Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সাক্ষাৎকার — বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত | সরোদিয়া

মন্দার মিত্র

 

[প্রখ্যাত সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের এই সাক্ষাৎকারটি ‘পরবাস’ ওয়েব প্রত্রিকার ১৪০৬ গ্রীষ্ম ও বর্ষা সংখ্যাদুটিতে প্রকাশিত হয়। ‘পরবাস’-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নেন মন্দার মিত্র। সম্প্রতি শিল্পীর প্রয়াণের পর সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ ‘পরবাস’ সম্পাদকের সহৃদয় অনুমতিক্রমে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ পুনঃপ্রকাশিত হল। বানান অপরিবর্তিত রাখা হল।]

 

বর্তমান সঙ্গীত জগতে সরোদ বাদনের প্রধান যে তিনটি শৈলী আছে, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তার একটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। আফগানি রবাবীয় গোলাম বন্দেগী খান বঙ্গশের সঙ্গে গুরু শিষ্য পরম্পরায় তিনি যুক্ত (বঙ্গশ ঘরানার অন্য শাখাটির খলিফা হলেন আমজাদ আলি খান)। বুদ্ধদেব বাবুর ঘরানার বাজনায় প্রাচীন রবাবী অঙ্গের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যায় বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। পরম্পরা-গত তালিমের সঙ্গে সঙ্গীতের প্রতি মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধদেব বাবুকে একজন বিরল শিল্পী করে তুলেছে। উনি দারুণ ভালো ছাত্রও ছিলেন, শিবপুর বি.ই কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক, সঙ্গীত ও অন্যান্য বিষয়ে সুবক্তা।

একটি শনিবারের দুপুরে দেড়-দু-ঘন্টা সময় চেয়ে আমরা গেছিলাম সাক্ষাৎকার নিতে। আড্ডা জমে যাওয়ায় সেটা দাঁড়াল প্রায় তিন ঘন্টায়। অমায়িক (এবং আড্ডাবাজ!) এই শিল্পীর সঙ্গে কথাবার্তার নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করা হল।

সাক্ষাৎকার শুরু করার আগে পরবাস-এর পরিচয় দিচ্ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বাবু জানান যে ‘দিশা সাহিত্য’ নামক নতুন একটি মাসিক পত্রিকায় উনি লিখতে শুরু করেছেন। “বামনের চন্দ্রস্পর্শবিলাস” এই শিরোনামায় লেখাটি ধারাবাহিকভাবে বেরোচ্ছে। এই খবরটা শুনেই টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিলাম, আনুষ্ঠানিকভাবে আর শুরু করা হল না।

মন্দার: এটাও তো লোককে জানানোর মতো একটা খবর।

বুদ্ধদেব: অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে, যেগুলো মানুষকে অন্তত আর কিছু না করুক হাসাবে। যেমন আমার ফার্স্ট ট্রাইস্ট উইথ মিউজিক ওয়াজ এট দ্য এজ অব ৩ ১/২ ইয়ারস।

(“বামনের চন্দ্রস্পর্শবিলাস”-এর) ফার্স্ট প্যারাগ্রাফটাকেই আমি রিপিট করছি। বাবা-মা তাঁদের সাড়ে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে গেছিলেন দিনাজপুরে একটা টাউন হল-এ, মিউজিক কনফারেন্সে। সেখানে স্টার পারফর্মার ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী। বাবা-মার বোধহয় এই আশা ছিল যে জ্ঞানেন্দ্র প্রাসাদের গান টান শুনে ছেলের মধ্যে সা-রে-গা-মা জারমিনেট করে কি না। ফল হল অপ্রত্যাশিত- ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ-কে বলল, “চুপ কর! অত চ্যাঁচাচ্ছ কেন?”

দিস ইস দ্য স্টার্ট!

অনেক সময় মানুষ সত্যি কথা বললে মেনি হিলারিয়াস থিংস কাম আউট, যেটা বলা উচিত, যেটা বলতে পিছপা হওয়া উচিত নয়। সব মিউজিশিয়ান- “আমার ঘরানাতে মিউজিকের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, আমার বাপ-ঠাকুরদা, মিউজিকাল ফ্যামিলি, আমার এই অমুক-এ এই করেছিলেন…” হয়ত কোনও কোনও ক্ষেত্রে সত্যি; কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে এটা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। আমার ঠাকুরদাদা- গান বাজনার বাষ্প তাঁর মধ্যে ছিল না- মারের চোটে আমার বাবার মুখ দিয়ে রক্ত বার করে দিয়েছিলেন, বাবা গান শুনতে গেছিলেন শুনে। এই হচ্ছে আমার মিউজিকের খানদান।

তা এই আসরে, আই ওয়াজ ভেরি ফোর্থরাইট ইন মাই ওপিনিয়ন। জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদের মুদ্রাগুলো ভয়ানক প্রবল ছিল। সম-এর মাথায় তবলিয়ার কাঁধে থাপ্পড়, হাঁটুতে থাপ্পড়, সে টেরিবল কাণ্ড। তা এই লোকটা পাগলের মত করছে, আমি এরকম করলে মা আমায় চাঁটি মেরে দেবে, এ কেন এরকম করছে! সো, আই ওয়ান্টেড টু সর্ট অব ওয়ার্ন হিম, যে এরকম করা উচিত নয়। আমার কথা কেউ শুনলো না, উনি কন্টিনিউ করতে লাগলেন। তখন আমি চেয়ারে– যেখানে বসেছিলাম সেখানে– উঠে দাঁড়িয়ে (সো দ্যাট আই কুড গেইন আ লিটল মোর হাইট) রিপিটেড মাই এডভাইস উইথ ডাবল দ্য গাস্ট: “বললাম না তোমাকে চুপ করতে! তবু চ্যাঁচাচ্ছ!” তখন তাড়াতাড়ি আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। দিস ইজ হাউ মাই লাইফ স্টার্টেড।

তারপরে নানা রকম ঘটনা, এ ও তা, সব: পড়াশুনা, ইস্কুলে যাওয়া, নানা জায়গায়.. একটা মুশকিল হচ্ছে যে আমি খানিকটা লিখেছিলাম, লিখে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ আমি কাউকে বলতে যাইনি, কিছুই না, কাজেই আমার লেখা কে পাবলিশ করবে? দু-একজন আমার কথা শুনে খুব উৎসাহিত হয়ে আমার যতদূর লেখা ছিল সেগুলো নিয়ে গেছিলেন, নিয়ে দে জাস্ট স্লেপ্ট ওভার ইট। আর কিছু করেননি। কাজেই আমিও… আই গট টোট্যালি ডিসইন্টারেস্টেড, যে আর লিখে কি হবে। এখন যে-ভাবে ‘দিশা সাহিত্য’ এসে আমাকে ধরল, তখন আমি যা ছিল তাদের দিয়ে দিলাম। আমার ধারণা ছিল যে আমি অনেকখানি লিখেছি। ও মা, আমার ছটা পেজ কি সাতটা পেজ এদের একটা পেজ-এর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এখন আমি লিখতে আরম্ভ করেছি। আর আমার অনেক জিনিস হয়ত ফ্ল্যাশব্যাকে আবার সেখানে গিয়ে বলতে হবে, কারণ আমার সেগুলো মনে ছিল না।

মন্দার: আপনার জ্ঞান গোস্বামীকে বকাবকি করার পর…..

বুদ্ধদেব: নেক্সট আমার যা মনে আছে: বাবা এমন চাকরি করতেন যে বদলি হতে হত। তিনি তারপর বরিশালে চলে গেলেন। তখন আমার বছর পাঁচেক বয়স। বাবার গান-বাজনা করার খুব শখ ছিল, কিন্তু আমার ঠাকুরদা এত….. বাবাকে প্রচণ্ড প্রহার করেছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তাঁর নাম-টাম কাটিয়ে তাঁকে বাড়িতে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। ঠাকুরদা থাকতেন কুষ্ঠিয়ায়, উকিল ছিলেন। বাবার দুর্ভাগ্য, বাবা এনায়েত খান সাহেবের খুব ভক্ত ছিলেন। তখন উনি এম,এ পড়ছেন। এনায়েত খানের খুব ভক্ত, তাঁর বাড়িতে যেতেন-টেতেন, খান সাহেবও বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার, অনেক রাত্তিরবেলায়, সে রাজাবাজার না কোন একটা জায়গা, তাঁকে নিয়ে বাজনা-ফাজনা বাজালেন পাশে বসিয়ে, তারপর ভালো করে খাওয়ালেন, খাইয়ে দাইয়ে ঘোড়ার গাড়ি করে বাবাকে ফেরত দিলেন। তখন দেড়টা বেজেছে। ইডেন হিন্দু হোস্টেলে, ইন দোস দেজ, রাত্তির দশটার সময় দরজা বন্ধ হয়ে যেত। তারপরে কেউ ঢুকলে তার নামে প্রিন্সিপালের কাছে রিপোর্ট করা হত। প্রিন্সিপাল তখন সায়েব, নামটা ভুলে যাচ্ছি, ডিরেক্টলি আমার বাবার মাস্টারমশাই ছিলেন, বাবা ইংরেজির ছাত্র ছিলেন। পরের দিন সকালবেলা প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠিয়েছেন:

— “প্রফুল্ল, তোমার এরকম শুনলাম”। “হ্যাঁ সার, আমি তো…তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমি কোনও বদ জায়গায় যাই নি, আমি গান শুনতে গেছিলাম”।

উনি বললেন, “আমি সেসব জানি না, তুমি আইন ভঙ্গ করেছ, আই হ্যাভ টু ডু মাই ডিউটি।” উনি এটা রিপোর্ট করে দিলেন আমার ঠাকুরদার কাছে। তারপরে তিন-চার দিন বাদে, তখন চিঠি যেতে তো বেশি সময় লাগত না- বাবার নাম একটা পোস্টকার্ড এসে হাজির:

