সাধন চট্টোপাধ্যায়
চল্লিশ ডিগ্রির গনগনে রোদ। কালো কম্বল জড়ানো মানুষটিকে দেখতে পেয়ে সরিৎশেখর অবাক। হাবভাবে বোঝা যায়, বেলা এগারটায় সদ্য বিছানা ছেড়ে, ব্রেকফাস্টের আয়োজনে দোকানে বেড়িয়েছেন। রুটি, ডিম বা কেক — টুকটাক সাংসারিক প্রয়োজনে। সরিৎশেখর চোখ ফেরায় না।
কী দেখছেন? হুশ করে পাশ কাটানো সাইকেলটার চোখাচুখি রহস্য, আঙুলের চিহ্নে মাথার স্ক্রু-ঢিলার ইঙ্গিত দিয়ে চলে যাওয়া।
পাগল? মস্তিস্ক বিকৃতি? হতেই পারে। সরিৎশেখরের কৌতূহল স্বাভাবিক হয়। নইলে, ছিট বা বিকারগ্রস্ত ছাড়া কে আর সমাজের চলতি অভ্যেসের মাপকাঠি উল্টে দেবে?
সরিৎশেখর আরও অবাক, আচমকা কম্বলের মানুষটি কাছে এসে সরিৎশেখরকে খুবই নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী ইঙ্গিত করে গেল?
কে? কখন? জানি না তো!
ঢোক গিলে সরিৎশেখর চেপে যেতে, মানুষটি ফের ধীরে সুস্থে জানতে চাইলেন, সাইকেলটা আঙুলে কী সব সিগন্যাল দিল আপনাকে?
এত সুন্দর ও ধীর ভঙ্গিতে মানুষটি কথা বলছেন যেন পথঘাটের অন্যান্য ব্যক্তির কোনও বিঘ্ন না ঘটায়।
ও কিছু নয়! আড়চোখে সরিৎশেখর জড়ানো কম্বলটি লক্ষ করে।
লোকটি ফের হাসি হাসি বলে ফেললেন, আপনার সৌজন্যকে ধন্যবাদ! …জানি ওটা কীসের ইঙ্গিত। … আপনি বিব্রত হবেন না।
সরিৎশেখর পোঁ ধরার ভঙ্গিতে, না না। ও কিছু না …আসলে, এমন চাঁদিফাটা রোদ তো…।
ত-বু আ-মি কে-ন ক-ম্ব-ল জড়িয়ে হাঁটছি? লোকটি অসমাপ্ত ভাবটুকু পূরণ করে দিলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। মানে ওই…. সরিৎশেখর খানিকটা কবুল করল।
মানুষটি এবার শান্ত ও দৃঢ় সরিৎশেখরের উদ্দেশ্যে, অবাক হচ্ছেন তো দেখে?…
মাফ করবেন, একটু গায়ে পড়েই জানাচ্ছি… সোজা কথার মুখটা সোজা খুলে দিলেই খুশি হতাম!
সরিৎশেখর ভিতরে ধাক্কা খেয়ে মুখোমুখি তাকায়। এ-রাস্তা, এ-অঞ্চলটা অচেনা নয় তার। প্রায় এ-পথে বাজার সারতে আসে। অনেক মানুষই চোখের চেনা। কিন্তু এ-মুখটি অচেনা, নতুন অতিথি যেন!
কাঁচা-পাকা একঝাড় চুল কপাল জুড়ে। নাকের তলায় ঝাঁটার মতো ঘন একটি গোঁফের ঝোপ। ডিম্বাকার লম্বাটে মুখের গড়ন। দৃষ্টিটি সর্বদা বহু দূরে কিছু যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু চোখের পল্লবজোড়া ভাঁজমারা। দশজনের চোখের চাইতে আলাদা। এই মুখ স্বতঃস্ফূর্তই অন্যের সমীহ আদায় করে ফেলে। তাই এখন মুখোমুখি সরিৎশেখর কেন আপন ছাতাটি বন্ধ করে ফেলল, এখন রোদ সত্ত্বেও — কার্যকারণ খুঁজে পেল না।
মানুষটি হেসে বললেন, মেলুন! আপনি ছাতা মেলুন!… আমায় ভদ্রতা জানাতে হবে না।
থাক! সরিৎশেখর বলে, অসুবিধা হচ্ছে না আমার!
লোকটি তবু ভদ্রতায় বলেন, আপনার ক্ষতি হতে পারে।… যাদের অভ্যেস নেই, নিজের ওপর আস্থা কম… এই রোদ তাদের…..
