Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিছক ঘাড়সংক্রান্ত

সোমেন বসু

 

বসে আছে লোকটা। যেখানে বসে আছে, সেটা ঠিক বসার জায়গা নয়। আমার-আপনার মাপে তো নয়ই, অনিল ঘোষের মাপেও নয়। এখানে নিজেকে মোটের ওপর স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পংক্তিভুক্ত করিয়ে আপনার সঙ্গে মাখো করার একটা চেষ্টা করা হল আর কী! সে যাই হোক, লোকটা বসে আছে অনিল ঘোষ নিজের ভাড়াবাড়ি থেকে বেরিয়ে আঁকাবাঁকা গলিপথ হেঁটে এসে তিন মিনিট দূরত্বের যে বাজারখানায় রোজ বাজার করে, তার উত্তরপ্রান্তে পুরসভার যে বড় ভ্যাটটা বানানো, তার পাশে। রাস্তার ধুলো আর ভ্যাটের উপচে পড়া নোংরাগুলোর ওপরেই, থেবড়ে। ভ্যাটের সিমেন্টের দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে। এমনিতে আর খুব একটা কিছু নয়, কিন্তু অস্বাভাবিক হল ঘাড়টা। মাথাটা এমন বেখাপ্পা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে রয়েছে যে মনে হচ্ছে ঘাড়টা নেই যেন। কিন্তু সেও আমার-আপনার এবং অনিল ঘোষেরও মাপে। মৃতদের মাপ জীবিতদের থেকে ভিন্নতর। লোকটা মৃত বলেই হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ, মুখ-নাক-কানের পাশে ঘুরতে থাকা ক’টা ডাগর মাছি কারও তেমন চোখ টানছে না। কিন্তু ঘাড়টা টানছে। অনিল ঘোষের তো বটেই।

পুলিশ এলে হয়তো ঘাড়টা নিয়েই চিন্তিত হত…

–ঘাড়টা দেখেছ? ওতেই বোঝা যাচ্ছে, এটা মার্ডার…
–এরকম একটা পাগল মাতালকে কে মার্ডার করবে স্যার? আর করলেই বা কী!

ঠিক। মানুষটা বেওয়ারিশ। তাই পুলিশ আদৌ এদিক মাড়াবে কিনা তাই সন্দেহ। হয়তো সরকারি ধাঙড় এসে লাশটা নিয়ে চলে যাবে বেওয়ারিশ লাশেদের ঠিকানায়। এই বেওয়ারিশ শব্দটা — কোথাও থেকে আসেনি, স্ব-জাতই — আবার অনিলকে বিরক্ত করা শুরু করল। মশার গানের পর মশার কামড়। ঘাড় থেকে বেওয়ারিশ। অনিল ঘোষ নিজে কী? বেওয়ারিশ? না বোধহয়! বা আধা!

সরে এল ওখান থেকে অনিল ঘোষ। বাজার করতে হবে। গিয়ে পান্তা খেয়ে কাজ। রাজমিস্ত্রির জোগাড়। পাঁচমিশেলি সবজি সবার কাছে। তাই হয়। কিছু আলুওয়ালা থাকে, আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন। শাকওয়ালা, না এরা সাধারণত ওয়ালি, তাদের কাছে কয়েকরকম শাক। এছাড়া সবার কাছে ঘুরিয়েফিরিয়ে সব সবজিই। একজনের কাছে গেল অনিল ঘোষ। এখান থেকে ভ্যাট এবং লাশটার ঘাড়টার তির্যক দূরত্ব। সেই রেখা বরাবর বারদুয়েক তেরছা চাহনি যাতায়াতও করে নিল। অথচ আশেপাশেই এমন দোকান ছিল, যেখান থেকে ওই ঘাড়ের অসীম দূরত্ব। চোখের আর কি! মাঝে কোনও সসীম বাড়িঘর কিছু ঢুকে পড়ে দৃষ্টিপথ আটকে দূরত্বটাকে অসীম করে দিয়েছে বেরসিকের মতো। বেরসিকই মনে হবে এখন অনিল ঘোষের। কারণ সে ওই দোকানগুলোয় যায়নি, এটায় এসেছে। নেশা ছাড়তে চেষ্টা করা নেশাখোর মানুষ যেমন ‘আচ্ছা রাত্তিরে খালি একবার’ গোছের ছাড় রাখে।

বাজার করা আর হল না। শুধু একটু কাঁচালঙ্কা ধনেপাতা নিয়ে ফেরতা গলিপথ ধরল অনিল ঘোষ। ওর এখন দাঁতের ফাঁকে একটা ঘাড় আটকে গেছে। আর মাথায় ছবি। একটার পর একটা। দুধে সর পড়ার মতো। বেচারি অনিল ঘোষ নিরক্ষর রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। ও জানে না, এসব ছবি জমে জমেই গল্প তৈরি হয়।