“তোমার যে পড়াশুনা কোনওকালেই হইবার নহে, এ বিষয়ে আমি বরাবরই স্থির নিশ্চয় ছিলাম। নেহাত তোমার গর্ভধারিণীর কাকুতি মিনতি ও নির্বন্ধাতিশয্য উপেক্ষা করিতে অপারগ হইয়া, দরিদ্র উকিল হইয়া মাসিক ৭৫ টাকা ব্যয়ে এই দুঃসাধ্য কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। আমার এই চিঠি পাইবামাত্র কলেজের খাতা হইতে নিজ নাম খারিজ করিয়া বাড়ি চলিয়া আসিবে, এবং আমার সেরেস্তায় খাতা লিখিত প্রবৃত্ত হইবে। ইতি আশীর্বাদক শ্রী মনমোহন দাশগুপ্ত।”

বাবা সে চিঠিখানা হাতে করে প্রিন্সিপালের কাছে গেলেন: “সার, আমি যাচ্ছি। আপনার মত একজন মানুষের কাছে পড়বার সৌভাগ্য হয়েছিল, চিরকাল মনে থাকবে।” প্রিন্সিপাল বললেন- “কি আবোল-তাবোল বকছ, হোয়াট ননসেন্স”! “না, আপনি সার আপনার ডিউটি করেছিলেন, আমার বাবা তাঁর ডিউটি করেছেন। দেখুন এই চিঠি”। “আমি তো পড়তে পারবো না, বাংলায় লেখা…”

বাবা তাঁর চোস্ত ইংরেজিতে তর্জমা করে দিলেন। প্রিন্সিপাল সায়েব তো শকড!

— “তোমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন তাই জন্য”। “না, আমাদের বাবারা এইরকমই, কি বলবো সার, আপনি আপনার কাজ করেছেন, উনি তাঁর কাজ করেছেন। আমি যাচ্ছি সার। আর কি বলব”। “তুমি এখন হস্টেলে যাও। গো ব্যাক টু ইওর হস্টেল। তোমার বাবাকে আমি ট্যাকল করব”। এইভাবে আমার বাবার পড়াশোনা রক্ষা হয়েছিল।

অতএব, বাবা এরকম গান-পাগলা ছিলেন বটে… আমি অনেকখানি ব্রাঞ্চ আউট করে এক দিকে চলে গেছিলাম, যাই হোক, আই এম কামিং ব্যাক টু ট্র্যাক।

বরিশালে, যেখানেই যেতেন, সেখানে গিয়ে লোকাল মিউজিশিয়ান কে আছে না আছে তাদের ধরে তাদের সঙ্গে ভাব করতেন, তারা বাড়িতে আসত, বিশেষ করে উইক-এণ্ড-এ, গান-বাজনা হত, খাওয়া-দাওয়া একটু আধটু হত। সেবারে যাদের সঙ্গে ভাব হল বরিশালে, তাদের মধ্যে একজন ভদ্রলোক বছর পঁচিশেক বয়স, আর একজনের বয়স হচ্ছে আঠেরো। ছোটজন তবলা বাজান, একটু-আধটু গান করেন, আর বড় ভাই বাঁশি বাজান। তা তখনও গান-বাজনা মোটামুটি কিছু ঢোকেনি, বাঁশি নিয়ে একটা জিনিস দেখে খুব ইন্টারেস্টেড হয়েছিলাম। বাঁশির ব্যাপারে তখনকার দিনে লোকের একটা কুসংস্কার ছিল, যে বাঁশি বাজালে থাইসিস হয়। রোগটার নাম-ও তখন সে রকম: থাইসিস হবে বাঁশি বাজালে, টিউবারকুলোসিস নয়। তা আমি কয়েকদিন আগে একটা মেলাতে গেছিলাম, মার কাছে কান্নাকাটি করেছিলাম, একটা বাঁশি দাও না, মা দেননি এই গ্রাউণ্ড-এ: ও ভয়ানক আনহেলদি জিনিস।

তা বসে গান-বাজনা শুনছি, আর আমি দেখছি ভদ্রোলোকের কাছে একটা নয়, গোটা বারো বাঁশি, একটা বাক্সর মধ্যে। হোয়াট এন ইমপ্রপার ডিস্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ! আমি আর কি বলব, আমাকে মা দেয়নি। একদিন মা ঘরের বাইরে ছিলেন, তখন আমি ভদ্রলোককে বললাম, “কাকাবাবু, আপনার তো বারোটা বাঁশি আছে, একটা বাঁশি আমাকে যদি দেন আপনি।” আনফরচুনেটলি, মাই মাদার হার্ড মি এণ্ড পাউন্ডস অন মি। ধরে নিয়ে গিয়ে… বাচ্চা বয়সে মার – এখনকার ছেলেরা বিশেষ মার-ধোর খায় না – মার এর কতরকম প্রকার আছে, তার মধ্যে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট ছিল আমার ক্ষেত্রে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে সুইচ অফ করে দেওয়া। অন্ধকারে দ্য প্লেস বিকেম এজ স্কেয়ারি এজ এ জাঙ্গল ফুল অব ওয়াইল্ড এনিম্যালস। দেড় ঘন্টা ওখানে থেকে তারপর যখন হোয়েন আই সিকিওরড রিলিজ, তখন গান-বাজনা শেষ হয়ে গেছে। এই ভদ্রলোক মা-কে একটা বাঁশি দিয়ে গেছেন, বলেছেন “বৌদি, বাচ্চাটাকে আর পেটাবেন না। অমন কেন করছেন, কে জানে, হি মে বি এ মিউজিশিয়ান লেটার অন।”

সেই বাঁশি এবং সে বাঁশির দাতা দুজনের কারুর মূল্য আমি বুঝতে পারিনি। সেই বংশী-বাদক ছিলেন পান্নালাল ঘোষ, যিনি পরে অত বড় একটা বিশাল জায়গায় বাঁশি-কে নিয়ে গেছেন। পান্নালাল ঘোষ এবং তাঁর ছোটভাই নিখিল ঘোষ, যিনি বম্বে-তে আছেন, জাস্ট কিছুদিন আগে মারা গেলেন। পান্নাবাবু তার পর থেকে- আশ্চর্য কাণ্ড- আমার সঙ্গে জীবনে তাঁর দেখা হয়নি আর। পিকিউলিয়ার .. আমার বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল বহুবার, আমি তখন শিবপুরে পড়ি। উনি “বুদ্ধদেব কই? বুদ্ধদেব কই? আপনাকে বলেছিলাম! আপনি কি মার মেরেছিলেন ওকে মনে আছে বৌদি? বাজাচ্ছে তো, গান-বাজনা তো করছে।” এট দ্যাট টাইম আই ওয়াজ মোর অর লেস অন দ্য মিউজিক্যাল ম্যাপ অব ইন্ডিয়া, অলদো এট আ ভেরি আর্লি এজ। আমার তখন কত হবে, বছর আঠেরো এরকম হবে। আমারও আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, দেখা হলে পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতাম, কিরকম বেয়াদপি করেছি আপনার সঙ্গে।

মন্দার: রাধিকা-বাবুর কাছে আপনার তালিম শুরু হল কবে থেকে?

বুদ্ধদেব: রাধিকা-বাবুর কাছে তালিম শুরু হল যখন, সেটা ন’ বছর বয়সে। রাউন্ড এবাউট এইট অর নাইন ইয়ার্স ওল্ড। তখনও যে গান-বাজনা খুব একটা দারুণ মাথায় ঢুকেছে তা নয়। মা একটু-আধটু সেতার বাজাতেন- সেটা আরেক কাহিনী।

এর অনেক আগে, বিটুইন বরিশাল এণ্ড রাজশাহী- রাজশাহীতে রাধুবাবু ছিলেন তো- দেয়ার ওয়ার আদার প্লেসেস। একটা ছিল ময়মনসিং। ওখানে যথারীতি আমার বাবা গিয়ে গান-বাজনা কারা কারা করেন তার খোঁজ শুরু করলেন। ওখানে প্রচুর জমিদার ছিলেন- শশীকান্ত আচার্য, স্নেহাংশুকান্ত আচার্য, সুধাংশুকান্ত আচার্য, এদের বাবা-জ্যাঠা, তারপর আরও অন্যান্য জমিদার ফ্যামিলি, ভবানীপুরের জমিদার- মানে এই ভবানীপুর নয়, ওখানে আরেকটা ভবানীপুর আছে- কালিপুরের জমিদার, রামগোপালপুর। এরা এন্টায়ার জমিদার-রা ছিলেন লার্জলি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, এবং বহুলাংশে বিবাহ-সূত্রে আবদ্ধ। এবং তখনকার দিনে , এই পার্টিকুলার গ্রূপ অব জমিদারস, এদের একটা মস্ত বড় আইডিয়াল ছিল, যে তুমি জমিদারের বাচ্চা হয়েছ বলে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বসে খালি খাবে-দাবে আর ঘুমোবে আর ইয়ে করবে, তা নয়। পড়াশোনা করতে হবে, এবং খুব কম একজাম্পল পাবেন যে এম,এ পাশ করেনি। এম,এ-বি,এল পর্যন্ত। আমার গুরু-ও তাই, রাধিকা মোহন মৈত্র। শিকার করতে হবে, আর গান-বাজনা শিখতে হবে, হুইচ ওয়াজ কনসিডার্ড এজ আ পার্ট অব এডুকেশন। মস্ত বড় মিউজিশিয়ান সব ক্ষেত্রে হচ্ছে কি না হচ্ছে- তাও তার মধ্যে ভালো ভালো মিউজিশিয়ান জন্মেছেন। একজন ছিলেন…. একজন কেন, অনেকগুলিই সেতার বাজিয়ে ছিলেন। তার মধ্যে একজন- লাহিড়ী চৌধুরী- তৎকালীন পশ্চিমে- পশ্চিম কেন, এনটায়ার বেঙ্গল তখন- সেখানে এনায়েত খান সায়েবের শিষ্যদের মধ্যে হি ওয়াজ দ্য ফোরমোস্ট। এনায়েত খান বলতেন সে কথা: “ও আমার সবসে বড়া সাগির্দ হ্যায়”। তাদের বংশের একজন এখনও এখানে আছেন ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী। ধৃতিকান্তর বাবা নীরদকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী খুবই ভালো সেতার বাজাতেন, এই জায়গায় এই সমস্ত লোকের সঙ্গে বাবার ভাব হয়েছিলো।

