Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঘাসফুলের বাগান

স্বর্ণেন্দু সরকার

 

তিনি রূপবান ও ঐশ্বর্য জড়িয়ে বেড়ে ওঠা পুরুষ, স্বয়ংদীপ ও স্বপ্রভ। বিরল অভিজাত্যবোধের অধিকারী। গর্জনশীল প্রবাহ থেকে দূরে স্বযত্নে — যিনি ঋজু রেখেছেন তার কশেরুকা, যা তুমুল তুফানে নিচু হয়ে পড়ে না। এই নিঃশঙ্ক, নির্লিপ্ত শিল্পী চারুকলা ফুটিয়ে তোলেন, এক অনালোকিত অঙ্গনের চত্বরে। চিরকাল তিনি এমনি নির্জনচারী হিসেবে থেকে যেতে চেয়েছেন — যেন সেই কবেকার মেসোপটেমিয়ার কারিগর, অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়।

বাইসনের রক্তের ভিতর যে পোষ না মানা মনোভাব থাকে, কিছুটা একরোখা, তীব্র। হঠাৎ জেগে উঠে বন-জঙ্গলের ভিতর অন্ধকারে আত্মসমর্পণ না করা একটা মনোভাব। আহা বাইসন, দূর থেকে গাছ কাটা ও সমবেত মানুষের উৎসারিত আনন্দ শোনার মতো কান ও মন কোনওটাই প্রস্তুত ছিল না তার। ফলে রাতে ঘুমের ভিতর স্নায়ুর প্রতিরোধ তাকেও টানটান করে রেখেছে। মনে হয় রাতে অন্ধকারের আবরণ ভেদ করে এক অজানা বিপদ ক্রমশ উঁকি মেরে এগিয়ে আসতে চাইছে, যেমন কুয়াশা ঢাকা নদীর পাশে গেলে মনে হয়, জলের কোলাহল শুধু কানে আসে কিন্তু রূপ দেখা যায় না। তার মনে হল অন্ধকারটা কাঁপছে। সহানুভূতির সমবেদনার পর্দা যেহেতু তার চোখে নেই, অবোধ বাইসনের চোখে শুধুই, পাঁচ জনের কাজ একা করতে পারে, কর্মঠ, কালো রঙের প্রকাণ্ড চেহারাই লেগে থাকে। রাত শেষ হয়ে একটা নুতন দিন শুরু হচ্ছে। গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে মানুষের দল। ভুলে যেও না শুধু দেখা ছাড়াও চোখের নানা কাজ থাকে। পাথরের গা বেয়ে নিঃশব্দে সরীসৃপের মতো যে জল গড়িয়ে আসে, তেমনি ভিজে গেল তার কুণ্ডলী পাকানো বড় একজোড়া চোখের সাজানো গাছপালার সবুজ।

গাছ কাটা হলে তার মন ও শরীর খারাপ হয়। আশির দশকের শুরুতে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ছাত্র শান্তিপ্রিয় সেনগুপ্তকে অরুণবাবু এই অনুভূতির কথা জানালে, তিনি কাঠের বিকল্প তৈরি করার কথা বলেন। বিকল্পের জায়গায় পরিবর্তে কী হতে পারে এই নিয়ে খোঁজ শুরু হয় তখন থেকে। যে ভাবে আমাদের শরীর নানা কিছুর সমাহার, তেমনি এক চিন্তা থেকে সিগারেটের কাগজ একসাথে একত্র করে, পরে কাগজের ছাঁট, মাথার চুল, রজন, পাটের থলে দিয়ে পরীক্ষা শুরু হল। পার্ক সার্কাসের মাথায় বাঁশের ঝুড়ি বানাতে বসেছে মহিলারা। সেই থেকে বাঁশ তার মাথায় চেপে বসে।

বাঁশকে কাজে লাগিয়ে দরজা, জানলা, ঘরের মেঝে, ঘরের ছাদ, সিঁড়ি, যা সম্ভব হয় সবই তৈরি করিয়ে ফেলেছেন। খুলে ফেলেছেন বংশজ নামের এক প্রতিষ্ঠান।

বাতাসে টুকরো টুকরো নানা কথা ছড়িয়ে আছে। সব যোগ করলে যা দাঁড়ায় অরুণবাবুর চোখ মুখের গড়নে একটা মর্যাদা আছে, যা এই পল্লীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিলের। এই বিষয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা, যা শিখতে হলে পল্লীকে গাছ কাটার বেদনা টের পেতে হবে। বাসনপত্র, কাঁটা চামচ কেমন বাঁশ দিয়ে সাজিয়ে দিলেন, এমনকি চায়ের টেবিল — কোনওটাই বাড়তি বলে মনে হল না। মানুষের মন যে আদিম অবস্থায় পড়ে নেই — এমন কাজ দেখলে মনে হয়। এ কাজ মানুষের আত্মপ্রচারের নয়।

