শারিফুস-সালেকিন শাহান
বাংলাদেশের পাবনা জেলার (বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার অংশ) সলংগা হাট ব্রিটিশ আমল থেকেই বড় ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সপ্তাহে দুই দিন হাট বসত।
এই শান্ত, সুন্দর জনপদ সলংগা আজ দুই-দুইটি গণহত্যার ক্ষত বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবার ব্রিটিশদের হাতে রক্ত ঝরেছে আর দ্বিতীয়বার পাকিস্তানিদের হাতে।
বাংলাদেশের বাইরে এই গণহত্যা নিয়ে কারও আগ্রহ নেই, বাংলাদেশের ভেতরেও এই গণহত্যা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।
এই গণহত্যা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নিদারুণ সমস্যা পড়েছি। গুগল কোনও সাহায্য করতে পারছে না -– ১৯২২ সালের গণহত্যাটি নিয়ে যেটুকু তথ্য দিচ্ছে সেটা আসলে একটি বক্তব্য, কোনও রকমের সূত্র ছাড়া। তবে ১৯৭১ সালের গণহত্যাটি নিয়ে ইদানিং কিছু লেখা হয়েছে।
১৯২২ সাল, ২৭ শে জানুয়ারি।
এই দিন ছিল বড় হাটবার। সলংগা বাজারে প্রচুর মানুষ, বেচাকিনি চলছে। বাজারের গোহাটায় ছিল স্বদেশি আন্দোলনের দপ্তর। এক স্কুলপড়ুয়া দশম শ্রেণির ছাত্র আব্দুর রশিদ ছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের নেতা। পরবর্তীকালে এই তরুণ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে তর্কবাগীশ উপাধি লাভ করেন এবং এলাকার মানুষের কাছে ঐ নামেই পরিচিত হন। জাতীয় স্তরেও আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ একটি পরিচিত নাম।
বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক, হাটে বিদেশি পণ্য বেচাকেনায় বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আব্দুর রহমান অসহযোগ আর খেলাফত আন্দোলনের কর্মীদের নিয়ে হাটে আসেন, বিদেশি পণ্য বেচাকেনায় বাধা দিতে থাকেন। তাদের প্রতিরোধ করতে ৪০ জন পুলিশের একটি দল নিয়ে আসে তৎকালীন পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আর. এন. দাস, জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক জনাব এস. কে. সিংহ। পুলিশদের মাথায় ছিল লাল পাগড়ি আর সেই দিনটি ছিল শুক্রবার।
স্বদেশিদের দপ্তর চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় নেতাদের সাথে আব্দুর রশিদকেও। এই ঘটনায় হাটের মানুষ ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে, মিছিলে যোগ দেয় সর্বস্তরের মানুষ। সেই উত্তাল মিছিল আর ক্রুদ্ধ জনতাকে রুখতে গুলি করার আদেশ দেয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। চলল গুলির বৃষ্টি। এলাকার মানুষের মাঝে প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী একজন মাত্র পুলিশ গুলি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন -– তিনি ছিলেন বাঙালি এবং হিন্দু।
সেদিন ৪,৫০০ জন হতাহত হয় এরকম বলা হলেও এলাকাবাসীর মতে ১০,০০০ জনের মতো হতাহত হয়েছিল (এই সংখ্যাটি একটু অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে কারণ ব্রিটিশ আমলে একটা বড় হাটে একসাথে এত মানুষের উপস্থিতি এবং তাদের মাঝে এত বেশি সংখ্যক মানুষের হতাহত হওয়া খুব স্বাভাবিক নয়)। প্রাপ্ত তথ্যমতে ১,২০০ জন নিহত হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সরকার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষ সমস্ত নিহতদের রহমতগঞ্জ নামের এক স্থানে গণকবর দিয়েছিল।
[মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ]
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন হয়েছিল, আজও আলোচনা হয়। চৌরিচৌরা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন বাতিল করে দেন, কিন্তু সলংগা হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোথাও কেউ নেই!
এমনই দুর্ভাগ্য যে খোদ বাংলাদেশের বাংলাপিডিয়ায় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এক লাইনও তথ্য নেই!
