স্টেশন মাস্টার
বাংলা বইয়ের বাজার বলতে ঠিক কী বোঝায়? বইমেলার মাঠে ঘুরতে-ঘুরতেই আমাদের মাথায় নতুন করে এসেছিল প্রশ্নটা। বাংলায় মুদ্রণশিল্পর ইতিহাস খুব অর্বাচীন নয়, তার প্রায় সোয়াদু’শো বছরের একটা জবরদস্ত ইতিহাস আছে। হুগলির অ্যান্ড্রুজ কোম্পানির ছাপাখানা থেকে আঠারো শতকের সপ্তম-অষ্টম দশকে কিছু কিছু মুদ্রণকাজ শুরু হয়েছিল, হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’-ও সেখান থেকেই আত্মপ্রকাশ করে। গ্রাহাম শ’ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৭৭২ থেকে ১৭৯৯-এর মধ্যে শুধু কলকাতা শহরেই বেশ কিছু ইংরেজি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল। তারপর উনিশ শতকের একেবারে গোড়া থেকেই উইলিয়ম কেরি সাহেবের শ্রীরামপুর মিশন ও ১৮১৮ সালের পর থেকে কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেসের উদ্যোগে বাংলা বই ছাপাইয়ের কাজ পুরোদস্তুর শুরু হয়ে যায়। সেখান থেকে এই ২০১৮ পর্যন্ত দুশো বছরের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলা বইয়ের বাজার ঠিক কোথায় এসে পৌঁছল, সেটাই আমরা বুঝতে চাইছিলাম।
ভাবতে-ভাবতে এরপর আরও কিছু প্রশ্ন তৈরি হতে শুরু করে। এই যে কলেজস্ট্রিট চত্বর জুড়ে এত বড়-মেজ-সেজ প্রকাশক ও বইবিক্রেতার রমরমে ব্যবসা, এই যে মেলার ক’দিন ধরে এত মানুষ এসে বইপত্র খুঁজছেন, নেড়েচেড়ে উলটেপালটে দেখছেন, কিনছেন – এসবই কি একটি দুর্দান্ত প্রাণবন্ত বাজারের চিহ্ন নয়? কিন্তু বইপ্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বন্ধুস্থানীয়রা প্রায় কখনওই স্বীকার করেন না যে ব্যবসা দারুণ চলছে। চোখের সামনে দেখছি কোনও কোনও প্রকাশকের শান্তিনিকেতনে দিব্যি বাংলোবাড়ি হচ্ছে, বাগানে পিটুনিয়া ফুটছে, কলকাতা পেরিয়ে জেলার মেলায় এবং সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে গাঁটরিবোঝাই বই যাচ্ছে – সেসব তা হলে কিছু নয়? মায়াপ্রপঞ্চ? এরই বিপরীতে চোখ পড়ে মেলার মাঠের মাছিতাড়ানো স্টলের দিকে, বই কেনার চেয়ে ফুডকোর্টে যেতে বেশি আগ্রহী পুস্তকপ্রেমীদের দিকেও। দেখি যত লোক আসছেন, তত লোক বই দেখছেন না, কিনছেন আরও কম, পড়ছেন ক’জন কে তার খবর রাখে? তা হলে এত আয়োজনের অন্তিম ফলটা কী হচ্ছে? বইয়ের বাজার কী সত্যি বাড়ছে? নাকি এ কেবলই বাইরের চাকচিক্য, প্রসাধনীর আড়ালে ভেতরের রুগ্নতাকে আড়াল করার করুণ চেষ্টা?
এইসব ভাবনা থেকেই মাথায় আসে, চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের মার্চ সংখ্যার বিষয় হতে পারে বাংলা বইয়ের বাজারই। সেখানে থাকবে তার অন্দর-বাহিরের বহুমাত্রিক উন্মোচন। সেই ভাবনা থেকেই আমরা বেশ কিছু প্রকাশকের সঙ্গে, বইবাজার বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও মতামত চেয়ে যোগাযোগ করি। অনেকেই উত্তর দেননি, কেউ কেউ দিয়েছেন। সেইসব উত্তর ও অনুত্তর থেকেই এই সংখ্যার রিজার্ভ্ড বগির লেখাগুলি তৈরি হয়ে উঠেছে। এই বিভাগে আমরা পেয়েছি অন্যধারার প্রকাশনা নিয়ে সদ্যপ্রয়াত কবি মণীন্দ্র গুপ্তর একটি বহুমূল্য রচনা। পূর্বপ্রকাশিত হলেও, সেটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সমকালীন ভাবনার এক আকর বলে আমাদের মনে হয়েছে। ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের লেখা দিয়েছেন মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর ইন্দ্রাণী রায়। এছাড়া এই বিভাগে লিখেছেন এই সময়ের দুই তরুণ ও প্রতিশ্রুতিমান প্রকাশক, লিরিক্যাল-এর সুমেরু মুখোপাধ্যায় ও অভিযান প্রকাশনের মারুফ হোসেন। বাজারের হালহকিকত জানতে আমরা কথা বলেছি বইবিক্রেতা সুনীল করের সঙ্গেও। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে অভীক ভট্টাচার্যের আরও একটি লেখা। কিন্তু তার পরেও মনে হচ্ছে বাংলা বইবাজারের অতি সামান্য একটি ভগ্নাংশকেই আমরা ধরতে পারলাম। বিন্দুতেই সিন্ধুর পরিচয় ধরা থাকে বলে শুনেছি – এ-ক্ষেত্রে সত্যিই তা ধরা পড়ল কি না, সে বিষয়ে আপনাদের বহুমূল্য মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
গত একমাসে আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন বাংলা ও এস্পানিওল ভাষার দুই প্রবাদপ্রতিম কবি মণীন্দ্র গুপ্ত ও নিকানোর পার্রা; পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জাগ্রত বিবেক, বিশ্রুত মানবাধিকার কর্মী তথা আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গির; দরবারি ঝুমুরের অন্যতম প্রাণপুরুষ মিহিরলাল সিংদেও; এবং আমাদের বাংলার প্রথিতযশা পরিবেশবিদ তথা পূর্ব কলকাতার জলাভূমি রক্ষা আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। এ-সংখ্যায় আমরা যথোচিত শ্রদ্ধায় স্মরণ করলাম তাঁদের। এ-ছাড়া রইল গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, অণুগল্প, হুইলার্স স্টল-সমেত অন্যান্য সমস্ত নিয়মিত বিভাগ।
এ-সংখ্যা যখন আপনাদের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে তখনও হাওয়ায় ফাগুয়ার রং, গাছে-গাছে পলাশ শিমুলের বর্ণময় বসন্ত-উদ্যাপন। এই বর্ণাঢ্যতার মধ্যেও আমাদের মনে থাকুক গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত সিরিয়ার রক্তমাখা শৈশব – সে-দেশের গৃহহারা নিরপরাধ মানুষের আর্ত মুখগুলি আমাদের রঙের উৎসবকে আর একটু সংযমী হতে শেখাক।
ভালো থাকুন।