Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আশিতে নবনীতা: একটি প্রতিবেদন

সাগরিকা শূর

 

নজরুল লিখেছিলেন, “মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য”। বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে একজনের সম্পর্কেও যদি এই মন্তব্য প্রযোজ্য হয় তিনি নিঃসন্দেহে নবনীতা দেব সেন। তিনি উচ্ছ্বল, তিনি সহাস্য, তিনি সুদূরপিয়াসী, আবার তিনিই কখনও তির্যক, কখনও ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোরও বটে। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক্স — সবেতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ, তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদী, আবার ততটাই আধুনিকা বা সমকালীন। এহেন চিরযৌবনার আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান প্রকাশক দে’জ পাবলিশার্স গত ১২ই জানুয়ারি বাঙালি পাঠককুলকে উপহার দিল এক অনন্য সন্ধ্যা। রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে সেদিন বাস্তবিক চাঁদের হাট — শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব গুহর মতো বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অভিভাবকদের উপস্থিতির পাশাপাশি শ্রীজাত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় বা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের নবনীতা-অর্ঘ্য বুঝিয়ে দেয় আশিতে পা দিয়েও নবনীতা কখনই শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। বাস্তবিক চন্দ্রিলের কথার সুর টেনে বলতেই হয়, “She is very there”.

অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে দে’জ পাবলিশিং-এর পক্ষ থেকে লেখিকার হাতে ফুল ও বই তুলে দেন সুধাংশুশেখর দে; শঙ্খ ঘোষ ও বুদ্ধদেব গুহ উন্মোচন করেন নবনীতার রচনা সমগ্রের প্রথম খণ্ড। নবনীতার থেকে কিঞ্চিৎ বয়োঃজ্যেষ্ঠ বুদ্ধদেব গুহ বারবারই ফিরে যান ফেলে আসা নানা রঙের দিনগুলোয়। চিররোম্যান্টিক বুদ্ধদেব তাঁর  উপন্যাসের মতোই প্রগলভ তাঁর স্মৃতিচারণেও, যৌবনের সেই আলো ঝলমলে দিনগুলোয় নবনীতার ‘ক্রেজ’, অমর্ত্য-নবনীতার বিবাহ ও তার ফলস্বরূপ বুদ্ধদেবের মতো অনেক যুবকেরই ‘ব্যর্থ প্রেম’ — এসবই সকৌতুকে দর্শককে পৌঁছে দেয় এক অন্য নবনীতার কাছে। অন্যদিকে রচনা সমগ্রের সম্পাদক শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় গত ৮-৯ মাসের অক্লান্ত চেষ্টায় প্রিয় লেখকের বই সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব সম্পন্ন করতে পেরে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানান।

দ্বিতীয় পর্বে দেখতে পাই আর এক নবনীতাকে — শ্রীজাত, অনিন্দ্য বা চন্দ্রিলের মতো জেন ওয়াই-এর লেখকদের চোখে ধরা পড়েন এক ‘অশীতিপর তরুণী’, যাঁরা আরও অনেক বাঙালির মতোই বিশ্বাস করেন না যে নবনীতা দেব সেন কোনওদিন আশির কোঠায় পা রাখতে পারেন। তাই তপন বন্দ্যোপাধ্যায় মাইকের সামনে দাঁড়িয়েই জানান দেন ‘আশি’ শব্দে তাঁর কী ভীষণ আপত্তি; তাঁর চোখে নবনীতা একান্তই ‘প্রাণোচ্ছল’, ‘ডাকাবুকো’, ‘স্বতঃস্ফূর্ত’। শ্রীজাত থেকে তপনবাবু, চন্দ্রিল থেকে অনিন্দ্য, সকলের কাছেই ‘সেন্স অফ হিউমর’ শব্দটার বোধহয় একটাই সংজ্ঞা — নবনীতা দেব সেন। চন্দ্রিল বললেন, নবনীতার অন্যতম ইউএসপি তাঁর ‘thereness’ বা সমকালের প্রতি সচেতনতা, তাই বয়স ও অনেক শারীরিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তাঁর অসুবিধা হয় না কোনওদিনই, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা লঘু হাস্যরসের সাথে গুরুগম্ভীর সাহিত্যিক আলোচনা বা সমালোচনাও তিনি সেরে ফেলেন অনায়াসে, সমস্ত বিষাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে “একহাতে খড়্গ আর এক হাতে মধুভাণ্ড” নিয়ে দিব্যি এগিয়ে চলেন তিনি। ‘তড়িৎচেতন’, ‘স্মিতমুখ’, ‘আগ্রহী’ নবনীতা আশ্চর্য সরসতা ও সরলতার মিশ্রণে তাঁর কৃষ্টিতে ঢেলে দেন এক ‘নাছোড় প্রসন্নতা’। অনিন্দ্যর কথায়, একদিকে তাঁর হাত ধরা আদিকবি বাল্মিকীর, অন্য হাত ধরা লীলা মজুমদার ও আশাপূর্ণা দেবীর। শ্রীজাতর ‘আদর’মাখা কবিতায়ও সেই নানা রঙের নবনীতার ছোঁয়াচ —