এঁদের একটা দিক ছিল, জানেন- তাঁরা এত বিরাট জমিদার ছিলেন, কিন্তু এত নিরহংকার ছিলেন- জামা-কাপড়-এ, আচার-ব্যবহার-এ – এখনও মনে হলে সকালবেলা মনে মনে নমস্কার করি। এখনকার দুনিয়ায় যে সমস্ত লোকের সম্মুখীন হচ্ছি, তাদের তুলনায় এরা কোথায় ছিলেন। পড়াশোনায় ভালো, ভালো গান-বাজনা করেন, বিরাট বিরাট বড়লোক সমস্ত। এরা আমাদের ময়মনসিং-এর বাড়িতে প্রায়শই এসে সন্ধ্যেবেলা, ওইরকম উইকএণ্ড-এ, গান-বাজনা করতেন। এই সময়ে- তারও একটু আগে থেকে হবে- আমার মা এদের একজনের কাছ থেকে সেতার শিখতে আরম্ভ করেন। খুব বেশি দূর এগোতে পারেননি- খাতায় লেখা কতগুলি গৎ, দু-চারটি তান এরকম। সেই থেকে আমার স্ট্রিংস সম্পর্কে ইন্টারেস্ট খানিকটা হয়েছিল।

তারপর বাবার রাজশাহীতে বদলি হয়েই ওখানে কে আছেন তার খোঁজ। আমার একজন পিসেমশাই রাজশাহীতে থাকতেন। তিনি বললেন এখানে তো রাধিকা মোহন মৈত্র আছেন। বাবা বললেন, অত বড় একটা লোক, তার ওপর শুনেছি বিশাল জমিদার, উনি কি আমার বাড়িতে আসবেন? বা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন? আমার পিসেমশাই বললেন, আপনি চেনেন না, অত্যন্ত অমায়িক লোক, আপনি গান-বাজনা ভালোবাসেন দ্যাট ইজ ইওর কোয়ালিফিকেশন। ও ঠিক আসবে, আমি ধরে নিয়ে আসবো। ওস্তাদজি এলেন আমাদের বাড়ি। অসাধারণ সুন্দর এক মানুষ ছিলেন। যেমন তাঁর গায়ের রং, তেমনি তাঁর চেহারা, বছর আঠাশ এইরকম বয়স। যন্ত্রটাও একটা ট্যান্টালাইজিং যন্ত্র। এই দুটো মিলে আমার কাছে একটা হিরো-ওয়ারশিপ এর মত একটা ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেল। আমি তখন ঠিক করলাম যে আমাকেও ওরকম হতে হবে। ওই যন্ত্রটাকেই আমার চাই, ইত্যাদি।

তারপরে আমার বাবা বিপন্ন হয়ে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে আমি আবার মাস ছয় বাদে যদি বদলি হয়ে যাই, তখন তোকে কে এই যন্ত্র-টা শেখাবে। কে শোনে কার কথা। আমি ঘ্যান-ঘ্যান করছি – ততদিনে আমার গুরুর সাথে যথেষ্ট ভাব হয়ে গেছে- এইরকম একদিন বিকেল বেলায়, আই ওয়াজ প্লীডিং ফর মাই কেস, আমার বাবা আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, এই সময়ে গুরুজি ঢুকলেন। “কী হয়েছে?”, আমি কেঁদে ফেলেছি। “না, আমি বাজনা শিখব, বাবা আমাকে কিছুই শিখতে দিচ্ছে না কিছুতে।” গুরু বললেন শেখ না, চেষ্টা কর তুই, কী আছে, অসুবিধা কী, দিন না ছেলেটা আমাকে। আমার বাবা মধ্যে মধ্যে খুব কড়া কথা বলতেন। ভদ্রভাবেই বলতেন। “দেখুন, ও কেরানির ছেলে, ওর ভাগ্যে আছে কোনওমতে লেখাপড়া করে পরীক্ষা পাশ করে চাকরি করে খাওয়া। বাবার জমিদারী নেই (জমিদারের ছেলেকে বলছেন)। আপনি ওর মাথা খাবেন না মশায়।” আমার ওস্তাদ গায়েই মাখলেন না। বললেন, “ঠিক আছে, পড়াশোনা করলে গান-বাজনা হয় না? আমি তো খুব নিরক্ষর নই, এম,এ বি,এল পাশ করেছি। আর আপনি যদি তার চেয়েও বেশি পড়াশোনা, বেশি বিদগ্ধ লোকের খবর জানতে চান, আপনি হীরু গাঙ্গুলীর কথা জানেন? তিনি হাই কোর্টের হেড এটর্নি, সারা ভারতবর্ষ তাঁকে চেনে। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই, দিনে আধ ঘন্টা এক ঘন্টা করে আরম্ভ করুক, তারপর দেখা যাবে। আমিই আপনাকে বলে দিলাম- আপনার ছেলের পড়াশোনা নষ্ট যদি হয়, তাহলে আমিই ওর বাজনা বন্ধ করে দেব।”

এই কন্ট্র্যাক্টে আমার বাজনা শুরু হল। ওস্তাদেরই বাচ্চা বয়সের ছোট একটা সরোদ নিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে ওখানে গান-বাজনা…. আমার ওস্তাদ রেগুলার এই এখনকার অল বেঙ্গল আর অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স- এর টেইল-এণ্ড-এ যত বড় বড় মিউজিশিয়ান আসত, ধরে নিয়ে যেতেন। রাজশাহীতে গান-বাজনা হত, তাদের দেখাশোনা ইত্যাদি, কিছু কিছু এক্সপিরিয়েন্স হল। তারপর যথারীতি, আফটার সে এবাউট এ ইয়ার এণ্ড হাফ, বাবা বদলি। কান্নাকাটি। আমার কী হবে। ওস্তাদ বললেন, “নিয়ে যাও যন্ত্র, তোমাকে আমি যা শিখিয়েছি, তুমি যদি সেগুলোকে রেগুলারলি রেওয়াজ কর, আর আজেবাজে জিনিস না বাজাও, তাহলে আই থিঙ্ক ইউ উইল প্রগ্রেস। আমি দেখি কী করতে পারি।”

এটা উনি – আমার গুরুভাগ্য কিরকম – একটা তো হল অত বড় একটা লোক, কোনও প্রশ্নই নেই আমার কাছ থেকে কোনওরকম টাকাকড়ি নিয়ে শেখাবার, নিজের যন্ত্র দিয়ে আমাকে শেখাচ্ছেন। তারপর কিছুদিন বাদে, মাস ছয়েক বাদে, বাবাকে খুলনায় চিঠি লিখলেন, যে আমি আপনাদের বাড়িতে একটু বেড়াতে যাচ্ছি। বলে ওখানে গিয়ে, পুরো দিন থেকে, আমার বাজনা একটু শুনে, আমাকে খানিকটা তালিম দিয়ে এলেন। এরকম ভাবে বোধহয় খুলনায় বার দুয়েক গেছেন। তারপরে, বাই দ্যাট টাইম, পার্টিশন অব বেঙ্গল কেম। ওস্তাদ সর্বস্ব হারিয়ে রাজশাহী থেকে কোলকাতায়, আমার বাবা-ও গভর্নমেন্ট অফিসার হিসেবে হিন্দুস্থান-এ কাজ করবেন এটা অপট করে ব্যাক টু কোলকাতা। সেই থেকেই আই ওয়াজ কনস্ট্যান্টলি উইথ হিম।

মন্দার: তালিম চলেছিল কত বছর?

বুদ্ধদেব: অলমোস্ট আপ টু দ্য মান্থ অব হিজ ডেথ। আমার আর কোনও গুরু নেই। ফ্রম এ টু জেড, আমি যা শিখেছি…. একটা মিউজিশিয়ান অনেক জায়গা থেকে তার মেটিরিয়ালস আহরণ করে, কিন্তু আমার বেসিক তালিম থেকে শুরু করে সরোদের লাস্ট ইয়ে পর্যন্ত, যতদূর আমি বাজাতে শিখেছি- রাধিকা মোহন মৈত্র। আর কেউ আমাকে শেখাননি।

মন্দার: উনি যখন মারা যান, তখন আপনার বয়স….

বুদ্ধদেব: ১৯৮১-তে। উনি খুব শোচনীয় ভাবে মারা যান। সিঁড়ি থেকে পড়ে যান, মাথায় চোট লাগে। ব্লিডিং হয়েছিল, হ্যামারেজ হয়েছিল। তখনকার মত ওষুধ-বিষুধ দিয়ে ভালো হয়ে গেলেন। আফটার এবাউট আ মান্থ, ভুল বকতে শুরু করলেন। কথাবার্তার কোনও রকম সঙ্গতি থাকত না। তখন এখানকার একজন বড় ডাক্তার অপারেট করলেন। … দ্যাট’স হাউ হি ডায়েড। ফিফটিন্থ অক্টোবর, নাইনটিন এইট্টি ওয়ান।..

মন্দার: আপনার তখন প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স। ততদিন আপনি রেগুলারলি ওনার কাছে তালিম পেয়ে গেছেন?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ, তবে চাকরি জীবনে কিছু সময়ে আমার এমন ভাবে কেটেছে …. চাকরি-টা তো একেবারেই কনড্যুসিভ টু মিউজিক ছিল না – মোস্ট আনমিউজিকাল কেরিয়ার পসিবল- মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার, পাওয়ার স্টেশন, বয়লার, কয়লা, আর আগুন আর হিট, আর রিক্যালসিট্র্যান্ট লেবার। এরকম সময় প্রায় বারো বছর আমার জীবনে গেছে। সেই সময়ে ওস্তাদের কাছে যেতে পারতাম না, উনি সেটা খুব মাইণ্ড করতেন, কষ্ট পেতেন।

মন্দার: ছোটবেলায় এত নাম করা সব ওস্তাদদের শুনেছেন, গুরু ছাড়া আপনার প্রধান মিউজিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স কারা?

