Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ত্রিপুরা-র নির্বাচনী রায় প্রসঙ্গে

ত্রিপুরা নির্বাচন ২০১৮

সৌভিক ঘোষাল

 

উত্তর-পূর্ব ভারতের তিন রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর, বিশেষ করে ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে একদিকে বিজেপি প্রভাবিত শক্তির অতি উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে বামেদের নিদারুণ হতাশা চোখে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে বামেরা ভারতের রাজনীতিতে মূলত তিনটি রাজ্যেই ক্ষমতাসীন ছিল এবং এই তিন রাজ্যের সাফল্যই জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রভাবের প্রাণভোমরা ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে গণ্য ছিল অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ। চৌত্রিশ বছরের একটানা শাসনের রেকর্ড সৃষ্টির পর সেখানে ২০১১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক শক্তিতে এবং ভোটের শতাংশ মাত্রায় যে ধারাবাহিক ক্ষয়ের সূচনা হয়েছে, তাকে কোনওভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। ত্রিপুরার পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে শুধু একটি নির্বাচনে পরাজয় বা ক্ষমতা হারানো নয়, ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাওয়ার পশ্চিমবঙ্গের বৈশিষ্ট্যটি আত্মপ্রকাশ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বাম শিবিরের মধ্যে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার পরাজয় নানা কারণেই এক নয়। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম-সহ জমি অধিগ্রহণ উন্নয়নের পথরেখা সংক্রান্ত যে বিতর্ক সি পি এম-এর বাম চরিত্রটি সম্পর্কেই মৌলিক প্রশ্ন হাজির করে দিয়েছিল, ত্রিপুরায় তেমন কিছু হয়নি। ২৫ বছরের একটানা শাসনের ফলে সৃষ্ট স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া সত্ত্বেও বামেরা যে ৪৫ শতাংশ ভোট ধরে রেখেছে, সেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসী আসনগুলিতে সি পি এম-এর জনবিচ্ছিন্নতা সবচেয়ে বেশি হয়েছে এবং কুড়িটি আদিবাসী আসনের মধ্যে দু-তিনটির বেশি সে জয় করতে পারেনি, যদিও এই আদিবাসী সমর্থনই ছিল ত্রিপুরায় সি পি এম গড়ে ওঠার পর্ব থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী জনাধার।

ত্রিপুরায় সিপিএম-এর সঙ্কটের মূল দিক অবশ্যই আদিবাসী মানুষজনদের সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা সাময়িক না দীর্ঘমেয়াদী তা আগামী দিনে বোঝা যাবে। আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে লড়াই করে আই পি এফ টি নামক যে সংগঠনটি নিজেদের এবং জোটসঙ্গী বিজেপির দিকে প্রচুর সংখ্যক আদিবাসী ভোটকে এবারের মতো টেনে নিতে সক্ষম হল মূলত একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে, তা কতটা সাময়িক চরিত্রের আর কতটা দীর্ঘমেয়াদী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন — তা আগামী দিনে বোঝা যাবে। সারা দেশেই আদিবাসীদের মধ্যে বিজেপি তার জনাধার বাড়িয়ে চলেছে এবং ত্রিপুরাও সেই ধারার নবতর সংযোজন কিনা সেটাও দেখার।

অন্যদিকে আদিবাসী এলাকাগুলিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিকাঠামো সহ উন্নয়নের সাধারণ ইস্যুগুলি বাম সরকারের আমলে অনেকটাই অবহেলিত হয়েছে। সরকারের তরফে নজরদারিসহ উদ্যোগের অভাব ছিল, ঢিলেঢালা মানসিকতা ছিল — এমন বিবরণ সেখানে ফিল্ড ওয়ার্ক করেছেন এমন দায়িত্বশীল মানুষেরা দিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর অনেক আগেই। দীর্ঘদিনের শাসনের পরেও আদিবাসী এলাকায় কাঙ্খিত উন্নয়নের অভাবের ফল সি পি এম-কে ভালোরকম ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতার মুখে দাঁড় করিয়েছে।

আদিবাসী এলাকাসহ গোটা রাজ্যেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে যে অর্থনৈতিক অবরোধ নামিয়ে এনেছিলেন তাদের ‘মিশন ত্রিপুরা’ প্ল্যান-এর অঙ্গ হিসেবে, তাকে মাথায় না রাখলে নির্বাচনী বিশ্লেষণ একদেশদর্শী হয়ে পড়তে বাধ্য। প্ল্যানিং কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ গঠনের পর ত্রিপুরার জন্য কেন্দ্রের তরফে বরাদ্দ অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে দিয়ে মানিক সরকারকে উন্নয়নের প্রশ্নে অনেকটাই পঙ্গু করে দেওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির যে বিশেষ অধিকার তাকে একদিকে খর্ব করা হয়েছে, অন্যদিকে লুক ইস্ট পলিসির ফাঁকা আওয়াজকে পল্লবিত করা হয়েছে। গ্রামীণ রোজগার যোজনায় ত্রিপুরার বাম সরকার অতীতে সাফল্যের যে ধারাবাহিক রেকর্ড করেছিল, তার ধারাকে রুখতে ইচ্ছাকৃতভাবে এর বরাদ্দকে আটকে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।

