Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ

কুণাল বিশ্বাস

 

বাকিদের ক্ষেত্রে কীরকম জানি না, খুব সম্ভব আলাদা কিছু না, আমার ক্ষেত্রে অফিস-টাইমে বনগাঁ লোকালে ওঠা এবং জায়গা খুঁজে দাঁড়াতে পারা, কোনওক্রমে বসে যাওয়া, কখনও বা ভাগ্যসফল হয়ে উইন্ডো-সিট পাওয়া, সবকিছু মিলে যাকে বলে কৃচ্ছসাধন– অনেকটা বহু ক্রোশ ঘুরে বহু অর্থ ব্যয় করে কোনও ভক্তের সাক্ষাৎ অমরনাথধামে পৌঁছানোর মতো। কিছুদিন আগে রাত ৯.০২-এর বনগাঁ লোকাল প্রায় মিনিট কুড়ি দেরিতে ছাড়ায় টিকিট কাউন্টার থেকে দৌড়োতে দৌড়োতে সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো মহাকষ্টযানে চেপে যাই কায়ক্লেশে। ভিতরে থিকথিকে ভিড় অত রাতেও, মুখোমুখি দু’সারি সিটের মাঝে বিপরীতমুখী চার-চার আট জন প্যাসেঞ্জার নিতম্বা-নিতম্বী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের তালুতে মুহুর্মুহু খৈনির চাটি, তাস নিয়ে গুলতানি আর বাদামওয়ালার সমবেত কল্লোল অগ্রাহ্য করে তা প্রায় সাড়ে ন’টা নাগাদ পোঁ দিয়ে ট্রেন ছাড়ল। বিধাননগর থেকে আরও একগুচ্ছ লোক ওঠার পর মশা গলবার জায়গা নেই, ভাবতে ভাবতেই দমদম জংশন এসে পড়ল আর মারমুখী ততোধিক লোক কনুইয়ের অদম্য জোরে পরস্পরকে গুঁতিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। ঠিক এরকম সময়, অকস্মাৎ ভীমরুলের কামড় খাওয়া বাচ্চার মতো মিহি গলায়, একটা মেয়ের আর্তি শোনা গেল—“ভাইয়া, চাইপা যান। চাইপা যান, ভাইয়া। পইড়া গ্যালাম…”। দরজায় শরীরের অর্ধেক বের করে দাঁড়িয়ে থাকা সভ্যদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “লেডিস ছাড়ে এহেনে কী কত্তি?”… “ওরা ওঠতে দেতো না। ফালায়ে দেতো! চাইপা যান…”

ভিতর থেকে আধবুড়ো কেউ কেউ সিট ছেড়ে উঠে দেখার চেষ্টা করল। একজন বিজ্ঞসুলভ চোখে আরেকজনকে মনে করিয়ে দিল, “দ্যাখলেন? কই না মাইয়ারাই মাইয়াগো সবচেয়ে বড় শত্রু!”

দমদম ক্যান্টনমেন্টে প্রায় সমসংখ্যক লোক ওঠে আর নামে। ট্রেন থামতেই আরেকবার ফের মেয়েলি গলায় চিঁ চিঁ আওয়াজ উঠল, “মইরা গ্যালাম! দেইখে যান ভাইয়া! দেইখে… পাও দুইখান গ্যালো!”… “তুই রেলিঙে চাপ”, বলে তটস্থ আরেকটি মেয়ে অন্যজনকে কোমর ধরে তুলে রেলিঙে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। স্পষ্টতই, ভিনদেশি নবাগতারা সংখ্যায় এক নয়, দুইজন। ভিতর থেকে একজন খানিক অশ্লীল হেসে বলে উঠল, “রঞ্জিৎদা, উই দ্যাখেন শিয়ালদা-বনগাঁ সার্কাস!”… রেলিঙ-উপবিষ্টা তড়িতবেগে সেদিকে চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