বুদ্ধদেব: আমি ওইটুকু বয়সে, ন’বছর বয়সে যাঁদের দেখেছি – গোলাম আলি খান সাহেব-কে দেখেছি, হাফিজ আলি খান সাহেব-কে দেখেছি। আলি আকবর খান সাহেব- আঠারো বছর বয়স, তাঁর ফার্স্ট এপিয়ারেন্স ওই রাজশাহীতে, কনফারেন্স-এ। এখানে এনায়েত খান সাহেবকে এক-আধবার কোনও মতে শুনেছি কি শুনিনি মনে নেই। মুস্তাক আলি খান সাহেব, তারপরে কলকাতায় যত তখনকার দিনে আমার ওস্তাদদের বন্ধু-বান্ধব, বড় বড় মিউজিশিয়ান যাঁরা ছিলেন- হারমোনিয়ামে মিন্টু ব্যানার্জি, কেরামতউল্লা খান সাহেব, এরা সব ভীষণ বন্ধু ছিলেন।

আর এঁদের আড্ডা বলে একটা জিনিষ ছিলো- দ্যাট ওয়াজ এ ভেরি প্রোডাক্টিভ আড্ডা। তাতে সব রকমই হতো- গাল-গল্প, ইয়ার্কি-ঠাট্টা, সবই হতো, কিন্তু দ্যাট ওয়াজ লার্জলি বেসড অন মিউজিক্যাল আ্যফেয়ার্স, মিউজিক্যাল রেমিনিসেন্সস, আর মিউজিক্যাল গ্রামার- একটা রাগ কি হওয়া উচিত, কি হয়েছে না হয়েছে। এই আড্ডাতে অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্ত হিলারিয়াস এপিসোডস এক এক জনের জীবনে, জাস্ট চুপ করে বসে থেকেই শোনা যেত। একজন ওই ওখানে বসে বসে, “আ্যই রথীন (রথীন চট্টোপাধ্যায়, ইনি ছিলেন শিবপুরের একজন মস্ত গায়ক, ওস্তাদের বন্ধু) তোর ওস্তাদকে ইন্স্যুরেন্স করাতে পেরেছিলি? সেই যে সেই ব্যাপারটা?” এইভাবে আরম্ভ হলো কথাটা। বুঝলাম যে রথীন চট্টোপাধ্যায় ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, সবাইকে ধরে ধরে ইন্স্যুরেন্স করাতেন। উনি গেছেন ওঁর গুরু ফৈয়াজ খান সাহেবকে ইন্স্যুরেন্স করাতে। তখনকার দিনে ইন্স্যুরেন্স বস্তুটা কি সেটাতো বোঝানো যেতো না চট করে। ফৈয়াজ খান সাহেব কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না : “ঝুট-মুট …একটা কোম্পানিকে আমি মাসে-মাসে বছরে-বছরে পয়সা দেব কেন? ক্যা ফ্যায়দা হ্যায়?” রথীনবাবু বললেন আপনি আগে আমার কথা শুনে যান, তারপরে আপনাকে আমি বলব। বললেন “আচ্ছা বোলো”।

–আমি যদি এরকম বছর বছর…

–বাহ্ এক বছর নয়, বারবার দিয়ে যেতে হবে? বছর বছর টাকা দিয়ে যাচ্ছি আমি?

–ধরুন হাজার টাকা করে দিয়ে যাচ্ছেন…

–পহলে বতাও কি ঝুট-মুট য়ে বেহুদা কোম্পানি কো কিস লিয়ে হামকো হজার রূপায়া দেনা হ্যায়?

–ওস্তাদ থোড়া মেহেরবানী সে আগে বাড়িয়ে। বীস্ সাল মে বীস্ হজার রূপায়া হো গয়া। কুড়ি হাজার টাকা যদি আপনার হাতে আসে বিশ সাল পরে, আপনার কত সুবিধা হবে।

উনি ফট করে জবাব দিলেন কুড়ি হাজার টাকা আমি আমার সুটকেসের মধ্যে, আমার পকেটের মধ্যেই রেখে দিতে পারি, এই কোম্পানিকে কেন দেব? ভয়ের চোটে ফৈয়াজ খান সাহেবকে কেউ বলতে পারছেনা যে বিশ সালের আগে মারাত্মক ঘটনাটা ঘটলে সত্যিকারের ফায়দাটা কোম্পানির কাছ থেকে আসবে। রথীনবাবুর মুখ দিয়ে তো বেরোচ্ছেই না, উনি ত-ত করছেন। তারপর ফৈয়াজ খান সাহেবের একজন অনুচর, তিনি বললেন, “হুজুর বাত ইয়ে হ্যায় কি আগর (খোদা না করে) বীস্ সালমে আগর আপকা কুছ হো জায়, আপকা মৌত হো জায়”…বাস! “হামারা সাগরিদ হো কে হামারা হি মৌত মাংগতা! কৌন হ্যায় ইসকো কান পাকড়কে নিকালো! রথীন (তখন বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে) হামারা পয়সা ভি লেগা, জান ভি লেগা।”

মন্দার: এই যে গানের আড্ডা হতো, আপনি এই আড্ডার সদস্য ছিলেন?

বুদ্ধদেব: সদস্য নয়, আ্যলাউড হতাম তখন, এই পর্যন্ত। চুপ করে বসে আছি এক কোনায়, কোনও আ্যকচুয়াল পার্টিসিপেশন ওয়াজ আউট অব কোয়েশ্চেন। বাবা-জ্যাঠারা হলে তো ঘাড় ধরে বের করে দিতেন, ওস্তাদ কেন জানিনা বললেন ঠিক আছে। সত্যি অদ্ভুত অদ্ভুত লোকেদের সাথে পরিচয় হয়েছে..দুটি লোক, দুজনেই একেবারে ফিনফিনে অদ্দির পাঞ্জাবি, ধুতি পরে। একজনের চোখে রিমলেস চশমা। তাঁদের কারোর পরিচয় জানতাম না, আমি জিজ্ঞাসাও করিনি ওস্তাদকে, ভেবেছিলাম নিশ্চয় ওরা জামাই-টামাই হবে। দুজনেই দেখতে খুব সুন্দর, একজন একটু মোটা। ওঁরা স্টেজে উঠে গান-বাজনা করতে বসলেন, একজন সেতার, একজন তবলা। একজন মুস্তাক আলি খান সায়েব, একজন কেরামতউল্লা খান সায়েব। দুজনেই এমন বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন, পরিষ্কার বাংলায় কথা-বার্তা বলতেন। এই রকম সব…

তারপরে এক ভদ্রলোককে দেখলাম, ওই রাজশাহীতে, কোনফারেন্সেই। গেরুয়া জামা-কাপড় পরা, দাড়ি, তবলা নিয়ে বসে আছেন। আমি ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকাবাবু, সন্ন্যাসীরা তবলা বাজায় নাকি?” উনি রেগে বললেন, “কী ইডিয়টের মতো কথা বলছিস! সন্ন্যাসী হতে যাবেন কেন, উনি হচ্ছেন জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ।” জ্ঞানবাবুর তখন দাড়ি ছিলো, ওনার বয়স তখন গুরুর থেকে একটুখানি বেশি- বত্রিশ-তেত্রিশ এরকম হবে।
গান-বাজনা যেগুলো হতো, সেগুলো তখনও অতটা বুঝতাম না, শোনা হতো। তারপরে কলকাতায় এসে সেই ওস্তাদের বন্ধুদের আড্ডা, ওস্তাদের বাড়িতে হতো, বা এক-আধবার এদিক-ওদিকে ওনার সঙ্গে গেছি। এই আড্ডাগুলো…দেখুন, ইঞ্জিনিয়ারদের আড্ডা নয়, কবিদের আড্ডা নয়, উকিলদের আড্ডা নয়, মিউজিশিয়ানদের আড্ডা হতো, কিন্তু এখন আমাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই। আমাদের প্রফেশনাল জেলাসি এত বেশি হয়ে গেছে যে আর…এই জিনিসটা বড় লস। এসব থেকে অনেক কিছু আহরণ করা যেত। অনেক জিনিস আমার শিক্ষা হয়েছে এই থেকে।

মন্দার: আপনি এখন বুঝতে পারেন যে ওই বয়সের বিভিন্ন লোকের থেকে ইনফ্লুয়েন্স আপনার বাজনায়…

বুদ্ধদেব: গান-বাজনার ইনফ্লুয়েন্সটা অনেক পরে এসেছে। শোনাটা আরম্ভ হয়েছিল, তারপর ন্যাচারালি ইন্টারেস্ট ইন দ্য সাবজেক্ট…যেমন ধরুন ওখানেই প্রথম শুনেছি শচীন দেববর্মনকে। রাধুবাবু খুব…

কিন্তু ইমবাইবিং দ্য ইনফ্লুয়েন্সস অব ভেরিয়াস মিউজিশিয়ানস, সেটা স্টার্টেড ফ্রম দ্য এজ অব সে পঁচিশ ছাব্বিশ এরকম থেকে। আর এটা সারা জীবন ধরে চলে মানুষের। যদি এখন কেউ গ্রোয়িং মিউজিশিয়ান হয়, ইফ হি ওয়ান্টস টু গো ফারদার, তাহলে এটা করতেই হবে। বেসিকালি তাঁর স্টাইল, তাঁর বক্তব্য, তাঁর বাচনভঙ্গি, এর মধ্যে তাঁর গুরু উপস্থিত থাকবেন, কিন্তু গুরুর কার্বন কপি হলে হি উইল নেভার বি আউটস্ট্যান্ডিং মিউজিশিয়ান হিমসেলফ।

মন্দার: গুরু ছাড়া এরকম কারা আপনার বাজনাকে ইনফ্লুয়েন্স করেছেন?

