অভিষেক সর্বজ্ঞ
“সমস্ত পৃথিবী বলছে আমি গোলাকার, কিন্তু আমার পায়ের তলার মাটি বলছে বলছে আমি সমতল। পায়ের তলার মাটির জোর বেশি কেননা সে যেটুকু বলে একেবারে তন্নতন্ন করে বলে। পায়ের তলার মাটির কাছ থেকে পাই তথ্য, অর্থাৎ কেবল তথাকার খবর। বিশ্বপৃথিবীর কাছ থেকে পাই সত্য, অর্থাৎ সমস্তটার খবর।”
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর[[১]]
রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী নন। তাই এই উক্তি বড়জোর একজন বৈজ্ঞানিক বোধসম্পন্ন কুতূহলী বিশ্বনাগরিকের উক্তি, যা প্রধানত প্রকৃতি, পরিপার্শ্ব এবং কিছু সাধারণ প্রতিষ্ঠিত সত্য সঞ্জাত। কিন্তু এই সহজ কয়েকটি বাক্যের মধ্য দিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন সামনে আসে যেগুলি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে মানুষকে ভাবিয়েছে। আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে তথ্য আহরণ করি। সেই তথ্যই কি সত্য? সেই তথ্য কি সব কালে সত্য? সব স্থানে সত্য? সবার কাছেই সত্য? যদি তা না হয় তবে আমরা তথ্যের মাধ্যমে যে জ্ঞান লাভ করি তা কি প্রকৃত জ্ঞান? ব্যাক্তি নিরপেক্ষ জ্ঞান? কোনটা জ্ঞান আর কোনটা নয়? নানা সময়ে মানুষ এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চেয়েছে। কখনও মনের মাধুরীতে কখনও বা যুক্তির তীক্ষ্ণ অসি চালিয়ে। সময় যত এগিয়েছে আপাত আর প্রকৃতর এই পার্থক্য ততই পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। দর্শনের ভাবজগৎ থেকে পৃথক হয়ে বিজ্ঞান স্বতন্ত্রভাবে নিজেকে তুলে ধরেছে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে সুনির্দিষ্ট চিন্তাপদ্ধতি, যার উপর ভিত্তি করে অনবরত চলেছে পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া। এভাবেই গড়ে উঠেছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্র।
মননে বিজ্ঞান, উত্তর সন্ধানের সূত্রপাত
প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ অথবা আধুনিক যুগ। সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনধারণপ্রণালী প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগুলির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও একটি সাধারণ প্রগতিগত মিল আমরা দেখতে পাই। তা হল প্রযুক্তির ব্যাবহার এবং একটি বিশেষ সময়ের পরিসরে প্রযুক্তিবিদ্যার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে যুগ পরিবর্তনের সূচনা। এগোনোর আগে এটুকু বুঝে নেওয়া দরকার যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পূর্ণ এক জিনিস নয়। মানুষ বাঁচার তাগিদে আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি আয়ত্ত করেছে এবং তা করেছে সেই পদ্ধতির বা তার ফলাফলের কোনও সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা না জেনেই বা জানার চেষ্টা না করেই। সে আগুন পেয়েই সন্তুষ্ট ছিল, তার উৎপত্তিগত কারণ নিয়ে ভাবিত হওয়ার কোনও তাগিদ সে প্রাথমিক পর্যায়ে অনুভব করেনি। অর্থাৎ সে প্রযুক্তির সঠিক ব্যাবহার করেছিল কিছুটা অবৈজ্ঞানিকভাবেই। সুতরাং বলা যায় শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রয়োগ বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ করে না। বিজ্ঞানের বিস্তার বাহ্যিক এবং মননিক উভয় ক্ষেত্রেই।
বিজ্ঞানের কার্যকারণ এবং তার উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রথম চেষ্টা করা হয় প্রাচীন গ্রিসে। পিথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস, আনাক্সিমেনেস, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো প্রমুখের হাত ধরে দর্শন, প্রযুক্তি, গণনা, জ্যামিতি প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিতে গ্রিস অভূতপূর্ব উন্নতি করেছিল। সমৃদ্ধ ও স্বচ্ছল প্রাচীন গ্রিসে জীবনধারণের বাহ্যিক সংগ্রামের চিন্তামুক্ত এক নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের উদ্বৃত্ত সময় চিন্তাজগতের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সামাজিক কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। কোনও সিদ্ধান্তে আসার মাপকাঠি হিসেবে সচেতন পর্যবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষিত তথ্যের বিশ্লেষণ করার প্রবণতা এই সময়ই প্রথম দেখা যায়। যদিও কালক্রমে তা গোষ্ঠীভিত্তিক ও subjective আকার নেয়। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে (যেমন ঘোড়া টানলে তবেই গাড়ি চলে) সিদ্ধান্তে এলেন যে বলপ্রয়োগে গতির সৃষ্টি হয় এবং বলই হল গতি সৃষ্টির কারণ। তার এই ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত কোনওরকম যাচাই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে না গিয়ে অনুগামীদের শর্তহীন সমর্থনে তত্ত্বে পরিণত হল। অবাক করা কথা গ্যালিলিও পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এই তত্ত্ব প্রশ্নাতীত ও স্থায়ী ছিল। তবে এটাও ঠিক যে সে সময়ে চিন্তাধারার অগ্রগতি ও তার ব্যাপ্তির বিচারে চিন্তার এই গোষ্ঠীকরণ ছিল প্রায় অবশ্যম্ভাবী। এর জন্য মোটামুটিভাবে দুটি ঘটনাকে দায়ী করা যেতে পারে। প্রথমত সে সময়ে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে কোনও আলাদা সীমারেখা তৈরি হয়নি, ফলে ব্যক্তিগত উপলব্ধি বহু ক্ষেত্রে বিজ্ঞান হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত কোনও সিদ্ধান্তের ঠিক ভুল যাচাই করার জন্য পোক্ত গাণিতিক ভূমি তখন ছিল না। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ক্রমেই বিজ্ঞান ও দর্শনের মূলগত পার্থক্য পরিষ্কার হতে থাকে এবং তা প্রকট রূপ ধারণ করে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূচনা লগ্নে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্র, দর্শন-বিজ্ঞান পৃথকীকরণ
বিজ্ঞান ও দর্শনকে আলাদাভাবে বোঝার এবং চর্চা করার জন্য একটি সীমারেখার প্রয়োজন দেখা দেয় যা তাদের সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক করবে। সীমারেখা টানার এই কাজ শুরু হয় বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) হাত ধরে।[[২]] বেকন সেই অর্থে হার্ড সায়েন্সের লোক ছিলেন না। কিন্তু কোনও চিন্তাকে ব্যক্তিগত গণ্ডি ছাড়িয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতন্ত্রের মাধ্যমেই তা সম্ভব যা তাকে দর্শন, অধিবিদ্যা ইত্যাদি সবকিছু থেকে আলাদা করবে — এই সরল কিন্তু উপেক্ষিত সত্য তিনি বুঝেছিলেন। বেকন প্রস্তাবিত আরোহবাদের (empiricism) মূল কথাই হল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে তথ্য গ্রহণ ও তাকে স্তরে স্তরে সাজিয়ে বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞানলাভ। ডিডাক্টিভ পদ্ধতির মতো এখানে আগে থেকে কোনও ধারণা বা সিদ্ধান্তকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয় না। বেকনের এই প্রস্তাব বহুদিনের জং ধরা স্থবিরতাকে যেন সজোরে আঘাত করল। তবে বিশ্বাসে যে বস্তু মেলায় না সেটা সবাই অত সহজে স্বীকার করতে পারলেন না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে প্রভূত বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়; কিন্তু তা হলেও ধাক্কা দেওয়ার কঠিন কাজটি তিনি করে ফেললেন। উপরন্তু লাভের লাভ এই হল যে ধর্মরক্ষার্থে বেকনের বিরোধিতা শুরু হলে বেকনীয় তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাগুলিও বোঝা গেল। আমরা দেখব বিজ্ঞানের উপর এরকম আক্রমণ অনেক সময়ই শাপে বর হয়ে বিজ্ঞানকেই কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ইতিহাসে বার্কলির (১৬৮৫-১৭৫৩) ভূমিকা ঠিক এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রমিক পর্যবেক্ষণের দ্বারা সিদ্ধান্তে আসলেই কি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব? এটাই ছিল বার্কলির প্রশ্ন। পর্যবেক্ষণ কখনওই ব্যাক্তি ও অবস্থা নিরপেক্ষ নয়। তাই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কখনওই প্রকৃত বাস্তবতায় পৌঁছনো যায় না। যুক্তিটি নেহাত ফেলে দেওয়ার মতো নয়। একটি তিনতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে কারও নিজেকে খুব উঁচুতে, কারও মাঝারি উঁচুতে, কারও আবার বেশ নীচুতে মনে হতে পারে। যতবারই পর্যবেক্ষণ করা হোক না কেন, ব্যক্তিবিশেষে ফলাফল আলাদা হবেই। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রসার নিয়ে কর্মসূত্রে পাদ্রী বার্কলির খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। তাই শুধু এটুকুতেই থেমে না থেকে বার্কলি জ্ঞান সন্ধানের মোহনায় বসালেন কোনও এক অগোচর, অসীম শক্তিমানকে। পরম সত্যকে স্থাপন করলেন ঈশ্বরের চৈতন্যে। এই পাশ্চাত্য মায়াবাদী মতবাদের অবতারণা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রের কাঠামোয় নতুন কিছু যোগ করতে না পারলেও নিশ্চিতভাবে কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন সামনে আনে যেগুলি বেকনীয় পদ্ধতিতন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। আপাত আর প্রকৃতের এই ধাঁধায় অপেক্ষাকৃত দৃঢ় যুক্তি দিলেন হিউম। সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে exact knowledge না বলে probable knowledge হিসেবে দেখালেন। এতে সাপও মরল আবার লাঠিও ভাঙল না। তবে সতত পরিবর্তনের এই ধারণায় জড়বৎ ধর্মের অপ্রাসঙ্গিকতা হিউমের কাছে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যুক্তিহীন, বাস্তববর্জিত প্রচলিত ধর্মীয় চিন্তাপদ্ধতির পঙ্গুত্বকে তীব্র আক্রমণ করে তিনি বললেন “commit it then to the flames for it can contain nothing but sophistry and illusion”.