“পায়ের তলায় সর্ষেদানা, হাতে কলম খোলা,

লেখারা তাঁর ভাবনা জলে ভাসানো গন্ডোলা,

এই দেখি এই চৌকাঠে, তো ওই দেখি ওই দূরে,

জৌলুসে তাঁর ধাক্কা লেগে সময় থুরথুরে…”

মিতভাষী শঙ্খ ঘোষ আদর্শ অগ্রজের মতোই নবনীতার হাতে তুলে দেন তাঁরই বড় মেয়ে অন্তরার সম্পাদনায় নবনীতাকে নিয়ে অন্তরার বন্ধুদের রচিত একটি কবিতার বই। বাচিক শিল্পী প্রণতি ঠাকুরের কণ্ঠে নবনীতার ‘দেশের চিঠি’ গল্প পাঠ, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতুলপ্রসাদী ও মধুশ্রী হাতিয়ালের ঝুমুর গান এবং সবশেষে বারাসাত আত্মজার উপস্থাপনায় নবনীতা দেবসেনের নাটক ‘জীবনবৃত্ত’ এ সন্ধ্যায় এক অন্য আঙ্গিক রেখে যায়, তার সাথে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো উপরি পাওনা বুদ্ধদেব গুহর কণ্ঠে গান, “আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার”। এই ৮১ বছর বয়সেও যাঁর ভেতর থেকে উঁকি দেয় ২১ বছর বয়সের এক উৎফুল্ল তরুণ।

