Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাজেট, হে ছলনাময়ী

বাজেট : ২০১৮

অমিত দাশগুপ্ত

 

জনগণের জন্য নয় ভোটের জন্য বাজেট

সাধারণত প্রাক-নির্বাচন বাজেটে সরকারগুলি প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি বর্ষণ করে থাকে। কেন্দ্রীয় ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকারটি অন্যরকম কিছু করবে তেমন কোনও প্রত্যাশা কারুরই ছিল না। এই সরকারটির, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাজকর্মের ট্র‍্যাকরেকর্ড অসত্য ভাষণের বিষয়ে যারপরনাই জোরালো। তাই এই বাজেটে যে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হবে তা বলাই বাহুল্য। বাজেট পর্যালোচনার বহুবিধ দিক রয়েছে। শিল্পপতিরা বাজেটের ক্রমাঙ্কও সাজিয়ে থাকে। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বিদেশী বিনিয়োগকারী, আমদানি ব্যবসায়ী, রফতানি ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্ত করদাতা এরকম বহুবিধ নাগরিক বা কর্তৃপক্ষ আছে যারা বাজেটে তাদের কতটা লাভ হল, বা বাজেটের পরে কী কী ভাবে নিজেদের কাজকর্মকে সাজালে আগামী বছর অধিকাধিক মুনাফা বা আয় করা যাবে তার হিসেবনিকেশের জন্য বাজেটের অপেক্ষায় থাকে। অন্যদিকে বাজেট ভাষণ শোনার অবকাশ বা বাজেটের খবর পড়ার যাদের সুযোগ বা সাধ্য নেই, সেই সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী, খেতমজুর, নিম্নবিত্ত জনগণের জন্য প্রতিটি বাজেটই বিবিধ সরকারি প্রকল্প ঘোষণা করে থাকে, যার খবর ওই সব বেনিফিশিয়ারিরা বাজেটর পরে পরেই পান না বা পেলেও তা রাজনৈতিক নেতাদের নিজ জয়গান বন্দনার মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। সেই তাহাদের এই ১৮-১৯ বিত্তবর্ষের বাজারে কী লাভ ক্ষতি হবে, আর তাদের লাভের গল্প শুনিয়ে শাসক দল কতটা ভোট নিজেদের জন্য গোছাবেন সেসব নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

বাইরে কোঁচার পত্তন

তবে মনে রাখা দরকার বাজেট একটি বাৎসরিক নিয়ম মাত্র; আমাদের দেশে সরকার যেহেতু ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়, তাই সেই পঞ্চবার্ষিক সময়কালের জন্য যে নীতি ও কার্যক্রম (যা নির্বাচনের ইশতেহারে থাকা উচিৎ বা নির্বাচনী বক্তৃতায় বলা হয়েছে) রয়েছে তাকে রূপায়িত করার জন্য বার্ষিক ব্যয় বরাদ্দ করাই বাজেটের কাজ। কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতবর্ষে ঘোষিত ‘নীতি ও কার্যক্রম’ রূপায়ণের জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির কোনও আগ্রহ সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়নি। বর্তমান সরকার তো সেদিক দিয়ে আরও কয়েক কাঠি উপরে। হিন্দুত্ব, ইতিহাস বিকৃতি, গোমাতা পূজন, সংখ্যালঘু নিধন প্রভৃতি পিছনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রম ব্যতিরেকে ও দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার অঘোষিত নীতি ছাড়া ভিন্ন কোনও নীতি তো তাদের নেই-ই। তাই প্রত্যেক বাজেটেই তারা ঘোষণা করেন ‘জনহিতকর’ প্রকল্পের। সাধারণ জনেরা জানতে আগ্রহী, বাজেটের মধ্য দিয়ে কত কর্মসংস্থান হবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে কত বরাদ্দ বাড়ল, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানে কী বন্দোবস্ত হল, কৃষকদের ফসলের উচিত মূল্য প্রাপ্তির কী ব্যবস্থা হল, খেতমজুরের কাজের নিশ্চয়তা বা শিল্প শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা সম্পর্কে নতুন কী ভাবা হল এইসব অতি তুচ্ছ ব্যাপার। রাজস্ব ঘাটতি, জিডিপি বৃদ্ধির হার, বিদেশি বিনিয়োগের প্রাচুর্য, শেয়ার বাজারে উচ্ছাস এসব নিয়ে ভাবার বিলাসিতা সেই আমজনতার নেই, আগ্রহও নেই। ফলে বাজেটের ভিতরে যাই থাক না কেন মোড়কটিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য, কৃষি- শ্রমিকের কর্ম নিশ্চয়তা এসব নিয়ে বড় বড় ভাষণ থাকবেই থাকবে।

