Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইতিহাস পুরাণের গোণ্ড বীর জটবা খণ্ডাৎ, পর্ব — এক

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

চতুর্থ উপকথা, শেষ পর্ব এখানে

 

মধ্যভারতের হাথিয়াগঢ়/হরিয়াগঢ় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী জুড়ে ছিল গাঔলি বা গ্বালিয়া রাজাদের রাজ্যপাট। আজ মধ্যভারতের অন্যতম শহর গ্বালিয়র এবং মধ্যভারতে বহুল ব্যবহৃত পদবী ‘গ্বালিয়া’ গ্বালিদের নামস্মৃতি ধরে রেখেছে।

ইতিহাস হিসেব দিচ্ছে — ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই অঞ্চলের দাপুটে শাসক ছিল এরা। তারপরেও বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাদের শাসন জারি থাকলেও, ক্রমে দুর্বল হয়ে এসেছিল। সেই সময়ে, সন ১৫৮০তে, দুই গ্বালি রাজা রণসুর ও ধনসুরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁদের রাজ্যপাটের থেকে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়াড়া ও কনহান নদী-উপত্যকাময় দেওগঢ়-হার‍্যাগঢ় অঞ্চলকে গোণ্ড আদিবাসী শাসন-স্বায়ত্তে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন বীরমন শাহর পুত্র জটবা। শাসন করলেন ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ অবধি, স্থাপনা করে গেলেন দেওগঢ়ের গোণ্ড রাজবংশ।

আইন-ই-আকবরী এও জানাচ্ছে যে জটবার সৈন্যবাহিনীতে ছিল ৫০ হাজার পদাতিক সৈন্য, ১৫০০টা ঘোড়া ও ১০০খানা হাতি, জানাচ্ছে কীভাবে ১,০১,০০০ তঙ্খার হিসেবে দেয় ভেট নিয়ে জটবা এসে হাজির হচ্ছে আগ্রায় আকবরের দরবারে। নাগপুরের জাদুঘরে জটবা-প্রচারিত তাম্রমুদ্রা দ্রষ্টব্য। জটবা খণ্ডাৎ প্রতিষ্ঠিত দেওগঢ়ের গোণ্ড আদিবাসী রাজবংশ দশ পুরুষ ও ১৭১ বছর শাসন করে। রাজ্যপাট ক্ষমতার শিখরে ওঠে এই বংশেরই আদিবাসী রাজা মহিপৎ তথা বখত বুলন্দ শাহর শাসনকালে। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে তাই আমরা ‘নাগবংশীয়’, অর্থাৎ সর্প-টোটেমধারী জটবার বংশধর এই বখত বুলন্দ শাহকে পত্তন করতে দেখব আধুনিক ভারতের অপার গুরুত্বপূর্ণ নগর — নাগপুর।

এইখানে আবার একটা অল্টার্নেটিভ রীডিং উঠে আসছে। উপরের ঐতিহাসিক তথ্যগুলো আসছে মাঁসারাম কুমরে বিরচিত ‘গোণ্ডবংশ কা ইতিহাস এবং সংস্কৃতি’ (২০১৪) থেকে। এদিকে মোতি কাঙালি তাঁর ‘গোণ্ডওয়ানা কা সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ (১৯৮৪)-তে বলছেন, ১০ম শতাব্দীতে পাঁচালগড়ের সাপ-টোটেমধারী গোণ্ড রাজা ঢোলাপুয়ার-এর কথা, যিনি হরিয়াগড়ের গ্বালি রাজা রণসু-ধনসুকে হারিয়ে স্থাপন করছেন রাজ্যপাট। একই তথ্য দিচ্ছেন সমসাময়িক অপর গোণ্ড স্কলার এস-বি সীডাম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বহমানি সালতানতের আতিথেয়তায় বসে এইসব রাজ্যপাটের দিকে ইঙ্গিত করলেন পারসিক ইতিহাসকার ‘ফারিশতা’।

