Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যে বই এখনও পড়িনি

সৈয়দ কওসর-জামাল

 

এমন একটি স্টেটমেন্ট দেওয়ার পর নিজেই নিজের অসহায়তাটিকে ধরতে পারি। ‘যে বই এখনও পড়িনি’ এই বাক্যে একধরনের গর্ব প্রকাশ পায়। অর্থাৎ আমি পড়ুয়া লোক, প্রচুর বইপত্র পড়ি, তবু কয়েকটি বই এখনও পড়া হয়নি, তাড়াতাড়ি সেগুলোও পড়ে ফেলব। বুঝতে পারি, নিজের রচিত ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। না মশাই, আমি মোটেই তেমন পড়ুয়া লোক নই। দু-চারখানা কবিতার বই আমার নামে বেরিয়েছে বলে পড়ুয়া হয়ে যাইনি। জীবনের সেরা সময় ছাত্রাবস্থা হলে সে-সময়কে হেলায় উড়িয়েছি প্রায় না-পড়েই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেতে হলে খুব বেশি পড়াশুনার দরকার হয় না। তখন ভাবতাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কর্মজীবনে ঢুকি, তারপর দেখাব কাকে পড়াশুনা বলে, আগে ডিগ্রিটা হাতে আসুক। তো এই ডিগ্রির জন্য অবশ্যই কোনও কোনও বই বাধ্যত পড়ে ফেলতে হয়েছে। তাও বোঝাটা সম্পূর্ণ হয়নি। কত যে গাইড বই ছিল মূল টেক্সটিকে বোঝানোর জন্য। কেনই বা হবে না, বলুন? ডিগ্রির জন্য কে কবে শেকসপিয়ারের নাটক বুঝেছে? কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে গোটা চারেক নাটক পাঠ্য ছিল। বিদ্যালয় জীবনের পুঁজি নিয়ে শেকসপিয়ারের হ্যামলেট বুঝব? না, বোঝা যায়? শত শত পণ্ডিত এখনও হ্যামলেট নিয়ে বই লিখে যাচ্ছেন! এ অবস্থায় এখনও সাহস হয়নি শেকসপিয়ারের অন্যান্য নাটকগুলো খুটিয়ে পড়ার।

শুধু কাহিনি জানাটা কোনও পড়া নয়। আমি কি আর সাহস সঞ্চয় করে শেকসপিয়ারের জগতে ঢুকতে পারব? ইচ্ছে হয়, একদিন সব পড়ে ফেলব, তা নিয়ে লিখবও।

তবু মনে রাখতে হয়, জীবন খুব ছোট। পৃথিবীর সব ভালো সাহিত্যপুঁথি এক জীবনে শেষ হওয়ার নয়। মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ার সময় ভেবেছি, মিলটনের পুরোটা একদিন ঠিক পড়ে নেব। এখনও হয়নি, আর কি হবে! একইভাবে ডি এইচ লরেন্স, ভার্জিনিয়া উলফ, টি এস এলিয়ট থেকে গেছেন আংশিক পঠিত হয়ে। একটি উপন্যাস পড়ি, তো আরও অন্য বাকি থেকে যায়। কাব্যগ্রন্থ পড়ি, তো কাব্যনাটকগুলো চেয়ে থাকে আলমারির ভিতর থেকে।

