সুস্নাত চৌধুরী
সাক্ষাৎকারটি ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত, এবং সুস্নাত চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
আপনার কবিজীবন এবং পরমা সম্পাদনা এবং প্রকাশনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলুন, একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে কবিতার দৃশ্যগত প্রেক্ষিতের বিবেচনায় একজন প্রকাশকের কি ভূমিকা থাকা উচিত?
আমার মনে হয় প্রথম নজর দেওয়া উচিত, পড়তে কি করে সুবিধে হয়। যেন ছাপার ভুল না থাকে, যেন ভাঙ্গা টাইপ না থাকে, যেন কালির বিতরণে সমতা থাকে — আগে তো ভাঙ্গা টাইপ বা ছাপা জ্যাবড়ানো-বিবর্ণ হত। এমনকি যদি লাইন ভাঙ্গা হয়, অনেকবার আমি চিন্তা করেছি, বড় লাইনের ক্ষেত্রে যদি চওড়ায় না ধরে খানিকটা এক্সট্রা আছে, তাহলে কোথায় বসবে? ঠিক কোনখানে? বসিয়ে-বসিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করতাম, কোথায় দিলে পরে এটা কনটিনিউশন বলে বোঝাচ্ছে, পড়তে সুবিধে হচ্ছে, এবং কোনও জার্ক আসছে না ৷ এগুলো লক্ষ করতে হবে৷ এগুলো নির্ভর করে এক্সপেরিয়েন্সের উপরে৷ সত্যিই এসব ভাবলে ভাবার আছে৷
আর দরকার হল লেখার পাশে ফাঁকা জায়গা৷ আমি হিসেব করে দেখেছি এক পৃষ্ঠায যদি একটি কবিতা আসে এবং চারদিকে একটা ফ্রেমের মত সাদা জায়গা থাকে, তাহলে একটা দৃশ্যরূপ তৈরি হয়৷ সেটি কিন্তু কবিতার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং সুবিধাজনক৷ আবার কবিতা এত ছোট-ছোট হয়ে গিয়েছে যে এক পৃষ্ঠায় একটিই কবিতা অনেকসময় ভালো লাগে না, মনে হয যেন বেশি শৌখিনতা হয়ে গেল৷ মানে, চার লাইন কি ছ-লাইন কি দশ লাইন –এটা খুব আনইকমনিকাল মনে হয় এবং মনে হয় যে বেশি সাজানো হল আর কি৷ ওরকম না করাই ভালো৷ তখন কী করব আমরা? সেটা যাঁর বই তাঁর উপরেই নির্ভর করে, তিনি কী ডিসিশন নেবেন ৷ আরেকটা জিনিস হয়, আমরা যে প্রবলেমটা ফেস করি হয়ত বড় কবিতা, দু-পৃষ্ঠায় গেছে, তখন আমি ভাবি আর কি, কবিতাটা বাঁ-দিকের পৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ হয়ে ডানদিকের পৃষ্ঠায় এসে গড়িয়ে যাবে৷ এই দুটো পৃষ্ঠার মধ্যেই কবিতাটা শেষ ৷ তাহলে আমাকে আর পাতা ওলটাতে হচ্ছে না ৷ ভাবতে হচ্ছে না যে এর পরে কী আছে, বা আদৌ কিছু আছে কি না৷ একবারেই পুরো চেহারাটা দেখা গেল ৷ মানে, খেয়াল রাখতে হবে, কোনওরকম আনএক্সপেকটেড কিছু যেন না ঘটে।
আর, আগে দেখতাম, হাতের কাজের উপর বেশি নির্ভর করত প্রেস৷ এই যে কবিতার শিরোনাম, এখন তো হেডিং সাধারণত একই টাইপে পয়েন্ট বাড়িয়ে, কিংবা লম্বায় বাড়িয়ে, বা পাশে বাড়িয়ে আলাদা করা হয়৷ কখনও বোল্ড করা হয়৷ সেটা যায় যেমন ইচ্ছে, যার চোখে যেমন ভালো লাগে৷ আগে কিন্তু তা ছিল না। আগে আর্টিস্টরা লেটারিং করে দিতেন, ব্লক করে ছাপা হত৷ তার ফলে, ওই হাতের কাজ এবং টইিপ সেটিং কিন্তু এক পৃষ্ঠায় আসত৷ এখানে চরিত্রের মেলামেশা দরকার৷ যদি না মেলে, তাহলে কিন্তু খারাপ লাগবে দেখতে ৷ মিললে খুব সুন্দর, সূদৃশ্য ৷
একইভাবে, পত্রিকায় কবিতা ছাপার ক্ষেত্রে দৃশ্যগত ভাবনার দিক থেকে একজন সম্পাদকের কী দায়িত্ব বলে আপনি মনে করেন? বা, এই প্রেক্ষিতে বই ও পত্রিকার নির্মাণের মধ্যে পার্থক্য কী?