চিন্তাজগতের এই আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয়। এতদিন প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল সর্বস্থানে সর্বকালে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে। কিন্তু চিন্তার পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে সেই বিশ্বাস আঁকড়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। বেকনের হাত ধরে যে নব্যচিন্তার সূত্রপাত আর নিউটনের হাতে যার পূর্ণতাপ্রাপ্তি সেই বিশ্বচরাচরে ঈশ্বরের কলকাঠি নাড়ার কোনও প্রয়োজন রইল না। নিউটনের গতি ও অভিকর্ষ সূত্রাবলী দ্বারা গাণিতিকভাবেও প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি একভাবে ব্যাখ্যা করা গেল। কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে এনারা প্রায় কেউই ঈশ্বরের অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করলেন না। নিয়ন্ত্রক হিসেবে মানতে না পারলেও ঈশ্বরকে তারা রেখে দিলেন সৃষ্টিকর্তা হিসেবে। তাদের মতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি ঈশ্বর নিয়ন্ত্রণ করেন না ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতি ওনারই সৃষ্টি। আধানাস্তিক এই ধারণাই হল ডীইজম (deism)। প্রাথমিক এই প্রতি-ঈশ্বর ধ্যানধারণাই কালের কোলে ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে বৃহত্তর এক নাস্তিক গোষ্ঠী গড়ে তোলে।[[৩]] শুরু হয় ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ অস্বীকারের প্রবণতা।
আপাত-প্রকৃত, সত্য কী?
“মহাবিশ্বের কোনও একটিমাত্র ইতিহাস নেই, নেই তার কোনও নিরপেক্ষ অবস্থান।”
–স্টিফেন ডব্লু হকিং[[৪]]
হকিং-এর এই উদ্ধৃতির সূত্র ধরেই আমরা পদ্ধতিতন্ত্রের হালের অবস্থা আলোচনা করব। হকিং এক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতন্ত্রের উল্লেখ করেছেন তা হল গঠনভিত্তিক বাস্তবতা (model-dependent realism)[[৫]]। এই পদ্ধতিতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল যে আমরা প্রত্যেকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পরিবেশ থেকে যে তথ্য গ্রহণ করি তার ভিত্তিতে মাথার মধ্যে বিশ্বের একটি মডেল তৈরি হয়। আর যখন এই মডেলের মাধ্যমে আমরা পারিপার্শ্বিক ঘটনাসমূহের (events) ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হই তখন যে মূল ধর্মগুলির উপর ভিত্তি করে মডেলটি গড়ে উঠেছে তা আমাদের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হয়। কিন্তু একটি ভৌত অবস্থার মডেল এক ব্যক্তি (বা ভিন্ন ব্যক্তি) একাধিক উপায়ে গড়ে তুলতে পারে, যেগুলি পৃথক পৃথক মূল ধারণা বা ধর্মের উপর ভিত্তি করে রচিত। এইভাবে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক মডেল দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে বিবৃত করা যায়। এক্ষেত্রে উক্ত মডেলগুলির সবকটিই সমানভাবে বাস্তব। বলাই বাহুল্য যুক্তির এই সূচ্যগ্র তীর ছিল ধর্ম এবং নির্ধারণবাদের (ডিটারমিনিজম)[[৬]] উপর প্রাণঘাতী আঘাত। এখন কেউ যদি বলেন যে তিনি