বারাসাত আসতে অলিখিত সিট এক্সচেঞ্জ বিধিতে আমরা সিট পেয়ে গেলাম। যারা তখনও বসে বসে ঘুমোবার ভান করছে তাদের কানের কাছে যথারীতি পরিত্রাহী আওয়াজ উঠল বারকতক—“দাদা, বনগাঁ তো চলে এল। আবার শিয়ালদার দিকে ট্রেন যাবে।”… টিপ্পনী কাটল একজন, “কী আর করবে! বাড়িতে কচি বৌ, অফিসে হাবড়া বস! দাদার ঘুম নাই, স্বপ্নদোষ আছে!” রেলিঙ-স্থিতা আকস্মিকভাবে শুধোলেন, “ভাইয়া, আপনেরা তো দিব্যি বইসা গ্যালেন। আমরা কি এভাবেই থাকব?”… জবাবে “ওহেনে বইসা সার্কাস দেখালি কি আর সিট পাবা? নামে আসো…” শোনা গেল।

দু’জন ইয়া বড় ঢাউস একখান ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হেলতে দুলতে ভিতরে আসল। প্রথমজন সাদা টি-শার্ট, খাকি ডেনিম পরা– চোখের নিচে হালকা কালশিটেসহ অনেকটা টলিউডের তনুশ্রী চক্রবর্তীর লুক অ্যালাইক, আর দ্বিতীয়জন নর্ম্যাল সালোয়ার-কামিজ। দ্বিতীয়জনের গলায় যতদূর মনে পড়ে ড্রাগন-আঁকা বাহারি একটা ট্যাটু ছিল।

“সিটের নিচে জায়গা হবে?”, প্রথমজন বলল, “অ্যাতোবড় ট্রলি রাখব কই?”…

সবাই নিরুত্তর। একজন শুধু সান্ত্বনা-পুরস্কার দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমার পায়ের নিচে দুইখান ব্যাগ। ওদিক দ্যাখো।”

অগত্যা মেয়েটি অন্যদিক হেঁটে গিয়ে ঝুঁকতেই গুষ্টির জ্যাঠা-কাকারা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একপাল হামবুড়ো কাঙাল মাছরাঙা যেন বহুদিন পর শিকার-সন্ধানে মগ্ন, কেউই আর পা তোলে না। মেয়েটি চূড়ান্ত আগ্রাসী গলায় বলল, “আরে ভাইয়া পা তোলেন না! পায়ে কি একজিমা আছে নাকি?”… অপ্রস্তত বুড়ো কটমট চোখে পা তুলল। মেয়েটি হাসতে হাসতে সঙ্গিনীকে বলল, “ভাইয়ারা আসলে এত ব্যস্ত… সারাদিন এত কাজকাম করে যে ঠ্যাঙ দুইখান তোলতেও তাগো সলতে নিভে যায়!”

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে শুরু করল দু’জন মিলে আর এই ফাঁকে গেটের কাছে দাঁড়ানো একজন মাঝারি গলায় টোন কাটল, “কসাইয়ের হাটের মাঝে ওয়ে ডবকা বুলবুল/থেকে থেকে কেন তুমি করো হে চুলবুল?”

মেয়েটি অত্যন্ত সপ্রতিভ মেজাজে চুলে ক্লিপ আঁটতে আঁটতে উত্তর দিল, “এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে…”

এবার আমি রীতিমতো কেঁপে উঠলাম। ইতিমধ্যে ওরা দু’জন আমার ঠিক মুখোমুখি বসেছে।

“’মেঘনাদবধ কাব্য’ কি আপনার সিলেবাসে ছিল?”, কালক্ষেপ না করে জিজ্ঞেস করে বসলাম।

“হ্যাঁ, ইন্টারে ছিল!”, মুচকি হেসে সংক্ষিপ্ত জবাব।

“ইন্টারমিডিয়েটে?”

“আইজ্ঞা!”

“আচ্ছা…”

“মাইকেল, রবি ঠাকুর, জীবনানন্দ সবই ছিল!”

“আপনি বাংলা সাহিত্যের স্টুডেন্ট?”