দ্যাখো, বইটাকে আমরা বিক্রি করি, কিন্তু কমোডিটি হিসেবে ধরি না। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ডিফারেন্স আছে৷ পত্রিকাকেও আমরা ভালোবাসি, কিন্তু যতই ভালোবাসি না কেন, তাকে কিন্তু আমরা কমোডিটি হিসেবে ধরি৷ কত কপি পত্রিকা বিক্রি হল তোমার — বলি না? কিন্তু বই-এর ক্ষেত্রে আমরা সেভাবে বলি না৷ পত্রিকার পিছনে যেহেতু একাধিক লোক থাকে, তাই উৎসাহটা অনেক বেশি থাকে৷ অনেকের শেয়ার রয়েছে আর কি৷ মানে, বাড়িতে খাওয়া আর চড়ুইভাতিতে খাওয়া, এর মধ্যে যে-তফাত, সেই তফাতই রয়েছে নিজের বই আর পত্রিকাতে৷
পত্রিকাতে আরেকটা জিনিস হচ্ছে… এটা আমি আমার নিজস্ব কথা বলছি, পত্রিকাতে কবিতা থাকে, প্রবন্ধ থাকে৷ তার মানে, গদ্য থাকে, পদ্য থাকে৷ পদ্যের কথা তো আগে বললাম, সেটা বই-এর ক্ষেত্রে যেভাবে করতে হয়, এখানেও সেই একই কথা প্রযোজ্য৷ কিন্তু গদ্য-পদ্য মিলিয়ে একটা অ্যাসর্টেড চেহারা আসে৷ সেখানে কী করব? বাইরের বইগুলো দেখলে কিন্তু অনেক কিছু মাথায় আসে আমাদের৷ যেমন প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা ফন্ট বদলে দিতে পারি৷ গদ্যের একরকম ফন্ট, কবিতার আরেকরকম ফন্ট৷ বদলে দিয়ে একটা দৃষ্টিগত তফাত আনতে পারি, ভালো দেখায়৷ পয়েন্টও বদলে দিতে পারি৷ পয়েন্ট বদলে বক্স করে যদি মাঝখানে ছাপি, ছবির এফেক্ট আসে৷ এগুলো কিন্তু করা যায়। আমি দেখেছি, ফর্টিস-ফিফটিসে ইংল্যান্ড থেকে একটা পত্রিকা বেরোত রডগিট বলে, বামপন্থার কাগজ, তাতে মাঝে-মাঝে ছোট পয়েন্ট বড় পয়েন্ট করে কম্পোজ করা হত৷ অসাধারণ দেখতে৷ এই জিনিসগুলো দেখলে পরে মাথায় অনেকরকম ধারণা কাজ করে৷ এই যেমন, আমার লাল স্কুলবাড়ি৷ সেখানে কবিতাগুলো শুরু হয়েছে নিচে রেঞ্জ রেখে৷ সাধারণত কী হত, ওপরে রেঞ্জ রেখে আরম্ভ হত, কিন্তু এটা নীচে রেঞ্জ রেখে আরম্ভ হয়েছে এবং যদি ওপারে নিয়ে গেছি তো মাথার উপরের গ্যাপটা বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে ব্যালান্স থাকে৷ শিরোনামটা রেখেছি একই জায়গায়৷ এই কায়দাটা নিয়েছিলাম ফরাসি বই থেকে৷ অরুণ মিত্রের কাছে অনেক ফরাসি বই আসত, আমাকে একটা দিয়ে বললেন দ্যাখো কী সুন্দর করেছে৷ আমি বল্লাম– বাঃ। দিন তো, আমি কাজে লাগাব। ঐখান থেকেই আমি এই ধারণাটা পেয়েছিলাম৷ এইরকমভাবে নানান দিক থেকে দেখতে হবে৷ সুবিধেটা প্রথম মনে রাখতে হবে, যাতে পড়ার কোনও অসুবিধে না হয়, সুখপাঠ্য হয় যেন৷
পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান-এ আপনি লিখছেন — ‘ফারসী, চীনে, রোমক লিপিগুলির এক একটির এক এক গতিপথ — ফারসী লেখা চলে আড়াআড়ি ডান থেকে বাঁয়ে। বই পিছনের পৃষ্ঠায় শুরু হয়ে শেষ হয় সামনের পৃষ্ঠায়৷ চীনে লেখায় শব্দ বা হরফগুলি নামে বৃষ্টিধারার মতো উপর থেকে নিচে, কিন্তু পরের পর শব্দ সাজানো হয় পৃষ্ঠার ডান কিনারা থেকে ক্রমশ বাঁয়ের দিকে৷ তুলিতে লেখা এই লিপি যেহেতু গাছের মগডাল থেকে লতার মতো নিচের দিকে নামে, অতএব চীনে নিসর্গ চিত্রের ছন্দের সঙ্গে অনেকখানি পাঠ্যবস্তুও ছবির সঙ্গে খুব খাপ খেয়ে যায়। ’
তাহলে কি কনটেন্টের সঙ্গে হরফের সাযুজ্য থাকা বাঞ্ছনীয়?
বাংলার ক্ষেত্রে হয়তো অন্যরকম হয়, কিন্তু হতে পারে৷ রবীন্দ্রনাথ তো অনেকরকম করেছিলেন৷ অবনীন্দ্রনাথ বা ঠাকুরবাড়ির অনেকে লেখার যেখানে কাটাকাটি হয়েছে; কাটাকুটিকে কাটাকুটির মতো না রেখে সেখানে ছবি করে দিতেন৷ রবীন্দ্রনাথও করতেন৷ ভালো লাগত৷ ধরো, রবীন্দ্রনাথের পূরবী-র ওই শেষ বসন্ত কবিতাটা — বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায় তোমার ছবি দূরে… ৷ এই যে কবিতাটা, এখানে কাটাকুটি করেছেন৷ কাটাকুটিতে মনে হচ্ছে, যেন সত্যিই একটা বাঁশবন, এবং মেয়েটা নেই৷ সূর্যাস্তটা আছে৷ এখন এই যে জিনিসগুলো এগুলো মনের অসম্ভব চেতনার শক্তি৷ কিংবা… দেখে বুঝতে পারা, যেটা আমি চাইছিলাম, সেটা এসেছে৷ এটা কিন্তু এনজয় করার৷ তো, এইদিক থেকে ব্যাপারটা ভাবা যেতে পারে৷ রবীন্দ্রনাথের ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে একটা এক্সিবিশন হয়েছিল, ছবির মতো টাঙিয়ে৷ আমি দেখেছিলাম৷ অসাধারণ৷ এমনকী তোমার ভেতরটা পর্যন্ত মেলোড হয়ে যাবে৷
পত্রিকা প্রসঙ্গে যেটা বলছিলেন, কবিতা আর গদ্য কি তাহলে আলাদা হরফে ছাপার কথা ভাবা উচিত?
