কৌশিক বাজারী
মূলত বাংলার জল হাওয়ার মধ্যেই একটা কিছু আছে! হয়ত ভুল বললাম। এই পৃথিবীর জল হাওয়ার মধ্যেই একটা কিছু আছে। যা মানুষকে সেই অপার্থিব শক্তির অধিকারী করে তোলে। উদাসীন ও উদার কখনও বা। প্রতিটি শিশুর মধ্যে তার জল মাটি পরিবেশ তাকে এই অনন্য জীবন উপহার দেয়। কেউ তার বাইরে নয়। সোনার চামচ আর মাটিরবাড়ির মধ্যে এখানে কোনও তফাত নেই। সে এক অপার সরলতা! ক্রমে এই মানুষেরই বানিয়ে তোলা সভ্যতা আর শিখিয়ে দেওয়া আচরণ তাকে অতি যত্নে এক পরিশীলিত চশমা প্রদান পূর্বক অকবি করে তোলে খুব ধীর ও নিশ্চিত গতিতে। যারা কিছুটা এই যত্ন এড়িয়ে ধুলি ধূসরিত থেকে যেতে পারে মনে মনে, তারা কবিত্ব বাঁচিয়ে রাখে খুব গোপনে। সংখ্যায় অল্প নয় তারা।
হ্যাঁ, হয়ত বইমেলার নাম শোনেনি তারা। অথবা বইমেলায় টেবিলে বসে থাকে চুপ করে। এরা হয়ত শঙ্খ ঘোষের খুব কাছের কেউ, অথবা তার নাম শোনেনি। কিচ্ছু এসে যায় তাতে! মূলকথা খুব শৌখিন পাঞ্জাবী বা শাড়ি পরিহিত বইপোকা সে নাও হতে পারে। হয়ত সারাদিন যাত্রী তোলা আর নামানোতে তার দিন যায়। টিকিট কাটা আর বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকার ফাঁকে, দুপুরে রাস্তার কোনও শস্তা হোটেলে ভাতের থালায় তার ঈশ্বর দর্শন ঘটে যায়। টিকিটের গোছার পিছনে লিখে রাখে– ‘সুতনুকা নামে এক দেবদাসীকে ভালবেসেছিলাম, এখনও বাসি’। আর হোটেলের পিছনে শিরিশগাছে হাজার বছরের পুরনো একটা হাওয়া দেয়। কেউ লক্ষ করে না। এই তো হয়!
এরা না হয়ে ওঠা কবি। আর হয়ে ওঠা কবি কারা? যারা একটা ধারাবাহিক চর্চার ভেতর নির্মাণ শিখে গেছে। যার সারাদিন মাঠে মাঠে জল সিচনে দিন গেল, যাত্রী তোলা আর নামানোতে দিন গেল, নির্মাণ শেখা হল না বলে এ হেন তিরস্কার! — কেউ কেউ কবি! যে লেখে সেই শুধু কবি নয়। এটুকু বলার।
নইলে সামান্য নির্মাণ শিখে নিয়ে আমার বইমেলা যাবার অধিকার জন্মাল! আমার মনের কথা আমি লিপি সাজিয়ে নির্মাণ করলাম এইবার। তুমি সেই সাজানো অক্ষর দেখে আমাকে চিনলে। যদি না পারতাম? যদি অন্যকিছু শিখে নিয়ে অন্য জীবন কাটাতাম? তাহলে আমি আর আমি নই? ভালবাসতে না আমাকে? এইসব দেখে, এই অনিশ্চিতির বিমূর্ত লিপির নির্মাণ আর অক্ষরে সাজানো জীবন দেখে ভয় হয়। ভয় হয়, কারণ নির্মাণেই আমার পরিচয়। আর কিছু নয়!