“জি?”

“আপনি কি বাংলা নিয়ে পড়েছেন?”

“আইজ্ঞা!”

“বাহ! মাইকেলকে আজকাল ক’জনই বা কোট করে আর বোঝে!”

“আমার পুরা মুখস্থ ছিল, ভাইয়া! আচ্ছা ভাইয়া, আপনার নাম?”

“কুণাল বিশ্বাস… আপনাদের?”

“আমি রিকা চৌধুরী আর অর নাম সানা চৌধুরী। ফুফার ঘর থেকে আইতাছি। চাচা-চাচি বনগাঁয় থাকে। ওখেনেই আছি কয়েকমাস। আমদের ঘর ঢাকার নারায়নগঞ্জে। আপনে কোথায় নামবেন?”

“ঠাকুরনগর! তা এখানে কি ঘুরতে এলেন? ভিসা ক’দিনের?”

“না ট্রিটমেন্ট করানোর লিগে… ভিসা আরও চার মাস আছে… আমি মাঝেমধ্যে আব্বুর নাম, এমনকি নিজের নামও মনে করতে পারি না! সাইকোলজিস্ট দেখাচ্ছি…”

“অথচ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ থেকে দিব্যি কোট করতে পারেন!”

“মোটে এইটুকখানি? আগে পুরা মুখস্থ ছিল!”

ট্রেনের অবশিষ্ট প্যাসেঞ্জারদের চোখে তখন বর্ণনাতীত সম্ভ্রম!

“চাচা ওদেশে যাননি বাঁটোয়ারার পর?”

“নাহ! যাব যাব কইরাও যাওয়া হয়নি! এখন তো বুড়া হইয়া গ্যাছে… আর সম্ভব না… তাছাড়া চাচা ভিটা ছাড়তে রাজিও ছিল না…”

“এখানে খুলনায় মেঘ করলে বারাসাতের লোক ছাতি খোলে…”

“দারুণ বললেন তো!”

“সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি!”

“আইচ্ছা!”

“পড়েছেন?”

“নাহ!”

“এখনও তো আছেন কয়েকমাস। কিনে নিন, পস্তাবেন না!”

“আইচ্ছা, দেখি! আমরা তো আসলে একই ছিলাম!”

“এমন মসজিদও আছে যার ওজু করার পানি এদেশে। এমন মন্দির, যার তুলসী মঞ্চ সীমান্তের ওই পারে।”

“এডাও সন্দীপনের?”

“হ্যাঁ!”

“বাহ!”

“এদিকে কমলকুমার, সন্দীপন আর ওদিকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, ইলিয়াস না পড়লে আধুনিক বাংলাগদ্যের ভোক্তা হ’ব কীভাবে!”

“এই তো ভাইয়া! আপনে আবার এদিক-ওদিক কোরতেছেন!”

“নাহ! আর করব না। ভুল হয়ে গেছে!”, নতমুখে চুপ করে গেলাম।

“’রূপসী বাংলা’ পড়েছেন?”, রিকা চকিতে প্রশ্ন করল।

“এখনও প্রায় মুখস্থ!”, ফের আত্মবিশ্বাস নির্গত হ’ল যেন!

রিকা শুরু করল–

“তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও– আমি এই বাংলার পারে

র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে…”

থামিয়ে দিয়ে আমি বলতে লাগলাম–

“দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে

ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাঙ ঘাসে অন্ধকারে

নেচে চলে– একবার– দুইবার– তারপর হঠাৎ তাহারে

বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে…”

উপস্থিত সবাই হা হয়ে ভ্যাবলা চোখে যেন গ্রীষ্মরাতের পালা দেখছে আর না জানি কতরকম খিস্তি মারছে মনে মনে… আঁতলামি, চুলকানি ইত্যাদি প্রভৃতি…

“ভাইয়া, হাবড়া ছাড়ছে। আপনের তো নামনের সময় হয়ে আসল…”, সানা চৌধুরী এতক্ষণ পর প্রথম মুখ খুলল।

“তুই ছাড় তো! জীবনানন্দর কবিতা কওয়ার সময় পোঙটামি মারস ক্যা? তুই ‘হিমু’ নিয়া থাক!”

