রৌহিন ব্যানার্জী
মৌলানা নুর-উর রেহমান বরকতি– নামটা আপাতত বেশ প্রচারিত। সবাই জানি ইনি কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের শাহী ইমাম– তর্কসাপেক্ষে কলকাতার সবচেয়ে প্রভাবশালী সংখ্যালঘু ধর্মগুরু। পাঠক, এই শেষ বাক্যাংশের শব্দগুলি একটু খেয়াল করবেন। “তর্কসাপেক্ষে”, “কলকাতার” এবং “সংখ্যালঘু ধর্মগুরু”– এই শব্দগুলি একত্র করলে মানে দাঁড়ায় ইনি প্রায় কিছুই না—কার্যত। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো এক মাস আগে কজন এই বরকতি সাহেবকে চিনতেন– নামে, পেশায়? আরেকটু ভেবে বলুন বছর দশেক আগেই বা কতজন চিনতেন– যারা রাজনৈতিক কর্মী বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরাসরি জড়িত নন? তসলিমা নাসরিন যখন কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হন তার আগে এই বরকতি নামটা কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমান, যারা ওই অঞ্চল বা কাছাকাছি বসবাস করেন তারা ছাড়া প্রায় কেউই শোনেননি। এই না চেনায় আমার আপনার কোন অকৃতিত্ব নেই– কলকাতার মতো শহরে একটা মসজিদের ইমামকে কেন চিনতে যাব বলুন দেখি? এখানে কজন গুগল না দেখে বলতে পারবেন কলকাতায় মোট কটা মসজিদ, কটা গীর্জা, কটা সিনাগগ, কটা মন্দির আছে– তাদের ইমাম, বিশপ, অ্যাবে, প্রধান পুরোহিতদের নাম কী? এমনকি মহামতি গুগলবাবাও বোধ হয় এই পুরো তথ্য রাখেন না।
অথচ একে চিনতে হল। আজ এই মুহূর্তে আমরা প্রায় সবাই এই ভদ্রলোকের নাম, কাম, বক্তব্য, ইতিহাস, ভুগোল সবই জানি। যে কারণে জানি সেটা খুব সুখকর নয়– যদিও অনেকের কাছে হাস্যকর বটে। বিগত কয়েক বছরে এই বরকতি, আরও কিছু সংখ্যালঘু নেতার মতন, নিজেকে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন (তার বিনিময়ে নিজেও যথেষ্ট সুবিধা নিয়ে গেছেন)– কারণ রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে “ভোটব্যাঙ্ক” (পড়ুন মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক)-এর চাবিকাঠি ধরে নিয়েছেন, সেই ব্যাঙ্ক ডাকাতির উদ্দেশে একে, এদের প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন– রাজনীতি নির্বিশেষে। হ্যাঁ সব রাজনৈতিক দল– এমনকি আপাত দৃষ্টিতে যারা এদের সরাসরি বিরোধী, সংখ্যাগুরুর রাজনীতি করেন, তারাও। বরং তারাই বেশি করে, যদিও আড়ালে আবডালে, এই প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। বাম, ডান, অতি ডান—সক্কলে। আর এখন এই বরকতিবাবু বিবৃতি দিয়ে বলেছেন তিনি ও তার অনুগামীরা পাকিস্তানের পক্ষে জেহাদ লড়বেন। এই জন্য ভারতের পঁচিশ কোটি মুসলমানকে এক হতে ডাক দিয়েছেন। কেন? কারণ “ভারত হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষিত হলে”। মাসির যদি গোঁফ গজায়– ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য এক বিবৃতিতে তিনি আবার বলেছেন, গাড়িতে লালবাতি যেহেতু সেই বৃটিশ আমল থেকে তাদের বংশানুক্রমিক অধিকার তাই রাজ্যের নেতা মন্ত্রীরা লালবাতি ত্যাগ করলেও তিনি তা করবেন না (অবশ্য সর্বশেষ খবর অনুযায়ী তিনি শেষ অবধি সেই “ত্যাগস্বীকার” করেই নিয়েছেন), কারণ “ইমাম হিসাবে” তাকে দ্রুত “অনেক জায়গায়” পৌঁছাতে হয়। সুররিয়াল মনে হচ্ছে না? আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে একজন “গুরুত্বপূর্ণ” সংখ্যালঘু