দ্বিতীয়তঃ
এই দূর মফস্বলে বসে দুলাইন কাব্যি লিখি বলে কলিকাতা বইমেলা যেতে শিখলাম। আমার বাবা কোনওদিন কলকাতা বইমেলার কথা জানত না। আমার কাছে শুনেছিল সেখানে নাকি শুধু বইয়ের মেলা! আমিও প্রথমবার সেখানে গিয়ে দেখলাম শুধু বইয়ের জন্য একটা মেলা! এত এত বই ছাপা হয়, বিক্রি হয়, লোকে তো পড়ে নিশ্চয়? যারা বই পড়ে তারা অসৎ মানুষ হয় না কখনও এমন শিখেছিলাম ছোটবেলায়। এত এত সৎ মানুষের একত্র সমাগম দেখে কী যে বিস্মিত হলাম! এত বই এত লেখক এত এত মানুষের ভিড় আর কলকাতা শহরের আলোকময় পথ দেখে আর মাথার উপর সুউচ্চ চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের আলো ঝলমল দেখে কিঞ্চিত দিশেহারা তখন। কলকাতার ময়দান অঞ্চলের এক জলাশয়ের ধারে সেই বিশাল মেলার এক প্রান্তে ছিল একটা অন্যপ্রকার ছাউনি। সেখনে ছোট ছোট অনুজ্জ্বল বইপত্র নিয়ে টেবিলে বসা কিছু অনুজ্জ্বল মানুষ। কিন্তু তাদের কারও কারও চোখ জ্বলত দেখেছি। তারা কবি, সম্পাদক, পাঠক, গ্রন্থনির্মাতা! বাকি মেলার থেকে এই অঞ্চলটাকেই বেশি ভালো লেগে যাওয়ার হয়ত কোনও কারণ ছিল না তেমন, তবু ভালো লেগে গেল। হয়ত সেই অনাত্মীয় শহরে সেখানেই একটা টেবিলে বসে থাকার অধিকার পেয়েছিলাম বলে, বন্ধু পেয়েছিলাম বলে। আর সেই থেকে আজও অব্দি আর আমার বাকি মেলা ঘুরে দেখা হল না। সেখানে বই পত্রিকা প্রচ্ছদ ছাপাই সবকিছুর ভেতর একটা হাতের ছাপ, ছোঁয়া ছিল। আলোকোজ্জ্বল বিশাল ব্যানার, সাজানো বইয়ের তাক, বিগহাউসের দুয়ারে উৎসাহী মানুষের দীর্ঘ লাইন থেকে কিছু দূরে, যেন খানিক ঘরোয়া জায়গা। হয়ত সে কারণেই একটা স্বস্তির জায়গা ছিল।
তো সেটা ছিল লেটারপ্রেসের শেষ যুগ। যদিও একটা যুগ শেষ হয়ে যাবার আগে কিছুতেই বোঝা যায় না তার দিন শেষ হয়ে এল। হ্যাঁ, সেটা পোস্টকার্ডেরও যুগ। কত কত মানুষ, তাদের মুখ চিনি না কখনও। হস্তাক্ষর চিনি শুধু। ঠিকানাও জানি। তবু সে ঠিকানায় যাওয়া হয়নি। আমার চিঠিরা যায়। তাদের চিঠিরা আসে। আর এইখানে এসে হঠাৎ তাদের কারও সাথে দেখা হয়ে গেলে কি ভীষণ আনন্দ! হস্তাক্ষর আর লেখার সঙ্গে মানুষটিকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দুজনেরই চোখে। সেই সময়টা দুম করে শেষ হয়ে গেল একদিন। শেষ মানে শেষ। আর ফিরবেই না কোনওদিন। আর নতুন সময় দ্রুত তার রূপ বদলাতে থাকল।
প্রযুক্তি এমন সর্বগ্রাসী, যে আর নির্জন বলে পৃথিবীর কোনও কোণা রইল না! তুমি মেলার ভিড়ে একা হারিয়ে যাবার অধিকারটুকু হারালে। আর দশজন বন্ধু পরিবৃত হয়েও একাকীত্বের মধ্যে ডুবে গেলে। মুখচেনা হয়ে গেল বহু বহু দূরের মানুষেরও। অথচ বন্ধুর হস্তাক্ষর, তার হৃদয় চলে গেল ছোঁয়ার বাইরে।
