সমীক্ষণ সেনগুপ্ত
একটি খটকার সূচনা
১৯৭৭ সালের মার্চের এক ঝলমলে সকাল। শীতের শেষ, প্রকৃতিতে রঙ ফিরে আসছে ধীরে ধীরে…
ফ্লোরেন্স শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত টাউন হল পালাতজো ভেক্কিও-তে সকাল থেকেই দর্শকরা ভিড় করছে একটু একটু করে। ঐতিহাসিক এই শহরের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন-কেন্দ্র।
মৌরিজিও সেরাচিনি নামের একজন তরুণ শিল্প-বিশেষজ্ঞ সেখানে উপস্থিত হলেন। সেরাচিনি-র কাজ মূলত art-diagnostician-এর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে শিল্পকীর্তির বিশ্লেষণ।
টাউন হলের মধ্যে অবস্থিত হল অফ ফাইভ হান্ড্রেড-এ তিনি প্রবেশ করলেন।
১৭০ ফিট বাই ৭৫ ফিটের বিশাল এই হলঘর। ১৪৯৪ সালে এটি তৈরি করেছিলেন সিমোন দেল পোলাইওলো, যাতে সেখানে গ্র্যান্ড কাউন্সিল-এর ৫০০ জন সদস্য বসতে পারে।
Hall of the Five Hundred
সেরাচিনি-র চোখ গেল হল অফ ফাইভ হানড্রেড-এর একদিকের দেওয়ালে আঁকা বিশাল ফ্রেসকোটির দিকে। গিওরগিও ভাসারি-র আঁকা “Battle of Marciano”। ১৫৬৫ সালে যখন এই হলটিকে তিনি পুনর্নির্মাণ করেন, তখনকার আঁকা ছবি এটি।
গোটা হলে একটি শান্ত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, অল্প কিছু দর্শক এদিক-ওদিক ঘুরে নানা শিল্পকীর্তির নমুনা দেখছেন…
সেরাচিনি-র মনে হল তিনি যেন ভুলে যাওয়া কোনও আগেকার সময়ে ফিরে গেছেন। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ভাসারি-র আঁকা “Battle of Marciano” ছবিটির দিকে… খুব মন দিয়ে যেন তিনি কিছু খুঁজছেন।
তাঁর নিজের মনের মধ্যে তখন কী চলছে বলা মুশকিল, হয়তো তাঁর মনে হচ্ছে পণ্ডশ্রম, বুনো হাঁস তাড়া করা হচ্ছে, কিন্তু তাঁর গুরু কার্লো পেদ্রেত্তি-র কথাটাও তিনি অস্বীকার করতে পারছেন না। হাজার হোক, ম্যাসাককিও-র “The Holy Trinity”-র ক্ষেত্রে তো ওই প্রাজ্ঞ মানুষটির অনুমান সঠিক হয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পড়ে পাওয়া গেল!!! খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে পাওয়ার মতো…
মাটি থেকে প্রায় ৪০ ফুট উপরে ছবিতে আঁকা একটি সৈনিকের সবুজ রঙের পতাকার উপর লেখা!!! এত ছোট যে সহজে চোখে পড়বে না…
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখে মৌরিজিও সেরাচিনি-র চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল… মনে পড়ে গেল পেদ্রেত্তি-র অসাধারণ কাজ “The Unpublished Leonardo”-র কথা।
ভাসারি-র পুরো ছবিটায় এই একটা জায়গাতেই শুধু লেখা। জনৈক সৈনিকের সবুজ রঙের পতাকার উপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা “CERCA TROVA”।
পুরানো সেই দিনের কথা
এর পটভূমি বিশদে জানতে গেলে আমাদের অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে। প্রায় ৫০০ বছর আগেকার ফ্লোরেন্সে…
তখন ইউরোপীয় রেনেসাঁর কেন্দ্রবিন্দুতে এই শহর। শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা সমস্ত ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিগন্ত রচনা করছেন দিকপাল সব মনীষীরা।
তৎকালীন শহরের গোনফালোনিয়ের অফ জাস্টিস, পিয়েরো সোদেরিনি ঠিক করলেন পালাতজো ভেক্কিওকে নতুন করে সাজানো হবে। তাই হল অফ ফাইভ হানড্রেড-এর দেওয়ালে তিনি ছবি আঁকার ভার দিলেন অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন দুই শিল্পীর উপর। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি এই চুক্তিপত্রে সই করলেন।
এই শিল্পীদের মধ্যে একজন যুবক। বয়স প্রায় তিরিশ, সৃষ্টিশীলতার মধ্যগগনে বিরাজ করছেন। চিত্রকলার থেকে ভাস্কর্যের দিকে তাঁর ঝোঁকটা বেশি। সদ্য সমাপ্ত করেছেন তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। তাঁর তৈরি ১৭ ফিটের অনবদ্য শ্বেতপাথরের মূর্তি “David” যেন বিদগ্ধজনের বিস্ময় ও সম্ভ্রমের প্রতীক!
