পবিত্র সরকার
১. ভাষাখিচুড়ি কেন?
প্রশ্নটা পুরোনো, উত্তরটাও কারও কারও জানা নেই এমন নয়। ধরা যাক মধ্যবিত্ত, শহুরে বাঙালির কথার এই একটা টুকরো— “ওকে, সি ইয়ু, চলি ভাই, এক্ষুনি আমার বসের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে ছুটতে হবে, প্লিজ ভাই, ডোন্ট মাইন্ড, আমার ইয়ঙ্গার ব্রাদারের একটা জবের ব্যাপারে বস একটু প্রমিজ করেছেন, তাই আইম ইন এ হারি, টাইম মেনটেন করতেই হবে, লেট হলে হয়তো চান্সটা মিস্ হয়ে যাবে। আমার হোম কন্ডিশন তো জানিসই, ফাদার রিটায়ার করেছেন অলমোস্ট ফাইভ ইয়ার্স, মা-বউ দুজনেই জাস্ট হাউসওয়াইফ, ওনলি আমি ফ্যামিলির জোয়াল টানছি। টা-টা।”
এই বানানো সংলাপটা কি খুব অবিশ্বাস্য? কিন্তু এরকম বাংলা কথা তো বাংলাভাষী অঞ্চলের পথে-ঘাটে শোনা যায়, বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক বেশি। রাজনৈতিক বক্তৃতায় তো ফুলঝুরির মতো এ ধরনের বাংলা ছোটে। এটা ইংল্যান্ড বা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নয় যে অল্পদিন প্রবাসী বাঙালি মা বাঙালি বেবিসিটারের কাছে বছর তিনেকের ছেলেকে রেখে বাইরে যাওয়ার আগে বলবে, “তুমি নটি হয়ো না বাপি, তোমার আন্টি তোমাকে ক্যারট দিয়ে রাইস মেখে দেবে, ইট লাইক আ গুড বয়, ওকে? ফিরে এসে যেন না শুনি তুমি ব্যাড্লি বিহেভ করেছ, ওকে?” বা ওখানেই কোনও বাঙালি চাকুরে যুবক সদ্য-আলাপিতা গবেষিকা তরুণীকে বলবে, “নেক্সট ফ্রাইডে ইভনিং-এ আপনি ফ্রি আছেন কি? চলুন না তা হলে একটু ডাইন-আউট করি, গল্পগুজবও হবে, আর ওদিন আর কুকিং-এর ঝামেলায় যাবেন না, আই প্রমিজ, আপনাকে আমি একটা ভালো সাপার কিনে দেব।”
বিদেশে এ রকম হতেই পারে। ইংরেজিভাষী দেশে ইংরেজিভাষার একাধিপত্য, সেখানে রেডিয়ো, টেলিভিশন সব ওই ভাষায় চলছে, রাস্তায় বেরোলেই ইংরেজি, সেখানে এমনটা হতেই পারে। বিদেশে যারা থাকে, তারা দেশে এসেও কথায় কথায় ও রকম ইংরেজি বলে ফেলে, পথে-ঘাটে, দোকানে-বাজারে।
কিন্তু যারা কস্মিনকালে বিদেশে যায়নি, সেই বাঙালিরা, বাংলাভাষী অঞ্চলে? এই ফেব্রুয়ারি মাসে, আর মে মাসে আমাদের এই নিয়ে শোক উথলে ওঠে, হাহাকার পড়ে যায় — আমরা হইচই ঠাট্টা ইয়ার্কি ব্যঙ্গবিদ্রুপ শুরু করে দিই, যারা এ রকম করে তাদের ধরে ধরে এক হাত নিই। তাতে আমাদের মাতৃভাষাপ্রেমের জ্বলজ্যান্ত সব প্রমাণ খাড়া হয়। যারা ‘বাংলিশ’ বলে তাদের যেন মুখদর্শন করতে চাই না আর। ভাবখানা এই যেন, আমরা নিজেরা কখনও বাংলিশ বলি না, ঘণ্টভাষা বলি না। সবটাই অন্যরা বলে। আমরা ভালো, ওরা খারাপ। আমরা কি কখনও নিজেদের দিকে আয়না ঘোরাই?