জন্ম থেকে মানুষকে মানুষরূপেই দেখেছেন, বানররূপে দেখেননি। তাই তার মডেল অনুযায়ী মানুষের আবির্ভাব মানুষরূপেই এবং বিবর্তন তত্ত্ব খারিজ করেন তাহলে সেই মডেলও ডারউইনের মডেলের তুলনায় সমানভাবে বাস্তব। তাহলে এই দ্বন্দ্বের অবসান কোথায়! ব্যাপারটিকে একটু সহজ উদাহরণের সাহায্যে ভাবা যাক। ধরা যাক ওই ব্যক্তি একটি মোটরগাড়ি করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় তার কল্পিত দুটি সম্ভাব্য মডেল নেওয়া হল। প্রথম মডেলে তিনি চোখ খুলে আছেন এবং রাস্তা দিয়ে তার বিপরীত দিক থেকে আসা অন্য গাড়িগুলি দেখতে পাচ্ছেন। দ্বিতীয় সম্ভাব্য মডেলে ওই ব্যাক্তির চোখ বন্ধ, তাই তিনি অন্য গাড়িগুলি দেখতে পাচ্ছেন না এবং সেগুলির অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন। এখন প্রশ্ন হল সম্ভাব্য দুটি সমানভাবে বাস্তব মডেলের মধ্যে কোনটি গ্রহণীয়? দ্বিতীয় মডেলে তিনি অন্য গাড়িগুলির অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন ঠিকই, কিন্তু এই মডেল কি তার চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর জন্য অন্য গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম? সক্ষম নয়। কিন্তু প্রথম মডেলটি সক্ষম। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে যেকোনও বাস্তব মডেল পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণে (অন্য কোনও সফলতর মডেলের ভিত্তিতে) সমানভাবে সক্ষম নয়। অনুরূপভাবে বলা যায় ওই ব্যক্তি যে মডেলের ভিত্তিতে বিবর্তন তত্ত্ব খারিজ করছেন তা ফসিল গঠনের কারণ এবং এরকম আরও নানা ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে না।
সুতরাং বেকনীয় তত্ত্বের অমীমাংসিত প্রশ্নগুলির উত্তর আমরা গঠনভিত্তিক বাস্তবতা দিয়ে একরকমভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছি। এবার দেখা যাক পদ্ধতিতন্ত্রের পরিবর্তনে বিজ্ঞান দর্শন কীভাবে পরিবর্তিত হয়। অথবা হয়তো ঠিক উল্টোটা!
ধারার সংঘাত, গুরুচণ্ডালী সম্ভাবনা
রেনেসাঁ লগ্নের পর থেকে বর্তমান সময় অবধি যে বিজ্ঞান দর্শন বিকাশ লাভ করেছে তাকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ধ্রুপদী বিজ্ঞান আর কণাবাদী বিজ্ঞান। এই ধ্রুপদী বিজ্ঞান দর্শন বুঝতে হলে বাস্তববাদ (realism) সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। হকিং-এর ভাষায় “There is no picture or theory independent concept of reality”.
১. বাস্তববাদ কী?
ধ্রুপদী বিজ্ঞান কতগুলি সুনির্দিষ্ট এবং স্বাধীন ধর্ম সম্বলিত একটি বাস্তব বাহ্যিক বিশ্বের অস্তিত্বের ধারণার উপর ভিত্তি করে বিকাশ লাভ করেছে যেখানে পদার্থের বাস্তব অস্তিত্ব আছে এবং তার নির্দিষ্ট কিছু ভৌত ধর্ম বর্তমান, যেমন ভর, গতিবেগ ইত্যাদি। এটি বাস্তব পদার্থ, তার নির্দিষ্ট ভৌত ধর্মসমূহ ও তাদের প্রতি আমাদের ধারণা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এখানে পর্যবেক্ষক আর পর্যবেক্ষিত বস্তু উভয়ই সেই বাস্তব ভৌত জগতের অংশ। এই ধারণাই হল বাস্তববাদ।
২. প্রকৃত বাস্তব বলে আদৌ কি কিছু আছে?