এই ঢোলপুয়ারের বংশেই ষোড়শ ঈশাব্দে জন্মগ্রহণ করলেন বীরমন উইকে। ততদিনে রাজগৌরব ম্লান। নাগবংশের অপর শাখায় তাদেরই এক ‘মাণ্ডাভি’ টোটেমধারী জ্ঞাতিরাজা ‘সংগ্রাম-শাহ’ গড়-মণ্ডলা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপে শাসন করছে ৫২ গঢ় (পর্বতমালা), ৫৭ পরগণায় বিস্তীর্ণ সমগ্র গোণ্ডওয়ানা। এই সংগ্রামশাহী ৫৭ পরগণার এক হরিয়াগঢ়, আর সেইখানেরই এক করদ পরগণা-শাসক বীরমন।

বীরমনের বয়স হয়েছে। সন্তান বলতে তাঁর একটিই — রাজকুমারী ঝুনিয়া রায়তার। একদিন তিনি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন — আসছে দশেরার পার্বণে যে যুবক তলোয়ারের এক কোপে বিপুলকায় এক মোষের গর্দান কাটতে পারবে, সেই তাঁর কন্যার পাণিগ্রহণ করবার এবং সম্পূর্ণ পাঁচালগঢ় রাজত্বের উত্তরাধিকার হবার যোগ্য বিবেচিত হবেন।

দশেরার দিন লোকে লোকারণ্য। রাগে মাটিতে খুর আছড়ে ধুলোর তুফান তুলছে সেই প্রকাণ্ড মোষ। নাক ফুঁসছে। সেদিন সেখানে বীরত্ব দেখাতে, রাজ্য ও রাজকন্যার লোভে, তলোয়ার হাতে অনেক যুবক উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু সেই মোষের রকম দেখে কারুর সাহস হল না এগোতে। এমন সময়, সবাই অবাক হয়ে দেখল —

একটা কাঠের তরোয়াল বাগিয়ে অকুতোভয়ে এগিয়ে চলেছে রাজার এক সেপাই — জটবা। মোষটা তেড়ে গেল তাঁর দিকে, শিং বাগিয়ে লাফ মারল। জটবা ইষ্ট দেবদেবীর স্মরণ নিল। তারপর অবলীলায় বাঁ হাত দিয়ে প্রতিহত করল মোষের শিং। একই সাথে ডান হাতে ধরা সেই কেঠো তরোয়াল দিয়ে বিদ্যুদ্গতিতে মারল মোষের গর্দান লক্ষ করে এক কোপ। এক লহমায় ধড় থেকে গর্দান আলাদা হয়ে গেল দুর্ভাগা সেই মোষের। কিছুক্ষণ হতচকিত স্তম্ভিত থাকল জনতা, তারপর হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল। তখনই সেই মাঠেই মণ্ডপ-সামিয়ানা খাটিয়ে বিয়ে হয়ে গেল ঝুনিয়া আর জটবার। ‘উইকে’-টোটেমধারীদের থেকে ‘খণ্ডা’-টোটেমধারী জটবার স্কন্ধে ন্যস্ত হল হরিয়াগড়ের রাজ্যশাসনভার।

জটবার আরও অনেক অলৌকিক কীর্তিকলাপের কথা গানে-বীরগাথায় স্মরণ রেখেছে গোণ্ডসমাজ।

গরীব পরিবারে জন্ম জটবার। জন্মটা আবার হয়েছিল একটা সীমগাছের নীচে। বাল্যে পিতৃহারা। মা পরের ক্ষেতে দিনমজুরি করে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করত। দিনভর ক্ষেতে কাজ করবার সময় সঙ্গে নিয়ে যেত কোলের শিশু জটবাকে, ঘুম পারিয়ে রেখে দিত ক্ষেতেরই কোনও শীতল ছায়ায়। একদিন অনবধানে সে জটবাকে এমন একটা জায়গায় রেখে দিল যেখানে ছায়া নেই। মা তো চলে গেছে দূরে ক্ষেতে, এদিকে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে ঘুম ভেঙে গেল শিশুর। জুড়ে দিল সে কান্না। হঠাৎ কোথা থেকে সেখানে হাজির হল এক বিরাট শঙ্খচূড়। ফণা ছড়িয়ে ছায়া দিল সে শিশু জটবাকে। শিশু পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।

