সোহম দাস
ভাসিতা, তোমাকে গোপনে একটা খোলা চিঠি লেখার ইচ্ছে ছিল। ধরো, সেটা তোমাকে লিখতে গিয়ে আমি অন্য কাউকে অ্যাড্রেস করে ফেললাম। বা ধরো, তোমাকেই। আচ্ছা, ভণিতা থাক। ধরো, এই শীতের শেষ, মরসুম-বদল, আমার মতো ঠাণ্ডার ধাত যাদের তাদের জন্য একটু পোশাকি সাবধানবাণী — এসব ছাপিয়ে তোমার বাজি হোক অন্য কিছু। এই ধরো সাড়ে বারো একরের মতো একটা জায়গা যেখানে ঢুকলে মাঝে মাঝে তোমার মনে হবে নিজের বাড়ি, বা উন্মাদ-আশ্রম, আবার কখনও মনে হবে হাইস্ট্যান্ডার্ড গোছের কিছু একটা যেটা আপাতত তোমাকে অন্তত বারোদিনের জন্য বারবার জড়িয়ে ফেলবে! অদ্ভুত লাগছে না শুনতে? বিশ্বাস করো, এটা বেশ অদ্ভুতই! এই ধরো, তুমি হাঁটছ, পাশে আমিও হয়তো। তুমি এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলে একটা ধূসর রঙের ঢাউস দেশ কোথা থেকে যেন হাজির হয়ে গেছে। একটা দেশের মধ্যে আরেকটা দেশ। সংস্কৃতির ভেতর সংস্কৃতি। যেখানে একাকার হয়ে যাচ্ছেন মোপাসাঁ-বনফুল, হুগো-বঙ্কিম, সার্ত্রে-রবীন্দ্রনাথ। ভাসিতা, এও কি সম্ভব! ও, তোমাকে আজকের তারিখটা বলিনি না? একুশ বছর আগে এইদিন আগুন লেগেছিল এই মাদকতায়, সে দিনটাও নাকি ছিল শনিবার! অবাক হচ্ছ ভাসিতা? আরও শুনবে, ঠিক একশো বছর আগে এই দিনে ভার্সেইতে সুপ্রিম ওয়ার কাউন্সিলের সম্প্রসারণ করে দিল ডেভিড জর্জের সরকার! ভার্সেই কোন দেশে বলো তো? যে দেশে মাঝরাতের পর অতীতের সোনালী সময়রা এসে খেলা করে যায়। দালি, জোলা, পিকাসো, হেমিংওয়ের সেই দেশ এবারেই এল এতটা জায়গা নয়, হৃদয় জুড়ে থাকার জন্যে! শুধু কোইন্সিডেন্স বলবে একে? বড্ড হালকা হয়ে যাবে, তুমি বরং অন্য কিছু ভেবো!
আচ্ছা, এবার তুমি এগোতে এগোতে দেখলে একটা গাড়ি কেউ সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। ভাগ্যের খেলা। শুনলে হাসি পায় না? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি ভাসিতা! ততক্ষণে পাশেই আবার তুমি দেখবে মানুষ কখনও হয়েছে তাত্ত্বিক, কখনও হয়েছে নাবিক, কখনও হয়েছে (স্ব)চিত্রগ্রাহক। তুমি এসব দেখবে, একটু পরে হয়তো এদের কোনও একজন তুমি হয়ে যাবে! আচ্ছা, কোনও একটা স্টলে ঢুকবে না? দ্যাখো ভাসিতা, ফাঁকা স্টল অথচ কত যত্ন নিয়ে বইগুলো মুছে রাখছেন পাকাচুলো ভদ্রলোক। কী বলবে তুমি একে? সন্তানস্নেহ বোলো না, ওটা তোমাদের একচেটিয়া থাক। তুমি বরং অন্য কিছু ভেবো!
মানুষ দেখো ভাসিতা! অনেকরকমের মানুষ। তাদের কথা, কথার তারা। কথারও গন্ধ থাকে, বিশ্বাস করো। “কলকাতা বইমেলা না বলে বৃহত্তর কলকাতা বইমেলা বলা উচিৎ এবার”। আরও অনেক কিছু শুনতে শুনতে তুমি এগোও। পিছোতেও পারো। এখানে যা খুশি তাই করতে পারো। আসলে তুমি স্টলে না ঢুকেও বইয়ের পাতা ওল্টাতে পারো। ভেবে দ্যাখো তো, এত চরিত্রের ভিড় — সবরকম চরিত্র, এত পট পরিবর্তন — এই উৎসব বলা হচ্ছে যাকে সেও কি কোথাও বইয়ের মতোই হয়ে যাচ্ছে না? তুমি একমত নাও হতে পারো, কিন্তু ভেবে দেখো।
আচ্ছা তোমাকে একটা অন্য জিনিস দেখাই। ওই দ্যাখো দূর থেকে নীল পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা হাতে দুটো পত্রিকা নিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে বলল, ‘আমরা একটা পত্রিকা করছি, একটু দ্যাখো দাদা!’ একরাশ স্বপ্ন, এই আকালের যুগেও! যেরকমই হোক, আমি কিনে নেব ওর থেকে! দেখবে তাতেই ওর চোখদুটো থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। ওই আলো সূর্যের থেকেও উজ্জ্বল আলো দেয়, সত্যি!
ভাসিতা, এটা একটা উৎসব, একটা উপন্যাস। তাও কোনওভাবে কৌতুকনাটক নয়। ‘জ্যোতিষ তাড়ান। পকেট বাঁচান’। না ভাসিতা, আসলে এটা জীবন। জানোই তো, লাফটার ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন। ও, আরেকটা স্বপ্নের জায়গা আছে ভাসিতা। নীল-সাদা স্বপ্নের দেশ। যেখানে তুমি ‘অনবদ্য’ কিছু পাবে, যেখানে তুমি বিস্ময় পাবে, যেখানে তুমি প্রাণ পাবে! এখানেই তোমাকে আমি ছেড়ে দেব, মানে গোপনে লেখা খোলা চিঠির শেষ আমি এখানে করব। তারপর তুমি বাকিটা শেষ কোরো!
পুনশ্চ: ভাগ্যের খেলা বলছিলাম না? আজকে দুজন হেরে গেছে সেই খেলায়। আবার আগুন জ্বলেছে আজ। তবে উৎসবে ভাঁটা পড়বে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকো। ৩রা ফেব্রুয়ারিগুলো দুঃখ ছাড়া অযাচিত আনন্দও দিয়ে যায়!