অন্যজন শিল্পী মাঝবয়সি। আত্মভোলা, আনমনা মানুষটির মধ্যে অনেক গুণাবলির সমাহার। শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ভাস্কর, সঙ্গীতজ্ঞ, বাস্তুকার — কি নন তিনি!!!
এই তিনি ঘোষণা করছেন যে শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিরোধকারী, স্থানান্তকরের পক্ষে সহজ এবং অগ্নি-নিরোধক হাল্কা সেতু বানিয়ে দিতে পারেন, তো এই তিনি বাঁদুরের ডানা পর্যবেক্ষণ করে তার প্রতিকৃতি এঁকে রাখছেন নোটবুকে। এই তিনি আতস-কাঁচের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের জাহাজে আগুন লাগানোর পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন, তো এই তিনি ইমোলা শহরের নিখুঁত মানচিত্র এঁকে দিচ্ছেন। তাঁর নোটবুকে উদ্ভট উদ্ভট সব ছবি আঁকা থাকে — ঘোড়ার মাংসপেশির গড়নের ছবি, নিখুঁত মানবদেহের ছবি (যাকে তিনি “ভিট্রুভিয়ান ম্যান” বলতেন), অদ্ভুত সব যন্ত্রের ছবি, ইত্যাদি।
সব কিছুই যে তিনি হাতে-কলমে করে দেখাতে পারেন তা নয়, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি বিফল হন, এবং ঈর্ষান্বিত সমালোচকদের হাসির খোরাক হন। কিন্তু তাদের শ্লেষ যেন তাঁকে স্পর্শ করে না, তাঁর দুর্নিবার অনুসন্ধিৎসা তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
স্টাডি অফ আ হর্স
এহেন শিল্পীকে বেছে নেওয়ার কারণ অবশ্য চিত্রকলায় তাঁর দক্ষতা এবং তাঁর নতুন কিছুর প্রবর্তন ক্ষমতা। ছবিতে Aerial perspective-এর ব্যবহার, “sfumato” ছবির কৌশল তাঁর কাজের অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য।
মিলান-এর সান্তা মারিয়া দেল গ্রাৎসি-তে তিনি এঁকেছিলেন “The Last Supper” নামের বিখ্যাত ছবিটি। পরিবেশজনিত কারণে ছবিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই তিনি এবার একটি নতুন পদ্ধতিতে ছবি আঁকবেন ঠিক করেছিলেন।
দি লাস্ট সাপার
চিনতে পারছেন এই দুজন শিল্পীকে ? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন — প্রথমজন হলেন মিকেলাঞ্জেলো বুওনারত্তি এবং দ্বিতীয় জনের আসল নাম লিওনার্দো দি সের পিয়েরো, যাকে আমরা চিনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বলে!!!