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে উপরোক্ত এই ধারণার সমান্তরাল নতুন এক তত্ত্বের উদ্ভব হয়। দেখা যায় হাইজেনবার্গ, দ ব্রগলি প্রমুখদের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কোয়ান্টাম ফিজিক্স বেশ কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণে সক্ষম। এই তত্ত্ব অনুসারে কোনও বস্তুকণার সুনির্দিষ্ট অবস্থান বা গতিবেগ কোনওটিই থাকতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তা কোনও নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষকের দ্বারা পরিমাপ করা হয়। তাই আমরা একথা কখনওই বলতে পারি না যে কোনও একটি পরিমাপের পর এই নির্দিষ্ট ফল পাওয়া গেছে কারণ ওই নির্দিষ্ট সময়ে তার মান ঠিক তত ছিল। এখানে বাস্তববাদী তত্ত্ব নৃশংসভাবে খণ্ডিত হল। নির্দিষ্ট বাহ্যিক বিশ্বে বাস্তববাদের ধারণার বিচ্যুতি একটি খুব সহজ উদাহরণের সাহায্যে বোঝানো যায়। কোনও ব্যক্তি নিজের ঘরে যদি একটি নিক্ষিপ্ত বস্তুকে সরলরেখায় যেতে দেখে তবে গোলাকার কাঁচের পাত্রে থাকা একটি মাছ কাঁচের মধ্য দিয়ে সেটিকে বক্ররেখায় যেতে দেখবে। সাধারণভাবে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসব যে মাছটি বিকৃত ছবি দেখছে। কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যাবে সেই ব্যক্তির দেখা ছবিটি যে অবিকৃত এমন মনে করার কিন্তু কোনও দৃঢ় কারণ নেই। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে মাছটির বাস্তবতা ব্যক্তিটির থেকে ভিন্ন। আমরা কোনও একটিকে অধিকতর বাস্তব ধরে নেব কোন যুক্তিতে!
৩. প্রতি-বাস্তববাদী (anti-realists) চিন্তার প্রেক্ষিতে এর গ্রহণযোগ্যতা কতখানি?
প্রতি-বাস্তববাদীরা যেমন বার্কলি ও আরও অনেকে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের বিরোধ করতে গিয়ে ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যে সুলভ ভাবনায় এতদূর অব্ধি ভেবে ফেললেন যে মনের কল্পনা ছাড়া আর কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। প্রকৃতপক্ষে তারা বিজ্ঞান থেকে সরে এসে অচেতনভাবে ধর্মীয় পঙ্গু দর্শন ভাবনাকেই আরেক রূপে তুলে ধরলেন। সেই দিক থেকে বলা যায় বাস্তববাদী ঘরানা এক নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত প্রাকৃতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণে কিছুটা হলেও সার্থক। তবে একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি, কণাবাদী বিজ্ঞান দর্শন আর কট্টর অ্যান্টি রিয়ালিস্ট এই দুই তত্ত্বই চরম বাস্তবকে অস্বীকার করলেও তাদের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। প্রথমটি হল একটি সুচিন্তিত চিন্তাপদ্ধতি যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাবলি নিপুণতরভাবে বিশ্লেষণের স্বার্থে বিকাশ লাভ করেছে। মনে রাখতে হবে কণাবাদী বিজ্ঞানের পোক্ত গাণিতিক ভূমি বর্তমান। কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। তার না আছে কোনও যৌক্তিক কাঠামো, না আছে কোনও গাণিতিক সম্পূর্ণতা।
একটা জিনিস এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তার পদ্ধতিতন্ত্র এবং তার দর্শনেরও আমূল পরিবর্তন ঘটে। সেই কারণেই বার্কলি গোষ্ঠীয় অবৈজ্ঞানিক চিন্তার থেকে সম্পূর্ণ স্বন্তন্ত্র সম্পূর্ণভাবে চরম বাস্তব তত্ত্ব খণ্ডিত হয়। পরিতাপের বিষয়, অনেকে এই দুই দর্শনের ফারাক না বুঝে গুরুচণ্ডালি দোষ করে ফেলেন।
বিজ্ঞানীর ধর্ম, বিজ্ঞানের স্বীকারোক্তি
ডারউইন বললেন মানুষের উৎপত্তি নাকি কোটি কোটি বছরের দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে, একদিনের খামখেয়ালিপনায় নয়। তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন বহু বছরের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের পর।[[৭]] তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে পর্যবেক্ষণ যদি আমাদের প্রকৃত জ্ঞান সরবরাহ করতে অপারগ হয় তবে ডারউইনের পর্যবেক্ষণভিত্তিক সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় কীভাবে (এক্ষেত্রে এই প্রশ্ন বিচার করতে হবে ডারউইনের সময়ের নিরিখে, যখন জিনতত্ত্ব যুগান্তকারী সাফল্যে মণ্ডিত হয়নি)? এখানেই চলে আসে বিজ্ঞানের খণ্ডনযোগ্যতার প্রশ্ন (question of falsification)।