম্পন্ন নরম দৃষ্টিতে চাইছিলেন, আমি বেশ কয়েকবার ভেবেছি, এনারা জানলেন কি করে, যে আমার বাবা মারা গেছেন! অন্য একটা প্রতিক্রিয়াও মজার। জলাভূমি নিয়ে কাজের কথা শুনে, অন্তত দুজন বললেন, হ্যাঁ, ওদিকে খুব মারে। আপনারা এখনও মার খাননি? অনেকটা, ‘সোমেন এখনও আপনাকে লেখা চেয়ে ফোন করেনি?’ গোছের।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে কাজ করতে চাইলে, ঠিক কোথায় কোথায় যেতে হতে পারে, তার একটা ধারণা দেওয়ার জন্য এই একটা ছোট তালিকা —
১। পরিবেশ দফতর। তার সঙ্গে ইস্ট কোলকাতা ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি।
২। কলকাতা কর্পোরেশন।
৩। মৎস্য দফতর। সেখান থেকে আপনাকে পাঠানো হবে, ফিশারিজ ডিরেক্টরেট এবং ফিশারিজ কর্পোরেশনে।
৪। সেচ দফতর।
৫। কৃষি দফতর। সেখান থেকে ডিরেক্টরেট ও এগ্রি সেন্সাস।
৬। কৃষি বিপণন দফতর।
৭। হর্টিকালচার, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতর।
৮। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর।
৯। ক্ষুদ্র শিল্প দফতর।
১০। নগরোন্নয়ন ও পূর্ত দফতর।
১১। সেল্ফ-হেল্প গ্রুপ ও স্বরোজগার দফতর।
১২। নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর।
১৩। পঞ্চায়েত দফতর।
১৪। উত্তর ও দক্ষিণ পরগণা জেলা প্রশাসন। এনআরজিএ সেল, তিনটি ব্লক অফিস, তিনটি বিএলআরও অফিস।
১৫। সাতটি পঞ্চায়েত।
১৬। এছাড়াও কখনও কখনও কোনও মহদাশয়ের অঙ্গুলি নির্দেশে, (যার বেশিরভাগটাই পরে বোঝা যাবে দিকভ্রষ্ট গোঁত্তা মারা) সংখ্যালঘু বিষয়ক দফতর, আদিবাসী উন্নয়ন দফতর, ডিস্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট, প্ল্যানিং-স্ট্যাটিসটিকস-প্রোগ্
কিছু হয়তো বাদ গেল, কিন্তু ইতিমধ্যেই তালিকাটা এমন অশ্লীল রকমের লম্বা হয়ে যাচ্ছে, এটুকুই আপাতত থাক। এখানে একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখা যাক। সোমেন যেহেতু আমাকে দিয়ে দুই হাজার শব্দ অন্তত লেখাবে ঠিক করেছে, আমরাও একটু আমাদের স্বার্থ দেখব। কিছু প্রশ্ন রাখব, প্রতি কিস্তির শেষে। যদি কমেন্টের থ্রেডে জবাব দেন, আমাদের কিছু সুবিধে হয়। না দিলেও একটা সুবিধে হয়। পরের কিস্তিটা না লেখার একটা মোক্ষম কারণ সোমেনকে বলা যাবে।
গুগুল করার পরিশ্রমের দরকার নেই। জাস্ট যেটা মনে হয় সেটা লিখে দিলেই হবে।
১। রোজ আপনার বাথরুম থেকে যে জলটা বেরোয়, আপনার বাথরুম থেকে বেরিয়ে সেটা কোথায় যায়, কোন ধারণা আছে? বলবেন সংক্ষেপে?
২। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি, East Kolkata Wetland — এই শব্দবন্ধটা পরিচিত? কোথায় কীভাবে জেনেছেন, আর কতটুকু জেনেছেন, বলবেন?
৩। রামসার কর্তৃপক্ষ, রামসার সাইট এই ব্যাপারগুলো চেনা? ঠিক কী জানেন, সংক্ষেপে একটু বলবেন?
৪। যদি এমনটা হয় যে আপনি এর আগে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি, রামসার, ইত্যাদি সম্পর্কে আগে থেকেই জানেন, তাহলে, এই জলাভূমি সম্পর্কিত ইস্যুগুলো আপনার প্রায়োরিটি অনুযায়ী সাজিয়ে দেবেন?
৫। কলকাতার বাস সংস্থান সমস্যা এবং কলকাতা শহরের বৃদ্ধি, এই নিয়ে কিছু ভেবেছেন কখনও? ভেবে থাকলে বলবেন?
আচ্ছা, আবার সামনের সপ্তাহে।