“যুদ্ধের” প্রস্তুতি
ঠিক হল, হল অফ ফাইভ হানড্রেড-এর মুখোমুখি দুই দেওয়ালে এই দুই দিকপাল শিল্পী নিজেদের শিল্প-সৃষ্টি করবেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম স্বল্প পরিসরের মধ্যে এরকম দুজন অসামান্য শিল্পীর যুগলবন্দি দেখার সুযোগ খুব কম পাওয়া গেছে।
দুজনেই আবার বিখ্যাত ফিওরেনটাইন মেদিচি-র পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন, কিন্তু নিজেদের মধ্যে রেষারেষির অন্ত নেই।
এ যেন মহাভারতের কর্ণ-অর্জুনের অস্ত্রপরীক্ষার সামিল!!!
১৫০৫ সালে আসল কাজ শুরু হবে, তার আগে দুই মহাশিল্পী যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।
লিওনার্দো বিষয় নির্বাচন করলেন ১৪৪০ সালের অ্যানঘিয়ারির যুদ্ধ অর্থাৎ Battle of Anghiari। এই যুদ্ধে ফ্লোরেন্স-এর হাতে মিলান-এর পরাজয় ঘটেছিল। সারা দেওয়াল জুড়ে যুদ্ধক্ষেত্রর একটি বিশাল mural আঁকার পরিকল্পনা করলেন তিনি। তার মধ্যে থাকবে ঘোড়ার পিঠে ভয়ঙ্কর যুদ্ধরত দুই দলের সৈনিকের ছবি। সৈনিকদের মুখের ভাব, পেশীর গড়ন, এমনকি তাদের ঘোড়াগুলির দৈহিক গঠন হবে একেবারে সত্যিকারের মতো, যাতে যুদ্ধের হিংস্রতা ও ক্ষিপ্রতা যেন আরও বেশি করে মূর্ত হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে মিকেলাঞ্জেলো বিষয় বৈচিত্রে কিছু কম যান না, তিনি বেছে নিলেন ব্যাটল অফ ক্যাসকিনা নামের যুদ্ধের নাটকীয় একটি মুহূর্তকে। ২৮শে জুলাই, ১৩৬৪ সালে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে ফ্লোরেন্স তার কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী পিসা-কে পরাজিত করেছিল এবং ফ্লোরেন্সের Duchy-র অধীনে নিয়ে এসেছিল। ছবির মুহূর্তটি বেশ আকর্ষণীয়। আর্নো নদীতে স্নানরত ফিওরেনটাইন সৈনিকরা জানতে পারে পিসা-র সৈন্যদল তাদের আক্রমণ করেছে। তাই তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নদী থেকে উঠে যুদ্ধবেশে সজ্জিত হচ্ছে। ঠিক এই নাটকীয় মুহূর্তটাই মিকেলাঞ্জেলো ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন!!