ধনেশ সরকার আর কনেশ সরকার দুইভাই। কনেশের কোনও মানে নেই, অবশ্য ওদের বাপ-মা ধনেশ মানেও জানত কিনা জানা নেই, তবে কনেশ যে স্রেফ মেলানোর খাতিরে নাম সে বোঝা যায়। কী ভাবছ? মিলিয়ে গণেশ কেন হল না? হবে না। গণেশ সরকার ওদের বাপের নাম, তাই। কিন্তু অমন নাম মিলিয়ে দিলেই তো আর স্বভাবচরিত্তির মিলে যায় না। এদের স্বভাবও বিপরীত। চরিত্র? সেও উল্টোই মনে হয়, তবে ওই মনেই হয়। এমনিতে ওদের এলাকায় মানুষ চরিত্রের বিচারবিশ্লেষণ নিয়ে অত মাথা ঘামায় না, তার ওপর সরকাররা হল আক্ষরিক সরকার। এদের যে কত জমি, এরা নিজেরাও জানে কিনা সন্দেহ। দু-পাঁচশো বিঘা যে হবেই, তাতে তো কোনও ভুল নেই। সেইরকম অগুনতি চাকর-রাখাল-বাগাল। গাঁয়ে আর একজনই আছে, যে সরকারদের সমকক্ষ, না, খানিক বেশিই হবে, সে হল ইসরাইল প্রধান। মহম্মদ ইসরাইল বা ইসরাইল শেখ যা খুশিই হতে পারে, কিন্তু লোকমুখে ওর এটাই নাম — ইসরাইল প্রধান। দূরদূরান্তের লোক ওকে এই নামেই এক ডাকে চেনে। সরকারদের থেকে এর কিঞ্চিৎ এগিয়ে থাকার কারণ ওই শেষের শব্দটাই। ইসরাইল প্রধান — বোধহয় জন্ম থেকেই — গাঁয়ের দাপুটে প্রধান। দাপট মানে যে সে দাপট! সেই যে ওর বাড়ির পুবপারের বিরাট বিলটা, যেটা গোটাটা ওরই, তার শেষ সীমায় সরু নদীটার ওপারে সাঁওতাল পাড়াটা ছিল। কিছু জমিজায়গাও ছিল ওদের। ইসরাইল যখন সেগুলো দখল করতে চাইল… দখলই বলে… যেটুকু পয়সার ভান করা, ও দখল ছাড়া আর কী…! সে সময় সাঁওতালরা প্রথমে বেঁকে বসেছিল। ইসরাইলের ভাই-বেরাদরদের তীর ফির মেরে হাটিয়েওছিল এক-আধবার। তারপরে একদিন বিশাল দল নিয়ে — দল না, বাহিনী বলাই ভালো — মাঝরাতে সব কটা বাড়ি পুড়িয়ে দিল প্রধান। কিছু মরেছিল, কেউ কেউ পালাতে পেরেছিল, আর বাকিরা তারপর থেকে ইসরাইলেরই বাঁধা চাকর হল। তারপর একবার সেই একটা অবাধ্য চাকরকে? তাকে তো ভরদুপুরে কত লোকের চোখের সামনেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল এই ইসরাইল প্রধান। এর নাম দিকে দিকে লোক জানবে না তো কি ঝড়ু রায়ের নাম জানবে? থানাপুলিশের কথা বলছ বুঝি? হ্যাঁ, সে আছে তো! এখান থেকে কাঁচা রাস্তায় সাতাশ-আঠাশ কিলোমিটার গেলে যে গঞ্জটা পড়ে, ওখানেই থানা। পুলিশও আসে বৈকি এখানে অবরেসবরে। ইসরাইল প্রধানের বাড়ি ঘুরতে। এলে সরকারবাড়িতেও একটা ঢুঁ মেরে যায় অবশ্য। ব্যস্ত না থাকলে প্রধানও যায় সাথে।

কনেশ সরকারের স্বভাবের মিল দাদা ধনেশের সাথে নয়, বরং ইসরাইল প্রধানের সাথেই বেশি। সদ্যোজাত শিশুর ব্রহ্মতালুতে হাত দিলে যেমন তলতলে ঘিলুর স্পন্দন অনুভব করা যায়, তেমন করে যদি গ্রামের ওপরের খোলস ভেদ করে ঐ তলতলানিতে পৌঁছনো যায় শুনতে পাবে ইসরাইলের বাপই নাকি কনেশেরও বাপ। তবে সে ওই সদ্যোজাতর অশক্ত খুলি। গ্রামসমাজ শিশু নয়, করোটি শক্তপোক্ত কাজেকাজেই। যেটা বলছিলাম… স্বভাব। চাকর রাখালদের চাবুক কি বাবলার কাঁটা ডাল দিয়ে পেটানো, খেতে না দেওয়া, এসব কনেশ সরকারের রুটিন কাজ। একদিন তো এক বুড়ো চাকরকে খেতে না দেওয়ার শাস্তি দিয়েছিল। তা ওর বৌ লুকিয়ে লুকিয়ে চাট্টি ভাত এনে দেয় তাকে। লোকানো কাজ লোকানো থাকে না। এই দোষে নিজের বৌকে গাছে বেঁধে চাবকেছিল কনেশ। খাওয়া বন্ধ ছিল মেয়েটার রাতে। সেও এক জোতদারের বেটি। কিন্তু হলে কী হবে, বেটি তো! ধনেশকে বরং এসবে দেখা যায়নি কখনও। গ্রামে তার পরিচয় মিষ্টি জোতদার বলে। মুখে বাপই ছাড়া কথা নেই…

–ধানগুলো বেশ করে মাড়া হয়েছে তো বাপই? দেখিস বাপ, একটা দানাও যেন বাদ না পড়ে…
–বেশ বেশ… কাজ তো নাই আজ আর… আহা! ওই দেখ বাপই, ছাগলগুলো কেমন ভ্যাভাচ্ছে! অবলা জীব! দে না বাপই কটা কাঁঠালপাতা কেটে…