প্রশ্নটা হল, কেন স্কুল-কলেজে পড়া মধ্যবিত্তের শহরে বাংলিশের এত ছড়াছড়ি? প্রশ্নটা পুরোনো। উত্তরটা সকলের জানা নাও থাকতে পারে।
একটা উত্তর: খিচুড়ি ভাষা তখনই লোকে বলে যখন, কেউ যে ভাবেই হোক, দুটো ভাষার মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হয়, দুটো ভাষায় অল্পবিস্তর কাজ করতে করতে এগোয়। আমরা স্কুলে দুটো ভাষা শিখছি, কাজে-কর্মে দুটো ভাষা ব্যবহার করছি, কাজেই মুখের কথাতেও দুটো ভাষার উপাদান ঢুকে পড়ে, একটার সঙ্গে আর-একটা গুঁতোগুঁতি করতে করতে। বলছি বাংলা ভাষা, কিন্তু তার মধ্যে বাংলা কথাকে ছটকে দিয়ে ইংরেজি কথা ঝাঁপায়। যতক্ষণ ব্যাপারটা আলাদা আলাদা ছুটকো শব্দের ব্যাপার থাকে তখন তাকে বলে বুলি-মিশ্রণ (code mixing), আর যখন বাক্যের মধ্যে আলগা শব্দ ছিটোনো ছেড়ে দিয়ে পুরো বাক্য অন্য ভাষায় কেউ বলতে শুরু করে, তখন তার নাম হয়ে যায়, আমাদের বাংলায়, বুলি-লম্ফন। সেখানে দুটো ভাষারই ব্যবহার হয়, অর্থাৎ দ্বিভাষিকতা (bilingualism) চলে, সেখানে একটা থেকে আর-একটায় যাতায়াত চলতে থাকে। বুলি-মিশ্রণ বুলি-লম্ফন একসঙ্গেও ঘটতে পারে, কোনও আটক নেই। বুলি-মিশ্রণে একটা ভাষা থাকে ভিত্তি, তাতে অন্য ভাষার শব্দ এসে বসে যায়। বুলি-লম্ফনে সে ভাষাটাকেই ছেড়ে যাই আমরা। উপরের প্রথম দৃষ্টান্তটা বুলি-মিশ্রণের। বুলি-লম্ফনের দৃষ্টান্ত হল— “আরে ভাই, কথা বলবেন না, I don’t’ want any scenes here. If you want to continue your family quarrels outside your residence, please go elsewhere. আমার কথাটা পরিষ্কার বুঝেছেন কি?”
দুটো ভাষার মধ্যে বাস করা, যাপনে দুটো ভাষাকে জড়িয়ে নেওয়া — এ হল নিতান্ত পাটিগণিতের হিসেব। অর্থাৎ এ রকম বুলি-মিশ্রণ বুলি-লম্ফনের ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে যাকে বলে দ্বিভাষিকতা। একটি জনগোষ্ঠীর দুই ভাষার ব্যবহার। হয়তো তাদের ক্ষেত্র আলাদা — ঘরে মাতৃভাষা বলছি আর অফিসে আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বলছি লিখছি, কিন্তু তা হলেও নিজের ভাষাকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায় না। আমাদের ক্ষেত্রে বাংলায় অজস্র ইংরেজি ঢুকে পড়ে, বুলি-মিশ্রণ আর বুলি-লম্ফনের চেহারা নিয়ে।
আশ্চর্যের কথা হল, কিংবা মোটেই আশ্চর্যের কথা নয় যে, আমাদের ইংরেজিতে এভাবে মুড়িমুড়কির মতো বাংলা ঢোকে না। হ্যাঁ, আমাদের ইংরেজি দুর্বল হলে আমরা কেউ কেউ ইংরেজি বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে বাংলা শব্দ গুঁজে দিই, যেমন “ইয়েস্ স্যার, ‘মানে’ আই ওয়ার্ক হিয়ার, স্যার! মাই নেম ইজ, ‘যাকে বলে গিয়ে’ ইব্রাহিম তালুকদার স্যার! আই অ্যাম এ ‘মানে কিনা’ ডিলিং ক্লার্ক, স্যার!” কিন্তু এ রকম ইংরেজি না বলবার চেষ্টাতেই আমরা জীবনপাত করি। অর্থাৎ দুটো ভাষা পাশাপাশি আছে, কিন্তু দুটো ভাষা যে খুব গোবেচারা আর নিষ্পাপ বন্ধুযুগলের মতো গলাগলি করে বাস করছে, কারও পাকা ধানে কেউ মই দিচ্ছে না তা নয়। এর মধ্যে অন্তত একটা ভাষা মই দেওয়ার জন্যে তৈরি। দ্বিভাষিকতার যে চেহারাটা আমাদের দেশে চলে সেটা হল subordinate bilingualism, অর্থাৎ পরাধীন দ্বিভাষিকতা, যেখানে একটা ভাষা অন্যের তুলনায় নানা দিক থেকে দুর্বল।