বিষয় নির্বাচনের পর শুরু হল “cartoon” আঁকা। যারা পরিচিত নন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি “কার্টুন” হল বড় মূল ছবির অংশবিশেষ। বড় কাজে হাত দেওয়ার আগে শিল্পীরা তার কিছু কিছু অংশ অন্য জায়গায় আঁকতেন, অনেকটা “রাফ-ওয়ার্ক” করে নেওয়ার মতো করে।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তাঁর কার্টুন আঁকলেন বাসিলিকা অফ সান্তা মারিয়ার পূর্ব দেওয়ালে। কার্টুন হলে কি হবে, এটিও একটি দেখবার বস্তু। ঘোড়ার পিঠে সেই যুদ্ধরত সৈনিকের ছবি, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকটি সৈনিকের মুখ-অবয়ব।
“Battle of Anghiari”-র কিছু কার্টুন
মহাযজ্ঞের সূচনা
যথাসময়ে হল অফ দি ফাইভ হানড্রেড–এ কাজ শুরু করলেন লিওনার্দো। বিশাল হলে আঁকা হবে বিশাল যুদ্ধের ম্যুরাল। আয়তনের হিসাবে এটিই হতে চলছে তাঁর জীবনের সব থেকে বড় কাজ। তাই তার আয়োজনও হল সেরকম। আধুনিক স্ক্যাফোল্ড–এর মতো ভাঁজ করা যাবে এমন একটি মই লিওনার্দো ব্যবহার করলেন, যাতে পুরো দেওয়ালটায় তাঁর হাত পৌঁছায়।
সব থেকে বড় চমক রইল অঙ্কন-পদ্ধতিতে। সাধারণত ম্যুরাল আঁকার নিয়ম হল কাঁচা প্লাস্টারের উপর শুকনো রঙ, জলে গুলে আঁকা। একে বলে ফ্রেসকো টেকনিক। “দা লাস্ট সাপার” এইভাবেই আঁকা হয়েছিল। এই পদ্ধতির অসুবিধা হচ্ছে শিল্পীকে খুব তাড়াতাড়ি আঁকতে হয় প্লাস্টার শুকিয়ে যাবার আগেই, এবং নিখুঁতভাবে, কারণ প্লাস্টার শুকিয়ে গেলে ছবি আর ঠিক করা যাবে না।
এই ছবিটি আঁকতে গিয়ে লিওনার্দো ব্যবহার করলেন মোমের সঙ্গে মেশানো তেলরঙ, যাতে সেটা শুকনো প্লাস্টারের উপর থেকে যায়। এই পদ্ধতিতে তিনি আরও বেশি রকমের রঙ ব্যবহার করতে পারলেন এবং ছবিটি আঁকতে তাঁকে তাড়াহুড়ো করতে হল না।
চিত্রকলার কাজ সুন্দরভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুদিন পর লিওনার্দো দেখলেন তাঁর আঁকা থেকে রঙ গলে গলে পড়ছে। বিশেষত ওপরের দিকের দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলোর রীতিমতো খারাপ অবস্থা।
অনেক পরীক্ষার মতো এই পরীক্ষাটিও সম্পূর্ণ নিখুঁত হল না। এখনকার বিশেষজ্ঞরা বলেন হয়তো তিনি একটু বেশি মোম ব্যবহার করে ফেলেছিলেন।
রঙ যাতে তাড়াতাড়ি শুকায়, সেই ব্যবস্থা করতে গিয়ে হল আরও বিপত্তি। ছোট ছোট উনুনের সাহায্যে তিনি রঙ শুকানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হায়, তাতে মোম আরও গলে গেল।
হতাশ লিওনার্দো ব্যর্থমনোরথ হয়ে কাজ ছাড়তে বাধ্য হলেন।
যেটা হওয়ার কথা ছিল সারা দেওয়াল জুড়ে একটি বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি, সেটা হয়ে দাঁড়াল দুই দলের ঘোড়া এবং সৈনিকদের মুখোমুখি সংঘাতের একটি খণ্ডচিত্র!
