Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমার বইমেলা — কৃষ্টির দুর্ভার স্মৃতি

ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

 

কিতাবসিন্ধুর ওপার থেকে…

এই ঋতুর মেলায়, মানে এই ঋতুর বইমেলায় আজই প্রথমবার গেলাম। এবং সম্ভবত শেষবারও। কেন শেষ, তার উত্তর দিতে গেলে অনেক আর্থ-সামাজিক কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে এই লেখায় সেই ব্যাখ্যা ফাঁদার দায় আমার নেই। থাকলে মুশকিল হত।

দু’নম্বর গেটের কাছে নামতে না নামতেই কানে এল একটা অদ্ভুত গান। সে-গানে বিশ্ববাংলা আছে, এমনি বাংলাও আছে বলে মনে পড়ছে, প্যারিস আছে, সম্ভবত শঁজেলিজে আছে, আর – ও হ্যাঁ – লিটল ম্যাগাজিন আছে। সাদা কালো আর রঙিন স্বপ্নের কথা আছে। সেই গানটা মনে হয় বইমেলার জন্য সরকারি তরফে তৈরি কোনও গান হয়ে থাকবে। যেটুকু সময় মেলায় ছিলাম, সেই গান মাঝে মাঝেই আছড়ে পড়েছে। মাঝের কিছু তুলনায় ভালো ও অভ্যেসে ভালো-লাগা গানের রেশ কাটিয়ে থাবড়া মারছে সেই বইগীতি। বলতেই হয়, বারংবার বইমুখী করে তুলছে এই গান! বইয়ের জন্য এত কিছু!

ফেসবুক থেকে রসদ নিয়ে বানানো তালিকার কিছু বই ধ্যানবিন্দু থেকে নিয়ে, তার হলুদ প্যাকেটকে সেখানেই রেখে কিছুটা দূর গিয়ে লিটল ম্যাগের শামিয়ানাতে পৌঁছে দেখলাম – ভোঁ ভাঁ! কোথায় কী! গোটা অঞ্চলে মনে হয় তখন দু’চারজন। বসে আছেন যুগপৎ চূড়ান্ত বিরক্তি ও ধৈর্য নিয়ে। আমা-হেন স্থূলত্বের উত্তম নিদর্শনকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তাঁরা বসে রইলেন। ফিরে আসবার সঙ্কল্প নিয়ে অন্যতর অঞ্চলে পা বাড়াতে হল সুতরাং।

তৃণমূল বনাম সিপিএম

সত্যি বলতে কী, গরম ছাড়া আর তেমন কিছুই আমার খারাপ লাগল না এই নয়া বইমেলার। হয় তো তখনও তেমন ভিড় জমে না-যাওয়াটা তার একটা কারণ। বইয়ের দোকান ছাড়াও চলার পথে নজর কেড়ে নিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার স্ট্যান্ড। সেখান থেকে সড়াৎ করে বেরিয়ে এসে ভারী সুন্দরভাবে আমাকে পাকড়াও করলেন এক ভদ্রমহিলা। অত্যন্ত ভদ্রভাবে তিনি বললেন, ‘বই কিনতে এসেছেন, এই সময় ডিস্টার্ব করব না। শুধু নাম আর নম্বরটা দিয়ে যান। আমরা আপনাকে পরে ফোন করে নেব স্যর।’ সঙ্গে একটা নীলরঙা কাগজও হাতে ধরিয়ে দিতে ভুললেন না তিনি। নজরকাড়া একটা লম্বা লাইন দেখলাম, এটিএমের পাশের দরজা দিয়ে ঊর্ধ্বমুখে চলে গেছে। সকলের হাতেই কিছু করে কাগজপত্র। মনে হল এঁরা বইয়ের প্রত্যাশায় আসেননি। অর্থাৎ, এক যাত্রায় পৃথক ফলের ব্যবস্থা।