ধর্মগুরু এই ধরণের সব বিবৃতি দিয়ে চলেছেন? বিশ্বাস করুন পাঠক, এনারা এই রকমই। জলসাঘর ছবির বিশ্বম্ভরের মতো-– একটা অ্যাবসার্ড, হারিয়ে যাওয়া জগতে এরা বাস করেন। এরা এখনও ভাবেন এদের ফতোয়ার জোরে পঁচিশ কোটি মুসলিম ভারতবাসী জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। বিশ্বাস করেন তার বাবা লাগাতেন তাই তার গাড়ির মাথার লালবাতিটি হেরিটেজ সম্পত্তি। তা সেসব ভাবুন, অ্যাবসার্ড জগতে বাস করুন– ক্ষতি ছিল না– কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। এদের সামাজিক অবস্থান এদের বক্তব্যকে একটা আলাদা গুরুত্ব এনে দেয়। “লক্ষ লক্ষ” না হলেও বরকতির বেশ কিছু অনুগামী আছেন তারা তার কথায় গুরুত্ব দেন (“নাচেন” কথাটা ব্যবহার করলাম না)। এবং রাজনৈতিক দলগুলি, যারা এখনও “মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক” ব্যপারটাকে একটা অবিভাজ্য, হোমোজেনিয়াস সেট বলে মনে করেন (এ আরেক অ্যাবসার্ড দুনিয়া যার কথা এখানে আলোচনা করছি না), এদের এই সব বক্তব্যগুলিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে ইস্যু বানিয়ে তোলেন। ফলে বরকতির এই হাস্যকর “জেহাদ”-এর ডাক আর ততটা হাস্যকর থাকে না– একটা অংশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়-– এবং তার চেয়েও বেশি করে সক্রিয় করে তোলে সেই সব সুযোগসন্ধানীদের যারা এই রকম ডাকের “প্রতিক্রিয়া” দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। এদেরই প্রচারে বলা হয় যে বরকতির নাকি লক্ষ লক্ষ সমর্থক, সরকার একে গ্রেফতার করে না কারণ এর গায়ে হাত পড়লে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রে রে করে দাঙ্গা লাগিয়ে দেবে। এবং সেই “আশঙ্কা”য় এরা আগেভাগেই দাঙ্গা লাগাতে তৈরি থাকেন। এই মিথটা ভাঙা খুব প্রয়োজন-– একাধিক কারণে।
প্রথমতঃ বরকতির অনুগামী সংখ্যা আদৌ “লক্ষ লক্ষ” নয়-– মেরে কেটে কয়েক হাজার। পাঠক যদি কখনও ধর্মতলায় টিপু সুলতান মসজিদের পিছনের রাস্তায় বরকতির ডাকা কোনও সংখ্যালঘু জমায়েত দেখেন, তাহলেই ব্যপারটার একটা আন্দাজ পাবেন। অথচ এই মসজিদেই ঈদের দিনে, এমন কি সাধারণ শুক্রবারের নামাজেও তার থেকে অনেক বেশি মানুষ অংশ নিয়ে থাকেন। ভারতীয়, বিশেষতঃ কলকাতার মতো শহরগুলির, এবং মফস্বলের বা গ্রামাঞ্চলেও মুসলিম সমাজের একটা বিরাট বড় অংশই এইসব বরকতি, সিদ্দিকুল্লাদের আদৌ নিজেদের প্রতিনিধি মনে করেন না-– তাঁদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, রাজনীতি আছে। মুসলিম ল বোর্ডও এরকম একটি অ্যাবসার্ড জনভিত্তিহীন সংগঠনে পরিণত হচ্ছে দ্রুত। অতএব বরকতিকে গ্রেফতার করলেই মুসলিম সমাজ সর্বস্তরে দাঙ্গা লাগিয়ে দেবে, এটা ভীষণ রকম অতিকথন-– এবং একটা সচেতন নির্মাণ। রাজনৈতিক দলগুলি নিজের নিজের স্বার্থে এই নির্মাণে অংশ নেয়। এবং নিঃসন্দেহে এই নির্মাণের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার হিন্দুত্ববাদী দলগুলি-– কারণ এই ধারণা বজায় থাকলে তাদের রাজনৈতিক লাভ সবচেয়ে বেশি। এই দুধ জল আলাদা তখনই হবে যখন সেই “ঘটনাটা” ঘটানো হবে। গ্রেফতার করা হবে। সরকার তথা প্রশাসন চাইলে পারেন, এবং প্রতিক্রিয়া যা হবে সেটা সামাল দিতেও পারেন, এটা সাধারণ নাগরিকের বোঝা জরুরী। বরকতি যা করেছেন, তাকে সহজ ভাষায় দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া বলে। তার গ্রেপ্তার না হওয়াটা কোনও প্রশাসনের পক্ষেই ভালো বিজ্ঞাপন নয়।