রুবেনস-এর আঁকা “Battle of Anghiari”-র প্রতিলিপি
১৬০৩ সালে খ্যাতনামা ফ্লেমিশ চিত্রকর পিটার পল রুবেনস এটির একটি প্রতিলিপি বানান। ল্যুভর মিউজিয়ামে আমরা এখন সেটই দেখতে পাই।
অন্যদিকে মিকেলাঞ্জেলোর Battle of Cascina-র কাজও বিশেষ এগোয়নি। তিনি আসল ছবিটির একটি সম্পূর্ণ কার্টুন এঁকেছিলেন বটে, কিন্তু পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের তলবে তাঁকে রোমে ছুটতে হল কাজ ফেলে রেখেই।
পরবর্তীকালে বার্তোলোমিও বান্দিনেল্লি নামের একজন শিল্পী হিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর আঁকা মৌলিক কার্টুনগুলি নষ্ট করে দেয়। কিন্তু তাঁর আগেই সেগুলোর প্রতিলিপি করেছিলেন মিকেলাঞ্জেলোরই ছাত্র সানগাল্লো। তাঁর উদ্যোগের ফলেই আমরা এখনও এই ছবিটি দেখতে পাই।
সানগাল্লোর আঁকা Battle of Cascina-র প্রতিলিপি
কাজেই যেটা হতে পারত রেনেসাঁ যুগের দুজন সেরা শিল্পীর যুগলবন্দী, সেটা হয়ে রইল মুখোমুখি দুটি অসমাপ্ত ছবি। যেন অনেক সম্ভবনা নিয়ে আসা সদ্য-অঙ্কুরিত দুটি মুকুল বৃন্তচ্যুত হয়ে মাটিতে পড়ে রইল।
হারিয়ে যাওয়া ছবি
১৫৬৩ সাল অব্দি এই অবস্থায় থাকার পর, চিত্রকর ও স্থপতি গিওরগিও ভাসারির ডাক পড়ল হল অফ দি ফাইভ হানড্রেডটিকে একেবারে ঢেলে সাজানোর জন্য। বর্তমানে ভাসারির নাম আমরা মূলত art-historian হিসাবে পেয়েছি। তাঁর লেখা বই — “Lives of the Most Excellent Painters, Sculptors, and Architects” থেকে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি।
তো সে যাইহোক, ভাসারি “Battle of Anghiari”-র দিকের দেওয়ালে আঁকলেন একটি বিশাল ফ্রেসকো, নাম “Battle of Marciano” বা “Battle of Scannagallo”। সদ্যসমাপ্ত ১৫৫৪ সালের সিয়েনা এবং ফ্লোরেন্সের যুদ্ধ এটির বিষয়বস্তু। লিওনার্দোর আঁকা “Battle of Anghiari”-র কোনও চিহ্নই রইল না আর। এবং “Battle of Anghiari” হয়ে গেল লিওনার্দোর হারিয়ে যাওয়া শিল্পকীর্তি…
আজকের দিনে কেউ যদি পালাতজো ভেক্কিওর হল অফ দি ফাইভ হানড্রেড-এ যান, তবে ভাসারির আঁকা “Battle of Marciano”-ই দেখতে পাবেন।
Battle of Marciano
আবার সে আসিছে ফিরিয়া…
এবার আমরা ফেরত আসি সেই ১৯৭৭ সালের মার্চে।
এর আগে ১৯৬০ সাল নাগাদ কার্লো পেদ্রেত্তি নামক একজন ইতালিয়ান art historian বলেছিলেন এমন হতেও পারে যে “Battle of Anghiari”-র ছবিটি এখনও সংরক্ষিত আছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। ওনার বক্তব্য হল এই যে — লিওনার্দো-অনুরাগী ভাসারি হয়তো ছবিটি নষ্ট করেননি। বরং এক ইঞ্চি মতো ফাঁক দিয়ে দেওয়াল তুলে তার উপরই নিজের শিল্পকর্মটি সম্পন্ন করেছেন। অর্থাৎ “Battle of Marciano”-র পেছনের দেওয়ালেই রয়েছে লিওনার্দোর সেই হারিয়ে যাওয়া ছবি “Battle of Anghiari”!