“আপনি বেহালা না গিয়ে বনগাঁ যাচ্ছেন কেন?”, সানা চৌধুরীকে আচমকা জিজ্ঞেস করলাম।

“বেহালাআআআ???”

“না অ্যাদ্দিন তো ‘সানা’ বলতে সৌরভ গাঙ্গুলির মেয়ে বুঝতাম। হের লিগ্যা পুছলাম!”

“দাদা কোচ হইলে বাংলাদেশ সিওর ওয়ার্ল্ড কাপ পাইত!”, রিকার উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো!

“আমার না একসময় হুমায়ন আহমেদ ভাল্লাগতো… এখন আর পোষায় না…”, সানা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে ইচ্ছে করে ফোঁড়ন কাটলাম।

“আমারও রবীন্দ্রনাথ ভাল্লাগেনা…”, সানা তেড়েফুঁড়ে বলল।

“আমি বললাম বলে?”

দু’জনেই জোরসে হেসে দিল।

“আসলে ভাইয়া ও হিমুর ব্যাপারে কিছু শোনলে কারোরে আস্ত রাখে না…”, রিকা হাসতে হাসতে সামাল দিল।

“তবে রবীন্দ্রনাথের চোখ, নাক খুব ভাল… ওরোম হ্যান্ডসাম আর কেউ না…”, সানা লাফিয়ে উঠল প্রায়।

গোবরডাঙ্গা থেকে ট্রেন ছাড়ল। আর মিনিট পাঁচেক পর নামব।

“ওদেশ গ্যালে আমদের বাসায় অবশ্যই আইবেন, ভাইয়া। পদ্মার ভাঁপা ইলিশ বান্দা!”, রিকা হাসল, “আর হ্যাঁ, ঐরোম এদিক-ওদিক বলবেন না!”

ইতিমধ্যে আমি ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ফেলেছি। উঠতে উঠতে বললাম, “আমার ঠাকুরদার জন্মভিটে ফরিদপুরে। বেঁচে থাকতে ওখানে একবার যাবই!”

“নিশ্চয় যাইবেন। কিন্তু, ‘এদিক-ওদিক’ করবেন না যেন!”, আবার খিলখিল করে হাসি।

ট্রেন থেকে নামামাত্রই জানলা দিয়ে দেখি দু’জন সমস্বরে বলছে, “ভাল থাকবেন, ভাইয়া”…

“আপনারাও ভাল থাকবেন। শুভরাত!” হেসে বললাম।

রাতের নৈঃশব্দ খান খান করে ট্রেন ছুটল বনগাঁ অভিমুখে। বিভাগ-পূর্ববর্তী সময়ে এ সবই ছিল তৎকালীন যশোহর জেলার মধ্যে।

টোটোয় চড়ে একা বাড়ি ফেরার পথে দু’চোখ মুদে কল্পনা করলাম শুধু–

মাল খেয়ে টাল লালমুখো সাহেব Radcliffe কাঁটাতার দেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে বাঁশ-খুঁটি পোতাচ্ছেন তড়িতবেগে। চারিদিকে ভাঙনের শব্দ। চোখের পলক ফেলার দ্রুততায় হাজার বছরের পুরনো একটা সংস্কৃতি খুন হয়ে যাচ্ছে। অকস্মাৎ নিজের অন্তিম সম্বল সস্তার ট্রাঙ্কটি হাতে কাদামাখা দু’পায়ে রূপশালি ধানের ঘ্রাণ শেষবার শুঁকে মুখোমুখি এসে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন নিরস্ত্র জীবনানন্দ– তাঁর চোখের কোণ থেকে কিছু রক্তবিন্দু টপটপ ক’রে ঝ’রে পড়ল দু’দিকের অন্তর্বর্তী ভূমিতে– হরীতকী ফলের মতন!