যথাবিহিতভাবে শ্রী সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় (তোপসে! তোপসে!)-এর দোকান চোখে পড়ল। আরও চোখে পড়ল একটা অল্টো গাড়ি, দে’জ-এর সামনের চত্বরে। মনে মনে প্রাচীন প্রবাদটা ঝালিয়ে নিতে গিয়ে দেখলাম সেটা উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে। ফালতু।

আমার পূর্বপরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে-নিতে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে, অথচ, সন্তর্পণে ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে দেখা হল মলাটদার শ্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলিয়ে-কইয়ে মানুষ। তিনি অবশ্য এক কথায় উড়িয়ে দিলেন সব। বললেন, বিক্রিবাটা নাকি এ-বছর জমেনি একেবারেই। ওঁর বিশেষ অনুরোধে যখন ইতিমধ্যে ক্রীত একপিস বইয়ের মলাটীভবনে আমি সম্মতি জানিয়ে ফেলেছি (মূল্য মাত্র কুড়ি টাকা এ-বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে) এবং সেই কাজে উনি রত হয়েছেন, তখন আমাদের হালকা কথা চালাচালির মাঝখানে এসে পড়ল দু’জন ছোট মেয়ে। মানে মেরেকেটে কলেজ-টলেজের হবে। উনি আমার কাজ সারতে-সারতেই ওদেরও অ্যাপ্রোচ করলেন। ওরা বিশেষ পাত্তা না-দিয়ে এগিয়ে যেতেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটল শ্রী চক্রবর্তীর। ‘সেই তো! বইয়ের যত্নের জন্য কেন খরচা করবে? ওর ডবল দাম দিয়ে গেলো গে যাও!’ ওদের শাপশাপান্ত করতে-করতে উনি আমার রুচির প্রশংসা করতে ভুলছিলেন না অবশ্য। শেষকালে মলাট দেওয়া শেষ হলে আলোচনা যখন সুজেট জর্ডন সত্যিই ‘মন্দ মেয়ে’ ছিলেন কী না সেইদিকে মোড় নিল, কোনও একটা অদ্ভুত ছুতো দেখিয়ে আমি ওখান থেকে পালালাম।

ছায়া সুনিবিড়…

এবারের বইমেলায় যদি সত্যি কোনও শান্তির নীড় থেকে থাকে, তবে সেটা আছে ফ্রান্স প্যাভিলিয়নে। ওই তাতাপোড়া গরমে ফ্রিস্কিং-এর বিরক্তি সহ্য করেও দু’বার আমি সেখানে ঢুকেছি, এবং নানাবিধ জটিল সাইকাডেলিক হট্টগোলের মধ্যে পড়েও দু’দণ্ড ঠান্ডা বাতাস পেয়েছি। এর বাইরে আমি জেনেছি, কিভাবে প্যারিস টুকে লুটিয়েনসাহেব বানিয়েছিলেন নয়াদিল্লি। আই লাব ইউ ফ্রান্স!

শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি কড়া ডোজের পক্ষপাতী। বাংলাদেশের সমকালীন কবিদের মধ্যে ইমতিয়াজ মাহমুদের রক্তাক্ত করার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে। ওঁর ‘কালো কৌতুক’ বইটা খুঁজতে ঢাকার বিখ্যাত আহসান মঞ্জিলের আদলে গড়া বাংলাদেশ প্যাভিনিয়নে ঢুঁ মেরেছিলাম। বিফল হয়ে ফিরতে হল। হুমায়ুন আহমেদ ও ইসলামি পুস্তকের প্রাচুর্য এড়িয়ে, এবং এই দুই বিষয়ের বইয়ের দোকানের সামনের জনসমাবেশের মধ্যে পথ করে নিয়ে ‘কালো কৌতুক’ আমি হস্তগত করতে পারলাম না ইমতিয়াজভাই। আমাকে ক্ষমা করবেন।