আস্তে, মোহন ভঙ্গিতে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিতে মানুষটি কথা বলছিলেন। মুখের বাক্যটি শেষ হয়নি তখনও, একজন বয়স্কা, সুন্দরী মহিলা গুটিগুটি গলি ধরে এসে বললেন, এগারোটা দশ। কখন আর ডিমটোস্ট খাবে?
তাহলে মহিলা এনার স্ত্রী। সদ্য চান সারা, খোলা চুল। ঘরে পুজো-আচ্চার আসন ছেড়ে উঠে এলেন মনে হল। সিঁথিতে কোনও কিছু চিহ্নের বালাই নেই। খুবই হালকা রঙের কিন্তু রুচিময় শাড়ি। পায়ে নরম তুলতুলে স্লিপার। গোড়ালির চারপাশ প্লেন এবং লালাভ। নখে হালকা রঙ। তবে বয়সের চাপে চোখের চারপাশে কাকের নখের ছাপ শুরু হয়েছে। সরিৎশেখর আরও বিস্মিত, মহিলাকে খুবই পরিচিত লাগছে। কয়েকবার যেন কোথায় দেখেছে। কাছে এসে, হাসিহাসি স্মার্টলি বললেন, আমার স্বামী!… অধ্যাপনা থেকে সদ্য অবসর নিয়েছেন!
অধ্যাপক? কীসের?
মাইক্রো বায়োলজির!
এতক্ষণে সরিৎশেখরের ভেতরে সম্ভ্রমের মাখন জমতে থাকে। আর চল্লিশ ডিগ্রিতে কম্বলের ঠাট্টা চলে না। তবু মহিলাকে পেয়ে কিছু ভদ্রতা জানাতে হয়।
খুব চেনাচেনা লাগছে আপনাকে?
আ-মা-কে? মহিলা মার্জিত রহস্য করলেন।
বিজ্ঞাপনে আসেন কি আপনি?
আ-মি! ধরা পড়া হাসিতে মহিলা বললেন, কৈ, না তো!
সরিৎশেখরের ভিতরে হালকা নেশার ঝিমঝিম।
যেন কোথায় ফেসটা দেখেছি… লোকাল চ্যানেলে কোনও…?
এবার মহিলা সহজ হলেন। তৃপ্তির হাসি ফুটল।
সে-তো কয়েক বছর আগে!… নতুন একটা মোবাইল শপ্ রিকোয়েস্ট করেছিল… ওঁরই দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিনা..!
এখন?
না, না! দু-একটা ফাংশনে রিকোয়েস্ট এলে আবৃত্তি করি।
হঠাৎ সরিৎশেখর বলে, আপনার স্বামীর নামটি জানতে পারি?
যদিও দাঁতে সামান্য বয়সের ক্ষয় শুরু, জুঁইয়ের পাটির হাসি জানিয়ে মহিলা, আসুন না!…
এইতো আমাদের বাড়ি… দোতলাটার পেছনে… আমাদের টি টাইম এখন… এক কাপ লিকার… আপত্তি নেই তো?
এখন চা? সরিৎশেখর ইতস্তত করতেই, মহিলা গোছানো ভঙ্গিতে, যদি আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট না হয়… জরুরি কাজ নেই তো?
সরিৎশেখর একটু অপরাধবোধে ভুগছিল। চলন্ত সাইকেলটার উগ্র ব্যবহার প্রসঙ্গে অবচেতনে ভাবছিল দুনিয়ার ফালতু মানুষের কথায় বেশি মূল্য দিতে নেই।
সরি! আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম বোধ হয়!
সরিৎশেখর সামলে নিয়ে বলে, মাপ করবেন!…. অন্য প্রসঙ্গ ভাবছিলাম… এ-দেশে আমাদের হাতের সময় এত প্রেসিয়াস নয়!.. কী নাম বললেন যেন আপনার স্বামীর?
এইচ দাশগুপ্ত!… ড. হীরেন দাশগুপ্ত!
সামনের গলি দিয়ে দুটো দালান ছেড়ে বাড়িটা। বহু দিনের নির্মাণ, দুর্গ প্যাটার্নের — প্রকাশ্য রাস্তা থেকে চট করে চোখে পড়বে না। এমনকি, বাড়িটা ঘিরে উন্নয়নের আধুনিক ছাপ অনুপস্থিত। নীরবে যেন কাছেই গুপ্ত হয়ে আছে।
সদর দরজায় পৌঁছানোর পথটা দু-বাড়ির সীমানা পাঁচিল ধরে অনেকটা। তাতে দুপাশে কুশজঙ্গলের ঝোপ গজানো, লতাগুল্ম — হাঁটলে মনে হবে কল্পনার কোনও ডাঙ্গা দিয়ে চলেছি।
এত জঙ্গল? সাফ করান না? সরিৎশেখর বিস্মিত।
উনি যত্ন দিয়ে তা বন্ধ রেখেছেন! সাফাই পছন্দ করেন না। মহিলা বললেন।
সাপ-ব্যাঙ-মশা… বিপদ হতে পারে!
