Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চণ্ডী লাহিড়ী

চণ্ডী লাহিড়ী | কার্টুনিস্ট

শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

 

৮৭ বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যখন চণ্ডী লাহিড়ী ‘লাস্ট সাপার’ খেতে বসেছেন যমদূতের সঙ্গে, তখনও তিনি সমানে সক্রিয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি যখন যোগ দিচ্ছেন তখনই তিনি ৩০-৩১, ফলে প্রায় ছ’দশকের মতো সময় জুড়ে কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী বাঙালির হাসিকান্না-হীরাপান্নার মহান চিত্রগুপ্ত। পুত্রসম আমি অনায়াসে তাঁকে ‘চণ্ডীদা’ বলতাম। আমার হাঁটুর বয়সী কাল-কা-যোগীরাও বলত। কারণ চণ্ডীদাকে জ্যাঠামশাই বা বাবু কোনওটাই বলা যেত না, ঠিক যেমন তাঁর চিরদিনের সুপ্রিয় টারগেট জ্যোতি বসুকে জ্যোতি জেঠু বা জ্যোতিদা বলা যেত না। কার্টুনটা তিনি কেমন আঁকতেন — এটা বলা আমার ক্ষমতার বাইরে কিন্তু তাঁকে বার কয়েক সামনে আঁকতে দেখেছি বলে বলছি; কোর্টের পেশকার যেমন স্পিডে টাইপ করেন বা পা-মেশিন চালিয়ে পাইকার দর্জি যে-স্পিডে সেলাই করেন, ঠিক সেই স্পিডে আঁকতে পারতেন তিনি। পরিষ্কার নির্দিষ্ট স্ট্রোক পড়ত কাগজে, যেন অবয়বটা সাদা কাগজে আঁকাই আছে আগে থেকে। অর্থাৎ একটা ঈশ্বরদত্ত ড্রইংয়ের হাত ছিল। আর সেই সঙ্গে ছিল অনবদ্য পর্যবেক্ষণ শক্তি। অঙ্গভঙ্গি, শরীরের গঠনগত দুর্বলতা, সাজগোজের হাইপয়েন্টস — এসব ধরতে এক লহমা লাগত। তাই তিনি সঞ্জয় গান্ধী আর সিদ্ধার্থশঙ্করের জুলফির মিল খুঁজে পেতেন। জ্যোতিবাবুর গোমড়াথেরিয়াম মুখের মধ্যে একটা ক্রূর চোখ আঁকতে পারতেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরেই ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল। চণ্ডী আঁকলেন, পরম তৃপ্ত মুখে মোটাসোটা ভারিক্কি চেহারার ইন্দিরা গান্ধী একটা বেড়ালছানার সাইজের বাঘের বাচ্চাকে কোলে করে ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছেন। বেড়ালটা ভেকু ভেকু চোখে বোঝার চেষ্টা করছে — এই নতুন ধাইমা আসলে কী চান! চণ্ডী সম্ভবত বোধবুদ্ধি তৈরি হওয়ার সময় থেকেই রাজনীতির ছাত্র ছিলেন। নবদ্বীপের বারেন্দ্র বামুনবাড়ির ছেলে, জয় গৌর ছেড়ে দীক্ষা নিলেন জয় মার্কস-এ। মগজে আঁশ গজাল মানিক বাঁড়ুজ্যে, ঋত্বিক ঘটক, শম্ভু মিত্তির, বিজন ভট্টাচার্যদের দেখে, মগজের আঁশ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আজীবন-প্রায় চাকরি করলেন ‘বুর্জোয়া’ পত্রিকায়। অবধারিত ফল যা, তা-ই হল। দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেক নামযশ, গুণীজন সান্নিধ্য, নামীর নেকনজর — সব জুটল; কিন্তু চণ্ডী আর পোলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট রইলেন না, তাঁকে সরে যেতে হল সোশ্যাল স্যাটায়ারে — নাম দিলেন সে-সিরিজের, ‘তির্যক’। চণ্ডীর তির্যক আনন্দবাজারের সম্পদ ছিল, কিন্তু বাংলা ভাষায় সেই উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধ থেকে কার্টুনের যে কদর ছিল পত্রিকা মালিকদের কাছে, অফসেটের যুগে এসে তা হঠাৎ উপে গেল। বহু কার্টুনিস্ট ইলাসট্রেটর হয়ে গেলেন, মরে গেলেন, ফুরিয়ে গেলেন, সরে গেলেন। চণ্ডী ডন কিহোতে থেকে সাঞ্চো পাঞ্জা হলেন কিন্তু কালো কালির কলমটি নামিয়ে রাখলেন না। বিজ্ঞাপনে, প্রচার ছবিতে, সরকারি গণমাধ্যমে চণ্ডীর কার্টুন সিগনেচার ছড়াতে লাগল। বড় খোঁপা স্লিভলেস ব্লাউজে পৃথুলা বাঙালি গিন্নি, ছোট্ট ফ্রকে সাজা কিশোরী, ড্রেনপাইপ প্যান্ট পরা লোকাল লুম্পেন, গান্ধীটুপি মাথায় দেওয়া অবাঙালি ‘মগনলাল’-রা, খোট্টা ঝাঁকামুটে, অসৎ অথচ খাণ্ডারনি মেছুনী, হারমোনিয়াম-টেপা যশোলোভী গায়ক, খইনিখোর পুলিশ, হাফপ্যান্ট পরা বিচ্ছু ছেলে — এঁরাই চণ্ডীর চারপাশ। এন্তেকালের আগের ক’দিনেও সরকারের ক্রেতাসুরক্ষা দফতরের জাগরণী ক্যাম্পেন আঁকছেন, এতটা কর্মভাগ্য কজনের হয়!