এদিকে তখন সেখানে উপস্থিত হল সেই ক্ষেতের মালিক। কাণ্ড দেখে সে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে ক্ষেতমজুরদের জড়ো করল সেখানে। সবাই অবাক ভয়ে দেখল, প্রকাণ্ড ফণা ছড়িয়া আছে কালনাগ, আর তার নীচে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে জটবা। লাঠি-সোটা দিয়ে আওয়াজ করে করে তো সেই গোখরোসাপকে সরানো গেল, কোলের ছেলে মা ফিরে পেল কোলেই, কিন্তু সেই থেকে জটবার দৈবশক্তির আঁচ পেয়ে গেল সকলে।

কিশোরকালে রাখাল-বালকের কাজ নিল জটবা সেই ক্ষেতমালিকের কাছেই। ক্ষেতের আশেপাশের জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে এসে কিশোর জটবা একটা তলোয়ার বানিয়ে নিল। সেই কেঠো-তরবারি দিয়েই সে বনের কাঠকুটো কাটত, হিংস্র শ্বাপদ থেকে আত্মরক্ষাও করত। ক্রমে সে সেই তলোয়ার চালনায় পরদর্শী হয়ে ওঠে জটবা খণ্ডাৎ, এবং যুবাকালে অচিরেই সে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিল। তার কিছুদিনের মধ্যেই, জটবা মোষ মেরে রাজা হবে।

গোখরো সাপের ফণায় শিশুরাজাকে ছায়া দেওয়ার কাহিনী আদি ও মধ্যযুগভর উপমহাদেশের অনেক মিথিকাল রাজারাজড়ার সাথেই যুক্ত। কামতাপুর রাজঘরানার প্রতিষ্ঠাতা নীলধ্বজের কাহিনীতেও এর ছায়া পাবেন বাংলার ইতিহাসবেত্তা। আবার কাঠের তলোয়ারের কাহিনী পাওয়া যায় অচলসেন তথা চর্যাপদের ভুসুকুপাদ তথা শূন্যবাদি নালন্দাচার্য্য শান্তিদেবের জীবনকাহিনীতে। এই ভুসুকুরও, বজ্রযান কিংবদন্তী অনুসারে, জন্ম রাজপরিবারেই। আবার রাঢ়বাংলার লোকভক্তিতে লোহার গণ্ডার কেটে শৌর্যবীর্য প্রমাণ করছেন ধর্মমঙ্গলের লাউসেন। উপমহাদেশময় শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে পরতের পর পরত হয়ে জমেছে মিথষ্ক্রিয়া-কিং-মেকিং-সেজ-মেকিং-দের ন্যারেটিভেরা, একটার ঘাড়ে হুমড়ি খেয়েছে আরেকটা, মিলমিশ খেয়েছে ইতিহাসের দ্বন্দ্বভিত্তিক দোলাচলে। তাদের লতায় পাতায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে তাই কোনটা বাস্তব আর কোনটা জাদু, নির্ণয়চেষ্টা ধুস্তরী মায়া।

যথাক্রমে মাঁসারাম কুমরে এবং মোতি কাঙালি ও এস বি সীডাম-দের কলমপথে আমরা পেলাম জটবা-বিষয়ক কিছু কাহিনী, ন্যারেটিভ ও কনফ্লিক্টিং টাইমলাইন। তাতে আরও কিছু যোগ হচ্ছে যখন আমরা চোখ রাখছি বেদনসিং ধুর্বে বিরচিত ‘কোয়া পুনেম গোণ্ডিয়ন গাথা’ (২০১৪)-র পাতায়।

 

এরপর পঞ্চম উপকথা, পর্ব — দুই