মহিলা নিশ্চিন্তে উড়িয়ে দেন, ও সব নেই কিছু… অনেক প্রিকশন্ আছে।
সরিৎশেখর আরও দেখে, সদর দিয়ে উঁচু সিঁড়ির চারপাশে পুরনো যুগের খেলনামুলোর ছড়ানো পাতাগুলো পর্যাপ্ত তেজি অবস্থায় জাঁকিয়ে আছে।কিন্তু ঢুকে পড়লেই ছিমছাম পুরনো অভিজাত পরিবেশ।
প্রফেসর দাশগুপ্তের বৈঠকখানাটি বইয়ে-বইয়ে ঠাসা। পুরনো আমলের ঢাকনা দেওয়া টেবিল ল্যাম্প। কাঠের চেয়ার, গদি। এখানে বাতাসেও যেন কাগজ-অক্ষরের ঘ্রাণ। পেয়ালা-পিরিচে চা এল। গন্ধ ছাড়ছে।
সামনের ছোট সোফাটিতে বসে অধ্যাপক যত্নে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। তবে একটা কম্পুটার আছে বটে এইসব পুরনোর মধ্যে।
অতি ভদ্রতায় টিপেটিপে ড. দাশগুপ্ত নিজের সম্বন্ধে খুবই বিনয় নিয়ে দু-চারটে তথ্য দিলেন। কোথায় পড়াতেন, জ্ঞান নিয়ে কোথায় কী কী চর্চা হচ্ছে, আজকাল ইন্টারনেটের যুগেও গ্রন্থের জগতের মানুষ কত বিচিত্র ও আত্মত্যাগী হয়ে উঠছে। বিশেষ-কৌটোর মধ্যে বুদ্ধিকে আর বন্দি রাখা যাচ্ছে না।
আমিই বলে যাচ্ছি! আপনার ব্যাপারে বলুন!
সামান্য! একটা মহকুমা আদালতে প্র্যাকটিস করি!
ওঃ! সামান্য কেন তা?
এর বিশ্লেষণ সরিৎশেখরের চট করে মাথায় আসে না। হেসে বলে, আমার কাজ ক্রিমিন্যালদের নিয়ে। অসামান্য কী করে বলি!
হঠাৎ ড. দাশগুপ্ত একখানা বই টেনে, ম্যাপসহ ছবি দেখিয়ে বললেন, এগুলো মরু এলাকার দেশ — দিনে পঞ্চাশ-ষাট ডিগ্রি… দেখুন আলখাল্লা মুড়িয়ে ঘুরছে!
মহিলা অতি শান্ত কণ্ঠে তখন, রণ, এ-প্রসঙ্গটা থাক!…. এখানে চল্লিশ ডিগ্রি অনেকটাই… যুক্তিতে মেলালে হবে কেন? দশজন এ-স্বাধীনতাকে বাড়াবাড়ি ভাবতেই পারে।
স্ত্রীর মন্তব্যে ড. দাশগুপ্ত রহস্য করলেন, হ্যাঁ, এক-খুরে মাথা না মোড়ালে এখানে চলে না।… সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ।
সরিৎশেখরের উদ্দেশ্যে ফের দাশগুপ্ত, আমার মন্তব্যে কিছু মনে করবেন না!
তখন মহিলা স্বাভাবিক ব্যবহারে স্বামীকে বললেন , একটু আগেই আলাপ হল।… উনি গতকাল বন্ধুর বাড়ি লাইটার ফেলে গেছিলেন… নিয়ে ফিরছিলেন যখন রোদে বেরিয়েছিলে তুমি।
সরিৎশেখর চাপা অপরাধবোধে বলে, হ্যাঁ, পরিচয়টা আকস্মিক, নাটকীয়।… কিছু মনে করবেন না।
সেই সাইকেলের পাবলিক ফের মনে পড়ে গেল তার।
একটু সময় নিয়ে অধ্যাপক ধীরে সুস্থে উত্তর দিলেন, কারও মনে করায় অন্যের কিছু যায় আসে না। মানুষ স্বাধীনতা নিয়েই জন্মায়!