২. শুধু দুটো ভাষা নয়, ভাষার গায়ের জোরের তফাত দেখুন
একটু আগেই বলছিলাম ইংরেজির মধ্যে খুব বেশি বাংলা শব্দ ঢোকেনি। কেন? বাঙালির ইংরেজির মধ্যে যে বাংলা শব্দ ঢুকতে সাহস পায় না, কিন্তু বাংলায় প্রচুর ইংরেজি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে তার কারণ আর কিছুই না — ইংরেজি ভাষার গায়ের জোর বাংলাভাষার চেয়ে অনেক বেশি। ইংরেজি প্রথমে ছিল আমাদের বিদেশি শাসকদের ভাষা, এখন হয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির আর প্রযুক্তির ভাষা। বড় চাকরিবাকরি ইংরেজি না জানলে জুটবেই না। সেই সঙ্গে, আগে যেমন ছিল, এখনও সে রয়ে গেছে উচ্চশিক্ষার ভাষা, উচ্চতর জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাষা। বিদ্যাচর্চার যে কোনও ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে হলে ইংরেজি বই আমাদের পড়তেই হবে। এই জন্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের মাস্টারমশাইরা ইংরেজি পড়া, ইংরেজি বলার সঙ্গে ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতেও বলতেন। এভাবে ইংরেজির অনিবার্যভাবে লেগে গেছে যাকে বলা হয় ভয়াবহ ‘প্রেসটিজ ফ্যাক্টর’, ইংরেজি বললে আমি পাশের ইংরেজি না-জানা লোকটার থেকে আলাদা হয়ে যাই, ‘বাবু’ হয়ে যাই। সে এক মহা সুখের অনুভব, প্রায় স্বর্গীয় আরামের বোধ — কিছু মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করার, অবজ্ঞা করার সুযোগ। আমি ওদের চেয়ে কত উন্নত! এ জন্যে যারা ইংরেজি জানে না তাদের আমরা প্রায় ‘অশিক্ষিত’ বলে গণ্য করি। ‘শিক্ষিত’ হল যারা স্কুলে ঢুকেছে, ইংরেজি পড়েছে, আর ‘অশিক্ষিত’ হল যারা ইংরেজি জানে না! আমরা মনেই রাখি না যে-মানুষ non-literate, সে আদৌ অশিক্ষিত নয়, শুধু মাতৃভাষায় লিখতে পড়তে শিখেছে তারা, কিংবা অক্ষরজ্ঞান যারা পায়নি (কেন পায়নি সে কথা রাষ্ট্র জানে) তারাও ‘অশিক্ষিত’ নয়। যাক-গে সে দুঃখের কথা।
এই ‘অশিক্ষিতে’রা ইংরেজি জানে না, তাই তারা অনেকে হয়তো সেই আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি কুলির মতো বলতেও পারে, সাহেবের মুখে ‘ড্যাম্’ গালাগাল শুনে — ‘সাহেব, ড্যাম্ যদি ভালো কথা হয়, তবে আমি ড্যাম্, আমার বাবা ড্যাম্, আমার চোদ্দপুরুষ ড্যাম্। আর ড্যাম্ যদি যদি খারাপ কথা হয়, তবে তুমি ড্যাম্, তোমার বাবা ড্যাম্, তোমার চোদ্দপুরুষ ড্যাম্ড্যামাড্যাম্ড্যাম্!’ কিন্তু যারা একটু-আধটু ইংরেজি জানে? তারা ইংরেজিভাষার গায়ের জোরের ব্যাপরটা সম্বন্ধে অনেক বেশি সচেতন। এত সচেতন যে তাদের গভীর অবচেতনে ঢুকে গেছে ব্যাপারটা। ফলে তাদের কথায়, তারা খেয়ালও করে না, আপনা থেকেই বাংলিশ বেরিয়ে আসে। ‘বাট্ আমি ওকে বললাম কী যে–’, ব্যাপারটা প্র্যাকটিকালি একই হল। সো আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই!’
এই গায়ের জোর যে কত, মহিমা যে কতখানি, তা বেশ বোঝা যায় যখন আমরা ইংরেজি গালাগাল শুনে যত রাগ করি, বাংলা গালাগাল শুনে তত রাগ করি না। এটা রাস্তাঘাটে আপনারাও লক্ষ করেন না, তা নয়। বাসের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে কেউ কারও পা মাড়িয়ে দিয়েছে বলে— ‘উহ্, (পাশের লোককে জোর ধাক্কা দিয়ে) কী করছেন? চোখে দেখতে পান না নাকি?’ ‘কেন, কী হয়েছে?’ ‘আরে মশাই, আমার ডানপায়ের কড়ে আঙুলটা যে থেঁতলে দিলেন!’ ‘ও, সরি!’ ‘আরে আপনি তো সরি বলেই খালাস, এখন আমার আঙুল নিয়ে হাসপাতালে না যেতে হয়! এখনও কী প্রচণ্ড জ্বলছে, মনে হয় হাড় ভেঙে রক্ত বেরিয়ে পড়েছে!’ ‘তা দেখুন, ভিড়ের বাসে এ রকম একটু-আধটু হতেই পারে।’ ‘হ্যাঁ, ‘হতেই পারে’, নিজেরা দেখবে না শুনবে না, আবার বলছে ‘হতেই পারে’।’ ‘আহ্ বলেছি তো সরি, এত রেগে যাচ্ছেন কেন?’ ‘রেগে যাচ্ছি কেন? কথা শোনো একবার! যন্ত্রণায় আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, আবার বলছে রেগে যাচ্ছি কেন? আক্কেল দ্যাখো একবার!’ ‘আরে মশায়, অত যদি আপনার সমস্যা তো ট্যাক্সি করে গেলেই পারেন!’ ‘কী, নিজে দোষ করে আবার তড়পাচ্ছেন! (ভেংচে) “ট্যাক্সি করে গেলেই পারেন!’ এ রকম চলতে চলতে তাপ চড়বে, শেষে একজন বলবে ‘শাট আপ’! তখন অন্যজন হঠাৎ তুমুল জ্বলে উঠে প্রচণ্ড ক্রোধে বলবে, ‘কী, শাট আপ? আপনি নিজে শাট আপ!’ এইভাবে পথের ঝগড়াটা অন্য একটা বিপুলভাবে সফল মাত্রায় পৌঁছে যাবে। সহযাত্রীরা বিনাটিকিটের বিনোদন পাবেন।
আমি আগেও নানা জায়গায় লিখেছি আর বলেছি যে, এ কথাটা সবচেয়ে বেশি করে বুঝেছিলেন বাঙালির মধ্যে এক ভদ্রলোক, যাঁর নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর সময়ে তাঁর মতো ইংরেজি জানা লোক ভারতীয়দের মধ্যে কম ছিল। তাঁর একেই কি বলে সভ্যতা প্রহসন থেকে একটা উদ্ধৃতি আমি আগে ব্যবহার করেছি, এখানেও তুলছি।
নব আর কালী দুই বন্ধু বারবনিতা-পল্লিতে একটি বাড়িতে অন্য বন্ধুদের বেশ অপেক্ষায় রেখে একটু দেরি করে ঢুকেছে। অন্য বন্ধুরা তখনই কিছুটা রসস্থ, তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার উপক্রম। এদের মধ্যে নবকে ঈর্ষা করে এমনও দু-একজন আছে। ঢুকে নব বলছে—
নব। …দেখ ভাই, আজ আমাদের এক্সকিউজ করতে হবে, আমাদের একটু কর্ম ছিল বলে তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে।
শিবু। (প্রমত্তভাবে) দ্যাট্স এ লাই।
নব। (ক্রুদ্ধভাবে) হোয়াট, তুমি আমাকে লাইয়র বল? তুমি জান না আমি তোমাকে এখনি শুট্ করবো?