দ্বিতীয়তঃ বাংলায় এই মুহূর্তে এই বরকতি ইস্যুটা একেবারেই অপ্রণিধানযোগ্য। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভাঙ্গর। এখানকার আন্দোলনটা আপাতদৃষ্টিতে পরিবেশ আন্দোলন-– কিন্তু মূল সংঘাত যে সেখানে নয়, সরকারের প্রতিক্রিয়ায় তা স্পষ্ট। আন্দোলনকারীদের একের পর এক অবৈধভাবে গ্রেপ্তারী, প্রায় নির্বিচারে ইউএপিএর মতো কালা কানুন প্রয়োগ করে তাদের জামিনটুকু পর্যন্ত না দেওয়া, এসবে স্পষ্ট, ভাঙর আন্দোলন ভেঙে দেবার পিছনে কায়েমী স্বার্থ আছে। এবং সরকার সেই স্বার্থের মদতদাতা। সদ্য সদ্য আরাবুল ইসলামের গুণ্ডাবাহিনী এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে। গতকালও একজন সাধারণ কৃষককে ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সমন্বয় কমিটির প্রায় পঞ্চান্নজন আন্দোলনকারী, কনভেনর সহ, প্রায় বিনা বিচারে আজ প্রায় দু’মাসের ওপর বন্দী। অথচ এইসব ইস্যুর থেকে নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে বরকতির মতো উটকো নেতাদের এসব অর্থহীন ফতোয়া প্রলাপ। সরকারের মতোই, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিও চায় এই সব নন-ইস্যু সামনে আসুক-– কারণ এগুলি তাদের মনের মতন ইস্যু। এই সব ইস্যুতে তারা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত ভাঙ্গর, ভাবাদীঘি প্রভৃতি আন্দোলনে, যেগুলি প্রকৃত অর্থে ক্লাস স্ট্রাগল, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের জন্য আন্দোলন, তাতে এই হিন্দুত্ববাদী দলগুলির কোনওরকম ভূমিকা নেই– কোনওদিন থাকেওনি। তারা ভালো করেই জানে, এই সব নন-ইস্যু ছাড়া তাদের পক্ষে এ রাজ্যে প্রাসঙ্গিক থাকা অসম্ভব।
তৃতীয়তঃ এই প্রথমবার, বরকতির মতো লোকেদের এই সব ফতোয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদটা উঠে আসছে সরাসরি ভারতীয় ইসলাম সমাজ থেকে। এই ব্যপারটা পঁচিশ বছর আগে হয়নি– হলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। বরকতির বিরুদ্ধে টিপু সুলতান মসজিদের প্রবেশদ্বারে আজ যারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তারা মুসলিম, সোশাল মিডিয়ায় এই বিবৃতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন মুসলিম মানুষজনই (অর্থাৎ যারা অন্তত নামে মুসলিম)। এটাকে যদি সূচক হিসাবে না ধরা হয় তবে তা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার চরম অভাব বলে ধরা ছাড়া (অভাব আছেই) আর কোনও ব্যখ্যা থাকবে না। রাজনৈতিক দলগুলির, শাসক বা বিরোধী, এবার বোঝার সময় এসেছে যে এইসব সিদ্দিকুল্লা, বরকতিরা ভারতের মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে আর গ্রহণযোগ্য নন। “ভারতের মুসলিম সমাজ” কোনও হোমোজেনিয়াস সেট নয়-– সে তার সমস্ত ভারতীয়ত্ব, সমস্ত বৈচিত্র নিয়ে নিজস্ব রূপেই দিব্যি বিরাজমান। আগেও তাইই ছিল– কিন্তু এখন যেটা নতুন হয়েছে তা হল এই নিজস্বতার সচেতন প্রকাশ। চতুর্দিকে অন্ধকারের ব্যাপ্তির মধ্যে এই আলোর দিশাটুকুকে ভারতীয় রাজনীতি যদি সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয় তবে তার নিজের দিশাহীনতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে নিঃসন্দেহে।