[[৮]] বিজ্ঞানের পদ্ধতিতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যে সে কখনওই নিজের খণ্ডনযোগ্যতা অস্বীকার করে না। অর্থাৎ কোনও একটি তত্ত্ব ততক্ষণই সার্থক যতক্ষণ না অপর কোনও তত্ত্বের দ্বারা পরীক্ষামূলকভাবে তাকে খণ্ডন করা যায়। সুতরাং ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব ততক্ষণই গ্রহণীয় যতক্ষণ না অপর কোনও তত্ত্ব দ্বারা তাকে খণ্ডন করা যায়। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হল নিউটনের গতি ও অভিকর্ষ সংক্রান্ত সূত্রাবলি। নিউটন পরবর্তী যুগে এই সূত্রাবলি ছিল পদার্থবিদ্যার স্তম্ভস্বরূপ। কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত এই বুনিয়াদী বলয়কে ছারখার করে দিল বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে প্রকাশিত আপেক্ষিকতার বিশেষ ও সাধারণ তত্ত্বের গবেষণাপত্র। বলা হল নির্দেশতন্ত্রের সাপেক্ষে একই বস্তুর গতিবেগ একই সময়ে ভিন্ন হতে পারে তবে আলোর ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। আলোর গতিবেগ নির্দেশতন্ত্র নির্বিশেষে ধ্রুবক। আরও বলা হল আলোও নাকি অভিকর্ষের প্রভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে যা নিউটনীয় সূত্রাবলি ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রমাণও পাওয়া গেল হাতেনাতেই। ১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ ও গণনা করে অভিকর্ষের প্রভাবে আলোর গতিপথ বিচ্যুতির প্রমাণ পাওয়া গেল, সেই বিচ্যুতির পরিমাণও আইনস্টাইনের গননার সাথে হুবহু মিলে যাওয়ায় নিউটনীয় সূত্রাবলি খণ্ডিত হল।
তবে প্রচলিত তত্ত্বের খণ্ডন আর তার বদলে নতুন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা, এই গোটা প্রক্রিয়ায় কিছু সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। তত্ত্বের খণ্ডন যেন যৌক্তিক হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই যৌক্তিক সংশয়বাদ, মের্টনের ভাষায় “organized scepticism”[[৯]] এর শর্ত পূরণ না হলে তার ফল ঋণাত্মক ও সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যেমন ডারউইনবাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার অধিকার একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানের অবশ্যই আছে কিন্তু তার ভিত্তি কখনওই জেনেসিস তত্ত্ব হতে পারে না। বৈজ্ঞানিকভাবে ডারউইনবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন স্টিফেন গুল্ড তাঁর “punctuated equilibrium” তত্ত্বের মধ্যমে যা organized skepticism-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনও প্রজাতি শারীরিক ও জীবনযাত্রার ছোট ছোট পরিবর্তন ঘটিয়ে সামগ্রিকভাবে সুস্থিত থাকে। কোটি কোটি বছরের এই ছোট ছোট পরিবর্তনের ফলে সেই প্রজাতি নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। গুল্ড জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডারউইনবাদের এই তত্ত্বে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন অনেক সময় একটি প্রজাতির মধ্যে আচমকা কোনও নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যা খুব দ্রুত জনসমষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং কোটি কোটি বছরের স্থিতাবস্থা ভেঙে সেই প্রজাতির বিবর্তনে প্রধান ভূমিকা নেয়। তারপর আবার সুস্থিত বিবর্তনের পর্ব চলতে থাকে। একেই punctuated equilibrium তত্ত্ব বলা হয়। লক্ষণীয়, গুল্ড প্রাকৃতিক নির্বাচন মারফত বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সংশয় প্রকাশ করেননি, প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচনের এবং বিবর্তনের ধরন নিয়ে এবং নির্দিষ্ট তথ্য ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে।
সংশয় যদি সুসংবদ্ধ, যৌক্তিক না হয়; যদি তা ব্যক্তি বা দলগত আদর্শের ভারে ন্যুব্জ হয় তবে তার ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে তার বহু উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে।
রুশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ত্রমিফ দেনিসভিচ লাইসেঙ্কো (১৮৮৯-১৯৭৬) “vernalization” নামক এক পদ্ধতির আবিষ্কার করেন যাতে গাছে প্রকৃত সময়ের অনেক আগেই ফুল ধরানো সম্ভব। এর থেকে তিনি হঠাৎ করে সিদ্ধান্তে এলেন যে এই প্রক্রিয়া একবার চালু করে দিলে তা নিজে থেকেই গাছের পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হবে। পর্যাপ্ত পরীক্ষা না করেই তিনি মূল জেনেটিক্স তত্ত্বের বিপরীত এই ধারণা সম্পর্কে প্রচার চালাতে থাকেন। বাইরে থেকে আরোপিত বৈশিষ্ট্য কখনওই বংশানুক্রমে চালিত হয় না। স্টেরয়েডের সাহায্যে বা জিমে গিয়ে যদি কোনও ব্যক্তি দেহে পেশীর আকার বৃদ্ধি করেন তার মানে এই নয় যে সেই বৈশিষ্ট্য তার পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হবে। সেসময় জেনেটিক্সের উপর কাজ করছিলেন আরেক রাশিয়ান বিজ্ঞানী ইভানভিচ ভাভিলভ (১৮৮৭-১৯৪৩)। অচিরেই তাঁর সঙ্গে লাইসেঙ্কোর বিরোধ বাধে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে এর জেরে ১৯৩৭ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব জেনেটিক্স সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। অবাক করার কথা এই যে বৈজ্ঞানিক মতের এই সংঘাতে সোভিয়েত সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতাবান এক অংশ লাইসেঙ্কোকে সমর্থন করে। লাইসেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে তারা হয়তো প্রমাণ করতে চাইছিলেন যে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় যে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই প্রভাবে একটি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক সমাজের গুণাবলী রুশ সমাজে প্রজন্মগত ভাবে সঞ্চারিত হবে, এর জন্য দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রয়োজন নেই। ১৯৪০ সালে নিজের মতে অবিচল থাকার অপরাধে ভাভিলভ গ্রেপ্তার হন। এর কয়েক বছরের মধ্যে সাইবেরিয়ায় চরম অবহেলায় তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত লাইসেঙ্কো তত্ত্ব বলবৎ থাকে। তারপর আবার তিনি সমস্ত পদ থেকে অপসারিত হন। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। জেনেটিক্সের প্রভূত ক্ষতিসাধন এবং সোভিয়েত ব্যবস্থার উপর সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান মহলে তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি করে লাইসেঙ্কো ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন।
ধান ভাঙতে এই শিবের গীত গাওয়ার কারণ এটুকুই বোঝানো যে বিজ্ঞানী যেখানেই আদর্শের অন্ধত্বে মতবাদ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন সেখানেই তিনি সত্যচ্যুত হয়েছেন। বিজ্ঞানের পদ্ধতিতন্ত্র সবসময়ই ব্যক্তিসত্তা ও আদর্শবাদের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। সত্যসাধনার এই পথে প্রায়শই এমন অবস্থা আসে যখন প্রচলিত তত্ত্ব বা পদ্ধতিতন্ত্র দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে সমস্যার যৌক্তিক সমাধান বের করাই একমাত্র পথ। বিজ্ঞানের ইতিহাস এমনই এক নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস, যেখানে জগদীশচন্দ্রের মতে বিজ্ঞানীকে শুধু বহির্বিশ্বের সঙ্গেই নয় নিজের মনের পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলির সঙ্গেও লড়াই করতে হয়। আত্মখণ্ডনের মাধ্যমে বিজ্ঞান এগিয়ে চলে।
টীকা:
[[১]] ‘আমার জগৎ’ প্রবন্ধ। সবুজপত্র পত্রিকা, আশ্বিন ১৩২১ সংখ্যা।
[[২]] উল্লেখ্য পদ্ধতিতন্ত্রের ক্ষেত্রে গ্যালেলিওর (১৫৬৪-১৬৪২) প্রভূত অবদান রয়েছে, তবে তিনি এ সম্বন্ধে আলাদা করে কোনও তত্ত্বের উল্লেখ করেননি। এ ব্যাপারে তাঁর অবদান শুধুমাত্র ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক থেকে।
[[৩]] এ প্রসঙ্গে দানি দিদেরোর বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন ডীইস্ট হল সেই ব্যাক্তি যে নাস্তিক হয়ে ওঠার আগেই মারা গেছে।
The Cambridge Paperback Encyclopedia-তে ডীইজমের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে তা হল: Belief in the existence of supreme being who is the ground and source of reality but who does not intervene or take an active interest in the natural and historical order.
[[৪]] “The universe itself has no single history, nor even an independent existence.”