এই প্রয়াস বাংলায় সেভাবে হয়নি। আমি দেখিনি। কিন্তু হলে ভালো হত৷ ডি কে গুপ্ত একটা পত্রিকা করতেন সারস্বত৷ এই পত্রিকাটি দেখলে বুঝতে পারবে, ছাপা দিয়ে কী করা যায়৷ না দেখলে, বোঝানো সম্ভব নয় এর ভেতরে কিন্তু পয়েন্ট বদলানো হয়েছে৷
এই যে প্রবন্ধের মধ্যে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়া, এইটা কিম্ভ চালু ব্যাপার হিসেবেই করছি, নিজের মন থেকে করছি না যে, আমি এইটা করব, এইটা এইরকম হবে, এত পয়েন্ট দেব — সেইভাবে হচ্ছে না, খুব কনশা’সলি করছি না৷
জনমানুষ ও বনমানুষ-এ আপনি লিখছেন — ‘পত্রিকা থাকলে অনেক মুরুব্বি এবং ভক্ত জোটে, এদের একটি কথাও শোনা উচিত নয়৷ ছাপাখানার কম্পোজিটর এবং মেশিনম্যানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারলে ফল খুব ভালো হয়৷’ শুনেছি আজকাল, বা আগেও হয়তো ছিল, অনেক সম্পাদক প্রকাশক নাকি হাতে-কলমে আর কাজ করেন না৷ শুধু লেখা বেছে, ম্যাটার দিয়ে দেন৷ ছাপা, প্রুফ দেখা, বাঁধাই এসব দেখভালের জন্য আলাদা লোক রয়েছে৷ এই প্রবণতা সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য?
‘আমার তো মনে হয়, যে সম্পাদক হবে, বা যার উপরে নির্ভর করছে বই বা পত্রিকাটা কীরকমভাবে বার করবে, তার নিজের রাইট ছাড়া উচিত নয়৷ এটা তো আমার একটা প্রিভিলেজ৷ আমি একটা পত্রিকা সাজাচ্ছি, পত্রিকাটা আমার প্রোডাকশন, আমি কেন ছাড়ব৷ আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব, আমার মতো করে, আমি যা ভালো বুঝছি, সেইভাবে করতে৷
তাহলে কি লেখা নিয়ে বা কন্টেন্ট নিয়ে যে আগ্রহ রয়েছে, প্রোডাকশন নিয়ে সেটা নেই? না, সেটাকে তত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না?
এই ব্যাপারটা মাথায় ঢোকেনি৷ এইটাই কারণ৷ তাই প্রোডাকশন নিয়ে সেই আগ্রহটা নেই৷ একজন সম্পাদক, সে লেখা সম্বন্ধে, তার মান সম্বন্ধেও এক্সপার্ট হবে, আবার কীভাবে তাকে সাজাতে হবে, সেই সম্বন্ধেও তার জ্ঞান থাকতে হবে৷ সেরকম লোক কম আছে, কিন্তু আছে। আরে, একটু-একটু করে নিজেকে তো ট্রেইন আপও করা যায়৷
‘সুমুদ্রিত’ বলতে আমরা কী বুঝি? নির্ভুল৷ মানে, সহজে বোঝা যায়, চোখের কষ্ট লাগে না… এইরকম৷ কিন্তু এর যে একটা এসথেটিক দিক আছে, সেইটে কি বুঝি? না, সেইদিকে আমাদের ঝোঁক আছে? এই সৌন্দর্যচেতনাটা ধরতে হবে৷
পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান-এ আপনি বলছেন — ‘এমনকি আধুনিক সুগঠিত টাইপ ফেসের নিখুঁত ছাপা যে দৃশ্যের নকশা তৈরি করে তাও একটি লেখাকে নীরবে রূপ দিতে থাকে৷ এই যুগে, আবৃত্তিকারের গলায় শব্দে শোনা গল্প কবিতা নয়, ছাপা পৃষ্ঠাগুলি তার এ কম্পোজ করা স্থির নীরব পটে যতখানি দেয়, লেখকের হয়ে তার চেয়ে বেশি অন্য কোনও মাধ্যম দিতে পারত না৷ ছাপাখানা, একসঙ্গে অনেক বই প্রস্তুত করতে পারে বলে নয়, লেখার সবচেয়ে আধুনিক, ভাবাবেগহীন দৃশ্যচিত্র তৈরি করে বলে আমি তার একান্ত অনুগত।’
এই প্রসঙ্গেই জানতে চাই, লেটারপ্রেস থেকে এই যে সাম্প্রতিক ডিটিপি-অফসেট-ডিজিটাল এই পরিবর্তনের কী প্রভাব বাংলা পত্র-পত্রিকা বা বাংলা মুদ্রণের ক্ষেত্রে পড়ছে বলে মনে হয় ?
