Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গ্লোবালাইজেশন, বাংলা ভাষা আর বাঙালি আইডেনটিটি

দৃপ্তা পিপলাই (মণ্ডল)

 

কলকাতা শহরের দোরগোড়ায় গ্লোবালাইজেশন এসেছিল সুপারমার্কেটের হাত ধরে, আর মফস্বল পেরিয়ে দূরের গ্রামে শহর থেকে আসা চিপস কিম্বা শ্যাম্পুর প্যাকেট আমদানির সঙ্গে সঙ্গে। দশ বছর আগেও পশ্চিমবাংলার যে গ্রামে শহুরে বিস্কুট আর চিপসের প্যাকেটের দেখা মিলত না, সেখানে হয়ত এখন মিষ্টির দোকানে পেপসির বোর্ড আর মুদির দোকানে নানা সিমকার্ড। গ্লোবালাইজেশন যেমন বদলে দিয়েছে শহুরে বাংলা আর গ্রামবাংলার চিত্র, তাদের কাছাকাছি এনে, তেমনি পাল্টে দিয়েছে শহুরে আর গ্রাম্য ভাষার চেহারা আর দূরত্ব। শহর, মফস্বল আর গ্রামকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে শহুরে পণ্যের বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন, টিভি সিরিয়ালের কথোপকথন আর ইন্টারনেট অ্যাক্সেস। শহুরে ভাষার দেওয়াল ক্রমে ভেঙে পড়ছে হুড়মুড় করে।

বছর দশেক আগেও বহু গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে টিভি আসেনি। কয়েক বছর আগেও হরেক বাংলা খবরের চ্যানেল আর সিরিয়ালের চ্যানেলের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। কলকাতার গড়িয়াহাট বা এসপ্ল্যানেডের পথচারীদের প্রাত্যহিক সংলাপ শোনার কোনও অবকাশ হয়নি নদীয়া বা দিনাজপুরের গ্রামের মধ্যবয়সী কৃষক, ব্যবসায়ী বা গৃহবধূর। তেমনি, বাঁকুড়ার নিজস্ব টানে কথা বলা সিরিয়ালের জনপ্রিয় চরিত্রের কল্যাণে শহরের টিনএজার শহরের বাইরের ভাষা নিয়ে কিঞ্চিৎ অবগত হতে পেরেছে। নদী কিম্বা জঙ্গলে ঘেরা যে গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে অনিয়মিত বাস সার্ভিস বা নিয়মিতভাবে অনুপস্থিত শহরের দিদিমণি, আনলিমিটেড ইন্টারনেটে বাংলা খবর বা সিরিয়াল সেই বিচ্ছিন্নতাকে অনেকটাই দূর করতে পেরেছে।

সারা পৃথিবীব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্থানিক দূরত্ব বেড়ে চলা সত্ত্বেও দূরত্ব কমে এসেছে ভাষার। বাংলা ভাষাভাষী নানা পরিবারের কনিষ্ঠতম জেনারেশন এখন ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, মুম্বাই, দুবাই, লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বৎসর অন্তে দুই মাস ভারতে আসেন, কেউ বছরে ছ’ মাস ভারতে থাকেন। এই জেনারেশানের পুত্র-কন্যারা বছরে দুই থেকে ছয় মাস নিয়মিত বাংলা শোনা বা বলার পরিবেশে বড় হয়, আর এই পুত্র-কন্যাদের পিতামহ-পিতামহী, মাতামহ-মাতামহী সঙ্গত কারণে ষাণ্মাসিক ভাবে পরিযায়ী হয়ে যেতে বাধ্য হন। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা ডায়াস্পোরার ট্র্যাডিশন তথা কমিউনিকেশনের বদল ঘটিয়ে ফেলেছে গ্লোবালাইজেশন। ডায়াস্পোরিক বাঙালি আর আইসোলেশনের গুঁতোয় কমিউনিটি বেঙ্গলি ক্লাসে নাতি-নাতনীদের ঠেলে পাঠাতে উদ্যোগী নন। কারণ, নাতি-নাতনীরা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে রোমান হরফে কথ্য বাংলায় কথোপকথন চালায়, ইউটিউবে বাংলা সিনেমা এবং মিউজিক ভিডিও দেখে এবং স্কাইপে প্রবাসী, আধা-প্রবাসী বা নন-প্রবাসী আত্মীয়কূলের সঙ্গে বাংলায় কথাবার্তা বলে।