Single history যে নেই তা বুঝতে গেলে alternative history সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।
বোরের মডেল থেকে পরমাণুর যে ছবি আমাদের চোখের সামনে আসে তা হল অনেকটা সৌরজগতের মতো। তাই সাধারণত ইলেকট্রন বলতে আমাদের মনে খুব ছোট পুঁতি বা বল বা ওরকম কিছু একটা আকার ভেসে ওঠে। কিন্তু দেখা গেল বোরের মডেল অনুসরণ করে বেশ কিছু ফেনোমেনা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। সেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে পাটিক্যাল কনসেপ্টের জায়গায় ক্লাউড কনসেপ্ট ব্যবহার করে কাজ করলে। এই দুই ধারণার মূলগত পার্থক্য হল এই যে ইলেকট্রনকে কণা হিসেবে ধরলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার অবস্থান নির্ণয় করা যায়, নির্দিষ্ট সময় পরে তার ভবিষ্যৎ অবস্থাও গণনা করা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ইলেকট্রনকে মেঘ সদৃশ ধরে নেওয়ায় যেকোনও নির্দিষ্ট মুহূর্তে তার অবস্থান বিস্তৃত অঞ্চলে ব্যাপ্ত থাকে। তাই সেই সময়ে ইলেকট্রনের কোনও নির্দিষ্ট অবস্থান পাওয়া যায় না। যা আমরা পেতে পারি তা হল একটি বিশেষ অঞ্চলে ইলেকট্রনকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই সময়ে অন্য কোনও অঞ্চলে ওই ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা নেই। একথা যদি বোঝা গিয়ে থাকে তবে আমরা ব্যাপারটা মোটা দাগে এইভাবে বলতে পারি যে একই ইলেকট্রন একই সময়ে একাধিক জায়গায় অবস্থান করতে পারে বা সেই সম্ভাবনা অন্তত উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই কোনও ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গেলে আমরা সেই ইলেকট্রনের সম্ভাব্য বহু ইতিহাসের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ইতিহাস নির্বাচন করতে পারি যা দ্বারা সেই ঘটনার সফলতম বিশ্লেষণ সম্ভব।
[[৫]] হকিং-এর লেখা The Grand Design, Bantam books, New York, বইতে এই তত্ত্বের বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
[[৬]] নির্ধারণবাদের (determinism) জন্ম নিউটনীয় যুগ থেকে। নিউটনের গতিতত্ত্বের মাধ্যমে যেহেতু কোনও সিস্টেমের প্রাথমিক অবস্থার ভিত্তিতে তার পরবর্তী অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব হল সেহেতু এরকম এক ধারণার উদ্ভব হয় যে বর্তমান অবস্থা অতীতের অবস্থা দ্বারা পূর্বনির্ধারিত, এবং বর্তমান অবস্থার দ্বারা ভবিষ্যৎ। ল্যাপলাসের ভাষায়–
“We may regard the present state of the universe as the effect of its past and the cause of its future. An intellect which at a certain moment would know all forces that set nature in motion, and all positions of all items of which nature is composed, if this intellect were also vast enough to submit these data to analysis, it would embrace in a single formula the movements of the greatest bodies of the universe and those of the tiniest atom; for such an intellect nothing would be uncertain and the future just like the past would be present before its eyes.” — “A Philosophical Essay on Probabilities (1814)”
নির্ধারণবাদের সীমাবদ্ধতা হল ধ্রুপদী বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে গণনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য অনুপস্থিত থাকায় জটিলতর ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ অবস্থার নির্ধারণ সম্ভব নয়। আর কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিক থেকে এই তত্ত্ব গ্রহণীয় নয় কারণ এক্ষেত্রে মূলগত পর্যায়ে কোনওরকম সূচক নির্ধারণ করা যায় না।
[[৭]] Origin Of Species By The Means Of Natural Selection বইতে ডারউইন বিবর্তনবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁকে আরও আক্রমণাত্মক দেখি যখন তিনি Decent of Man বইতে ঈশ্বরের ধারনাকে জন্মগত না বলে দীর্ঘ সংস্কৃতিগত অভ্যাসের ফল (কু?) বলে বর্ণনা করেন।
[[৮]] অনুমান ও খণ্ডনের নীতির (conjectures and refutations) কথা বললেই উঠে আসে বিজ্ঞানী কার্ল পপারের নাম। যাচাই (verification) করার বদলে পরীক্ষাসিদ্ধতাকেই (testability) তিনি বিজ্ঞানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেন।
[[৯]] রবার্ট মের্টন ১৯৪২ সালে বিজ্ঞানের চারটি আদর্শের কথা বলেন, যথা : universalism, communism, disinterestedness এবং organized scepticism.
উল্লেখ্য, communism বলতে এখানে বিজ্ঞানচর্চায় সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। মার্কসীয় কমিউনিজমের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।
তথ্যসূত্র:
১. ইতিহাসে বিজ্ঞান, জে ডি বার্নাল, আনন্দ প্রকাশনী
২. ভগবানের লেত্তি, আশীষ লাহিড়ী, গাঙচিল
৩. অন্য কোনও সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইন্সটিটিউট
৪. Essays on History of Science, Soumitro Banerjee, Breakthrough magazine
৫. The Grand Design, Stiffen W Hawking, Batman Books, New York.