ঠিকই বলেছিলাম৷ লেটারপ্রেস খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত মাঝেমাঝে৷ মানে, ভাঙা টাইপ কিংবা মেশিনে চাপাতে যাওয়ার ঠিক আগে টাইপের বাঁধুনিটা হড়কে গেল৷ সমস্ত টইিপ ঝুরঝুর করে পড়ে গেল৷ এই যে সমস্যাগুলো, এগুলো আর হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ কতখানি রিস্ক নিয়ে যে কাজ করা হত৷ এখন নিঃসন্দেহে অনেক সুবিধে হয়েছে, অনেক সুদৃশ্য হয়েছে৷ ভাবা যায় না, একটা টাইপ ভাঙা নয়৷ এটা আমরা আশা করতে পারিনি৷ তারপরে, যে লেখক, সে যদি কম্পিউটার চালাতে জানে, সে নিজেই করে নিতে পারে সবটা৷ আমি পারি না, শিখিনি, কিম্ভ অনেকে তো পারে দেখছি৷
আর, একটা ব্যাপার আছে, আগেকার কম্পোজিটররা বানান ভালো জানত ৷ আর এখন নিয়মাধীন বানান উঠেই গেল প্রায় ৷
এই যে বলছেন অনেকে নিজেরাই করে নিচ্ছেন, ডিটিপি ডিজিটালের এই অতিব্যবহার ও সহজলভ্যতায় আখেরে নান্দনিকতা কি মার খাচ্ছে?
এটা আমি সেভাবে বলতে পারব না৷ কিন্তু ভুল লোকের হাতে গিয়ে পড়লে হবে না৷ এর মধ্যে তো বই তৈরির ব্যাপার রয়েছে, যে এটা করবে, তাকে সেটা শিখতে হবে৷ আদারওয়াইজ হবে না৷ সে তখনই কাজটা করবে, যখন সে কাজটা পারে৷
তবে, মাঝে-মাঝে এইসব ছাপা টাপা নিয়ে প্রদর্শনী হওয়া উচিত, যেমন ছবির প্রদর্শনী হয়, সেইরকম৷ তাহলে অনেকটা বোঝা যাবে৷ এগুলো হওয়া দরকার৷
রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির কথা বললেন৷ পিলসুজ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে (১৯৮৯) খুব ইন্টারেস্টিং একটা কথা বলেছিলেন আপনি — ‘ক্যাশমেমোর সাদা পিঠে, বই কিংবা চায়ের বাদামি ঠোঙায় খসড়া করা কবিতা আমার সহজে উতরোয়৷ এক বন্ধু তার ব্যবসা উঠে যাবার পর ডেলিভারি চালানের একখানা আস্ত বই উপহার দিয়েছে৷ ডিমইি অকটেভো, পাতাগুলো পর পর হলদে, গোলাপি আর সাদা৷ লাল স্কুলবাড়ি-র প্রায় সব কবিতইি ওই ডেলিভারি চালানে লেখা।’
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এই ফিক্সেসনগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রাফ কাগজে আমার লিখতে সুবিধে হয়৷ কারণ ওটার কোনও দায়িত্ব থাকে না৷ একটা কাগজ নষ্ট করছি, এই দায়িত্বটা থাকে না৷ আর মনেও খুব ফ্রি থাকি — ও যাবে তো যাবে৷ সুতরাং, মনটা ফ্রি থাকলে লেখা উতরোয় সহজে৷
আসলে, এ হল আমার কার্পণ্য৷ আমার স্বভাবটা একটু কৃপণ৷ এছাড়া আমি তো আর কোনও কারণ খুঁজে পাই না৷ অনেকে তো সাজগোজ করে কবিতা লিখতে বসতেন, সামনে গোলাপফুল গোঁজা৷ এখন অবশ্য অন্য সাজগোজ থাকে৷ আমার ওসব কিছু দরকার পড়ে না৷
এই প্রসঙ্গে বলি, একটা জিনিস করলে কিন্তু মন্দ হয় না৷ মনে করো, তুমি একজন কবির কবিতা ছাপলে, পাঁচ-ছ’টা কবিতা, সঙ্গে তার পাণ্ডুলিপির একটা কাটাকুটি করা পৃষ্ঠা পাশে ছেপে দিলে৷ একটা ছবির এফেক্ট-ও আসবে, তার স্বভাবটাও বোঝা যাবে৷
লাল স্কুলবাড়ির তিনটি পর্বের শুরুতে আপনার নিজেরই আঁকা তিনটি ছবি রয়েছে৷ সঙ্গে কবিতার অংশবিশেষ৷ ছবিগুলি আঁকার বা ব্যবহারের সেই প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল?