পরিকল্পিত নানা বিমাতৃসুলভ আচরণে সরকারি স্তরে টাকা আটকে দেওয়ার পাশাপাশি বিজেপির পক্ষে জনসমর্থন কিনতে দলীয় স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিপুল টাকা। কংগ্রেস, তৃণমূল সহ সমস্ত বিরোধীদের কার্যত কিনে নিয়ে নির্বাচনের অনেক আগেই প্রায় একমাত্র বিরোধীর জায়গা বিজেপি দখল করে। বিপুল টাকার পাশাপাশি আর এস এস-এর শক্তিশালী সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক এবং প্রধানমন্ত্রী সহ হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীদের লাগাতার ত্রিপুরা সফরের মধ্যে দিয়ে ত্রিপুরা জয়ের মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গেছে বিজেপি।

লোকসভায় যে রাজ্য থেকে মাত্র দু’জন প্রতিনিধিত্ব করেন সেই রাজ্য জয়ে এত বিপুল উদ্যমের কারণ কী বা তা জয়ের পর তা নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে তথা সমস্ত প্রচারমাধ্যমে এত ঢক্কানিনাদের রহস্য কী তা বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। আসলে এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ পেলব হয়ে আসা ভাবমূর্তিটাকে চাঙ্গা করে নিতে চাইলেন মোদি, অমিত শাহ ও তার দলবল। গুজরাট ভোটে বড়সড় ধাক্কা, নীরব মোদি সহ নানা তছরুপ মামলায় ছিছিক্কার সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপির ভাবমূর্তিকে যথেষ্ট ম্লান করে দিয়েছিল। ত্রিপুরার মতো ক্ষুদ্র রাজ্যে বিজয়ের পর বিজেপির অতি আড়ম্বরপূর্ণ উৎসব তার ওপর এসে পড়া কালিমামোচনের মরিয়া চেষ্টা।

এরই পাশাপাশি মতাদর্শগতভাবে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যে বামপন্থীরা, তাদের হীনবল করার ও দেখানোর বিশেষ প্রয়োজনকে বিজেপি কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বাধ্য হয়, ত্রিপুরা পরিঘটনা তারই প্রমাণ। ত্রিপুরা বিজয়ের পরদিনই বিরাট লেনিন মূর্তিকে সাড়ম্বরে ক্রেন দিয়ে উপড়ে ফেলার নিন্দনীয় ঘটনা বুঝিয়ে দেয় এখনও “এ স্পেকট্রা ইজ হন্টিং”।

ত্রিপুরা নির্বাচনে পরাজয়ের পর বাম শিবিরে যে হতাশা দেখা যাচ্ছে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গোটা প্রেক্ষাপট ও তথ্যাবলীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু আসন সংখ্যার নিরিখে ত্রিপুরার পরাজয়কে বিশ্লেষণ করাটা ভুল হবে। আসন সংখ্যায় বাম ও বিজেপির বিপুল ব্যবধান দেখা গেলেও শতকরা ভোটের হিসাবটা একেবারেই অন্যরকম। সেখানে সি পি এম এবং বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ মাত্রা প্রায় সমান, ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার নির্বাচনী ফলাফলকে মিলিয়ে ফেলা এইসব কারণে একেবারেই ভুল হবে। পশ্চিমবঙ্গে ২০১১-এর নির্বাচনে বামেদের পরাজয় ছিল মূলত স্বখাতসলিলে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম সহ জমি অধিগ্রহণে ভুল নীতি, জবরদস্তি, দীর্ঘ শাসনের অপরিসীম ঔদ্ধত্য ইত্যাদির সঙ্গে নানা ধরনের বিরোধী শক্তির বেশ কয়েক বছরের লাগাতার গণআন্দোলনের ফল ছিল ২০১১-র পশ্চিমবঙ্গের জনরায়। অন্যদিকে ত্রিপুরায় দীর্ঘ ২৫ বছরের শাসনে দুর্নীতি বা ঔদ্ধত্যের কিছু অভিযোগ থাকলেও ভারতীয় রাজনীতির প্রচলিত আবহাওয়ায় তা বিশিষ্ট হিসেবে নজরে আসেনি। গণআন্দোলনের বিপ্রতীপে ভোট কুড়োতে বিজেপি মূলত টাকা ও পেশিশক্তির ওপরেই ভরসা করেছে। তাই পরাজয় থেকে যেটুকু সদর্থক শিক্ষা তা অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু তা থেকে বামেদের সার্বিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অমিত শাহ সচেতনভাবেই যে প্রচারে নেমেছেন, (ভারতের কোথাও বামেদের প্রয়োজন নেই) তাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়াটা চরম ভুল হবে।

পুনশ্চ — নির্বাচনের আগেই বিপুল টাকার বিনিময়ে যে ঘোড়া কেনাবেচা আধা গোপনে ত্রিপুরাতে সম্পন্ন হয়েছিল, সেই অলীক কুনাট্য রঙ্গ প্রকাশ্যে সম্পন্ন হচ্ছে নাগাল্যান্ড এবং মেঘালয়ে। মেঘালয়ে ৬০টি আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি আসনে জিতেই বিজেপি সরকার গঠনকে পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তার চাবিকাঠি নিজের দিকে রেখে দিতে তারা সচেষ্ট। নাগাল্যান্ডে প্রকাশ্যেই তারা সরকারের নিয়ন্ত্রক হতে চলেছে। এর আগে গোয়ার নির্বাচনেও এই বৈশিষ্ট্য সামনে এসেছিল, যার স্মৃতি এখনও টাটকা।