বুদ্ধদেব: গোলাম আলি খান সায়েব, বিলায়েত খান সায়েব, বহুলাংশে আলি আকবর খান সায়েব, আলাউদ্দিন খান সায়েবেরও ইনফ্লুয়েন্স আমার মধ্যে ছিলো। এইগুলো সবই জাস্ট মেকানিক্যালি গ্র্যাফটিং সাম পার্ট অব দেয়ার মিউজিক অনটু মাইন-এটা নয়। শুনে ভালোলাগে যেটা ন্যাচারালি ভেতরে ঢুকে গিয়েছে সেটা।

মন্দার: রাধুবাবুর বাজনায় অসাধারণ wit এর পরিচয় পাওয়া যায়, এমন কথা জ্ঞানবাবুর লেখায় পড়া যায়, আপনিও অন্যত্র বলেছেন। গান বাজনার ক্ষেত্রে wit কাকে বলে?

বুদ্ধদেব: বাজনার ক্ষেত্রে উইটটা হচ্ছে-আপনি একটা লোকের কথাবার্তা শুনছেন। কথাবার্তা শুনে, তার কথা ফলো করতে করতে, আপনি দেখলেন এক্সপেক্টেড এর পরের যেটা হবে, কথাটা যেদিকে যাবে সেদিকে না গিয়ে টোটালি ইন এ ডিফারেন্ট ডিরেকশন চলে গেল। সেটা হয়ত এমনই মজার, বা এমনই ইন্টারেস্টিং হে আপনি এক্সপেক্টই করেননি। দ্যাট এলিমেন্ট অব সারপ্রাইজ। সারপ্রাইজ, কিন্তু ইটস নট ননসেন্স, ইটস পারফেক্ট সেন্স। এটা ওস্তাদের কথাবার্তার মধ্যে ছিল। লোকে চমকে যেত কথা শুনতে শুনতে, যে কোনদিকে চলে গেলেন কথা বলতে বলতে! বা একটা লোককে তার পিছনে লাগতে গিয়ে এমন একটা কথা বলে ফেললেন- যেগুলো তাৎক্ষণিক, আগে চিন্তা করে যে বার করা যেত তা নয়। এইটে ওঁর বাজনার মধ্যে ছিল। এটা একটা খুব বড় এলিমেন্ট বাজনার বলে আমার বোধ হয়েছে। আমি কিন্তু ওই জিনিসটা অতটা ইমবাইব করতে পারিনি। চেষ্টা করেছি, ওটাকে আমি কনশাসলি চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি করতে। এটা একটা লোক নিয়ে জন্মায়, তাঁর সঙ্গেই চলে যায়। স্টাইলের মধ্যে এই জিনিসটা ছিল।

মন্দার: উনি ট্র্যাডিশনও খুব মেনে চলতেন শোনা যায়।

বুদ্ধদেব: এটার জন্যই ওনার খুব বেশি সার্কুলেশন হয়নি। বাজনার দুটো দিক আছে। একটা হচ্ছে: বাজনা সব দিক থেকে কারেক্ট, ট্র্যাডিশনালি কারেক্ট, রিচ ইন কন্টেন্ট, সব কিছু। কিন্তু ক্লাসিকাল মিউজিক আমজনতার কাছে যদি পপুলার হতে হয়…ক্লাসিকাল মিউজিক বোঝাতে গেলে, ভালো ক্লাসিকাল মিউজিক কোনটা এটা আ্যপ্রিশিয়েট করতে গেলে, একটা মিনিমাম লেভেল অব ইনিশিয়েশন দরকার- এনি ক্লাসিকাল মিউজিক- শ্রোতাদের থাকা দরকার। আগেকার দিনে বেশি শ্রোতা ছিল না, কিন্তু যারা ছিল তাদের মধ্যে এমন এমন শ্রোতা ছিল যে ওস্তাদরা তাদের দেখে সমীহ করে গানবাজনা করতেন-যে আজ অমুক বাবু আছেন, ভালো করে গান বাজনা করতে হবে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন, আজকে আপনি রাগটাকে যেভাব ট্রিট করলেন, আমার পছন্দ হলো না। বলে দিতেন। এখন এরকম শ্রোতা… ক্রমশ যখন আমাদের শ্রোতা বাড়ল- ৩০, ৪০, ১০০, ২০০ এর বেশি লোক তো আগে হতো না, সে জায়গায় ৫০০০ লোকের প্যান্ডেলে যখন গানবাজনা হতে আরম্ভ করল, তখন সে সব লোককে আপনি কি দিয়ে এন্টারটেন করবেন?  এমন কিছু আঙ্গিক মিউজিক বার করতে হবে যাতে অর্ডিনারি লোক এন্টারটেন্ড হয়। এবং সেগুলো গ্রামাটিকালি ইনকারেক্ট হয়ত নয়, কিন্তু দ্যাট ইজ ডেফিনেটলি আ্যট এ মাচ লোয়ার ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল অব মিউজিক- যেটা বোঝাতে বেশি কষ্ট করতে হবে না। সেই ধরনের শ্রোতাদের খুশি করতে না পারলে আপনি পপুলার আর্টিস্ট হবেন না। এটা আমার গুরুর ক্ষেত্রেও হয়েছে, আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে।

মন্দার: তা স্বত্বেও আপনি ট্র্যাডিশন রক্ষা করে গেছেন। অবশ্য এটা ঠিক যে আপনার ক্ষেত্রে বাজনোটা প্রধান উপজীব্য নয়, তা হলেও…

বুদ্ধদেব: চেষ্টা করেছি মেন্টেন করতে। কিন্তু আমি তো বরাবর চাকরি করিনি। আমি আ্যজ আর্লি আ্যজ পসিবল চাকরি থেকে পালিয়েছিলাম। ৫৫ বছর বয়সেই আই টুক প্রিম্যাচিওর রিটায়ারমেন্ট। যাতে করে আমি বাকি সময়টা, যে কদিন হাত পা চালু থাকে, গান বাজনা করতে পারি।

মন্দার: আপনার কি মনে হয় ট্র্যাডিশন জলাঞ্জলি না দিয়ে পপুলারিটি সম্ভব?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ, ট্র্যাডিশনকে জলাঞ্জলি না দিয়েও। ট্রাডিশন মানে আমি যেটা বোঝানোর চেষ্টা করছি সেটা হচ্ছে: রামায়ণ মহাভারতের কথা চিন্তা করুন। তার মধ্যে এমন অনেক চ্যাপ্টারস আছে হুইচ আর ভেরি রিচ ইন ফিলজফি, আবার এমন এমন কিছু চ্যাপ্টারস আছে যেটা একটা অর্ডিনারি লোকও বুঝতে পারে। সবরকমই। ইটস আ্যন এপিক। এখন এপিকের এই জায়গাগুলোই যদি আমি নিয়ে ক্রমাগত পরিবেশন করি…সমস্ত রামায়ণ-মহাভারত সমন্ধে যার আইডিয়া আছে, বা যার বাজাবার ক্ষমতা বা বাজাবার ইচ্ছে ইজ টিউনড টু দ্যাট লেভেল যে “আমি সমস্ত জিনিসটা, যা যা বক্তব্য আছে সবকিছুই বলব” তার বাজনার ভেতরে পার্সেন্টেজ অব কনটেন্ট যেটা অর্ডিনারি লোককে আনন্দ দেবে সেটা খুব বেশি না। এটা হয় অনেকের ক্ষেত্রে।

ইন ফ্যাক্ট, আই সাসপেক্ট যে আমি আগে..৩০ বছর আগে যে বাজনা বাজাতাম্, তখনকার দিনে সে বাজনা যথেষ্ট লোককে ইয়ে করেছে। আমি আনকনশাসলি খানিকটা, কিছু কিছু জায়গায়, বাজনাকে ডাইলিউট করে ফেলেছি। তা না হলে লোকে হয়ত আমার বাজনা শুনত না।

প্রত্যেক আর্টিস্টের, সে আলাদা একটা লোক যাকে শোনা উচিত এই হিসেবে যদি গণ্য হতে হয়, তা হলে তার নিজস্ব কিছু বক্তব্য রাখতেই হবে। এবং সেই বক্তব্যটা প্রথম দিকে অনেকেরই মাথায় ঢুকবে না। কিন্তু সে যদি ক্রমাগত করে…এরকম চ্যাপ্টারস আমার বাজনার মধ্যে আছে যেগুলো হয়তো আমি ভেবে বের করেছি- যা আমার বক্তব্যের মধ্যে এই কতগুলো জায়গা স্পেশালি বিলঙ্গ টু মি। সেগুলো লোককে কিছু কিছু জায়গায় শোনাতে শোনাতে পিপল হ্যাভ গট আ্যকমস্টেড টু দ্যাট, এন্ড দে হ্যাভ কালটিভেট এ টেস্ট ফর দ্যাট। এটা হতেই পারে।

মন্দার: শিক্ষা বা শিষ্য প্রসঙ্গে: আপনি শেখান তো? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যাপারে আপনার কিরকম আশা আছে??