কার স্বাস্থ্য কে ফেরায়

বাজেটের যে বিষয়টি নিয়ে সর্বাধিক আলোড়ন হয়েছে তা হল, ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ’ জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প, ‘জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্প’। জেটলি সাহেবের কথায়, দেশের ১০ কোটি গরীব ও নিম্নবিত্ত পরিবারকে বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমার বন্দোবস্ত বিনে পয়সায় করা হবে যার ফলে ৫০ কোটি মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ পাবে। ওই প্রকল্পটির ডাক নাম দেওযা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নামে, মোদিকেয়ার; এমনকি মোদিজি স্বয়ং তাকে মোদিকেয়ার নামেই প্রচার করছেন। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি, এখনও কয়েক গিগাবাইট তার উপরে লেখা যায়। কিন্তু আমজনতার কোনও সুরাহা যে তাতে তেমন হয় না, তা বলাই বাহুল্য। ২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য বলে যে ঘোষণা ১৯৭৮ সালে আলমা আটায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক সম্মেলনে করা হয়েছিল, সেই ঘোষণাপত্রের অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিল ভারতবর্ষ। ২০০০ সালের পরে ১৭ বছর কেটে গিয়েছে, এখনও সে ঘোষণার কিছুই রূপায়িত হয়নি। উপরন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় সকলকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার বদলে বেসরকারি চিকিৎসার দিকে দেশকে ঠেলে দেওযা হচ্ছে ক্রমাগত। মোদিকেয়ারই হোক বা জাতীয় স্বাস্থ্যসুরক্ষা প্রকল্পই হোক সে বন্দোবস্তকে জোরদার করবে। বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমগুলিকে আরও মুনাফা করতে দেওয়ার ও বিমা কোম্পানিগুলির ব্যবসা প্রসারিত করতে দেওয়ার জন্য যেমন পূর্বতন রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনাকে (আরএসবিওয়াই) ব্যবহার করা হয়েছে তেমনিভাবেই আরও ১৬-১৭ গুণ আকারে মুনাফার আযোজন করা হবে যদি এই প্রকল্প কার্যকরী করা হয়।

টাকা কোথায়

তবে বাজেট বরাদ্দ দেখে মনে হচ্ছে সরকার অন্তত এই বিত্তবছরে প্রকল্পটিকে কার্যকরী করতে আগ্রহী নয়। আরএসবিওয়াই-এর আওতায় থাকা পরিবারগুলিকে ৩০,০০০ টাকা বার্ষিক চিকিৎসা বিমার সুবিধে(!) দিতে পরিবার পিছু কমবেশি ৫০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। যদি সেই বিমার অঙ্ককে ৫ লাখ টাকায় নিয়ে যেতে হয় তাহলে পরিবার পিছু বিমা করতে মোটামুটি ৮০০০ টাকা লাগবে। ফলে ১০ কোটি পরিবারের জন্য লাগবে ৮০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ২০০০ কোটি টাকা। সরকার বলছে কেন্দ্র ৬০% ও রাজ্য ৪০% দেবে। যদিও রাজ্যগুলি সেটা মানবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। যদি তাও হয়, তাহলেও ওই বিমার জন্য বরাদ্দ দরকার ৪৮ হাজার কোটি টাকা। ফলে এটা ধারণা করাই যেতে পারে যে, বিজেপি সরকার অন্তত এবছরে প্রকল্পটিকে তেমনভাবে কার্যকরী করতে চায় না। কিন্তু চিকিৎসার সঙ্গতিহীন পরিবারদের জন্য ৫ লাখ টাকা বার্ষিক বিমার কথা রটিয়ে ভোট গোছানোর প্রচার তো এবছরই শুরু করা যাবে।