প্রথমে, যথারীতি তাঁর এই অদ্ভুত তত্ত্বটিকে সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পেদ্রেত্তি ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হওয়া বই “The Unpublished Leonardo”-তে এরকম দুটি চার্চ এবং একটি কোর্টরুমের উদাহরণ দিলেন যেগুলি ভাসারি সংস্কার করেছিলেন ১৫০০ সাল নাগাদ। পেদ্রেত্তি দেখালেন যে এই তিনটি ক্ষেত্রেই কিন্তু ভাসারি পূর্ববর্তী শিল্পকর্মগুলি ধ্বংস করেননি। বরং তিনি ঠিক যেমন বলেছিলেন সেরকম দেওয়াল তুলে সেগুলি সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তাহলে “Battle of Anghiari”-র ক্ষেত্রেও তাই হয়ে থাকতে পারে।
গিওরগিও ভাসারি
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ইতালীয় শিল্পী মাসাককিওর আঁকা “The Holy Trinity”-র ক্ষেত্রে তো তাই-ই হয়েছিল। ১৪২৫ সাল নাগাদ ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নভেল্লা নামক চার্চে আঁকা হয়েছিল এই ছবিটি। তারপর ১৫৬৮ সালে প্রথম কসিমোর আদেশে ভাসারি চার্চটিকে নতুন করে ঢেলে সাজান, এবং অনেকদিন শিল্পকর্মটির কোনও খবর পাওয়া যায়নি। শেষে ১৮৬০ সালে যখন চার্চটিকে পুনঃ-নবীকরণ করা হয় তখন মাসাককিওর আঁকা এই ছবিটি অলটার-এর পেছন থেকে আবিষ্কার হয়।
অনুসন্ধান পর্ব
১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে যখন পূর্বে-দ্রষ্টব্য ছবিটিতে মৌরিজিও সেরাচিনি যখন দেখলেন “CERCA TROVA” কথাটি লেখা আছে, তখন তিনি প্রায় নিশ্চিত হলেন যে ভাসারির আঁকা “Battle of Marciano”-র পেছনেই লিওনার্দোর সেই হারিয়ে যাওয়া “Battle of Anghiari” ছবিটি রয়েছে। কারণ “CERCA TROVA” কথাটির অর্থ হোল “seek, and you shall find”। সেরাচিনির মতে এটি ভাসারির একটি সংকেত, যার মাধ্যমে তিনি দর্শককে অনুসন্ধান করতে বলছেন।
কিন্তু ১৯৭৭ সালে সেরাচিনি বাধাপ্রাপ্ত হলেন প্রযুক্তিবিদ্যার দিক থেকে। তাঁর কাছে তখন এমন কোনও উপায় ছিল না, যার মাধ্যমে তিনি উপরের ছবিটির ক্ষতি না করে দেওয়ালের পেছনের ছবিটির অনুসন্ধান করতে পারেন। কাজেই তাঁকে তখনকার মতো কাজ স্থগিত করতে হল।
কাজ বন্ধ হলে কী হবে, সেরাচিনি বসে থাকার লোক নন। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৩ সালে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর অবদান সম্পূর্ণ অন্য ক্ষেত্রে। শিল্পকলার কোনও রকম ক্ষতি না করে সেটির বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৭ সালে তিনি স্থাপন করেন Diagnostic Center for Cultural Heritage।
লিওনার্দোর সম্মন্ধে লেখা পেদ্রেত্তির বই
মৌরিজিও সেরাচিনি
সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে যখন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভবন হল, তখন ২০০২ সালে লেজার স্ক্যানিং, থার্মাল ইমেজিং, গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং রাডার ইত্যাদি ব্যবহার করে সেরাচিনি খুঁজে বার করলেন যে ভাসারির ছবিটির পেছনে সত্যিই আধ ইঞ্চি মতো ফাঁক রেখে আর একটি দেওয়াল আছে। ওনার তত্ত্বের নিরিখে এটি সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। কিন্তু সেই দেওয়ালে কোনও ছবি আছে কিনা, সেটা জানার মতো ব্যবস্থা তখনও হয়নি।
২০০৫ সালের একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে কয়েকজন পদার্থবিদের সাথে সেরাচিনি আলোচনা করে জানলেন বিশেষ “বন্দুক”-এর সাহায্যে গামা রশ্মি বিচ্ছুরণ করে দেওয়ালের পেছনের ছবির অস্তিত্ব সম্মন্ধে জানা যাবে। খুবই নির্ভরযোগ্য পরিকল্পনা, কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যবহার করার খরচ প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার! এছাড়াও ক্ষতি হওয়ার ভয়ে রেনেসাঁ যুগের অত পুরনো ছবিতে এরকম gamma rays বিচ্ছুরণ করতে কর্তৃপক্ষ রাজি হলেন না।