বুদ্ধদেব: শেখানো- লাস্ট বছর আষ্টেক-দশেক ধরেই ভালো করে শেখাচ্ছি। আমার গোটা কতক ছাত্র খুবই ভালো হয়েছে। আই হ্যাভ রিলিজড নিয়ারলি ফিফটিন পারফর্মারস ইন দা মিউজিক্যাল ম্যাপ অব ইন্ডিয়া। কিন্তু তাঁদের মধ্যে জনা ৪-৫ জন প্রফেশন হিসেবে মিউজিককে নিয়েছে। বাকিগুলো আমারই মতন- এ এই চাকরিতে, সে সেই চাকরিতে, অন্য কাজে। তবু তারা বাজাচ্ছে। শেখানোটা সেই জন্য যতটা মন দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করেছি সব ক্ষেত্রে তার পুরো এফেক্ট হয়নি।

যেমন ধরুন আমার নিজের অবস্থা। আমি যদি ডেইলি ১৮ ঘন্টা করে রেওয়াজ করতে পারতাম লাইক এ প্রফেশনাল, তাহলে আমি যতদূর চোখে দেখতে পারছি আমি আরও খানিকটা হয়ত এগোতে পারতাম। সে সময়টা আমি পাইনি। কিন্তু দেখতে তো পারছি যে এখানে যাওয়া যায়। যদি কারোর মাসলের জোর থাকে এবং সময় থাকে তাকে আমি বলে দিতে পারি এই জায়গায় চলে যান। তাকে সেই পর্যন্ত আমি আ্যডভান্স করে দেবার ক্ষমতা রাখি, আমি নিজে পারি আর না পারি। এটা বহু ক্ষেত্রে হয়। গুরু মে নট বি এ স্টার পারফর্মার- এমন অনেক গুরু আছেন যাঁরা স্টার পারফর্মার তৈরি করেছেন। যেমন দুটি তবলিয়া- স্বপন চৌধুরী ক্লাসিকালের দিকে, বিপ্লব মন্ডল লাইট মিউজিকের দিকে। দুটি দিকপাল তবলিয়া। তাঁদের গুরুর নাম কিন্তু কেউ জানে না। নিতান্ত সাধারণ একজন বাঙালি ভদ্রলোক। কোনও দিন কোনও কনফারেন্স-এও তাঁর নাম  শোনা যায়নি। তিনি যা দেখতে পেতেন- ছেলেগুলোর ভিতর মেটেরিয়াল ছিল- উনি সেরকমভাবে তৈরি করে দিয়েছেন।

আমি যাদের কাছে পেয়েছি- ভালো মেটেরিয়াল পেয়েছি অনেকগুলোই- কিন্তু যে কজন অল-আউট এফর্ট দিয়েছে তাদের আমি যতটা পেরেছি এগিয়ে দিয়েছি। এবং তাদের আমি বলেই দিয়েছি- যা আমার গুরু বলেতেন- আমার বাজনা একেবারে চোখ বুজে কার্বন কপি করো না। তাহলে তুমি কিন্তু নিজে কোনোদিন একটা ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক মিউজিশিয়ান হিসেবে কোনও ঠাঁই পাবে না। এই হচ্ছে আমাদের ছাত্র। ছাত্রদের মধ্যে প্রায় গুটি ১৫ আছে। আরো কয়েকটি ছেলে, যেমন ধরুন অর্ণব- অর্ণব অত্যন্ত ট্যালেন্টেড ছেলে, হয় ক্যান রিয়ালি গ্রাইন্ড হিমসেলফ টু এ লার্জ ডিগ্রি, কিন্তু করছে পড়াশোনা, হুইচ ইজ টেকিং আ্যওয়ে মোর দ্যান হাফ অব হিজ টাইম। এটা আমারই ট্র্যাজেডি- আমি চোখে দেখব যে আমি যতটা তাকে নিয়ে করতে পারতাম ততটা হয়ত হবে না। গুরু হিসেবে এটা একটা ট্র্যাজেডি আমার।

মন্দার: এদের মধ্যে কাদের জন্য আমরা ভবিষ্যতে কান খোলা রাখব?

বুদ্ধদেব: আমার ছাত্রদের মধ্যে- আরলিয়েস্ট বলে দিচ্ছি – সে এখন আবার আমাকেও গুরু হিসেবে স্বীকার করে না, কিন্তু তাকেও আমি শিখিয়েছি, আমার গুরুর ছাত্র, নরেন ধর। তারপরে জয়দীপ ঘোষ, এখন মধ্যপ্রদেশে আছে। দেবাশীষ ভট্টাচার্য- একজন গিটার বাজায়, একজন সরোদ বাজায়, সরোদ যে বাজায় সেই দেবাশীষ ভট্টাচার্য। প্রত্যূষ ব্যানার্জি, অতনু রক্ষিত। এদের নাম আপনারা খুব বেশি শুনতে পান না এই জন্যে- প্রত্যূষ ইজ এ ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান, মানে রেগুলার প্রফেশনাল মিউজিশিয়ান। কিন্তু অতনু রক্ষিত হচ্ছে শ্রী ঘৃত বাড়ির ছেলে। সে সব সময় ব্যবসা নিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু নো ডাউট হি ইজ এ রিয়েলি ট্যালেন্টেড মানে সুপার ট্যালেন্টেড মিউজিশিয়ান। এদের মুশকিল হচ্ছে যে এদের ওই পরিমাণ গ্রাইন্ডিং না করলে একটা যে ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে মঞ্চে গিয়ে লোকের নজর কাড়া- এইখানে তারা সবসময় পৌঁছায় না। এরকম আরো অনেক নাম আছে। এখনও যাদের শেখাচ্ছি তাদের মধ্যে ইয়ংগেস্ট ব্যাচে – দেয়ার আর টু সাচ বয়েজ ইন আমেরিকা। এক হচ্ছে অভিজিৎ আগরওয়াল, ওই আগে শুরু করেছিল আমার কাছে। তার পরে অর্ণবের সাথে দেখা হয়েছে। অর্ণব এখন শিখছে খানিকটা, যদ্দুর আমি পারছি।

আর এখন সব বিষয়ে কম্পিটিশন তো…এখন দেয়ার ইজ আ্যন ইমপেসেন্স টু গেট দেয়ার ফাস্ট। এটা আমাদের সময়ে ছিলো না। আমাদের সময় ছিলো যখন তখন লোকেই খুঁজে বের করত যে কে ভালো ট্যালেন্ট। আমাদের কোনও চেষ্টা করতে হয়নি যে আমাকে এই কনফারেন্স-এ বাজাতে দাও, এখানে এই করতে দাও। কোনওদিনই করতে হয়নি। এখন জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতন গান-বাজনটাও এমন একটা জায়গায় যেখানে ইট সিমস টু বি ওভারপপুলেটেড। সেই জন্য কম্পিটিশন ইজ ভেরি মাচ মোর ফিয়ার্স। এবং সেটার মধ্যে তাই অনেক রকমের…কি বলব…আ্যনিমাল টেনডেন্সিস ঢুকে গেছে। এগুলো সব জায়গায় যেরকম হয় এখানেও সেইরকম হচ্ছে। কাজেই এখনকার ইয়ংগার জেনারেশনের পক্ষে ইটস আ মাচ গ্রেটার চ্যালেঞ্জ। এবং সেই জন্য তারা কোনও মতে যতটা তাড়াতাড়ি শর্টকার্ট-এ গান বাজনা করা যায় সেরকম একটা রাস্তায় যাবার চেষ্টা করছে। এবং আ্যলংসাইড দেয়ার এফর্টস টু লার্ন এন্ড প্র্যাকটিস মিউজিক দে মাস্ট অলসো ট্রেন দেমসেল্ভস আপ ইন ম্যানিউভারিং, ইন পাব্লিক রিলেশনস, এন্ড সো মেনি থিংস, যাতে গান-বাজনার প্রোগ্রামে জোটে বেশি।

এরপর প্রসঙ্গ ঘুরে যায় সঙ্গীত সমালোচনায়। একটা ঘটনার কথা দিয়ে আরম্ভ করলেন।

বুদ্ধদেব: প্রথম গোলাম আলি খান সাহেবের গান শুনতে গেছি। সেই আমার ৯ বছর বয়েসের কথা, রাজশাহীতে। দেখে তো আমি তখন ঘাবড়ে গেলাম – এই লোকটা গান করবে কি করে? এইরকম কালো, মুশকো চেহারা, এরকম গোঁফ, হাতে একটা বেঁটে লাল লাঠি, মাথায় পশমের একটা ফেজ টুপি। এসে বসলেন ওখানে। তাকিয়ে দেখছি কি ব্যাপারটা হতে যাচ্ছে। অডিয়েন্সও অনেকটাই আমার মতন। একজন বললে, ‘এই দ্যাখ, দ্যাখ, তুলোর বস্তা এসে বসল রে।’ এরকম সব রিসেপশান হচ্ছে – নিজেদের মধ্যে মার্মারিংস আর কি। তারপর উনি সুরমণ্ডলটাকে বাঁধলেন। সুরমণ্ডলটাকে বাঁধতে আরম্ভ করার সময়েই লোকের কথাবার্তা একটু থেমে গেল। তারপর উনি গলা যখন ছাড়লেন তখন আমার মনে হল সামথিং ইজ হ্যাপেনিং। মালকোশ গাইছিলেন। আমি তখন আন্দাজ করতে পারছি যে মালকোশ- ওস্তাদকে শুনেছি বাজাতে, আমি নিজে তখনো মালকোশ জানি না।

খানিকক্ষণ বাদে – মিনিট দশেক বাদে – পেছন দিকে দুই বুড়ো বক বক করতে লাগল: ‘ধ্যাত্তেরি! কি হচ্ছে এটা? এটা কি মালকোশ হচ্ছে? রাধু – [ রাধু মানে আমার ওস্তাদ রাধিকা মোহন মৈত্র] – রাধুর কাণ্ড – কোথা থেকে সব ধরে নিয়ে আসে। একটা মেঘের মত চেহারা, উনি গাইবেন মালকোশ। কোথায় মালকোশ হচ্ছে শুনি বল তো? আমাদের কানা কেষ্টর ‘ফিরে চলো আপন ঘরে’-র সঙ্গে এক বিন্দু মিলছে?’