চৈতন। (নবকে ধরিয়া বসাইয়া) হাঃ, যেতে দেও, যেতে দেও, একটা ট্রাইফ্লীং কথা নিয়ে মিঝে ঝকড়া কেন?
নব। ট্রাইফ্লীং? -– ও আমাকে লাইয়র বল্লে — আবার ট্রাইফ্লীং? ও আমাকে বাঙ্গালা করে বল্লে না কেন? ও আমাকে মিথাবাদী বল্লে না কেন? তাতে কোন্ শালা রাগতো? কিন্তু — লাইয়র — এ কি বরদাস্ত হয়?
(দ্বিতীয়াঙ্ক, প্রথম গর্ভাঙ্ক)।
আমাদের কবি-লেখক-নাট্যকারেরা অনেকেই ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’দের বাংলিশের নমুনা তুলে তাদের নিয়ে ঠাট্টবিদ্রুপ করেছেন, কিন্তু মধুসূদনের মতো পরিষ্কার করে কেউ দেখাননি যে, কেন আমাদের কথায় কথায় ইংরিজি বুলি-মিশ্রণ ঘটে যায়, তাতে আমাদের কী সুখ হয়, আমাদের দিশি কালো রঙে কতটা সাদা ছিটে তৈরি হয়।
৩. ভাষায় কি অন্য ভাষার শব্দ আসবে না?
এটা ঠিক, যে ভাষার ‘বিশুদ্ধি’ বলে কোনও গোঁড়ামির প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। অন্য ভাষার সঙ্গে দহরম মহরম হলেই ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ ঢুকবে, কারণ আমরা অন্য সংস্কৃতিও আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, আমরা আতিথ্য দিচ্ছি, আমন্ত্রণ করছি অন্য সংস্কৃতিকে। ঢুকে পড়ছে জীবনযাত্রার উপকরণ, তাদের নাম সুদ্ধ— চেয়ার, টেবিল, লাইট, ফ্যান থেকে অ্যাটম বম্ পর্যন্ত ; ঢুকে পড়বে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের নাম— স্কুল, কলেজ, ক্লাব, চার্চ, অ্যাসেম্ব্লি, পার্লামেন্ট, ইউনেস্কো; ঢুকে পড়বে নানা কাজ ও প্রক্রিয়া এবং তার ফলাফলের বর্ণনা— অপারেশন, সার্জারি, প্রোমোশন, ডিমোশন, ডিসমিসাল, ইম্পোর্ট, এক্সপোর্ট, রিটায়ারমেন্ট; ঢুকে পড়বে ভাবনাত্মক শব্দ ও তার পরিভাষা— ট্র্যাজেডি, কমেডি, ইম্প্রেশনিজম্, লিবিডো। আমাদের ভাষায় বিশ্বায়নের এই একটা দিক, গ্রহণের দিক। এই রকম আরও কত কী। কখনও কখনও আমরা আমাদের ভাষায় কিছু পরিভাষা তৈরি করবার চেষ্টা করব যারা ও ভাষাটা জানে না তাদের জন্যে, কিন্তু সে কাজটা সব সময়ে সফল হবে না, কারণ অন্য ভাষাটা আমাদের জ্যান্ত ব্যবহারে চলবে, পরিভাষাগুলোকে সেই জীবন দিতে সময় লেগে যাবে।