চোখে দেখা আর কানে শোনা হিসেবে তিন বিঘে জমি। মাপজোক বড় মানুষদের কাজ। ঝড়ু রায়রা এরকম চোখে দেখেই জমি মাপতে শিখেছে জ্ঞান হওয়া ইস্তক। জ্ঞান হওয়া ইস্তক জমির সাথেই তো সব বাঁধাছাঁদা। নাড়া কাটা, আগাছা কামানো থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে রোয়া বোনা কাটা মাড়া। কত বয়স হবে ঝড়ু রায়ের? এক কুড়ি হয়েছে কি? কে জানে? হবেও বা। বাপ-মা ছিল চাকর। সরকারদের। কবে কীভাবে হয়েছিল… ওর বাপ-মাই হয়েছিল, নাকি তারও আগে দাদা-দিদিরা… সেও ঝড়ু রায় জানে না। সরকারদের দুনিয়ার মধ্যে একটা টুকরোয় লাইন দিয়ে কিছু ঝুপড়ি তোলা ওদের বাঁধা চাকরদের জন্য, তারই একটাতে থাকত ও আর ওর বাপ-মা। সকাল থেকে মাঠে যেত সবাই, ঝড়ু রায়দের বয়সি ছেলেপুলেদের একটা দল ছিল, ওরা যেত ছাগল নিয়ে। তারপর সারাদিন কাটিয়ে বিকেল হতে খেয়েদেয়ে ঘরে ফিরে সন্ধে নামতে না নামতেই ঘুম। খাওয়া মানে হঠাৎমটাৎ ভাত, আর বেশিদিনই ভাতের মাড়। সে মাড়ও একেকদিন খুব কম। ধনেশ সরকার বেরিয়ে বলত, “বাপই, গরুগুলা আজ অনেকটা মাড় খেয়ে নিয়েছে… একটু কষ্ট করে খাও আজ…!” তখনও হাইলডিং চাষটা শুরু হয়নি। এক একরাত অন্যরকম হত। সেদিন বাপ ফিরত একটু বেশি রাতে। এসে ওর পাশে শুয়ে পড়ত, আর চোলাইয়ের ঝাঁঝালো গন্ধে ছোট্ট ঝড়ু রায়ের ঘুম ভেঙে যেত। একটু ভয়ে ভয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে দেখত বাপ শুয়ে শুয়ে আর মা বাপের পাশে বসে বসে কাঁদছে নিঃশব্দে। অন্ধকারেও দেখা যায়, যাদের অভ্যাস আছে তারা জানে। দেখত, মা বাপের পিঠে কি একটা মালিশ করে দিচ্ছে। একটা ক্বাথ মতো জিনিস, ঘাসপাতাজড়িবুটি দিয়ে বানানো। কী কী দেয় সে বুড়োবুড়িরা জানে। মালিশ করলে ব্যথার আরাম হয় খানিক। আর একেক দিন… সেদিনগুলোতে ছোটবাবু, মানে এখন ঝড়ু রায়ের কাকা… পাশের সাঁওতাল ঘরগুলোতে আসত দারু খেতে। ঘরে না, এসব ঝুপড়িতে কনেশ সরকার ঢুকত না। পাশেই কনেশের একটা দালানঘর তোলা ছিল, আছে এখনও, দারুঘরা, আসত সেখানে। সেদিনগুলোতে বাবা ঘরেই বসত চোলাইয়ের বোতল নিয়ে। ভয়ে ভয়ে মটকা মেরে শুয়ে থাকত ছোট্ট ঝড়ু রায়। আর মাঝেমাঝে পিটপিটিয়ে দেখত বাবার দড়িপাকানো পেশিগুলো যেন বেশি ফুলে ফুলে উঠছে। কপালের দুপাশে রগদুটো দপদপাচ্ছে, চোখগুলো চুলায় দেওয়া জ্বলন্ত কাঠের মতো লাল…। মা থাকত না সে সময় ঘরে। ফিরত রাত করে। কাঁদতে কাঁদতে…।

এই দিনলিপি মেনে বড় হয়ে ওঠা ঝড়ু রায় আপাতত এই তিন বিঘে জমির পশ্চিম আলে একটা শিমুলগাছে ঠেস দিয়ে বসে জমিটা, জমিতে বেড়ে ওঠা সবুজ ধানগাছগুলো দেখছে। ধানগুলো কামাতে হয়। পায়ের ধারে পড়েও আছে কালাইটা। কিন্তু ঝড়ু রায়ের মন নেই তাতে। আলগোছে মাঝেমাঝে হাতটা চলে যাচ্ছে বাঁ গালে, মশাটশা নেই যদিও। চোখগুলো লাল ঝড়ু রায়ের। সেই ওর বাপের চোখগুলো যেমন হত।

প্রধানদের সঙ্গে সরকারদের সখ্যতা ছিল বরাবরই। গ্রামের বুড়ো মানুষরা, খুব কম এরা… নেই-ই প্রায়… বুড়ো হতে না হতেই টপটপ মরে যায় কেমন লোকগুলো… বলতে পারবে সকালবেলার কাজের তদারকি, চাকর পেটানো, খাওয়াদাওয়া সেরে ইসরাইলের বাপ চলে আসত এই সরকারদের আঙিনায়। গণেশ সরকারেরও ততক্ষণে সারা হয়েছে ওই কাজগুলো… কাজের তদারকি, চাকর পেটানো, খাওয়াদাওয়া। গণেশের বাড়ির ভেতর থেকে খাটিয়া আসত, তারপর ওর বৌ, দুটো হুঁকো আর জল হাতে নিয়ে। বৌকেই ওগুলো নিয়ে আসতে হবে তার কোনও মানে ছিল না, সরকারবাড়িতে তো আর চাকরবাকর কম পড়েনি, কিন্তু তাও বৌটাই আসত। এটা ছোট বৌ গণেশের, বয়সে ওর থেকে অনেকটাই কাঁচা, বড় বৌটাও থাকত বাড়িতেই, সে নাকি বাঁজা বলে এই দ্বিতীয় বিয়ে। সে যাক গে, তারপর এক লুঙ্গি পরা আর এক ধুতি পরা বুড়ো হুঁকো খেতে খেতে দেশদুনিয়া নিয়ে আলোচনা করত…