পায়ে পায়ে ধুলো ওড়ানো পথ, ভাঙা পুতুলের মিছিল, কোলকুঁজ মানুষের ভিড়, স্লোগানের মতো উচ্চস্বরের কথার ফাঁক পার হয়ে — ডোবার শৈবাল যেভাবে নদীর স্রোতে নিচু হয়ে আসে, তেমনি এই কাজের প্রতি সমাজ ঝুঁকে দেখবে একসময়, শৈবালগুলো পাড়ের দিকে এসে একদম আটকে থাকতে চাইছে; কিন্তু পরমুহূর্তে সময়ের স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে।

নদীর স্রোত দেখা যাচ্ছে না, কারণ নদীই সময়। হুহু করে লাফিয়ে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। যখন তার দম ফুরিয়ে আসছে, তখন দেখা যাচ্ছে তার উপরে নৌকা ভাসছে। সবকিছুকে নিঃশেষ করার মতো ঢেউ উঠছে। মানুষ সুফল পেতে শুরু করেছে সময়ের।

মানুষ দেখে তার অন্তরের জ্বালা টের পাওয়া যায় না। রেডিও প্রথম কে আবিষ্কার করেছিল, কে স্বীকৃতি পেল। অরুণবাবু যখন এই কাজ শুরু করেন আশির দশকের শুরুতে, বাণিজ্যের নৌকা তখন অন্য ঘাটে। তার সামনে কোনও উদাহরণ ছিল না। শিল্পের তাগিদে বা নিজের মুক্তির উপায় খুঁজতে বা এই পৃথিবীতে যেন গাছ কাটা প্রয়োজনীয় কেউ অনুভব না করে — কোন ভূত তার মাথায় চাপল কে জানে। মানুষ যেমন বাধ্য হয়ে অন্যায় কাজ করে, নিজের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি বা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে, তেমনি নিরুপায় নিষ্পাপ বোধ থেকেই হয়তোবা, মানুষের কল্যাণ হোক, সবুজ ভরা থাকে মধুগন্ধ বাতাসে, যেন সৎ উদ্দেশ্যে।

এই দেশে ১৩০ রকমের বাঁশ পাওয়া যায়। বাঁশ যা এতদিন ছিল মানুষের সামাজিক অশিষ্ট শব্দ, তিনি এই অপবাদ ঘোচালেন মাত্র। কাঠের পরিবর্ত হিসেবে বাঁশের জায়গায় যদি অন্য কিছু খুঁজে পান তিনি সেই দিকেই ছুটবেন। বাঁশের প্রতি তার কোনও মোহ নেই। তিনি শুধু চান গাছ কাটা বন্ধ হোক।

এমন একটি ভাবনা, যেন তিনি নিজেই নবীন ঈশ্বরের বয়োবৃদ্ধ সংস্করণ। একা একাই তিনি বাঁশের টুকরো সাজিয়ে রাখছেন, কোনওটি ধুচ্ছেন, চারপাশে জল ছিটিয়ে পড়ার শব্দ, যন্ত্র পরীক্ষা চলছে, আয়োজন উদ্যোগের মতো ব্যস্তসমস্ত হয়ে কাজ করে চলেছেন। মেজে ঘষে যত্নে ফুটিয়ে তুলছেন নানা আকার।

শুকনো পাতা পায়ের নিচে পড়ার শব্দের মতো, নীরবতা ভেঙে তিনি চান তার এই শ্রম মানুষের কাজে আসুক। এই দেশে কে এই কাজ নিশ্চয়ই কেউ প্রথম শুরু করে, হয়তো এমনই শুভ চিন্তার ফসল হিসেবে। আমার আপাতত আগ্রহ আতর মাখানো তার এই চিন্তায়, বিশ্রামের বিন্দুর লেগে থাকা এই আন্তরিক সততায়। মৃত্যু পর্যন্ত চলে গিয়েও যে বিস্ময় কাটে না, তাতে। এই কাজ মানুষের প্রেমে-অপ্রেমের নয়, এই কাজ পৃথিবীর ঘটনা। অরুণবাবুর জীবনের ৩০ বছরের কর্মফল, একা একা পথ চলায় তিনি জানেন; যার কেউ নেই তার রবি ঠাকুর আছে।