পাঁচ বছরে ডবল

আরেকটি ভোট ক্যাচার ঘোষণা হল কৃষকদের অবস্থার উন্নতি। দেশের খাদ্য সরবরাহকারীদের আয় ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করার কথা মোদি-জেটলির ‘ধ্যানজ্ঞান’। তাই সরকার অশোক দালওয়াই কমিটি তৈরি করেছিল। ওই কমিটি বলেছে আয় দ্বিগুণ করার জন্য দরকার কৃষিতে ২০১১-১২ সালের মূল্যে ৬৪০ হাজার কোটি টাকা। তা করতে গেলে প্রতি বছরে ২২% (স্থির মূল্যে) হারে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করায় যাদের এত উৎসাহ তারা এই বছরে বাজেটে কৃষিতে সামগ্রিক বরাদ্দ বাড়িয়েছে চলতি মূল্যে মাত্র ৭%। অর্থাৎ প্রকৃত মূল্যে কিছুই বাড়েনি। ফলে ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ আয়ের বদলে সরকার প্রকারান্তরে কৃষিকে অবহেলাই করছে।

দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না

ভোট পাওয়ার জন্য ঢাক বাজানোতে ভারতীয় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি কেউই কম যায় না; তবে বর্তমান শাসক এব্যাপারে উদার। ফলে এম এস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে কৃষিপণ্যের সহায়ক মূল্যকে উৎপাদন ব্যয়ের দেড়গুণ করার কথা ঘোষণা করেছেন জেটলি সাহেব। কিন্তু এই তালে উৎপাদন ব্যয়ের সংজ্ঞাটা স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ থেকে পাল্টে দিয়েছেন, পরে ব্যাখ্যা দেওযার সময়ে। উৎপাদন ব্যয় বলতে উপকরণের উপরে ব্যয়ের সঙ্গে পারিবারিক শ্রমের মূল্য যোগ করে যা হয় কেবল তাকে ধরা হয়েছে। কিন্তু ওই অঙ্কের সঙ্গে জমির লিজের জন্য ব্যয় বা নিজ জমির ক্ষেত্রে অনুরূপ অনুমিত ব্যয় ধরেই স্বামীনাথন কমিটির উৎপাদন ব্যয়ের ধারণা। ফলে জেটলিবাবুর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ নির্ভর সহায়ক মূল্যের থেকে অনেকটাই কম। কেবল তাই নয় তা সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী সহায়ক মূল্যের সঙ্গে বর্তমান সহায়ক মূল্যের তেমন কোনও তারতম্যও নেই। তাছাড়া সরকারি স্তরে শস্য সংগ্রহ ব্যতিরেকে ওই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কোনও মানেই থাকে না। কিন্তু এব্যাপারে, আগেই বলেছি যে, কৃষিতে স্থির মূল্যে তেমন কোনও ব্যয় বৃদ্ধিই ঘটে নি।

কাজ চাই কাজ দাও

যে গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা কর্মসূচী বা ১০০ দিনের কাজ চালু আছে, সেই খাতে টাকার অঙ্কেও বরাদ্দ বাড়েনি, অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ কমেছে। ফলে কৃষি শ্রমিকের কর্ম নিশ্চয়তা বিষয়টিকে তাচ্ছিল্যই করা হয়েছে। বাজেট শিল্পক্ষেত্রে তেমন কোনও বিনিয়োগের উৎসাহ দিতে পারেনি বা সরকারি বিনিয়োগের কোনও উৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি তৈরি করেনি যার ফলে বিপুল কর্মসংস্থান হতে পারে। সেই বছরে দু’কোটি বেকারের চাকুরির প্রতিশ্রুতি কোথায় যে পালিয়ে গেল, কে জানে।

ঢাকের আওয়াজে সিঁদ কাটার শব্দ আড়াল

সব মিলিয়ে অসত্য ভাষণে পারদর্শী একটি সাম্প্রদায়িক শাসক যা করতে চায় সেটাই এই নির্বাচনমুখী বাজেট করেছে। বিপুল নিনাদের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আদতে পর্বত মূষিক প্রসব করেছে। সেটাই স্বাভাবিক। প্রতিনিয়ত ব্যাঙ্কের টাকা তছরুপকারীদের দেশ ছেড়ে পালাতে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারীরা গদিতে টিকে থাকার জন্য ধর্মের উসকানি দিযে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করবে, আর অন্যদিকে পুকর চুরি করার সময়ে মিথ্যে জনকল্যাণের গল্প কথা উচ্চনাদে প্রচার করবে। বাজেট ২০১৮-১৯ তার উজ্জল উদাহরণ।