–তোর ঘোড়াটা বেশ চকচকা আছে। আমায় এবার একজোড়া কিনতে হয়…
–কত করে চলছে এখন দাম? জানো কিছু?…

–বাসন্তীপুরে বলে অনেক দূর থেকে যাত্রার দল এসেছে রে? যাবি নাকি?
–চ, ঘুরে আসি… আমিও শুনলাম সেদিন হাটে।…

–তোদের ওই পাহান চাকরটার বৌটা তো বেশ ডাগর… খেয়াল করিনি অ্যাদ্দিন!
–হুঁ, সবদিকেই ডাগর…
–বলিসও না! ডাকিস পরদিন…

ইসরাইল প্রধান আর ধনেশ-কনেশের মধ্যেও সদ্ভাবই ছিল। এরকম রোজ আড্ডা মারতে বসা হত না আর। তার মূল কারণ ইসরাইলের প্রধানি। নিজের বাড়ির দাওয়াতে বসেই যে কাজটা চালাত ইসরাইল। পঞ্চায়েতেও ভোট হবে, পার্টিরা ভোটে দাঁড়াবে, ঝড়ু রায় বলে একটা পদবী পাবে ভোটের খাতায় নাম তোলার জন্য… সেসব আরও কদিন পরের কথা। আর তখনই বোঝা যাবে সরকার আর প্রধানদের মধ্যে যতটা সদ্ভাব দেখা যেত, আসলে ততটা নেই।

জ্ঞান হওয়া থেকেই মাঠে কাজ করেও মাঠের সাথে কোনও আত্মীয়তা হয়নি ঝড়ু রায়ের। নাড়ীর টান তো দূরের কথা, রোজ সকালে দাঁতন করার জন্য দাঁতনের প্রতি যে অভ্যাসের টানটা হয়, কোনওদিন দাঁত না ঘষলে যে টানটা মনে করিয়ে দেয় যে আজ দিনটার সব ঠিকঠাক নেই, সেরকম কোনও টানও নেই। বরং জমি ঝড়ু রায়ের বিরক্ত লাগে। যেসব দিনগুলোতে একটু দূরের মাঠে কাজ থাকে, আর কাজ খুব থাকে না, সে দিনগুলোতে ও দিব্যি ফাঁকি মেরে নেয়, কোনও অসুবিধা হয় না। এমনই তো হওয়ার কথা! যতই খাটো, জিনিস তো অন্যের… তাতে টান কেনই বা হবে, আর হলেই বা কী! কিন্তু তাও কৃষকদের এরকম একটা টান হয়! ওই যে সরকারদের জমির পশ্চিম সীমান্তে সরু নদীটা, তার ওপারে একটু জঙ্গল মতো জায়গা, সেখানে একটা তুরীটোলা আছে। ওদিকের জমিতে গেলে ঢুঁ মারে মাঝেমাঝে ঝড়ু রায়। রাতের খাওয়াদাওয়ার পরও গেছে দু-চারদিন, তবে সারাদিন খাটাখাটনির পর তখন আর গতর দেয় না। তা ওখানে কেউ চাকর নয়। জমিজায়গা নিজেদের নেই এক ছটাকও, ওই জনমুনিষ খাটে সরকার বা প্রধানের ভুঁইতে। ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছে ঝড়ু রায়, এক-আধ বিঘে নিজের জমির কথা ভাবে সবাই। ঝড়ু রায় কোনওদিন ভাবেনি অমন। চাকর বলেই বোধহয়। ভাবনাও খাবারের মতো। সবার মাথায় সব সয় না।

কিন্তু থাকে কি? ভাবনা? লুকিয়েচুরিয়ে? অবচেতন যাকে বলে? ঝড়ু রায় এসব জানে না, জানার কথাও নয়। সে বাদ দাও। ও তো ও যে রায় সেটাও জানত না। ঝড়ু রায়রা জাতে তুরী। ঢাক বাজানো এদের জাতব্যবসা। কিন্তু সে বাজনা তো পরব-সরবে। সম্বৎসর তো নয়। তাই চাষীই সবাই। আর ঝড়ু রায়দের তো ও সব জাতব্যবসা মনে থাকারও কথা নয়। ওকে ধরলে তিন পুরুষ চাকর খাটছে ওরা সরকারদের। ওদের জাতের ভাষাটাও যেমন ঝড়ু রায় বলতে পারে না ঠিকঠাক। ওই তুরীটোলায় গিয়ে শুনেছে ভাষাটা। এখন মোটের ওপর বুঝতে পারে। ফিকে হয়ে আশা স্মৃতিতে ঠাহর পায় ছোটবেলায় মা-বাপকে বলতে শুনেছে বটে এই ভাষা। সে যাক গে, এই যে আগেরবার সব তোড়জোড় পড়ল, নাকি সবার নাম তুলতে হবে ভোটার লিস্টে। পঞ্চায়েত ভোট হবে, জীবনে প্রথমবার। চাকর ঝড়ু রায় থেকে মালিক কনেশ সরকার, সবারই এক ভোট। আর সবার ভোটেই নেম্বার হবে… প্রধান হবে…! তখনই চাকর ঝড়ু ঝড়ু রায় হল। সরকারি বাবুরা বলল,

–কোন জাত তোর? তুরী? তুরী মানে কি পাহান?
–না না পাহান না, এরা তুরীই। হাড়িদের কোনও ব্রাঞ্চ হতে পারে।
–সে মরুক গা। কিন্তু টাইটেল কী হবে? তুরী?
–উফ! রায় করে দিন। এরা রায় লেখে। কিছুই জানেন না দেখি…
–হ্যাঁ সব গুষ্টির জাত…. ইত্যাদি।