নতুন প্রজন্ম বিদেশবাসী হয়ে বাংলা ভুলে যাবে এই ভয় যেমন ছায়া ফেলেছে প্রবাসী বাঙালির মনে, আবার সেই ভয়ের বিপরীতেই গ্লোবালাইজড ই-দুনিয়ায় নবপ্রজন্মের বাংলা চর্চার প্রভূত অবকাশ তৈরি হয়েছে, যা হয়ত প্রবাসী সঙ্ঘের উইকলি বাংলা ক্লাসের চেয়েও কার্যকরী বাংলার ব্যবহারকে বাঁচিয়ে রাখতে। সুতরাং গ্লোবালাইজেশন বাংলা ভাষাকে মেরে ফেলছে এই মর্মে কান্নাকাটি করা বহুক্ষেত্রেই অমূলক। কিছু নির্দিষ্ট ব্যবহার ক্ষেত্রে (Domain) বাংলা বলা বা ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই বাংলা মিশে রয়েছে নানা স্থানীয় ভাষার সঙ্গে (জার্মান, স্প্যানিশ, কানাড়া, মগহী বা অন্য কোনও ভাষার সঙ্গে)।

আঞ্চলিক বাংলা বলতে আমরা কয়েক দশক আগেও যা বুঝতাম, এখন তার অর্থ পালটে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে বাংলার তথাকথিত ‘উপভাষা’ অঞ্চলের চিহ্নিতকরণ হয়েছে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বাংলা ডায়াস্পোরা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক বাংলার সংজ্ঞাও পাল্টেছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলার মধ্যে দূরত্ব কমার ক্ষেত্রে কমন স্পেসে বাংলা কথাবার্তা চালানোর এক সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ করি না। নিজ অঞ্চলের আঞ্চলিক বাংলা (পোশাকী ভাষায় Lingua Franca) সাবলীলভাবে বলতে পারে অনেকেই। পশ্চিমবাংলা কিম্বা বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্যের আঞ্চলিক বাংলা নানা আঞ্চলিক ভাষার সাথে (যেমন মুন্ডা, সাদরি, মগহী, ওড়িয়া ইত্যাদি) মিশে যোগাযোগের এক কমন ভাষা তৈরি করেছে, তেমনি পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বাংলা বিভিন্ন ভাষার সাথে মিশে যোগাযোগের এক কমন ভাষা তৈরি করে চলেছে। আঞ্চলিক বাংলা সাবলীলভাবে বলতে পারে যে ছাত্রীটি, সেই মুন্ডা বা ওঁরাও মেয়েটিকে ‘ভালো বাংলা’ বলার জন্য শিক্ষিকা চলন্তিকা ধরিয়ে দেন হাতে। সেই শিক্ষিকাই হয়ত আবার বানানবিধির বৃত্তের বাইরে গিয়ে ফেসবুকে ‘লাইক দেন’, মোবাইলে ‘কল দেন’ এবং টুইটারে ‘পোস্ট দেন’। বিশ্বায়নের পৃথিবীতে অন্যান্য দেশের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা আঞ্চলিক বাংলায় কোনও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি, কারণ বাংলা সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা নয় মোটেই।

গ্লোবালাইজড দুনিয়ায় বাংলা কারও ক্ষেত্রেই একমাত্র ভাষা নয়। শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার যে কোনও ব্যবহারক্ষেত্রেই বিরল। অথচ, শুদ্ধ বাঙালিয়ানার গরিমায় ফু্লেফেঁপে শুদ্ধ বাংলার মহিমাপ্রচার চালানো হয় গ্রামের ইস্কুলের বাংলা ক্লাসে। অন্যদিকে তথাকথিত নন-স্ট্যান্ডার্ড ভাষা নীরবে প্রবেশ করে শহুরে ভোকাবুলারিতে। কলকাতার রিয়ালিটি শোতে ঢাকার বাংলা এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে বেশ কিছু বছর আগে, এবং কলকাতার ভাষায় ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। বহু বছর ধরে গড়ে তোলা বাংলার দেওয়াল এভাবেই ভাঙছে। আর এই দেওয়াল ভাঙা বাংলা ই-স্পেসে ব্যবহার করছেন এমনকি মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীও।