এই দুই বুড়ো মরে গেছেন, কিন্তু এখনো বেচে আঁছেন কিছু কিছু সঙ্গীত সমালোচকের মধ্যে।

সঙ্গীত সমালোচক হতে গেলে তাঁর রাগ সম্বন্ধে, সঙ্গীত সম্বন্ধে… he must be at least an unsucessful musician – unsuccessful to the extent যে সে শিখেছে কিন্তু মিউজিশিয়ান হিসেবে খুব বেশী নাম করতে পারেনি, বা অন্য কিছু প্রফেশন সে করছে। তখনি সে… তা না হলে সে কি…মানে…

আরো একটা জিনিস আছে – এত পোলারাইজেশন – এক একজন সঙ্গীতসমালোচক এক একটা ঘরানা, বা একটা কোনও পার্টিকুলার আর্টিস্ট ওরিয়েন্টেড। আর সবাই তার কাছে খারাপ, বা তেমন কিছু নয়। আরো কিছু সঙ্গীত সমালোচক আছেন যাঁরা একেবারে মাইনে করা চাকর। তাঁরা নিজেরাও জানেন, এবং তাঁরা এটা বুঝতেও পারেন যে কিছু কিছু বুদ্ধিমান লোক আছে – সবাই তো ইডিয়েট নয় – তারা পড়লেই বুঝতে পারে যে তাঁরা একথা কেন লিখেছেন, তবু তাঁরা লিখে যান। কারণ তাঁরা জানেন যে ওই গোয়েবেলিসয়ান থিওরি – যে একটা জিনিস বারবার বারবার রিপিট করতে করতে দেশের ৯৯% লোকের মাথায় ওইটাই ঢুকে যাবে। এই ধরনের মিউজিক ক্রিটিসিজম হয়।

মন্দার: রেকর্ডিঙের প্রসঙ্গে আসি। পশ্চিম বাংলায় যাঁরা গাইয়ে বাজিয়ে, তাঁদের রেকর্ড কলকাতায় মোটামুটি পাওয়া যাবে এটা আশা করা যেতে পারে, কিন্তু পাওয়া যায় না।

বুদ্ধদেব: পাওয়া যায় না ফর দা ভেরি সিম্পল রীজন যে তাঁরা লতা মঙ্গেশকর নন।

তারাপদ চক্রবর্তী কোনদিন আমির খান সাহেবের মতো অতটা সমীহ এবং সম্মান আমাদের কাছ থেকে পাননি, কারণ তিনি আমাদের একজন। বাঙালির টিপিকাল ইয়ে। আমি দুজনের মধ্যে কম্পেয়ার করছি না। কিন্তু তারাপদ চক্রবর্তীর একটাও ভালো রেকর্ড আপনি পাবেন না। যে দু একখানা রেকর্ড আছে সেগুলো এইচ-এম-ভি স্ক্র‍্যাপ করে দিয়েছে, কারণ “সেগুলো তেমন বিক্কিরি হয় না।” যে কজন সারা ভারতবর্ষে এমন তাঁদের ক্লাউট যে তাঁদের রেকর্ড মেনটেন না করলে লোকে গালাগাল দেবে, সেরকম সেরকম লোকের কিছু কিছু হচ্ছে। আবার কিছু কিছু লোকের ইনফ্লুয়েন্সও আছে। সে বললে তার রেকর্ড হবে।

রাধিকা মোহন মৈত্রর একটাও রেকর্ড নেই। একটা দুটো ছোট খাট ডিস্ক আছে, সেগুলো খুঁজে পাবেন না। আমার নিজের একটা তিন মিনিটের ডিস্ক ছিল – ওয়ান অব মাই বেস্ট পারফরমেন্সেস – মেনি পীপল রেফার টু ইট ইভেন নাই, যারা পুরোন লোক – পাওয়া যাবে না। স্ক্র‍্যাপ করে দিয়েছে। তারপরে একটা এল-পি হয়েছিল সেটাও স্ক্র‍্যাপ করে দিয়েছে। ওই- প্রথমবার হাজার দুই প্রিন্ট করে তারপরে আর দে মে নট প্রিন্ট ইট, কারণ লাখে লাখে বিক্রি না হলে তাদের কাছে কোনও দাম নেই। আদারওয়াইজ আপনাকে প্রথম ৪-৫টা নামের মধ্যে একটা হতে হবে। তবে আপনার রেকর্ড যদি ওরা করে, কখনো কখনো ক্ষমা-ঘেন্না করে ডাকে আপনাকে। আদারওয়াইজ দে হ্যাভ অল ভ্যানিশড্ ফ্রম দা মার্কেট।

মন্দার: ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর বেস করে কম্পোজিশন বা ইম্প্রোভাইজেশান’ এইরকম কোন বিষয়ে আপনি কিছু করার কথা ভাবছেন, এমন একটা কথা পড়েছিলাম। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।

বুদ্ধদেব: আমাদের দেশে অনেক রকম কাণ্ড হয়। আই ক্যান গিভ ইউ দা এনটায়ার স্টোরি, গিভিং দা নেমস্ অব অল পার্সোলালিটিজ ইনভলভড্। কিন্তু এটা আপনি পাব্লিশ করতে গেলে লীভ আউট দা নেমস্। কিন্তু আমাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে আই উইল স্ট্যাণ্ড আপ অ্যাণ্ড সে ইয়েস আই হ্যাভ সেড সো। এ বিষয়ে কোন ভুল নেই।

গানবাজনা করতে গেলে লাস্ট আইটেমে গিয়ে অনেকেই বলে যে একটা ধুন বা একটা ভাটিয়ালি কিছু বাজান। আমি এ ব্যাপারে খুবই উইক ছিলাম। কোনদিন শিখি নি, বা মন দিয়ে কিছু করি নি। যখন আমায় এই জিনিসটাকে কন্ট্রোল করতে হল বাইরে বাজাচ্ছি বলে – ধুন বাজিয়ে, ভাটিয়ালি বাজিয়ে- তখন মনে হল ভাটিয়ালিই যদি বাজাব, রবীন্দ্রসঙ্গীত কি দোষ করল?

সেই সময়ে বিলায়েৎ খান সাহেব একটা বাজনা বার করেছিলেন – ভেঙে মোর ঘরের চাবি। হি ওয়াজ দা ফার্স্ট ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এইভাবে বাজিয়েছিলেন। এবং একেবারে এনটায়ার সুরটাকেই বাজিয়েছিলেন।

আমি প্রথমে সেই ভাবেই শুরু করেছিলাম। করতে গিয়ে দেখলাম যে রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসাবে বাজাবার কোন প্রয়োজন নেই। এর ভেতরে এমন এমন মেটেরিয়াল আছে, রবীন্দ্রনাথের রাগ বেসড্ গানের ভেতরে এমন কাণ্ড করেছেন, রাগের এমন এমন দিক খুলে দিয়েছেন – বল্লাম না, একটা রাগ সম্বন্ধে, রাগকে এক এক লোকে এক একটা অদ্ভুত অ্যাঙ্গল থেকে দেখে – যেটাকে ইউজ করতে পারলে অসাধারণ বন্দিশ তৈরী করা যায়। সেটা আমাদের বাহাদুরি নয়, রবীন্দ্রনাথের বাহাদুরি।

এটা মনে হওয়ার পরে আমার ফার্স্ট কম্পোজিশন যখন তৈরী করলাম – ১৯৭৫ সালে এটা তৈরী করেছিলাম – বছর ২-৩ বাজিয়ে [প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, রাগ ছিল পিলু], ১৯৭৮-এ ন্যাশনাল প্রোগ্রামে থার্ড পীস হিসেবে আমি সেটাকে বাজিয়ে দিয়েছিলাম অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে। আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত বোঝা যাচ্ছে, কট্টর যাঁরা আছেন ওখানে তাঁরা যদি বলেন এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, তুমি আরেকটা কিছু করে পাঠাও। আই ওয়াজ প্রিপেয়ারড উইথ মাই আরগুমেন্টস। আমায় – যদি ওরা চ্যালেঞ্জ করত, আমি বলতাম দুটো জিনিস আমাকে বল – কোথায় এ জিনিসটা সরোদ হয়নি, আর কোথায় পিলু হয়নি।

আমরা যখন বন্দিশ তৈরী করি, হয় অন্য একটা গান থেকে, না হয় অন্য একটা বন্দিশ থেকে খানিকটা টুকরো নিয়ে, জোড়াতাড়া দিয়ে। কাজেই আমি সেইটাই করেছি, একটা গান থেকে করেছি। আমাকে বলতে হবে, তোমরা না করতে চাও, কিন্তু আমার আরগুমেন্টের জবাব দাও। দে ডিড নট চ্যালেঞ্জ ইট, দে পাসড ইট। সেই থেকে আমার সাহস বেড়ে গেল। আই স্টারটেড ওয়ার্কিং অন ইট।

মন্দার: এই পীসের মূল প্রেরণা কোন্ গান থেকে পেয়েছিলেন?

বুদ্ধদেব: সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে।

তারপরে… ১৯৭৮-এর কথা হল এইটা। ১৯৮৫-এ আমি X-কে এই জিনিসগুলো শোনালাম। X ওয়াজ সো ইম্প্রেসড, বললেন একটা প্রোগ্রাম করতে হয় আমাদের। আমি, X, Y, বালসারা সাহেব পিয়ানোতে – এই প্রোগ্রামটা করলাম। কম্পোজিশানগুলো আমার, ওঁরা গান করছেন, সেই গানের লাইনের পরে পরে আমি আমার নিজের কম্পোজিশানটা বাজাচ্ছি, এইরকম করে। ইট ওয়াজ এ রোরিং সাকসেস। “দেশ”-এর সেই রিভিউ হয়তো আমার কাছে এখনো আছে। তারপরে যথারীতি দেশের লোকেরা, W-এর লোকেরা লাফিয়ে পড়ল যে এই একটা নতুন টেরিটরি পাওয়া গেছে, আর এ ব্যাটা একটা নগণ্য বাঙালি, একটা লাথি মারলেই তো ছিটকে পড়বে। ৮৫-র পরে আমি যতবার X-কে বলেছি… বার কয়েক আমি X-কে বললাম, যে “X, এত ভালো হয়েছে জিনিসটা, আরো কয়েকবার করি না কেন? একটা রেকর্ডও কি বার করা যায় না?” X আগে যেরকম এনথুজিয়াস্টিক ছিলেন, তখন দেখলাম পিকিউলিয়ারলি X বিকেম ভেরি কোল্ড। দু-একবার বলার পরে উনি বললেন, “না ভাই, এ আর কাকে গিয়ে বলব, ভাববে যে প্রোগ্রাম চেয়ে বেড়াচ্ছে।” কথাটা আমার মনে ঝট করে লাগল। X- এর প্রোগ্রামের অভাব নেই। পুটিং টু অ্যান্ড টু টুগেদার: প্রোগ্রাম চেয়ে বেড়াচ্ছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আমি আর তাঁর কাছে যাই নি। তার অল্পদিন বাদে তিনি W-কে নিয়ে ABCD-তে ওনার নিজের অ্যাকাডেমির টাকাকড়ি তোলবার জন্য…