এখন মেলার ভিড়ে থরে থরে সাজানো পুস্তক। সব একরকম! সকল মুখ, সকল প্রচ্ছদ, যেন ইউনিফর্ম পরিহিত এক ভিড়ের সমাহার! অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ধরা যাক পাশাপাশি একই রকম ঝকঝকে মলাটে উপস্থিত দুই কবির কবিতার বই শোভা পাচ্ছে। ধরা যাক একজন তরুণ আর অন্যজন নাতিপ্রবীণ। প্রকাশক অতীব যত্নের সঙ্গে কোনও শিল্পীকে দিয়ে তার প্রচ্ছদ আঁকিয়েছেন। প্রায় একইরকম ঝকঝকে নির্মাণ। এখন আর বাঁকা ট্যারা কিছু হয় না। সব নিখুঁত! অত্যন্ত স্কিলড। তাই প্রোডাক্সন খারাপ হয় না আর কোথাও। এখন আমি, এই পাঠক, কিভাবে খুঁজে পাব সেই দুই কবির সত্তা? সোজা উত্তর– তার রচনার মধ্যে। তাহলে অঙ্গসজ্জা কি আর কবিকে উপস্থাপনের দায় নেবে না একেবারেই? আজ এই সর্বগ্রাসী প্রযুক্তির দিনে ওই একইরকম মলাটে বন্দি দুই কবি যে আসলে একই রকম দিনাতিপাত করেন না তার ছাপ আঁকব কীভাবে? একজন সুন্দরবনের বিজলিহীন প্রত্যন্ত গ্রামের খাঁড়ির ধারে বসে যে চন্দ্রভুক কবিতাগুলি লিখে গেলেন আর নগরবাসী কবি তার গলিঘুঁজি অধ্যুষিত জটিল উপশিরাগুলি নির্মাণ করলেন তার ছাপ কোথায় ছাপার নির্মাণে? এই ক্লোনসুলভ পুস্তকগুলি কতটা সহায় হবে দৃশ্যের নির্মাণে? অথচ অন্যরকমই তো হওয়ার কথা ছিল। এখনও কোনও কবি কাটাকুটি খেলাসহ সম্পূর্ণ কবিতার খাতা ডিজিটালে উপস্থিত করলেন না আমাদের সামনে। ডাইরির এক কোণে, কবিতার সামান্য উপরে সংসারের হিসেব দেখা গেল না। আনমনে নামিয়ে রাখা চায়ের কাপের গোল দাগ দেখা গেল না কবিতার গায়ে। অথচ এসব হতে পারত খুব সহজেই। সেই একই মলাট আর উৎসর্গ পৃষ্ঠা আর ব্লার্বের বিজ্ঞাপন শিখিয়ে দিয়েছে বিপণন।
তবু এর মাঝে বইমেলা ঘুরে যে সমস্ত অমলিন বইগুলির দেখা পাওয়া গেল সেগুলির কথা না বললে শূন্য কুম্ভের মতো আওয়াজ হবে এই লেখায়। তাই কয়েকটি অতি আবশ্যিক বইয়ের নাম। প্রথমেই বলি রাবণ প্রকাশনা থেকে ‘অতঃকিম, ভুত?’ একটি অদ্ভুত বই বটে। এই বইয়ের লেখক অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ও অদ্ভুত মানুষ। লেখক আত্মপক্ষে লিখেছেন– এই বই পাঠককে ভূতের ভয় দেখানোর জন্য নয়। বরং এর উদ্দেশ্য, হরর-আনক্যানি-ইরি নিয়ে সাহিত্য নিয়ে একটু নাড়াঘাঁটা। পশ্চিমের পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও যে এই বিশেষ সাহিত্য-বিধাটি জবরদস্তভাবে চর্চিত, সেকথা পাঠককে খানিক মনে করিয়ে দেওয়া। এরমধ্যে ‘আকাদেমিক’ ভূতের সন্ধান করাটাও বাঞ্ছনীয় নয়। কলকাতার শীতকালের দমকা বাতাসের মতোই এই বই ফুরফুরে। দায়হীন।