তা ঘটনা হল, কয়েক মাস ধরে এই তিন বিঘা ভুঁইকে বড্ড ভালোবাসছে ঝড়ু রায়। এত ভালোবাসছে যে আমাদের ওসব অবচেতনের তল্লাশ করতে হচ্ছে। দুমাস আগে যখন বিয়েটা ঠিক হল ওর ওই তুরীপাড়ার শহীদের বোন মীনার সঙ্গে, তখন ঝড়ু রায়ও ধন্দে পড়ত এই নিয়ে। কার ওপর টান বেশি ওর, মীনা, না এই তিন বিঘা? এখন যখন, মানে এই দিনচারেক হল মীনা এসে ওর সাথে থাকা শুরু করেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মীনার পাল্লাটা ভারি। আর ঠিক এই মুহূর্তে? যখন ঝড়ু রায়ের চোখদুটো লাল আর গালটা চিড়বিড় করছে? এখন তো ওর এই হালকা হালকা শিষ বেরনো সবুজ লকলকে ধানগাছে ঢাকা জমিটাকে ডাইনি মনে হচ্ছে! ধনেশ সরকারের পোষা ডাইনি!

সেদিন সন্ধেবেলা রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে লাঠিটা হাতে নিয়ে কনেশ সরকার বেরিয়েছিল নিজের ঘর থেকে। গন্তব্য চাকরবস্তিতে ওর ঘর। দেখেছিল দাওয়ায় চেয়ার পেতে বসে এক মনে হুঁকো টানছে দাদা ধনেশ সরকার। সামনে একটা খালি চেয়ার রাখা। জরুরি আলাপ থাকলে এটাই ধনেশের ধরন। ঝড়ু রায়ের বাপকে যেদিন সন্ধেয় নেশার ঝোঁকে হাতের লাঠিটা দিয়ে ঘাড়ে এক বাড়ি মেরে মেরেই দিয়েছিল কনেশ সরকার, তার সেদিন রাত করে এমনভাবেই বসেছিল ধনেশ। ওই ঘটনাটা নিয়ে একটু শোরগোল হতে পারত। সময়টা ভালো ছিল না। ঠেকানো গেছিল।

–আজ হাটে সুরেশ মাস্টারের সঙ্গে কথা হল অনেক…
–হাটখোলার সুরেশ মাস্টার?
–হুঁ!
–কী কথা?
–দেশদুনিয়ার পরিস্থিতি ভালো নয়। টের পাচ্ছিস কিছু?
–ওই নস্কালদের কথা বলছ? ওরা তো আমাদের এদিকে ঢুকতে পারেনি! আর এখন তো সাড়াশব্দ কমেও গেছে…
–কমা মানেই শেষ হওয়া নয়!
–আরে তুমি ও নিয়ে ভেবো না! আমার লোকজন আছে তো! একটু দারু আর মুরগা খাইয়ে দিলেই ওরকম দশ-বারোটা নস্কাল বুঝে নেবে!
–গজুয়ার মতো কথা বলিস না! এই হল তোর দোষ!

ঘাড় গুঁজে যায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ কনেশ সরকারের।

–রাজ্যে ওলটপালট হয়েছে খবর রাখিস?
–জানি তো! ইসরাইলের দল হেরে গেছে।
–তারপর?
–কী তারপর? কলকাতায় কোন পার্টি কী করল, ও দিয়ে আমাদের এখানে কী হবে??
–হুঁ! কিছুই জানিস না! পঞ্চায়েতে এবার ভোট হবে, জানিস? ভোটার লিস্টের কাজ শুরু হবে। চাকরবাকর সবার ভোটে নাম উঠবে। সবার ভোটে নেম্বার প্রধান হবে। জানিস এগুলো?

কনেশ চুপ। চাষের কাজকর্ম দেখা, মাঠে চাকর পেটানো, ঘরে বৌ পেটানো, আর মাঝেমাঝে রাতে ওর দারুঘরায় গিয়ে কারও ডাগর বৌ পেটানো, ধামসানো ছাড়া ও আর কিছু সত্যিই জানে না। আগেরদিন দুখুর পুতুটা…

–শোন, অবস্থা সুবিধের না। একটু কায়দা পাল্টাতেই হবে। এর আগে ধান কাটা ইসরাইল আটকে দিয়েছিল দাপট দেখিয়ে। নস্কালরাও এদিকে ভালো ঢুকতে পারেনি, ঢুকলে কী হত বলা যায় না! ইসরাইল কাটা পড়তই! ও নস্কালদের টার্গেট ছিল বলেও শুনেছি। সে যাই হোক, নিজেদের জায়গাজমি ক্ষমতা সব বাঁচাতে গেলে এখন আর ওরকম দাপট দেখিয়ে চলবে না, খাতির দেখাতে হবে…
–ওই তোমার মতো বাপই বাপই?? ও আমার দ্বারা হবে না!
–সে সব করতে হবে না তোকে! আমি যা বলছি তুই তাই শোন…

দাদার কথা শুনতে শুনতে আর দুখুর পুতুর কথা মনেও পড়েনি সেদিন কনেশ সরকারের। বাপরে! দাদা বুদ্ধি ধরে বটে। নতুন পার্টি, যারা গরীবের পার্টি, একটা ভালো লোক খুঁজছিল এই এলাকায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর জন্য। ধনেশ সরকার আদর্শ। সে মিষ্টি জোতদার। জোতদার বটে, কিন্তু সে আর কী করা যাবে! জোতদার ছাড়া আর লেখাপড়া জানেই বা কে? একটা নেম্বার বা নেতা হতে গেলে দুটো বিদ্যে তো থাকা দরকার পেটে! সুরেশ মাস্টার সেদিন আরও বলেছিল ধনেশ সরকারকে, যে এর পরে জমি কত রাখা যাবে সেসব আইনও আসছে! তাই আগে থেকেই পার্টিতে ঢুকে সব বন্দোবস্ত করে রাখা ভালো। নইলে পরে বিপদ হবে।