দুটো ভাষা কাছে আসা মানে হল দুটো সংস্কৃতির কাছে আসা। সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান হলে শব্দেরও আদানপ্রদান হবে। সব ভাষাই অন্য ভাষা থেকে, কাছে আসার সুযোগ পেলে সে ভাষা থেকে শব্দ ধার করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। ইংরেজি ভাষার মতো ধার-করিয়ে ভাষা আর দুটি নেই। এমনকি এমন যে সংস্কৃত ভাষা, তার মধ্যেও কত-না ভাষাপরিবারের, বিশেষত দ্রাবিড়, শব্দ ঢুকে পড়েছে তাও বারো-র মতো পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন। গ্রিক শব্দও ছিল বেশ কয়েকটা, তা সংস্কৃতের নিজের বংশগত সম্পদই বলা যায়। কাজেই ভাষার বিশুদ্ধি নিয়ে কোনও ছুঁচিবাই দেখানোর কোনও মানে হয় না। ফরাসিরা এ ব্যাপারে একটু নাক-উঁচু ছিল, কিন্তু তাদের ভাষাতেও যাকে ‘আমেরিকানিজ্ম’ বলে তা বেশ কিছু ঢুকে পড়েছে, ‘ও কে’, ‘কোকা কোলা’, ‘ম্যাকডোনাল্ড’ যেমন।
এক সময় বাংলাভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে একটু শুচিবাই বা ‘বামনাই’ ছিল। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা ‘কলম’-এর বদলে ‘লেখনী’, ‘দোয়াত’-এর বদলে ‘মস্যাধার’, ‘আদালত’-এর বদলে ‘বিচারালয়’, ‘পাট্টা’-র বদলে ‘ভোগবিধায়ক পত্র’ — এইসব লিখছিলেন আর লেখার সুপারিশ করেছিলেন। আর এক দুর্ধর্ষ সংস্কৃত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁদের ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন যে, “তাঁহাদের সে চেষ্টা কখনই সফল হইবার নয়।” এমন যে বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধের ভাষা দেখি—
“আসল কথা, জমীদারকে, “আগমনী”, “নজর”, বা “সেলামী” দিতে হইবে। আবার টাকার অঙ্কে ‘দু-আনা’ বসিল। …যে পারিল না, সে কাছারিতে কয়েদ হইল, অথবা তাহার দেনা বাকির সামিল হইল।” এই লেখাতেই পরে আছে, “পরান বড় দাঙ্গাবাজ লোক, ক্রোক করিলে দাঙ্গা হাঙ্গামা খুন জখম করিবে বলিয়া লোক জমায়েত করিয়াছে। অতএব আদালত হইতে পিয়াদা মোকরর হউক।”
ভাষার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র আছে, যেখানে বিশেষ ধরনের শব্দের ব্যবহার একটু বেশি হয়। তাকে ইংরেজিতে বলে রেজিস্টার, আমরা বাংলা করেছি ‘নিরুক্তি’। হিন্দুধর্মের ভাষার নিরুক্তিতে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার একটু বেশি, ইসলামের বাংলা নিরুক্তিতে আরবি-ফারসির। আমাদের আইন আদালতের ভাষাতেও তাই। অর্থাৎ সব শব্দেরই একটা স্বাভাবিক এলাকা আছে, সেখানে সে শব্দ মানানসই, অন্যত্র তা তত মানানসই নয়। এ যেন খানিকটা ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ গোছের অবস্থা।
৪. মুখের কথায় তা হলে কী হবে?