উনবিংশ শতকে ব্রিটিশদের হাত ধরে যে বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছিল, তার পক্ষে সওয়াল করার জন্য তৈরি ছিল বাংলা ব্যকরণ, বানানবিধি ও মুদ্রিত বইপত্র। গ্লোবালাইজেশন গড়ে তুলেছে এক নতুন বাংলা, যা কোনও ভাষা অ্যাকাডেমি বা বানানবিধির দাস নয়। এর কারণ, বাংলা ব্যবহারের প্রাত্যহিক স্পেসের কোনও মালিক নেই। কোনও নম্বরকাটা মাস্টারমশাই নেই। সেখানে নতুন বাংলা নিজের মতো চেহারা নিচ্ছে, নানা ভাষার উপাদান মিলিয়ে-মিশিয়ে। গ্লোবালাইজেশন যেমন বহু সোশ্যাল অর্ডারকে ক্রমাগত চুরমার করছে, তেমনি ভাষা কাগুজে নিয়মকে চুরমার করছে নিজ নিয়ম অটুট রেখে।

একের পর এক বাক্য গড়ে তোলার যে ফ্রেম আমাদের মস্তিষ্কে বাস করে, সেখানে আসলে কোনও খবরদারি নেই। তা শুধুই এক অ্যাবস্ট্রাকট ফ্রেম। সেই ফ্রেমে মালমসলা যোগায় চারপাশে শোনা শব্দ, বাক্য, বাক্যাংশ। গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা ধরণের বাক্য আর বাক্যাংশ, তাদের কেউ রিমোট দিয়ে কন্ট্রোল করছে না। তাই গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে বাংলা ভাষা কোনও বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। কমন স্পেসে ব্যবহারের কোন গণ্ডি টানা নেই। গ্লোবালাইজড বাংলা অনেকটা তাসের দেশের মতো। সেখানে কেউ মরাকে বাঁচা বা স্বর্গকে অপরাধ বলতে বাধ্য করে না।

গ্লোবালাইজেশনের সমাজভাষাতত্ত্ব (Sociolinguistics of Globalization) অনুযায়ী বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার সুপার-ডাইভার্স বা বহুবিধ। বাংলা ভাষা এর ব্যতিক্রম নয়। গ্লোবালাইজড পৃথিবী বাংলা টিকিয়ে রাখছে নাকি বাংলা ভাষার সর্বনাশ করছে, এ’কথা ভাষার বহুবিধতার ভিত্তিতে ভেবে দেখা দরকার। ইন্টারনেট আর নানা নতুন মিডিয়া বাংলা চর্চার সুযোগ গড়ে দিচ্ছে। বাংলায় ই-ম্যাগাজিন, রেসিপি পেজ, অনলাইন শপিং সাইট ব্যবহার করছেন অনেকেই। তাহলে মৃত্যুর পথে কি সত্যিই এগোচ্ছে বাংলা? গ্লোবাল দুনিয়ায় বাংলা পালটে গিয়ে যখন নতুন রূপ নিচ্ছে, তখন তাকে কি ভাষা পরিবর্তনের খাতিরে দেখতে পারি না? ভাষার এই পরিবর্তন গড়ে তোলা নাকি ভেঙে ফেলা (progress or decay) তা বুঝতে পারা যায়  বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। যখন কোনও ভাষা সমস্ত ডোমেইন-এ বিলুপ্ত হয়, তখনই তাকে মৃতপ্রায় ভাষা বলা হয়। বাংলার ক্ষেত্রে এ’টি সত্যি নয়।

বাংলা কিন্তু মৃত্যুর পথে এগোচ্ছে না, পরিবর্তিত হচ্ছে কেবল। আসলে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছে একভাষাভাষী বাংলাতন্ত্র, যা বহু দিন ধরে বহু যত্নে গড়ে তোলা। এই বাংলাতন্ত্র অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের বহু গ্রাম্য মানুষকে ব্রাত্য করেছিল এলিটিজমের ধুয়ো ধরে। ‘প্রকৃত’ বাঙালি এলিট আইডেনটিটি যখন মাল্টিপল আইডেনটিটির কাছে হেরে যাচ্ছে সেখানেই আসলে যুদ্ধক্ষেত্রের জন্ম। আইসোলেটেড বাঙালি প্রকৃতপক্ষে লড়ছে গ্লোবালাইজড বহুভাষী বাংলা চর্চার ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে। গ্লোবালাইজড পৃথিবীর প্রতিপক্ষ তাই ‘মনোলিঙ্গুয়াল বাংলা’ নামক অস্ত্র। প্রবাসে দুর্গাপুজো বা পঁচিশে বৈশাখে বাঙালি সেই মনোলিঙ্গুয়াল স্পেসটুকু গড়ে নেয়, যা বছরের অন্যসময় অনুপস্থিত। আবার এই সময়েই আইসোলেটেড বাঙালি গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে পা রাখতে চায় কোনও এক অদৃশ্য স্পিডবোটে চড়ে। সেই স্পিডবোট হতে পারে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনে বাংলা রচনা লেখার প্রতিযোগিতা, কিম্বা কলকাতা আর অন্য মহাদেশীয় শহরের সম্মিলিত পুজো ফোরামের কথাবার্তা।