ইসরাইল প্রধান মানতে পারেনি হারটা। মানা কষ্টকরও, বললামই তো জন্ম থেকেই বোধহয় প্রধান ইসরাইল। মানুষ যেহেতু ভুলেই মেরে দিয়েছিল ওর আগে মহম্মদ না পরে শেখ, তাই হারার পরেও লোকমুখে ও ইসরাইল প্রধানই রয়ে গেল। কিন্তু সে থাকা কি আর থাকা। বরং লোকে ছড়া কাটাও শুরু করল, ‘আবাদ জোর, কিন্তু নাই রে ধান/তার নাম ইসরাইল প্রধান’! ধনেশ সরকার অবশ্য, কনেশ সরকারও, অনেকবার প্রধানকে বুঝিয়েছে যে এ নেহাতই কৌশল একটা। জমি বলো, দাপট বলো, সবই প্রধানের থাকবে আগের মতোই! শুধু কতগুলো কায়দা করা। পার্টিটা বদল করে নিতে হবে, সিলিং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর জন্য সরকাররা যেরকম কায়দা করছে, সেরকম একটু করতে হবে… এই। কিছুই কানে দিল না গোঁয়ার প্রধান। একবার শেষ চেষ্টা করেছিল গ্রামের মুসলমানদের উসকিয়ে একটা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগানোর। কিন্তু যখন সে উসকানি মুসলমানরাই খেল না খুব একটা, তখন চুপ করে গেল একবারে। ধনেশ সরকারের মনে একটাই খিঁচ থাকল। ইসরাইলের মতো প্রধান হওয়া হল না ওর। স্রেফ নেম্বার। প্রধান হাটখোলার সুরেশ মাস্টার। আগে থেকে ঢুকে বন্দোবস্ত করে রেখেছিল মাস্টার।

তাও এসব তো হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর। পঞ্চায়েত অফিস তৈরি হল, জমির সিলিং আইন আসল, ভেস্ট খাস জমিতে পাট্টা দেওয়া চালু হল, ইসরাইল প্রধানের হার্টের ব্যামো ধরা পড়ে লোকটা পঙ্গু হয়ে গেল, ধনেশ সরকার সব বুদ্ধি শিখে এসে তাড়াতাড়ি উকিল ডেকে দলিলের পর দলিল বানাতে লাগল… বাড়ির বৌ মেয়ে তো বটেই, দেখা গেল এক-আধটা পুরনো গরুর নামেও কিছু জমির দলিল হয়েছে… সব দলিলগুলোই অবশ্য থাকল সরকারদের সিন্দুকে, দলিল আর তার সাথে দু-একটা পাট্টাও… ওই যে টুকটাক কিছু জমি ভেস্ট হওয়া ঠেকানো যায়নি, সেগুলোর… যারা পাট্টা পেয়েছে, মানে ধনেশ সরকারই ঠিক করে দিয়েছে কে পাবে, তারা আর কী বোঝে এইসব কাগজপত্রের… তাই শুভাকাঙ্খী হিসেবে ধনেশ সরকারই রেখে দিল সেগুলো নিজের কাছে, জমিতে চাষবাস যেমন চলছিল কিছু ইতরবিশেষ সমেত তেমনই চলতে লাগল, হাইলডিং চাষ শুরু হল, মানুষের ভাতের অভাব মিটল অনেকটাই, দিকে দিকে জাঁকিয়ে বসল ধনেশ সরকারের মতো মিষ্টি জোতদাররা, যাদের মিষ্টত্ব কম ছিল তারা রীতিমতো পার্টি অফিস বা পঞ্চায়েত অফিসের কোচিং ক্লাসে গিয়ে সেসব অর্জনে ব্রতী হল, আর যারা পারল না সেই ইসরাইল প্রধানরা পঙ্গু হতে লাগল, বাংলার গ্রামাঞ্চলে ভূমিসংস্কার হয়ে গেল…

এই তিন বিঘা ভুঁইয়ের সঙ্গে ঝড়ু রায়ের আশনাই শুরু তখন থেকেই…

বাপ একদিন রাতে আর ঘরে এল না। ঘুমিয়ে পড়েছিল ঝড়ু রায়। পরদিন নানা হুটোপাটির মধ্যে ভালো বোঝেনি। শুধু শুনল ওর বাপ নাকি দারু খেয়ে দারুর ঘোরে ওই উত্তরের জঙ্গলবাড়িতে পড়ে মরে গেছে। এমনিই। পড়ে মরে গেছে। মা কাঁদছিল। দুপুরে নদীর পাড়ে শ্মশানে যাওয়া হল। বড়বাবু এসেছিল সেখানে, ধনেশ সরকার। ওখানেই ঝড়ু রায়ের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘বাপইরা সবাই শোনো, আজ থেকে এই ঝড়ু আমার ধরম বেটা। আমি দেখাশোনা করব ওকে।’ সেই থেকে বড়বাবু ওর বাপ, ছোটবাবু কাকা। গ্রামের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় এই ধর্মসম্পর্কগুলো আসলের মতোই স্ট্যাটাস পায়। উপরেউপরে তো বটেই। ধনেশ সরকার অবশ্য যাতায়াত শুরু করল ঝড়ু রায়দের ঝুপড়িতে। সপ্তাহে তিনদিন-চারদিন। সন্ধের পর। ঘরটাকেও ঠিকঠাক করে দিল। ঝুপড়ি থেকে ঘর। লোকজন বলল ছেলের টান। আর বলল মঙলুর বিধবা বৌটার টান। দুটোই ফিসফিস করে, দ্বিতীয়টা বেশি। মা অবশ্য আর বেশিদিন বাঁচেনি ঝড়ু রায়ের। একদিন ঘুমের মধ্যেই মরে গেল! পাশের ঘরগুলোকে ঝড়ুকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিল তখন ধনেশ সরকার। ‘ও কিন্তু আমার ধরম বেটা। মানে বেটাই এক কথায়। ওর যেন কোনও অসুবিধা না হয় দেখবি!’ না বললেও দেখতই। একটা ন-দশ বছরের ছেলে বাপ-মা মরে একা রয়েছে, আর তাকে প্রতিবেশীরা দেখছে না, এরম শহরের পুরনো পাড়াগুলোতেই হয় না প্রায়, তো গ্রামে! লোকগুলো মিটমিট হেসেছিল ধনেশের কথা শুনে। আর শীতের রাতে আগুন পোহাতে পোহাতে গল্প করেছিল মিষ্টি জোতদার কেমন ‘বেটাই এক কথায়’ বলে গেল! দুই কথা… তিন কথা… কবে হবে?!