প্রথম প্রেফারেন্স দিয়েছি ছবিটাকে৷ ছবিটাকে আমি সিলেক্ট করেছি যে, এইরকম ছবি এই ক্যাপশন দিয়ে যাবে৷ তিনটে ছবি৷ অনেক চিন্তা করেছিলাম এই বইটার ক্ষেত্রে৷ ঠিক করেছিলাম তিনটে ছবি দেব, ছবিটাকে পরিষ্কার করার জন্য নিচে তিনটে লেখা৷ এইভাবেই…৷
পিলসুজ পত্রিকার ওই সাক্ষাৎকারেই আপনার মন্তব্য ছিল ‘শুধু ছন্দ কেন, একজন কবির যাবতীয় অলংকার, আঙ্গিক, প্রকরণ এবং চাতুরি, সবই জানা কর্তব্য৷ একজন কবি ভোরবেলা উঠে কি স্থির করে নেন — আজ আমি যে কবিতাটি লিখব তা গদ্যে হবে না পদ্যে? সনেট না ভিলানেল স্রগ্ধরা না মালিনী?
প্রত্যেকটি কবিতা তার নির্দিষ্ট চেহারা নিয়ে আসে৷ আধারের সঙ্গে আধেয় ওতপ্রোত, অচ্ছেদ্য৷ কবিতা গান্ধারীর পুত্রদের মতো একটিমাত্র পিণ্ড থেকে জন্মায় না, কুন্তীর ছেলেদের মতো তাদের এক-এক জনের এক-এক রূপ, এক-এক গুণ, এক-এক চরিত্র৷ ধর্ম, আকাশ, বাতাস, ভেষজ, নিরাময় সবাই এসে জীবনের গভীর উৎসব সম্পূর্ণ করেন৷ পাঠক দ্রৌপদীর মন নিয়ে দেখলে ঠিকই বুঝতে পারবেন৷
কিন্তু কেউ যখন সিরিজ লেখেন, তখন তো একটা ফ্লো-এ লিখতে থাকেন হয়তো৷ সেক্ষেত্রে কি এই ভাবনা কিছুটা হলেও কবির ভেতরে কাজ করে না?
সিরিজ লেখে যখন, তখন সে খানিকটা মেশিনের মতো কাজ করে৷ কবির মতো ততটা নয়, যতটা মেশিনের মতো৷ ঠিক আছে?
পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান-এ এক জায়গায় আপনি লিখছেন “ছবি, ভাস্কর্য, স্থাপত্য এরা হচ্ছে শিল্প, বস্তুগত, অবয়বময়৷ কবিতা নিরবয়ব তাকে কিছুরূপেই শিল্প বলা যাবে না৷ তেমন তেমন গল্পও শিল্প নয়৷ কবিতা আর গল্প যদি শিল্প না হয় তবে তারা কী? বস্তুর ভর আছে, শক্তির ভর নেই এইভাবে দেখা যাক প্রভেদটাকে৷ ছবি, ভাস্কর্য, স্থাপত্যের তো ভর আছে, আর কবিতা, গল্পের ভর নেই তারা শক্তি৷..…বস্তুর বিশ্লেষণ বা বিচার করা খানিকটা সহজ৷ কিন্তু শক্তির বিচার করবে কে? তাই কবিতা বিচার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়৷ এইখানে ভালো কবির অসুবিধা এবং খারাপ কবির সুবিধা৷’
এ-লেখা প্রথম প্রকাশের পর কুড়ি বছরেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে৷ আজ এই ২০১৫-১৬ সালে এসে কীভাবে দেখছেন? ‘ভালো কবির অসুবিধা এবং খারাপ কবির সুবিধা’ কী জায়গায় রয়েছে?