এরপর শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনিতা অগ্নিহোত্রীর যৌথ উপস্থাপনায় নবনীতাকে মধ্যমণি করে শুরু হয় আলোচনাপর্ব — অনুষ্ঠানের তৃতীয় ও অন্তিম পর্ব। বিষয়: নবনীতার অধ্যাপনা ও সাহিত্য। কবিতার জন্ম প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “কবিতা লেখার মনটা খুব আহ্লাদী, খুব একটা ধাক্কা না পেলে, ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ ধাক্কা না পেলে কবিতা হয় না”, অকৃত্রিমভাবে কবিতা না আসলে তাই বেছে নেন অনুবাদ। সাহিত্যের এই বিরাট পরিসরে তাঁর বিবিধ ধারায় অবাধ অথচ অপরিকল্পিত সঞ্চরণ বুঝিয়ে দিতে দিতে বলেন কোনও লেখা সত্যিকারের লেখা হয়ে উঠতে ঠিক কতটা যত্ন প্রয়োজন, বুঝিয়ে দেন লেখা বিষয়ে তিনি ঠিক কতটা খুঁতখুঁতে। প্রকৃত শিল্পী মাত্রই ডিসস্যাটিসফায়েড। নিজ সৃষ্টির প্রতি সন্তোষ বোধহয় শিল্পীর শিল্পবোধকেই ক্ষুণ্ণ, মলিন করে। নবনীতার কথাতেও তাই ঝরে পড়ে সেই চির-অতৃপ্তির সুর, “কোনওদিন কোনও লেখা লিখে মনে হয় না যথেষ্ট ভালো হল… আমি তো পণ্ডিত নই… নিজেকে আমার কবি মনে হয়… কবি হওয়ার চেষ্টা আমি করব… যতদিন পারি চেষ্টা করব” শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কেন অ্যাকাডেমিক কাজ করছ না?’ প্রশ্নে লেখিকার অকপট উত্তর, “অ্যাকাডেমিক লেখার জন্য মনটা শানিত রাখা দরকার, মনটা এখন আগের মতো শানিত রাখি না”, নিজের ‘আলসেমি’-কে দোষ দিতে দিতে বলেন, অ্যাকাডেমিক কাজের জন্য নতুন কিছু দেওয়া চাই, সেখানে রিপিটেশন চলে না। তার জন্য একটা ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডিসিপ্লিন’ দরকার। জীবন ও লেখা দু’ক্ষেত্রেই নিজের শর্তে এগিয়ে চলা, খেয়ালি নবনীতা সাহিত্যের প্রায় সব ধারায় সমান সাফল্যের ঝুলি কাঁধে নিয়েও জানান, তিনি মনে করেন যা লেখেন তিনি শুধু সেটুকুরই যোগ্য, যা লেখেন না সেটা তাঁর নয়। ফরমাইশি লেখা তাঁর আসে না, বাজারের চাহিদার জন্য তাঁর কলম নয়। এক কল্যাণময় জীবনে বিশ্বাসী নবনীতা তাই বলেন, “এমন কিছু লিখব না যাতে সমাজের ক্ষতি হয়… এমন কোনও লেখা লিখে লাভ নেই যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনও উপকার না হয়… আমার লেখা থেকে যেন কোথাও কোনও অকল্যাণ না যায়…”। পাঠকের সাথে তাঁর বাণিজ্যিক যোগ নয়, পাঠক তাঁর ভালোবাসার, পাঠক তাঁর ‘বন্ধু’। দীর্ঘ আশি বছরের ভালোবাসা কুড়োতে কুড়োতে তাই তাঁর কথায় বারবার উঠে আসে পাঠকের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, ধন্য হয় তাঁর নবনীতা-জন্ম।

সংসারে কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের বয়স কখনও বাড়ে না, সময় তাঁদের চুলে পাক ধরায়, যোগ-বিয়োগের হিসেব তাঁদের ৮০-র কোঠায় পৌঁছে দেয়, শুধু তাঁদের ভেতরের কোনও অবোধ শিশু তখনও আড়াল থেকে চোখ টিপে জানান দিয়ে যায় তিনি কিন্তু সেই ছোট্টটিই আছেন, তেমনই সরল, তেমনই কাঁচা, তেমনই আদুরে, তেমনই কুতূহলী; বয়সের হিসেব যাঁদের কাছে শুধুই কিছু সংখ্যামাত্র; কনকনে শীতের দিনেও মিঠে রোদে ভেসে যায় তাঁদের ‘ভালোবাসার বারান্দা’, আর সেই কমলালেবু রোদে পা মেলে চুল শুকোতে শুকোতে হয়তো কোনও এক গল্পদিদার মতো নবনীতা তখনও লিখে চলেন ‘সীতা থেকে শুরু’-র মতো যুগান্তকারী কোনও লেখা, কিংবা ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকবাহনে’-র মতো কোনও সরস ট্রাভেলগ বা অনন্য কোনও কবিতা, সময় সেই বারান্দায় এসে থমকে যায়, হয়তো চুপটি করে বসে গল্প শোনে আরও অনেক অনেক পাঠকের মতো, জীবন সে বারান্দায় সুখ খুঁজতে আসে, জন্মদিন ভালোবেসে তাঁর নরম দু’গালে চুমো খেয়ে যায় আরও অনেক জন্মদিনের অপেক্ষায়।

এমনি করেই ভালো থাকুন নবনীতা, ভরে থাকুন, ভরে রাখুন। আরও আরও ঋদ্ধ করুন নিজেকে ও তাঁর অগণিত পাঠককুলকে।