সন্ধের মুখে ডেকেছিল ধনেশ সরকার। তলব নয়, ডাক। ঈশারাও বলা যায়। মাঠ থেকে ফিরছিল তখন ঝড়ু রায়। বেলাটা মরে এসেছে প্রায়। বাঁশথোপটার এখানে হাগতে-টাগতে না এলে কেউ থাকে না। বড়বাড়ির কারও থাকার তো প্রশ্নই নেই। ঘন বাঁশঝাড়, দুপুরেও আলো ঢোকে না। এটা ঝড়ু রায়ের ঘরে ফেরার পথ। ধনেশ সরকারকে দেখে চমকে গেছিল ও। তাও আবার একা…

–এদিকে শোন একটু বাপই…
–বাবা, আপনি এখানে?!
–কেন? বাপ বেটার কাছে আসতে পারে না!
–না না তা কেন?… অবাক লাগছিল ঝড়ু রায়ের। কিছুদিন ধরেই ওর চারপাশের দুনিয়া কেমন টাল খাচ্ছে যেন! কিন্তু আজ আবার কী?

একটা আলের ওপর বসেছিল গিয়ে ধনেশ সরকার। ঝড়ু রায় মাটিতে, ধরম বাপের পায়ের সামনে।

–পশ্চিম ভিটেয় আমার যে তিন বিঘা মাটি আছে, কেমন ওটা?

কেমন মানে? ঝড়ু রায়ের দুর্বোধ্যতা বাড়তে থাকে।

–ওই ভুঁইটা তোর নামে করে দিলাম, বুঝলি?

না। বুঝল না। খালি বলল…

–আমার নামে?!!!
–হ্যাঁ রে বেটা, তোর নামে। তুই আমার বেটা তো, নাকি? কাগজপত্তর সব করা হয়ে গেছে। ও আমার কাছেই রয়েছে। থাকুক। তোর কাছে থাকলে কোথায় না কোথায় হারাবে। তুই এই দু হাজার টাকা রাখ। ওখানে তো হাইলডিং করি না আমরা। তুই লাগা। ও তোর জমি এখন। ধান তোরই হবে…

বিমূঢ়ের মতো হাত বাড়িয়ে ধনেশ সরকারের ধুতির কোঁচ থেকে বের করে দেওয়া টাকাগুলো নিয়েছিল ঝড়ু রায়। কী হচ্ছে, সেটা তখনও অব্ধি ওর কানই রেকর্ড করেছে কেবল, মাথা শোনেনি।

–আর হ্যাঁ, এ কথা যেন কাকপক্ষীতেও না জানে। দিনকাল অন্যরকম এখন, বুঝিসই তো! কতরকম দাবিদার খাড়া হয়ে যাবে জানাজানি হলে!

ধনেশ সরকারের হিলহিলে শরীরটা অন্ধকারে সাপের মতো মিলিয়ে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়েছিল ঝড়ু রায়। তারপর ঘরে ফিরেও ঘোর কাটেনি। রাতে ঘুম আসেনি। পরদিন ভোর হতে না হতেই ছুটে এসেছিল এই ভুঁইবাড়িতে। হেউতির নাড়াগুলো রয়ে গেছিল তখনও… এই শিমুলগাছটা পাশে… রাতের শিশির গায়ে মেখে শুয়েছিল জমিটা। ওর জমি! নিজের জমি! একদম কাগজপত্তর করা জমি! এ জমিতে যা হবে, তা ওর একেবারে! বসে পড়েছিল ঝড়ু রায় থুপ করে মাটির ওপরেই। সোহাগ করে নিজের বৌয়ের পাশে যেন। আর তারপরেই কালকের নোটগুলো নিয়ে দৌড়েছিল দোকানে সার, বীজ কিনতে। বৌয়ের শাড়িজামা যেন। আর বিকেলেই ঐ তুরীপাড়ায় গিয়ে শহীদদার সঙ্গে মীনার ব্যাপারে কথা বলা।

কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে গেছে কাল রাতে।

ধনেশ সরকার এসেছিল কাল বেলা ডোবার পরপরই। মীনাকে বিয়ে করে এনেছে ঝড়ু রায় দিন চার-পাঁচ হল। বৌ নিয়ে বাবাকে প্রণাম করে এসেছিল। হঠাৎ করে কাল ধনেশ সরকারকে ঢুকতে দেখে ঝড়ু রায় ভেবেছিল হয়তো সেই বিয়ের সুবাদেই এসেছে বাবা। মীনাকে তাড়াতাড়ি বসতে দিতে বলেছিল।

–থাক থাক… আর বসা লাগবে না। আমার টাকার কী খবর ঝড়ু? কবে দিবি ফেরত?