এটুকু জানি যে, ক্ষেত্রবিশেষে, অর্থাৎ নিরুক্তিতে বিশেষ ধরনের শব্দ, ধার-করা বিদেশি শব্দ সমেত, ব্যবহার করাই যায়। মনে রাখতে হবে, বাংলায় যেগুলোকে আমরা ‘তৎসম’ শব্দ বলি, সেগুলোও সংস্কৃত থেকে ধার-করা শব্দ, বাংলার নিজের ব্যাকরণে তৈরি-করা শব্দ নয়। এ ধরনের কোনও ধার অবশ্য আর ফিরিয়ে দিতে হয় না, আর এগুলো আমরা আস্তে আস্তে নিজেদের মতো করে ভেঙেচুরে আমাদের জিভের পক্ষে সহজ করে নিতে পারি। অর্থাৎ তৎসমকে অর্ধতৎসম আর তদ্ভব করে নিতে পারি। এইভাবেই ইংরেজি ব্লাউজ থেকে আমরা অর্ধতৎসম করেছি ‘বেলাউজ’, ‘লর্ড’ থেকে তদ্ভব করেছি ‘লাট’। তৎসম শব্দগুলোর বেলায় আমরা সংস্কৃত উচ্চারণ ভুলিয়ে দিয়ে বাংলা উচ্চারণে গ্রহণ করেছি, আর অর্ধতৎসম আর তদ্ভব অবশ্য পুরোদস্তুর বাংলা শব্দই হয়ে গেছে, যেমন হয়েছে চেয়ার-টেবিল জাতীয় ইংরেজি শব্দ, দরদ, কলম, কাগজ জাতীয় ফারসি শব্দ, বা আরবি আল্লা, নামাজ, তোবা, তসবি ইত্যাদি। এর অনেকগুলোকেই মূল ভাষার লোকেরাও তাদের শব্দ বলে চিনতে পারবে না।
ধার-করা শব্দ এক হিসেবে ভাষারই নিজের সম্পদ হয়ে ওঠে। কিন্তু তবু ভাষার একটা চেহারা আছে যাতে ভাষাটা সেই ভাষা বলে মনে হয়। তার বেশি বুলি-মিশ্রণ ঘটলে মনে হয় ঘণ্ট বা খিচুড়ি। এই খিচুড়ি শুধু বাংলাভাষার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে তা নয়, টেলিভিশন খুললে আপনারা শুনবেন ‘হিংলিশ’, তামিলভাষীরা জানেন ‘তাম্লিশ’ কাকে বলে, পাঞ্জাবিদের আছে ‘পান্লিশ’। এটা যেন নিজের জোরের ভাষা নয়, একটা অধীনতার ভাষা, দুর্বলতার ভাষা। আমাদের নিজেদের ভাষায় যথেষ্ট শব্দ থাকা সত্ত্বেও তা না ব্যবহার করে আমরা অকারণে ইংরেজি শব্দ ঢোকায়। ‘কিন্তু’ না বলে ‘বাট্’’ লাগাই, ‘আসলে’ না বলে ‘ইন ফ্যাক্ট’ বা ‘অ্যাকচুয়ালি’ বলি, অবশ্য না বলে ‘অফ কোর্স’ বলি, টেলিফোনে কথায় কথায় ‘ও কে’, ‘ফাইন’, ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলি, আর সেই এক আগাপাশতলা অদ্ভুত বাংলা খাড়া করি যাতে বাংলাটা আর বাংলা বলেই মনে হয় না। তাই দেখি, বাংলা ভাষাসাহিত্যের ছেলেমেয়েরাও আজকাল বলে আমরা বেঙ্গলিতে অনার্স আর বেঙ্গলিতে এম এ পড়ছি। এই ‘মুখের বাণী’ কার কানে ‘সুধার মতো’ লাগে আমরা জানি না।
৫. কথা বলার সময় খেয়াল রাখতে হবে কী বলছি