অবশেষে ২০১১ সালে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া গেল যে ভাসারির ছবিটিতে কিছু কিছু অংশে যেখানে মৌলিক রঙ নেই, সেখানে খুব ছোট কিছু ছিদ্র করা যাবে। এই ছিদ্রগুলি দিয়ে এন্ডোস্কোপিক ক্যামেরা ভেতরে ঢুকিয়ে ছবি তোলা হল, এবং পেছনের দেওয়ালের রঙের স্যাম্পেল নেওয়া হল। দেখা গেল, পেছনের দেওয়ালটিতে সত্যিই এমন কিছু রঙ আছে, যেগুলি লিওনার্দো ব্যবহার করতেন। রঙের নমুনার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, একই রকম কালো পিগমেন্ট তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত “মোনালিসা”য় এবং “সেন্ট জন দা ব্যাপটিস্ট”-এ।
অনুসন্ধান কাজে ব্যস্ত সেরাচিনি
অভূতপূর্ব এই সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও সেরাচিনিকে এখানেই থেমে যেতে হল। ছবিতে ফুটো করার এই পদ্ধতির এত সমালোচনা চতুর্দিকে হতে থাকল, যে কর্তৃপক্ষ আর অনুমতি দেওয়ার সাহস করল না। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেরাচিনিকে কাজ বন্ধ করতে হল।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে পারলে “গামা রে” পদ্ধতিতেই আবার অগ্রসর হওয়া যাবে।
উপসংহার
বন্ধুগণ, আমরা এই যাত্রার শেষ পংক্তিতে পৌঁছে গেছি।
আমাদের এই অভিযানে যেমন স্বমহিমায় বিরাজ করছেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, তেমনি মৌরিজিও সেরাচিনির অবদান এ বিষয়ে কোনও অংশেই কম নয়। অন্যদিকে ফ্লোরেন্স কর্তৃপক্ষের উদ্বেগের কারণও যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য, কারণ এখনকার উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার দিনে আমাদের দুটি ছবিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা উচিত।
ভবিষ্যতে আমরা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে সেরাচিনির মতো অনুসন্ধিৎসু মানুষগুলির দিকেই চেয়ে থাকব, যারা হারিয়ে যাওয়া “লিওনার্দো” উদ্ধার করার কাজে ব্রতী হয়েছেন। তাঁদের এই অসাধারণ কাজের জন্য সমগ্র মানবজাতি-ই তাঁদের কাছে ঋণী।
References :
- http://www.todayifoundout.com/index.php/2016/01/the-lost-leonardo/
- http://news.nationalpost.com/news/leonardo-da-vinci-battle-of-anghiari
- http://www.telegraph.co.uk/culture/art/leonardo-da-vinci/9140337/Leonardo-da-Vincis-Battle-of-Anghiari-nothing-to-find-but-disappointment.html
- http://letteraturaartistica.blogspot.in/2014/12/leonardo-da-vinci.html
- http://blogs.artinfo.com/secrethistoryofart/2015/01/17/the-latest-on-leonardos-lost-battle/
- http://www.aboutfamousartists.com/index.php/2015/03/michelangelos-battle-of-cascina/
- http://www.italian-renaissance-art.com/Battle-of-Cascina.html
- https://soundaffairs.wordpress.com/production-themes/battle-of-cascina/
- http://www.florenceinferno.com/cerca-trova-or-catrovacer/
- https://www.academia.edu/8835382/A_Musci_A_Savorelli_Giorgio_Vasari_cerca_trova._La_storia_dietro_il_dipinto
- Wikipedia Articles
- পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখা “মোনা লিসা” প্রকাশক – প্রতিক্ষণ ।
———–