ভাষালিপি প্রকাশনা বরাবর ছোটপত্রিকার অনুষঙ্গে প্রকাশনায় এক বিরল ব্যতিক্রম। এবারেও তাঁরা একঝাঁক আশ্চর্য বই নিয়ে এসছেন। অনুবাদ গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের ‘জালালউদ্দীন রূমী : জীবন ও কবিতা (দ্বিতীয় খণ্ড)। বাংলায় রূমী চর্চার এক অনবদ্য দলিল এই বই। এবং শ্রী ধরিত্রীপুত্রের অননুকরণীয় ভাষাভঙ্গি এই কাব্যের প্রাচীনতার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত এক অন্য অনুভব। যা অন্য কারও অনুবাদে এই অধমকে আলোড়িত করেনি সেভাবে (অবশ্য পড়েছি আর কটা।)।
এবার একটি কবিতার কৃশ বই পড়ে প্রায় আত্মহারা হলাম। কবি অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের সাথে আমার এক অন্যরকম পরিচয়। তিনি আমাকে চেনেন না। আমি চিনি এক রহস্যময় পথে। যেরকম এই আলো-অন্ধকার! এই নিঃসঙ্গ একাকী নির্জন শব্দাবলীর ভেতর দাঁড়ালে আমি আর নিজেও কি এই আমি! জানি না। এই কবি আমার বন্ধু হবেন কিনা কখনও। যদি হন, আমি কী ভাষায় কথা বলে উঠব জানি না! এটুকু জানি সেই ভাষার লিপিবদ্ধতা জানা নেই আমার। হয়ত দুটি হাত ধরে একমিনিট নীরবতা জানাব। এটুকু প্রণাম এই অচেনা কবির। হ্যাঁ, এই কথাগুলি এক্ষুনি মনে হল অনিন্দিতার ‘জানলা দরজার দেশে একা’ বইটির থেকে একবার মুখ তুলে। এই বইটিরও প্রকাশক ‘রাবণ’।
ঐহিক পত্রিকার বইয়ের সম্ভারও এবার তাক লাগানো। এপার বাংলা ওপার বাংলার মেলবন্ধনে এখানে নবীন ও প্রবীনের গল্প কবিতার বই মিলেমিশে গেছে।
নতুন প্রকাশন বইতরণী প্রকাশ করেছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা ও গদ্যের বই। এরমধ্যে কবি গৌতম চৌধুরীর গদ্য গ্রন্থ ‘বহুবচন, একবচন’।
ধ্যানবিন্দু পত্রিকার গদ্য সংখ্যা সহ সেই প্রকাশনা থেকে চার কবির পুনর্মুদ্রণ বড় সুন্দর। ধন্যবাদ ধ্যানবিন্দু।
এছাড়া আরও অনেক মণিমাণিক্য নিশ্চয় ছড়ানো রয়েছে এই মেলায়। যা আমার সামান্য দর্শনে অগোচরেই থেকে যাবে। তাদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার।
এবার তৃতীয় কথাটি বলে শেষ করি, পড়ে রইল নির্মাণ না শেখা পথঘাটের অসংখ্য কবি! যে নিজেকে কবি বলে চেনে না। আর এই অধমের যে আমি ভুল নির্মাণের ফাঁদে এক কবিযশোপ্রার্থী বইমেলা পিপাসু ভাঁড়। মফস্বল থেকে এসে কবি সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি ভিড়ের ভেতর। চিনে ফেললে ডাক দিয়েন। আমার ঝকঝকে বইগুলির কথা বলে আসব আপনাকে। ইতি।