যা বলেছিলাম, এখনও তাই আছে৷ কিছু পাল্টায়নি৷
চাঁদের ওপিঠে-তে একজায়গায় বলছেন — ‘…তাহলে এই প্রস্তাবিত কবিতার শরীর কেমন হওয়া উচিত? গদ্যপদ্যের বিরোধভঞ্জন ইত্যাদি কথা তো অনেক হয়েছে৷ তবু এখনও আমরা সেই রবীন্দ্রনাথেই আছি৷ আসলে কবিতার কথা ভাবলেই আমরা যেন ক্লীবাবস্থা পাই৷ মন উদাস হয়ে যায়, কলম এলিয়ে পড়ে, ভাষা বেপথু৷
জীবনে যা ভাবি, যে কথা বলি, কবিতায় গেলেই যেন তাকে উলটেপালটে দিতে হবে৷ অথবা এ যেন এক প্রেতাবিষ্ট অবস্থা — আমরা নিজের কথা বলি না; চালু, বিবর্ণ, মৃত কবিতার প্রেত আমাদের গলা অধিকার করে নেয়, আমাদের গলায় সে-ই কথা বলে৷ আর, পরে আমরা রটাই — আমরা নির্মাণ করি না, আমাদের ভর হয়৷ একটু উপরের তারা, যারা সত্য কথা ছাড়া বলেন না, এমন কি সেই তীব্র সৎপুরুষরাও কবিতার সামনে কেমন যেন ‘হত ইতি গজ’-র বিলোল যুধিষ্ঠির হয়ে যান৷ এর চেয়ে পুরো মিথ্যুক হওয়া ভালো ছিল৷’
কবি ও কবিতার ক্ষেত্রে এমনটা কেন হয় বলে মনে করেন?
বলে তো, কবিরা বলে না? আমার ভুল হতে পারে, এটা হচ্ছে যে, একটা কথা আমি বলব, সেই কথাটা আমার ভেতর থেকে আসবে৷ আমি বিশ্বাস করব৷ তা না, কবি হলে পরে কীরকম বলা উচিত ছিল, সেই কথা ভেবে যদি বলি, তাহলে সেটা আমার কথা হল না৷ এবং এটা খুবই এলোমেলো ব্যাপার হয়ে যায়৷ তারপর, কবিতার ভাষা যেন আলাদা৷ কেন? আমাদের মুখের ভাষা কি যথেষ্ট নয়? অথবা, কবিতার ভাষা যদি অন্যরকম হয়ও, সেইটা মুখের ভাষার সঙ্গে মিশে যাক৷
ওই একই লেখায় বলছেন — ‘কবিতাকে আমরা, অভ্যাসবশত, বহুদিন ধরে ভেবে আসছি স্ত্রীলিঙ্গ৷ সেভাবেই আমরা তাকে সাজাইগোজাই৷ কেন, তাকে কি পুৎলিঙ্গ ভাবা যায় না? শুধু দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনেই হয়তো তার শরীর ও আত্মা, আমাদের আকাঙ্খিত পথে, পালটে যেতে পারে৷’
এই জায়গাটি যদি একটু সবিস্তারে বলেন৷
কবিতাকে আমরা সাধারণত মেয়ে ভাবি৷ মেয়ে ভাবি এই জন্যে যে, সে নরম, সে সব সহ্য করতে পারে না, সে সুন্দর, তার ভাষা স্বতন্ত্র হয়৷ কবিতার আবার চেহারার বর্ণনা আছে, তার কোমর সরু হবে, নিতম্ব মোটা হবে৷ এর কী মানে আছে! মনে করো, স্ট্রাইক নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা, সেইটা কি এই কবিতার চেহারাতে মানাবে? প্রত্যেকটা লেখার যে-ভাব, সেই লেখা কিন্তু সেই ভাবকে ধারণ করার উপযুক্ত হওয়া চাই৷
আপনার টুনুনান্টাং লেখাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে — ‘…আদিম স্তরে রয়ে গেছে এমন নরগোষ্ঠীর কিছু গান উপস্থিত করছি, যদি তাতে শব্দদৈন্য এবং অর্থহীন ধ্বনির সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক কিছু বোঝা যায়:
হা মা লা হা মা লা হা মা লা হা মা লা
ও লা লা লা লা লা লা লা লা লা
টেরা ভেল ফুয়েগোর অধিবাসী ইয়ামানা ইন্ডিয়ানদের এই গান কাউকে দেখে স্বাগত, বিস্ময় ও আনন্দ জানাবার গান, ছোট ছোট লাফের সঙ্গে গাওয়া হয়৷ ইয়ামানাদের গান এই রকমই — সত্যিকারের শব্দ একটাও নেই, সবই অর্থহীন ধ্বনি৷ কিন্তু তাদের ভাবাবেগটা তো বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে৷
তান্ তান্দিনানান্ তান্দিনানে
তানান্ তান্দিনা তান্দিনানে
শ্রীলংকার ভেদ্দা আদিবাসীরা তাদের অর্থসঙ্গত গানের শুরুতে এবং শেষে এই অর্থহীন ধ্বনিগুলি ঐ অনুক্রম রক্ষা করে গায়৷ আমাদের সঙ্গীতে তেলেনা অথবা দক্ষিণী নাচের রোল হয়তো এই এরই জিনিস, উচ্চম্ভবের শিল্পীদের গায়নে যা ক্রমশ সূক্ষ্ম এবং দুর্ধর্ষ শিল্পিতা পেয়েছে৷
ধ্বনিসাদৃশ্যে আরও অনেক তুলনা মনে আসে৷ রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর একটি :
টুনুনান্টাং টুনুনান্টাং লোহিত যাচ্ছে বয়ে…
টুনুনান্টাং টুনুনান্টাং সময় যাচ্ছে ক্ষয়ে৷
ব্রহ্মপুত্রের জল বয়ে যাওয়া বা ধমনীতে রক্তের শব্দ কিম্বা আয়ু ক্ষয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই অতীব অর্থপূর্ণ৷ কিন্তু শেষে ঐ কঠিন সত্য আর মনে থাকে না, শুধু বাজতে থাকে অর্থহীন টুনুনান্টাং ধ্বনি — যে ধ্বনি জলকলরবের আর সময়ের ঘণ্টার৷ অতএব অবোধ্য ধ্বনিও সবসময় নিরর্থক নয়, আদিমদের ধ্বনি তো নয়ই৷’
এখানে ‘ধ্বনি’র কথা বলছেন৷ দৃশ্যও কি নয়? ‘অর্থহীন’ শব্দও কি চোখের উপর ভাসতে থাকে না?
যার যেমন ক্যাপাসিটি, সে তেমনি এনজয় করে৷ এলিয়টের লেখায় রয়েছে না — ডা ডা ডা৷ সংস্কৃত৷ এমন বাজ চমকাচ্ছে যে মানুষ একরকম শব্দ করছে, অসুররা অারেকরকম করছে, আর দেবতারাও অারেকরকম করছে৷ এটা শব্দের ব্যাপার হল৷ কিন্তু যে-ভাযায় কবিতাটা লেখা, সেখানে তো এইটা, মানে, সংস্কৃত যায় না৷ আবার ধরো, আমির খান৷ ওঁরা সরগম করেন তো, সরগমে প্রথমে ছবিটা আনার চেষ্টা করেন — গলাতে কাজ করলে, সেইটে একটা ছবি আনে কি না৷ তো, আমির খান বলছেন যে, ‘রে’ লাগাতেই কৈলাশের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন৷ যখনই ‘রে’ লাগাচ্ছেন, কৈলাশের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন৷ তখন বুঝতে পারছেন যে, ‘রে’-টা ঠিক আছে৷ এটাও তো শব্দ থেকে দৃশ্যে আসছে৷ এগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত৷ খুব সূক্ষ্মভাবে জড়ানো রয়েছে৷ আমাদের নিজস্ব ধ্যানধারণা যত সূক্ষ্ম হবে, তত আমরা এদের হদিশ পাব৷