মন্দার: নাম উল্লেখ প্রয়োজন হবে না। সকলেই বুঝবে X, W এরা কারা।

বুদ্ধদেব: না, না, অনেকেই বোঝেনি। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নির্বোধ আছে, নাম শুনেই গড়াগড়ি খায়।

তো সেই ABCD-তে প্রোগ্রামটা হল। আমিও বুঝে গেলাম যে কেন আমার প্রোগ্রাম আর হল না। তার কিছুদিন বাদে আবার আমি শুনলাম যে এইচ-এম-ভি-তে X, W-তে নিয়ে একটা রেকর্ড করছেন। তখন আমার ভয়ে মাথা ঘুরে গেল। আমার সেই ‘৮৫-এর প্রোগ্রামটা, তার সমস্ত রেকর্ডিং, তার কপি X-এর কাছে ছিল। হয়ত আমার একজ্যাক্ট কম্পোজিশানটা বাজাবেন না, কিন্তু ওগুলো আবার ইউজ করে ফেললে – W যদি ইউজ করে- তাহলে এমন একটা ব্যাপার হবে যে আমার নিজের তৈরী ঘরে আমি একদিন বাইরের থেকে এসে দেখব আর কেউ বসে আছে, অ্যাণ্ড হি ইজ আস্কিং মি হু আই অ্যাম অ্যাণ্ড হোয়াই আই হ্যাভ কাম হিয়ার।

তখন আমি দূরদর্শনে চলে গেলাম। সেখানে একজন খ্যাপা মত বাঙালি ভদ্রলোক ছিলেন প্রোডিউসার, জগন্নাথ মুখার্জী। হি টুক ভেরি কাইণ্ডলি টু মি। আমি তাঁকে বললাম যে মশাই আমি বাঙালি হিসাবে আপনার কাছে এসেছি। আপনি আমাকে একটা চান্স দিন। আই ওয়ান্ট টু বী ইন্টারভিউড বাই সামবডি। আমি একজন-দুজন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক-গায়িকা চাই এবং আমি বাজাব। এটা আমি কি করলাম, কবে থেকে করলাম, কেন করলাম, এবং কি ভাবে করলাম জিনিসগুলো, ওগুলো ঠিক করে এক্সপ্লেন করবার জন্য। উনি বললেন ঠিক আছে, আমি মধুমতি [মৈত্র]-কে ঠিক করে দিচ্ছি। মধুমতি ইন্টারভিউ নিল, অতনু সান্যাল আর বোধহয় প্রতিমা মুখার্জি এদের নিয়ে আমি করতে আরম্ভ করলাম। রিহার্স যখন করছি, তখন জগন্নাথ-দা সেটা শুনে হি বিকেম সো এনথিউজড, বললেন এটা আমি এখানে লোকাল সার্কিটে কেন, এটা আমি রবীন্দ্র উইকে দিল্লী থেকে টেলিকাস্ট করব ন্যাশানাল হুক-আপে(?)। আমি বললাম, দাদা আপনার কতটা হিম্মত জানিনা। ওখানে বাঘের ঘর আর আমি সামান্য চিংড়ি মাছ। এক ধাক্কায় এটাকে ওরা নস্যাৎ করে উড়িয়ে দেবে। তবু এখানে যদি হত টেলিকাস্ট, ওখান থেকে করতে গেলে… উনি বললেন তুমি দেখ, আমি পারি কি না। আমি ১০ বছর দিল্লী টেলিভিশানে কাজ করেছি। সামহাউ অর আদার, হি গট টু টেলিকাস্ট ইট। আমার ৮-১০ টা কম্পোজিশান। এবং সেই জিনিসটা আমি ন্যাচারালি তিনটে চারটে জায়গায় কপি করিয়ে রাখলাম। রেকর্ড হয়ে রইল যে এই জিনিসটা আমার তৈরী করা।

তারপর শুনলাম এইচ-এম-ভি-র রেকর্ডিং এখন কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তার কিছুদিন বাদে আবার এইচ-এম-ভি-র রেকর্ডিংটা হল – ওই যেটা ক্যাসেটে বেরিয়েছে বাজারে। সেটা বেরল। তার পর থেকে আমি যতবার চেষ্টা করেছি কোন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ককে নিয়ে… একটা হচ্ছে যে বিকজ অব মাই রিলেটিভ ডার্থ অব পাব্লিসিটি অ্যাণ্ড গ্ল্যামার, আর বিকজ অব দা ইন্টারফারেন্স অব সাম আনসীন হ্যাণ্ড, আমার এটা এক পা এগোয়নি। শেষকালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি টুক সাম ইন্টারেস্ট। তাদের জন্য আমি ৮-৯ টা গান- গান এবং বাজনা – রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলাম। তারপরে দু-একটা জায়গায় এই প্রোগ্রাম করেছি, কিন্তু জিনিসটা ওখানেই আছে।

মন্দার: এটা আপনার রেগুলার কনসার্টের অঙ্গ হিসেবে বাজান কি?

বুদ্ধদেব: না। প্রেজেন্টেশনটা এইভাবে হয়: (ক্রমশ আরো স্পেশালাইজড হচ্ছি এতে) আগে আমি বলি যে আমি কি করতে চেষ্টা করছি, আপনারা যদি আমাকে এক্সপেক্ট করেন যে আমি সরোদে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাব- যেমন গীটারে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজায় – সেটা নয়। একেবারেই নয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের থেকে কতগুলো মেন মেলোডিক লাইনস, যেগুলো আমার কাছে খুব অমূল্য মনে হয়েছে, সেগুলোকে ইম্প্রোভাইজ করে আমি ক্লাসিকাল কম্পোজিশান তৈরী করেছি ফর ইন্সট্রুমেন্টস। কম্পোজিশান যখন তৈরী করা হয় তখন এইভাবেই তৈরী করা হয়। সোর্স ইজ আইদার সাম সং, অর সাম আদার ইন্সট্রুমেন্টাল বন্দিশ, আপনারা সেই জন্য হুবহু যদি গানের লাইনের সঙ্গে মেলাতে যান, তাহলে হয়তো আমাকে মনে মনে গালাগাল দেবেন। কিন্তু একটু নজর করে দেখলে দেখবেন যে গানের লাইনগুলো এর মধ্যে অনেক জায়গায়ই লুকিয়ে আছে। হয়তো গানের সমস্তটাই আমি ইউজ করি নি, আমার প্রয়োজন নেই। যে জায়গাটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট সেটাকে আমি এমন ভাবে ঢুকিয়েছি যে দ্যাট বিকামস্ দা মেনস্প্রিং অব দা কম্পোজিশান।

গায়করা যেটুকু আমার প্রয়োজন সেটুকু ওরা গাইল। তখন আমি সেই লাইনটাকে আগে হুবহু রিপিট করলাম। নেক্সট রিপিটিশানে তাকে একটু চেঞ্জ করে দিলাম। থার্ড অর ফোর্থ রিপিটিশানে ওটার ফাইনাল ফর্ম বাজিয়ে তারপরে গৎ টা আজ এ ক্লাসিকাল পীস- সমস্ত কিছু, বিস্তার, তান ইত্যাদি সহযোগে – যতটুকু সময় দেওয়া যায় বাজাই। দেন আই টেক আপ দা নেক্সট ওয়ান। অনেক সময় বলি বাজনাটা আগে শুনুন, চিন্তা করুন কোন গান থেকে এসেছে। এইভাবে…

মন্দার: রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোন গান থেকে…

বুদ্ধদেব: অন্য কোন গান থেকে আমি করি নি। তবে নজরুল নিয়েও করার ইচ্ছে আছে।

মন্দার: আচ্ছা আপনি গান শোনেন তো নিশ্চয়ই? আপনার প্রিয় গায়ক কারা?

বুদ্ধদেব: আমার ২-৩ জন ছাড়া বেশি শুনতে… সময় নেই আর কি। আমি গোলাম আলি খাঁন সাহেবের ১-নম্বর ভক্ত, আমির খাঁন সাহেব…। ফৈয়াজ খাঁন সাহেবকে এখনো বুঝতে পারি না ভালো করে। তাঁর গলার রেকর্ডিং আছে আমার কাছে একটা… আমাকে সম্মোহিত করে না।

সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছিল ওনার লেখার প্রসঙ্গ দিয়ে। বৃত্তাকারে আবার আমরা সেই বিষয়টিতেই ফিরে এসে সাক্ষাৎকার শেষ করলাম। এর পর কিছুক্ষণ এটা সেটা বিষয়ে আলোচনা হল। তারপরেই খেয়াল হল যে অ্যাক-দেড় ঘন্টা সময় চেয়ে আমরা প্রায় ৩ ঘন্টা নিয়ে ফেলেছি। ততক্ষণে সন্ধ্যেও হয়ে গেছে। আমরা উঠে পড়লাম।

(সমগ্র সাক্ষাৎকারটি পড়তে হলে রসিক পাঠক ‘পরবাস’ পত্রিকার সাইটে দেখতে পারেন। সমগ্র সাক্ষাৎকারের লিঙ্ক –

https://parabaas.com/GRISHMO2/LEKHA12/bSaxat.html
https://parabaas.com/GRISHMO2/LEKHA12/bSaxat_p2.html
https://parabaas.com/BORSHA3/LEKHA13/bSaxat13.html)