পৃথিবী জুড়ে একভাষিকতার প্ল্যাটফর্ম ভেঙে পড়ছে যখন, তখন মনোলিঙ্গুয়াল আইডেনটিটি বলেও আসলে আর কিছু থাকছে না। আমরা অনেকেই মনোলিঙ্গুয়াল আইডেনটিটিকে আশ্রয় করে গ্লোবালাইজেশনের বিরোধিতা করছি, অথচ এই সময়েই পৃথিবী জুড়ে বিশ্বনাগরিকতা বা বৃহত্তর আইডেনটিটির ক্ষেত্র জন্ম নিচ্ছে। যে আইডেনটিটি ক্ষেত্র অবশ্যম্ভাবীভাবে বহুভাষী। যে বাবা-মা ওয়াশিংটনে ছেলেমেয়ের সাথে আই-এস-ডি কলে কথা বলে প্রবাসী বাংলার ফিলিং নিতেন সপ্তাহান্তে, তাঁরা এখন দোকানে-বাজারে-বাসে-ট্রেনে অবিরত প্রবাসীর বাংলা শুনতে পারেন হোয়্যাটস্যাপ কলে বা মেসেঞ্জারে। একই বেঞ্চে বসা স্কুলের চার বন্ধুর পরিবারের কেউ থাকেন বিশ্বের চার শহরে। এই চার জায়গার নানারকম ভাষা পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা বাংলা রোজ এক-ই স্পেসে যোগাযোগ চালায়।

বাংলা ভাষাভাষীদের কথোপকথনের স্পেস আর নেটওয়ার্ক — এ নানারকম ধরণ গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাংলার সাথে নানা ভাষার যোগাযোগ বাড়ছে — একদিকে নানা আঞ্চলিক ভাষা, অন্যদিকে গ্লোবালাইজড নাগরিকের ভাষা। কুড়ি বছর আগে বাংলার কোনও গ্রামে যে ছাত্রটি এক লাইন গ্রামাটিক্যাল ইংরিজি লিখতে পারত না, সে এখন মোবাইলে ক্রিকেটের স্ট্রিমিং শোনে ইংরিজিতে। সুতরাং জলে-স্থলে-নভতলে কেউ আর মনোলিঙ্গুয়াল নেই। মনোলিঙ্গুয়াল আইডেনটিটি বলেও কিছু থাকছে না আর।

বহুভাষী বাঙালি তথা বাংলা ডায়াস্পোরার প্রতিনিধি গড়ে তুলছে নানা কথোপকথন ক্ষেত্র। তেমনই এক ক্ষেত্র The Bong Sense-এর Facebook Page-এর থেকে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘How to survive কাজ….. after all কাজ is created by capitalist slave owners to শোষণ us’। এখানে বাক্যের কাঠামো ইংরিজি, তাতে বাংলা শব্দ বসেছে। আবার, ‘যখন তোমার সারাদিনের biggest achievement is bus-এ seat পাওয়া।’ এই বাক্যে কাঠামো এবং কর্তা বাংলার, তাতে বসেছে কিছু ইংরাজী কর্ম। The Bong Sense-এর তরফে The Grumpy Bangali Beral জানাচ্ছে, ‘Yes Bongsense is in Benglish. This is done jaate probashi bangalis and non-bangalis can get a taste of bangaliyana.’ বাঙালি বেড়াল এই বহুভাষী ক্ষেত্রের কথা আমাদের জানাচ্ছে এবং বিভিন্ন স্পেসের বাঙালিকে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে The Bongsense chatroom, app, webpage, facebook page আর instragram-এ।

উপরের উদাহরণের এই ধরণের বাক্য বা বাক্যবন্ধ প্রাত্যহিকভাবে ব্যবহার হয়, কিন্ত কেন? বাক্যের কাঠমোর আসলে কোনও ভাষা নেই, তা অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিমূর্ত। নানা সামাজিক কারণে চারপাশ থেকে শোনা ভাষার টুকরো বাক্যদের সাজিয়ে তুলেছে। গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে এক ভাষায় বাক্য সাজানো লেখার ক্ষেত্রে সম্ভব, দ্রুতগতির কথোপকথনে প্রায় অসম্ভব। কাজের প্রয়োজনে তিন/চারটি ভাষা যিনি ব্যবহার করেন, তাঁর পক্ষে কেবলমাত্র একটি ভাষাই ব্যবহার করা বেশ কঠিন — শব্দ কিম্বা কাঠামোর দুই ক্ষেত্রেই।