মহিলা ফের শান্ত ভঙ্গিতে, কারও তো মনে করার কিছু থাকতেই পারে।… মেজরিটি নিয়েই তো সংসার।… যাক, উনি আমার সেই অ্যাড-এর ব্যাপারটা মনে রেখেছেন।
ড. দাশগুপ্ত সরল হাসি দিলেন। সে তো মশাই চোদ্দ সালের ব্যাপার।… তিন বছরের পুরনো!… সাবাশ আপনার স্মৃতিকে…. ব্যাপার কী জানেন, ছাঁচে না ফেলতে পারলেই পাগল অথবা রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিপন্ন করা… সরি, ফের আপনাকে বোর করছি। মল্লিকা রেগে যাচ্ছে।
সরিৎশেখর ইতস্তততায় বলে, হ্যাঁ, হুক্কাহুয়া শুনলেই আমরা গলা মেলালে কর্তারা খুশি।
মল্লিকাদেবী বললেন, এদিকে এলে আসবেন। তবে ওনাকে প্রায়ই আমন্ত্রণে বিদেশ যেতে হয়…
সারা বছর এখানে আমরা থাকতে পারি না।
সরিৎশেখর বুঝল এবার উঠে পড়া প্রয়োজন।
আপনারা দুজনেই যান? কার জিম্মায় বাড়িটা থাকে?
তখন বন্ধই থাকে।… উনি চলতি হাওয়ার বিপক্ষে… প্রোমোটারকে দেবেন না।
অধ্যাপক হাল্কা রসিকতায় মাথায় স্ক্রু ঘোরাবার ছন্দে বললেন, নিশ্চয় এজন্য মাথায় আমার গণ্ডগোলের ভাবনা হচ্ছে?
মুখের পেশীতে হাসিহাসি ভঙ্গি।
সরিৎশেখরের গালে নীরবে একটা থাপ্পড় পড়ল। হজম করে বলে, না না কেন? কী নিয়ে ভাবব?
অধ্যাপক গম্ভীর। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে টের পেলেন, ঠাট্টাটি সৌজন্যবোধ লঙ্ঘন করে ফেলেছে।
বাইরে রোদ গনগন করছে। পৌনে বারোটার মুখে ঘড়ির কাঁটা। অধ্যাপক দাশগুপ্ত এখন ফ্রেশ হবেন। এটাই ওনার রুটিন অভ্যাস। চলতি হাওয়ার ব্যতিক্রম। ফের একটা সিগারেট ধরিয়ে সতর্ক রসিকতায় বললেন, ধরুন যদি হুক্কাহুয়া করে ফরমান জারি হয় দিনের একই টাইমে সবাইকে ফ্রেশ হতে হবে … আমি পটিফোবিয়ায় মরে যাব! তা কেন হবে? সরিৎশেখর এবার যেন ভাবনায় সামান্য প্রতিরোধ জানায়।
ধরুন যদি অমন আইন জারিতে মেজরিটি সায় দেয়?… আর আপনি তার বিরোধী? কী হবে? বিজ্ঞানীর প্রশ্নে সরিতশেখর কিছু বলার আগেই, অধ্যাপক ‘বলা হবে আপনার বিকৃতি, না হয় মাথার স্ক্রু, বলেই আঙুলে প্যাঁচের চিহ্ন দেখালেন।
কুশজঙ্গলের পথে গেট অবধি এগিয়ে দিতে দিতে, মল্লিকা পুরনো প্রসঙ্গ তুলে বললেন, জোর করলে জঙ্গল সাফাই করে দিতে পারি।… ইচ্ছেও হয় কখনও… বাধাটা কোথায় জানেন? সরিৎশেখর সামান্য অন্যমনস্ক।
বিকেলে উনি ঝোপের পথটুকুতেই পায়চারি করেন… কী ফিলিংস তার জানি না…. বাইরে বিশেষ বেরুতে চান না।….. বেরুলেই পথে ঘাটে… বলেই মহিলা আহত চোখে বাকিটুকু উহ্য রাখলেন।
ভদ্রতা সেরে সরিৎশেখর পথে। গনগনে রোদে ছাতি খুলতে হল। সকলেরই মাথায় ছাতা এখন।
পেছন থেকে পরিচিত একজন আওয়াজ দিল, গ্যালেলিওর বাড়িতে আপনি? পরিচয় আছে নাকি?
গ্যা-লে-লি-ও?
পরিচিত জনটি এবার পুরনো পাদ্রিদের খসখসে গলায় বলে, নাটক করছেন?
মুহূর্তে সরিৎশেখর পাল্টি খেয়ে হুক্কাহুয়া করে উঠল।
আরে না, না! মাথা খারাপ হয়নি আমার!
দু’জনে খোলামেলা হাসি দিল এবার।