জানি, এ কাজটা খুব কঠিন। কথা বলি মনের ভাবকে ঠেলেঠুলে বার করবার জন্য, অত হিসেব করে কে কথা বলে? তাই তো বলি, ‘আমি অফ কোর্স মিনিস্টারের কথার ওপর ডিপেন্ড করছি না, উনি প্রমিজ করেছেন বলেই নেচে ওঠার কিছু নেই। এই তো ব্রিজের ফাউন্ডেশন লে করা হল, ওয়ার্ক শুরু হোক, লেবার মিস্তিরি ইঞ্জিনিয়ার লাগুক, তবে তো কনভিন্স্ড হব!’ অবশ্যই এর অনেকটাই ঘটে আমরা ব্যাপারটা খেয়াল করি না বলে। আমাদের ভাষাব্যবহারের অনেকটাই মুহূর্তের তাগিদে, অসচেতন, স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার। চারপাশের হাওয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বিদেশি শব্দগুলো জাঁকিয়ে বসে থাকে, ফলে সেগুলোই মাথায় ঢুকে যায়, মুখের কথায় বেরিয়ে আসে। হয়তো এবার খেয়াল করে ব্যবহার করার সময় এসেছে, কারণ ভাষাটার চেহারা কেমন কিম্ভূত হয়ে যাচ্ছে কখনও কখনও। হয়তো ২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে-র সম্মান রাখার জন্য সময় হয়েছে মাথার টনক ঠিক রেখে কথা বলার।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথদের একটা আড্ডায় ঠিক হয়েছিল যে, যে বাংলার মধ্যে অকারণে ইংরেজি শব্দ বলবে তাকে এক পয়সা করে জরিমানা (দেখুন, আমি খেয়াল করে ইংরেজি কথাটা এড়িয়ে গেলাম) দিতে হবে। গল্পটা হুবহু মনে নেই, কিন্তু যিনি প্রস্তাবটা রেখেছিলেন, তিনিই ‘ফাইন’ বলে ফেলেছিলেন বলে, জরিমানার বাটিতে তাঁকেই প্রথম পয়সা ফেলতে হয়েছিল। আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের উপর এই শর্তটা চাপানো গেলে দেশের প্রচুর রোজগার হত। তা তেমন সুদিন কি আর আসবে?
আমরা কেউ সংকীর্ণ বাংলাপ্রেমিক নই, আমরা কেউ চাই না যে শিক্ষিত বাঙালি শুধু একটা ভাষা নিয়ে জীবন কাটাবে। কিন্তু আমরা কেউ একই সঙ্গে চাই, যেন আমরা খেয়াল করে পথে ঘাটে বাংলাভাষাটা বলে চলি। যেন কথায় কথায় এবং অকারণে এ ভাষার গায়ে ইংরেজি শব্দের ছ্যাঁকা না লাগাই। রাজনীতিবিদ থেকে (ইংরেজির হিসেবে) উচ্চশিক্ষিত মধ্যশিক্ষিত স্বল্পশিক্ষিত সমস্ত বাংলাভাষীর কাছে আমাদের আবেদন, ভেবেচিন্তে সেই বাংলা ব্যবহার করুন যে বাংলাটা খিচুড়ি ভাষা বলে মনে হবে না। ধার-করা, হজম-করা শব্দাবলি নিয়েও বাংলার ‘বাংলা’ হয়ে ওঠবার ক্ষমতা আছে। নিজেরা সেই বাংলা বলুন, ছেলেমেয়েদের (ইংরেজি মাধ্যমে পড়তেই পারে তারা) এই বাংলাটা বলতে শেখান। তারা ইংরেজিও শিখুক ভালো করে, কিন্তু বাংলাটাকে ভুলে গিয়ে নয়।
আশা করি এবার ফেসবুকে কোনও বাঙালির কাছ থেকে ‘হ্যাপি ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’ সম্ভাষণ পাব না। ‘বাংলিশ ভাগো!’ ‘আসল বাংলাভাষা’ জাগো!