সুতরাং ভাষা মিশ্রণ গ্লোবালাইজড পৃথিবীর একটি স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। তা বাংলার ক্ষেত্রেই হোক, বা তামিলের ক্ষেত্রে, স্প্যানিশের ক্ষেত্রে হোক বা ইংরাজির ক্ষেত্রে। আমি যদি জোর করে একশো শতাংশ বাংলা ব্যবহারের শপথ নিই, সেটা অবাস্তব। কারণ একশো শতাংশ বাংলা বলে আসলে কিছু নেই, বাংলা যে নিজেই একটি মিশ্রিত ভাষা, তার স্বপক্ষে যুক্তি দেবার জন্য নীহাররঞ্জন রায় বা সুনীতি চাটুজ্জের শরণাপন্ন হতেই পারি। তাহলে গ্লোবালাইজেশনের বিরোধিতা করতে গিয়ে যখন বাঙালি সত্তাকে শুদ্ধতার নিরিখে অস্ত্র করছি, তখন ঠিক কেমন বাংলা আমাদের অস্ত্র হচ্ছে? কোন সময়ে সেই বাংলা বলা হত? যদি বলি কলকাতার অল ইন্ডিয়া রেডিও–র সম্প্রচারে, তবে সেই বাংলা কোচবিহার টু সুন্দরবন সবাই নিজের ভাষা হিসেবে মেনে নেবেন তো? যদি না নেন, তবে কি রেডিও-র বাংলাও অপরের ওপর শাসন চালানো ভাষা নয়? গ্লোবালাইজড দুনিয়ায় ক’জন-ই বা অল ইন্ডিয়া রেডিও শোনেন? এফ এম-এর ভাষা পপুলার সারা বাংলায়, এফ এম-এর ভাষা কি মনোলিঙ্গুয়াল ভাষানীতি মেনে চলে? মোটেও না। এই একই কথা বাঙালি বেড়ালও বলতে চেয়েছে আসলে।

আরেকটা কথাও এক্ষেত্রে বলা দরকার। অপর ভাষার শাসন নিয়ে কথা বলা যেমন দরকার, তেমনি দরকার অপর ভাষার সাথে প্রাত্যহিক বাংলার মিশ্রণকে পৃথিবীব্যপী যোগাযোগের স্পেস হিসাবে চিহ্নিত করার। কোন পথে ভাষা বদলাবে, সেই পথকে নির্ধারণ করা সহজ কাজ নয়। কোন কোন পরিস্থিতিতে কোন কোন ভাষার সঙ্গে বাংলা যোগাযোগ গড়ছে, সেটাই আসলে নির্ধারণ করে দেয় ভাষার ধরণ। ফ্রম গড়িয়াহাট টু সিঙ্গাপুর, ফ্রম শ্যামবাজার টু সানফ্রান্সিস্কো — কথা আরও বাড়ছে এবং বাংলা আরও বদলাচ্ছে।

বদলাতে বদলাতেই দিব্যি বেঁচে আছে বাংলা ভাষা। কোনও দেশে কোনও ক্ষেত্রেই সেখানে মনোলিঙ্গুয়ালের অধিষ্ঠান নেই। সুতরাং বাংলাকে বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না, বরং নানা সময় আর নানা স্পেসের ভাষাকে উদযাপন করা যায়। এই উদযাপনেরই ফল হল বিশ্বব্যাপী বাঙালির কথা বলার ই-স্পেস, নানা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ। অনলাইন ঠাকুমার ঝুলি যেমন বেঁচে থাকতে পারে, তেমনই বেঁচে থাকতে পারে নতুন বাংলার লাইন, নতুন বাংলায় লেখা গান, সিনেমার ডায়ালগ, রেকর্ডবন্দি এফ এম সংলাপ, টিভি চ্যানেলের তর্কবিতর্ক।

‘কমন কথা বাতিল’ হবে কি না, তার সমন কি কেউ জারি রাখতে পারে?

ঋণ:

Aitchison, J. 2004.  Language Change: Progress or Decay? Cambridge: Cambridge University Press.

Bloommaert, J. 2014. From Mobility to Complexity in Sociolinguistic Theory and Method. Tilburg University: Tilburg Papers in Cultural Studies.

The Bong Sense App.

https://www.sil.org/language-assessment/language-vitality