এত এত ছবির বাইরেও চণ্ডী লাহিড়ী আরও বহু কাজ করেছেন। শুনেছি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনের ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনায় করা অ্যানিমেশন আছে, দেখিনি। বহু পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুবই চিন্তা-উসকে-দেওয়া লেখালেখি আছে, যা একত্র বই হয়ে বেরলে আমরা পড়ে স্বস্তি পাব — তা এ-ছ্যাঁচড়া ভাবীকালের কতটুকু উপকার আসবে, ভেবে কী লাভ! শত বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন মানুষটা, প্রচুর বকতে পারতেন, কিন্তু শূন্য কলসির বগ্‌বগ্‌ নয়, তাঁর অভিজ্ঞতার কুম্ভ পূর্ণই ছিল। বিশেষ করে, যাকে বলে সোসিও-পলিটিক্যাল উইস্‌ডম। মনে পড়ছে, এক শীত-সকালে চণ্ডীদাকে নিয়ে গিয়েছিলাম বালিতে, প্রায় গঙ্গাপাড়ে কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণের বাড়ি, রেবতীবাবু তখন সৃষ্টির বাইরে সরে এসেছেন। দুজনে গিয়ে বসলেন এক মন্দিরের পাথরবাঁধানো চবুতরায় — আড্ডা শুরু হল। প্রফুল্ল সেন, বিধান রায় থেকে জ্যোতি-সিদ্ধার্থ, নেহেরু ইন্দিরা থেকে জয়প্রকাশ-জগজীবন রাম হয়ে ‘মহান ভারত’-এর স্বপ্ন দেখা রাজীব — সব চলল, দুজনেই নিরন্ন দুঃখী দুর্নীতিগ্রস্ত দেশটাকে দেখছেন একটা ‘নারদীয়’ দৃষ্টিতে, তাতে রস আছে, কশ নেই! এটাই চণ্ডীর মতো মানুষজনের দর্শন ছিল।

চণ্ডী ছোটদের জন্য বেশ কিছু বই রচনা করেছেন, সেগুলো প্রায় লু-সুন-এর লেখার মতো সরল। তবে আমি তাঁর যতটুকু কাজের সঙ্গে পরিচিত, তাতে মনে করি, তাঁর সেরা কাজ ‘কার্টুনের ইতিবৃত্ত’ নামে একটি মাঝারি সাইজের বই। সারা পৃথিবীর কার্টুন, বিশেষ করে দুই বিশ্বযুদ্ধ ও তারপরের শীতল দুনিয়ার টানাপোড়েনের সময়ের প্রেক্ষিত থেকে চণ্ডী দেখেছেন তাঁর দেশের কার্টুন। গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল থেকে শুরু করে তাঁর দ্রোণাচার্য প্রতুল লাহিড়ী ওরফে ‘পিসিয়েল’, শৈল চক্রবর্তী, রেবতীভূষণ হয়ে চণ্ডী আলাপ করিয়ে দেন ‘শঙ্কর’ ও আর কে লক্ষ্মণ-এর শৈলীর সঙ্গে। সঙ্গে অনেকগুলো ছবি, যা কার্টুনের ইতিবৃত্তকে বুঝতে, শনাক্ত করতে সাহায্য করে। চণ্ডী লাহিড়ীর এ এক চমৎকার কাজ বের করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ‘অপশাসনের’ আমলেই। আজ সে-বই কি আর আমল পায়! তবে এ বই আজও পাওয়া গেলে ভারী আনন্দ হত। মনে পড়ল এর ভূমিকাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, লিখেছিলেন ‘শ্রীমান’ চণ্ডীকে ভালোবেসে হীরেন মুখার্জী।

কমিউনিস্ট চণ্ডী চেয়েছিলেন, তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া হোক বাগবাজারের গঙ্গাঘাটে। তাঁর মেয়ে তাই করলেন। এবারে ওপারে পৌঁছে কমিউনিস্ট হীরেন্দ্রনাথ কি জ্যোতি বসু কি প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হল কি না, কে জানে!