ধনেশ সরকারকে নিয়ে ঝড়ু রায়ের এই কুড়ি-বাইশ বছরের স্মৃতিতে বিস্ময়ের পাল্লাটাই বেমক্কা ভারি। সেই বাপ মরার পর হঠাৎ ধরম বেটা বানাল, তারপর আবার জমি দান, আর এখন আবার টাকা ফেরত। প্রথম ধাক্কায় ঝড়ু রায়ের তো মনেই পড়ল না কোন টাকা, আর সেটা মুখ ফসকে বেরিয়েও গেল…

আর তখনই কানের গোড়ায় সপাটে চড়টা পড়ল।

–দু হাজার টাকা যে নিলি, ভুলেও গেলি? ধানগুলো তো ঠিকঠাক দেখভালও করছিস না! কাল সকালে গিয়েই কামান দিবি। ওই ধানটা দরকার আমার। ধান ভালো হওয়া চাই…।

দুই কথা… তিন কথা…

মীনা থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল বারান্দাতেই। গালে চিড়বিড়ানি জ্বালা আর চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া জল সামলেই ঝড়ু রায়ের মুখ থেকে আবার বেরিয়ে গেল—

–কিন্তু ও জমি তো…
–কাল আমি আবার আসব। টাকাটা রেডি রাখিস!

এটাই নিয়ম। ঝড়ু রায়ের পাট্টা ধনেশ সরকারের কাছেই থাকবে। মুখে বলেও দেওয়া যায় যে ও জমি ওর। কিন্তু সেটা কাজে কখনওই হতে দেওয়া যাবে না। যখনই দেখবে কোনও পাট্টাদার জমির সঙ্গে বেশি মাখামাখি শুরু করেছে তখনই রাশ টানো। ঝড়ু রায় জমির কথা বলে বিয়েও করে ফেলবে, তাও এত তাড়াতাড়ি, এতটা ভাবেনি ধনেশ সরকার।

বেলা ডুবে আসছে। গালের চিড়বিড়ানিটা তো কমেইনি, বরং এই এখনই ধনেশ সরকার আবার আসবে মনে পড়লে বেড়ে যাচ্ছে। এই শিমুলতলাতেই বসেছিল ঝড়ু রায় সারাদিন। দুপুরে খাবার নিয়ে এসেছিল মীনা রায়, খায়নি ঝড়ু রায়। খানিক চুপ করে বসে থেকে চলে গেছে মীনা রায়। নতুন বৌয়ের সামনে এরম একটা চড়! তাও মিথ্যে বলে! ওকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে! অপমানটাই বাজছে বেশি ঝড়ু রায়ের। নইলে মালিকের হাতে চাকরের মার খাওয়া এমন তো কিছু দুর্লভ ব্যাপার নয়। কিসের অপমান? পৌরুষের? হবেও বা। হলেও বা! লাল চোখ নিয়ে উঠে ঘরের দিকে এগোয় ঝড়ু রায়। এগোনোর আগে পড়ে থাকা কলাইটাকে এক লাথি মেরে ছিটকে দেয় ভুঁইবাড়ির ভিতর। তখনও ও জানে না এই জমির সাথে ওর এটাই শেষ লেনদেন।

ধনেশ সরকার চলে এসেছে। বারান্দায় পিঁড়ি পেতে দিয়েছে মীনা রায়। বসে রয়েছে তাতে, বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে। ঝড়ু রায় দেখল একবার। লাল চোখ দিয়ে।

–কিরে, টাকা এনেছিস?
–না।

উঠে দাঁড়িয়ে হাত চালাতে যেতেই নিজের ধরম বাপের বুকে এক ধাক্কা মেরে লোকটাকে আবার পিঁড়িতে বসিয়ে দিল ঝড়ু রায়। তারপর… নিমেষের মধ্যে… কী যে চেপেছিল ওর মাথায়… বাপের, মায়ের, নিজের সব শক্তি এক করে চড়াম করে এক লাফে বারান্দায় উঠে পেছন থেকে ধরম বাপের ঘাড়টা ধরে দিল কট করে মটকে! পরের নিমেষে সম্বিৎ আসতে যখন ঝড়ু রায় আর মীনা রায় ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তড়িঘড়ি, ধনেশ সরকার তখনও ধাপের ওপর পিঁড়িতেই বসে আছে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে। শুধু ঘাড়টা অদ্ভুতভাবে বেঁকে মাথাটা ঊর্ধ্বমুখে উঠে রইল। ও, বলা হয়নি… পিঁড়িটা ঝড়ু রায়ের নিজের বাপ মঙলুর বানানো আম কাঠ কেটে। ওর মাকে বানিয়ে দিয়েছিল এটা ওর বাবা…

ভাড়াঘরের বারান্দাটাতে শুয়েছিল অনিল ঘোষ। কাজে যায়নি আজ। মালতী ঘোষ একবার এসে কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখে গেছে। জ্বরটর নয়। থাক, এমনি মন টন খারাপ বোধহয়। মালতী ঘোষ এসব ব্যাপারে বা সময়ে ঘাঁটায় না। ঠিক হয়ে যাবে। হলে নিজেই বলবে। ছেলেটার দেড় বছর বয়স হল। ওকে দেখতে দেখতে রান্না সারল। ভাত ডাল আর আলুকুমড়োর তরকারি। ওই ছিল বাড়িতে। আজকে বাজার করেনি লোকটা। খেতে ডাকল এবার মালতী ঘোষ। কে জানে খাবে কিনা!

খেতে এল অনিল ঘোষ। এবং ঘাড়টার কথা মনে করে অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই ভাত খেল সেদিন।