কলেজজীবনের প্রথমদিকে সাহিত্যপাঠের আগ্রহ থেকে বিশ্বসাহিত্যের অনেক গ্রন্থ অনুবাদে পড়েছিলাম। গ্রিক নাটক, ফরাসি উপন্যাস ও কবিতা এভাবেই পড়েছি। কাম্যুর আউটসাইডার অনুবাদে প্রথম পড়ি, পরে অবশ্য ইংরেজিতে পড়েছি। এখন কিছুটা ফরাসি ভাষাটা রপ্ত করার পর মনে হয় মূল ভাষায় কবে পড়ব? ছেলেবেলায় একটি উপন্যাস বন্ধুরা মিলে পড়তাম — ভিক্টর হুগোর, ‘লা মিজারেবল’। এখন জানি, লেখকের নাম হুগো নয়, য়্যুগো। আর উপন্যাসটি হল ‘লে মিজেরাবল’। সে যাই হোক, কাহিনিটি পড়ে কী আনন্দ-ই না  পেয়েছি, দুঃখও পেয়েছি। য়্যুগোর উপন্যাসটি এখনও ফরাসি ভাষায় পড়ে উঠতে পারিনি। অরুণ মিত্রের অনুবাদে ভলতের-এর ‘কাঁদিদ’ পড়েছি, সাধ হয় ফরাসিতে একবার পড়তে। কাম্যুর ‘প্লেগ’ না ইংরেজি, না বাংলা অনুবাদে এখনও পড়িনি। বইটি সংগ্রহে আছে, তবু পড়া হয়নি। এই মুহূর্তে অন্তত দশটি পৃথিবীখ্যাত গ্রন্থের নাম মনে করতে পারি, যা এখনও আমি পড়ে উঠতে পারিনি। সংকল্প করি এবার ঠিক পড়ে নেব। কিন্তু সময় বড় ঈর্ষাকাতর, প্রতি মুহূর্তে বাদ সাধে। এই সুযোগে পুনরায় প্রতিজ্ঞাটি ঝলিয়ে নিই। পড়তে হবে মিলান কুন্দেরার ‘দ্য জোক’, এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’, এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘থ্রি কমরেডস’, আর হ্যাঁ, জীবনের শেষপ্রান্তে হলেও একবার পড়ে নেব, ‘দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। মার্কেস কি পুরো পড়েছি? মনে হয় না।

এত যে পড়া ও না-পড়ার কথা বলছি, সব পড়া কি সমান? ফ্রান্সিস বেকন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিলেন, তাঁর একটি মূল্যবান কথা মনে পড়ছে — কিছু বই চেখে দেখতে হয়, কিছু বই গিলতে হয়, আর কিছু বই চিবিয়ে হজম করতে হয়। অর্থাৎ পাঠের শ্রেণিবিভাগ আছে, আছে পাঠকেরও। কেমন পাঠক আমি? বাংলাদেশের মনস্বী লেখক আহমেদ ছফা তাঁর প্রিয় শিক্ষককে এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছেন, যা অপ্রাসঙ্গিক হবে না:

‘আপনে যখন মনে করলেন, কোনও বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইলেন, যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না! আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইলে পারে, আপনের শব্দভাণ্ডার সামান্য হইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইরা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।….’

হলফ করে বলতে পারব না যে জীবনের এতগুলো বছর ধরে যত বই পড়েছি, তাদের ‘আসল জিনিসটা’ রিপ্রোডিউস করতে পারব। গ্রন্থভাণ্ডার কি তবে শূন্যই থেকে যাবে? না, এতটা পেসিমিস্টিক হতে রাজি নই। অবসর মুহূর্তে, ঘটমান বর্তমানের সার্কাসে জড়িয়ে যেতে যেতে, কখনও কি কোনও মহান গ্রন্থপাঠের স্মৃতি এসে জানিয়ে যায় না যে এ নতুন কিছু নয়, পৃথিবীতে প্রায়শই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে? কী পড়েছি, তা নয়, এখন তাই উচ্চকণ্ঠে বলা দরকার কী কী পড়ে যেতে চাই সংক্ষিপ্ত এই পাঠের জীবনে।

আমার এই লেখা পড়ে এতক্ষণে নিশ্চয় আপনি ধরে নিয়েছেন আমি বিশ্বসাহিত্য নিয়েই শো-অফ করে গেলাম। কী করব, নিজের ভাষায় তেমন কিছু পড়িনি বললে কি আর রক্ষা আছে! বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব রবীন্দ্রনাথ সব পড়েছি? অথচ এখন দিনের অনেকটা সময় কাটে তো তাঁকে নিয়েই! তবে ইচ্ছে জাগে, সতীনাথ ভাদুড়ী আবার পড়তেই হবে, মৃত্যুর আগে হলেও। অল্প বয়সে বাংলা উপন্যাস প্রচুর পড়েছি, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সন্দীপন, আর নয়। নতুন লেখকদেরও নয়। সময় দিয়ে আর একবার পড়তে চাই কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে মহাভারত। পেরে উঠতেই হবে। ভয় শুধু একটাই, দিনের আলো ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।