কৃষ্টির দুর্ভার স্মৃতি ও রঙ্গিলা দলানের মাটি

এত বড় একখানা লেখা ফেঁদে বসেছি বটে, কিন্তু তেমন বইপ্রেমী আমি নই — এ-কথা আপনাদের জানিয়ে না রাখলে সত্যের অপলাপ হবে। বই কিনতে কলেজ স্ট্রিটে না-গিয়ে বইমেলায় কেন যাই, নিজেকে এই প্রশ্ন করে আমি কোনও সদুত্তর পাই না।

ব্যাপারটা শুধু নস্টালজিয়াও নয়। তারও তো জন্মের কারণ থাকে।

আসলে, বই বিষয়টাকে একরকম ভক্তি করতে শিখেছি বলে মনে হয়। ওটা বই, সুতরাং ওটা ভালো। শুধু তাই নয়, বইমেলা হল কৃষ্টিবান মানুষের সমাগমক্ষেত্র, এইরকম কিছু একটা ভাবতে শিখেছি মনে-মনে। শুনলে অবাক হবেন, এই কবি-লেখকদের মধ্যেও যে যথেচ্ছ বদমাইশি বাসা করে থাকে, আমার এই ধারণার বয়েস খুব বেশি নয়। একটা বোকা-বোকা আদর্শবাদ থেকে জন্ম নিয়েছে আমার বইপ্রীতি। তাই হয় তো বইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসার অনেকটাই বই কেনার সঙ্গে-সঙ্গেই ফুরিয়ে যায়, সঙ্গিনীকে সঙ্গম-পরবর্তী মুহূর্তে যেমন তীব্রতায় দূরে রাখেন কেউ-কেউ।

এই কৃষ্টিবান মানুষ সাধারণ্যে বিচরণ করেন না। তাঁদের পথটা অন্যতর। কারণ তাঁদের ভাবনা অন্যরকম। অল্টারনেটিভ। সাধারণ পথের রসদ নিয়ে আমার এই অন্যপথের অ্যাডভেঞ্চার আদতে একেবারেই নিষ্ফলা, এই সত্যটা আমি জানি। তবু মেনে নিতে পারি না। তাতে ব্যর্থতাবোধ বাড়ে বই কমে না। সারা জীবনের সঞ্চিত বিফলতার ওপর উপর্যুপরি অসাফল্যের আঁটি চাপিয়ে যাই আমি, মধ্যবিত্ত পাতি বাঙালি আমি। ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে… আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়, বায়ুপরশন নাহি সয়…

কৃষ্টির দুর্ভার স্মৃতি ও সত্যপালনের চেষ্টায় আমি বইমেলায় যাই। প্রতি বছর। যেতে হয়, তাই যাই। আমার আসল বইমেলা ঠিক এইরকম। তবে আজকে দেখলাম, আমার সেই আগের বইমেলা আস্তে আস্তে আগের গাম্ভীর্যের খোলস ছেড়ে হয়ে উঠছে পপুলার। সরকারি দফতরের স্ট্যান্ডে র‍্যাকের উপর শোভা পাচ্ছেন হিন্দি ছবির দেশপ্রিয় মহানায়ক। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বইয়ের নামকরণে টিভির জনপ্রিয় কমেডি শো-এর ছোঁয়া। মুষ্টিমেয় এলিটের লীলাক্ষেত্র আজ হয়ে উঠছে সর্বসাধারণের, যেমন করে রোমান হরফের ‘সাহায্যে’ বঙ্কিম ও রবি পৌঁছবার অপেক্ষায় আছেন ‘জেন-এক্স’ বাঙালির ঘরে-ঘরে।

জীবনে লিটল ম্যাগ না-করা, উল্লেখযোগ্য কোনওরকম সাহিত্যের চর্চা না-করা আমার তো এ-দেখে শান্তি পাবার কথা ছিল। পাচ্ছি না কেন? ভুল-শেখার দালানকোঠার মাটি খসে পড়ছে বলে?