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে সরকারি হিসাবে ১৫০০ আর বেসরকারি হিসাবে ২৫০০ জন আহত আর ৩৭৯ জন বা ১০০০ জন নিহত হয়েছিলেন।
১৯২২ সালে সলংগা হত্যাকাণ্ডে সরকারি হিসাবে ৪,৫০০ জন হতাহত, বেসরকারি হিসাবে ১০,০০০ জন আর ১,২০০ জন নিহত হয়েছিলেন।
চৌরিচৌরায় উন্মত্ত জনতার হামলায় ২২ জন পুলিশ নিহত হয় এবং তারপর বেরিলিতেও সংঘর্ষ হয়। এর ফলে গান্ধীজি ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করে দেন। আজকের ভারতের ইতিহাসের কোথাও ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারির সলঙ্গায় এই রক্তক্ষরণের তিলমাত্র উল্লেখ নেই। বাংলাদেশেও নামমাত্র আলোচিত হয়েছে এই গণহত্যা।
এত বিপুল রক্তক্ষয়, এত বিপুল প্রাণের বিনিময়ে যে ঘটনা ঘটেছিল, আমরা কেন সেই ইতিহাসটাই ভুলে গেলাম? কীভাবে ভুলে গেলাম?
আজকের বাংলাদেশের খুব অল্প কিছু মানুষ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ এই সম্পর্কে জানেন না বলেই ধারণা করছি।
[আজকের সলঙ্গা বাজারের দুটো ছবি]
২৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালের এই দিনে সলংগা থানার চড়িয়া মধ্যপাড়া গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সিরাজগঞ্জ জেলার সর্ববৃহৎ এই গণহত্যায় প্রায় দু’শো জন শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে রচিত হয় একটি ইতিহাস।
১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল পাবনা জেলার কাশীনাথপুর ডাব বাগানে হানাদার পাকিস্তানী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় ৫০ জন পাক হানাদার। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পাক হানাদার বাহিনী ২৫ এপ্রিল রবিবার সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাবনার কাশীনাথপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের হাটিকুমরুল গোলচত্বরের একটু দূরে চড়িয়া নামের স্থানে রাস্তায় ব্যারিকেডের মুখে পড়ে পাক বাহিনী থামতে বাধ্য হয়। স্থানীয় রাজাকারদের সাহায্যে তারা সন্ধান পায় চড়িয়া শিকারের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে অন্য একটি কাশীনাথপুর গ্রামের। এই গ্রামকেই পাবনা জেলার কাশীনাথপুর মনে করে পাকবাহিনী খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি।
রাজাকারের দলের সাহায্যে পাকবাহিনী খোঁজ পায় চড়িয়া মধ্যপাড়ায় ডাঃ শাজাহান আলী, ইয়াকুব আলী ও মোহাম্মদ আলীসহ অন্যদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ঘাঁটির। তারপর সেই ঘাঁটি ধ্বংস করতে শুরু হয় পাকবাহিনীর নির্মম গণহত্যা।
২৫শে এপ্রিল বিকাল নাগাদ চড়িয়া-শিকারসহ আশেপাশের তিন-চারটি গ্রামের প্রায় ২০০ মানুষকে ধরে আনা হয়। বন্দিদের দুই লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মৃতদের মধ্যে মাত্র ৬৩ জনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ড নিয়েও আলোচনা নেই। একটা কারণ হতে পারে ১৯৭৫ পরবর্তী ইতিহাসের উল্টোযাত্রা এবং ঐ সলঙ্গা এলাকায় সেই পুরোনো রাজাকারদের প্রেতাত্মা জামাত-ই-ইসলামির নতুন করে ফিরে আসা।
তবে সেক্ষেত্রেও মুল প্রশ্নটি থেকেই যাবে — কেন ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি সলঙ্গা গণহত্যাটি কলকাতায় আলোচিত হয়নি?
কেন গান্ধী, জিন্না বা কলকাতার বাঙালি রাজনীতিকদের কাছে এই গণহত্যাটি উপেক্ষিত হয়ে থেকে গিয়েছিল?
এ বিষয়ে সে সময়ের পত্রপত্রিকায় কী লেখা হয়েছিল সেটি জানতে পারলে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবে।