Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সর্বজনীনতার শিকড়েই তিনি ফিরে যেতে চেয়েছেন

গোলাম রাশিদ

 

বিশিষ্ট সমাজকর্মী কাঞ্চা ইলাইয়া তাঁর ‘হোয়াই আই অ্যাম নট অ্যা হিন্দু’ (১৯৯৬) বইটিতে লিখেছিলেন, হিন্দু ধর্মটির উদ্ভবই হয়েছে তথাকথিত নিচু জাতের লোকদের দমিয়ে রাখার জন্য, ‘দলিত’ করার উদ্দেশ্যে। বইটি প্রকাশের বাইশ বছর পর শশী থারুর লিখলেন, হোয়াই আই অ্যাম অ্যা হিন্দু। এই সাম্প্রতিক বইটি অবশ্যই তাঁর জবাবি কোনও বই নয়। কিন্তু এবারও সেই কাস্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধে শশী প্রশ্ন তুলেছেন। এবং নিজেই এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এই বলে যে, এ দেশে কাস্ট আছে বিভিন্ন জাতিগত, শ্রেণিগত, পেশাগত ভেদ বোঝানোর জন্য। এটাকে সিস্টেমেটিক করার পিছনে মূল অবদান ছিল ব্রিটিশদের। বেদব্যাস, যিনি বেদের সংগ্রাহক, একজন নিচু জাতের জেলে ছিলেন। রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি শিকারি ছিলেন। দুজনেই পূজনীয় হিন্দু সমাজে, এমনকি ব্রাহ্মণদের কাছেও। এ প্রসঙ্গে থারুর একটি ঘটনার উল্লেখও করেছেন। আদি শঙ্করের চলার পথে একবার এক চণ্ডালের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তাঁর শিষ্যরা তাকে পথ থেকে সরে যেতে বললেন। কিন্তু সেই চণ্ডাল বলল, তুমি কে যে আমাকে সরে যেতে বলছ? আমার মধ্যে যে ‘আমি’ (সেলফ) রয়েছে, তা কি তোমার মধ্যে থাকা ‘আমি’র থেকে আলাদা? আদি শঙ্কর তার কথা শুনে চমৎকৃত হলেন এবং তাকে গুরু হিসেবে স্বীকার করলেন। এইসব উদাহরণ দিয়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, বর্তমানে যে জাতিভেদ প্রথা রয়েছে সেটার জন্য ধর্ম দোষী নয়। এ জন্য সম্পূর্ণই দায়ী এর অনুসারীরা। একইভাবে তিনি স্বঘোষিত গডম্যানদের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, এরা হিন্দু ধর্মের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এর দায় ধর্ম নেবে না।

হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই পুরো গ্রন্থ জুড়ে ভারতীয় রাজনীতির মি. পারফেকশনিস্ট, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল শশী থারুর হিন্দু ধর্মকে সনাতন ধর্মরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, বারবার এর বহুগামিতা, সর্বজনীনতা উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টান বিশ্বাস করে যিশু ইশ্বরের পুত্র, মুসলিম বিশ্বাস করে আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সা. প্রেরিত দূত। কিন্তু হিন্দু ধর্ম, যাকে তিনি সনাতন ধর্ম বলতেই বেশি আগ্রহী, এমন কোনও নির্দিষ্ট বিশ্বাসে আস্থা স্থাপন করে না। ধর্ম নিজস্ব ব্যাপার এবং তুমি মনের মাধুরী মিশিয়ে ঈশ্বরের প্রতিকৃতি রচনা করে তাঁর উপাসনা করতে পারো। হিন্দু একটি সভ্যতা যা কোনও ডগমাতে বিশ্বাস করে না। এখানে একজন নিজস্ব ঈশ্বর বা ইষ্টদেবতা বানিয়ে নিতে পারে। এখানে একজন অন্যজনের ইষ্টদেবতাকে গালি দেয় না। যেটাকে কোরআনে বলা হচ্ছে, লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিন অর্থাৎ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আমাদের জন্য আমাদের জন্য ধর্ম। তিনি হিন্দু ধর্মকে একটি বট গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা তার শাখাপ্রশাখা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রশস্তভাবে এবং শিকড়ও একাধিক। আদি শঙ্কর, রামানুজ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধীরা এই উদার বিশ্বাসেরই প্রচার করে গেছেন। এখানে কোনও একটি কোরআন বা বাইবেল নেই। আছে শ্রুতি, স্মৃতি, ইতিহাস, পুরাণ, দর্শন। এই ধর্মের কোথাও উৎসব মানে পোঙ্গল, থাইপুশম, আবার কোথাও দুর্গোপুজো, গণেশ চতুর্থী, ওনাম। হিন্দু বলে কোনও প্রথাগত ধর্মের কথা তিনি মানতে চাননি। বহু আচার-উৎসব মিলিয়ে এক মিশ্র জীবনধারাকেই তিনি হিন্দু ধর্মের প্রকৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। সেই ধর্মের প্রতিনিধিরূপে তিনি গর্বিত।

হোয়াই আই অ্যাম অ্যা হিন্দু

শশী থারুর

প্রকাশক — আলেফ

মূল্য — ৬৯৯

বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে তিনি ধর্মের সর্বজনীনতা ব্যাখ্যা করার পর বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পলিটিকাল হিন্দুইজমের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই সময়োচিত ব্যাখ্যাই বইটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিজীবন ও ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলে যে গণ্ডগোল হচ্ছে তার প্রতিবাদ তিনি করেছেন। হিন্দু সংস্কৃতিকে জাতীয়করণ করার যে প্রচেষ্টা সেটার জন্য তিনি সাভারকর, গোলওয়ালকর, শ্যামাপ্রসাদ, দীনদয়ালের ভূমিকার কথা আলোচনা করেছেন। যারা হিন্দু নয় তারা কী এ দেশের প্রতি অনুরাগী? বিশ্বস্ত? কৃতজ্ঞ? গোলওয়ালকরের এই প্রশ্ন বিদ্ধ করে সংখ্যালঘু মনকে। ধর্মীয় পরিচিতি ও জাতীয়তাবাদকে এক আসনে বসিয়ে দেয়। অথচ মুসলিম সেনারা শিবাজির হয়ে যুদ্ধ করেছেন, আসফাকউল্লাহ খান শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। তবুও তাদের জাতীয়তা ও দেশপ্রেম নিয়ে আরএসএস-এর মতো হিন্দুত্ববাদী দল সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। যদিও এই দলটিই ১৯৪৮-এ গান্ধীজী হত্যার পর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। এরপর শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ করার অনুমতি ছিল। হিন্দু সমাজ তৈরির স্বাধীনতা তাদের ছিল। কিন্তু হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির জন্য জনসংঘের মতো দল গঠনের প্রয়োজন পড়ল, যা পরে ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম দেবে। ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে ৫৪৫ আসনে মাত্র দুটি সিটে জয়লাভ করে দলটি। তারপর দেশে ক্রমাগত সংখ্যালঘু বিরোধী হাওয়া তুলে, ধর্মীয় আগ্রাসনকে কাজে লাগিয়ে তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। দেশ সাক্ষী থেকেছে আমেদাবাদ, মোরাদাবাদ, মিরাট, বিহার শরিফ, নেলি, গুজরাত প্রভৃতি দাঙ্গার। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের অপরাধে জুনায়েদ খানকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে ট্রেন থেকে। অথচ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এ দেশকে সমৃদ্ধ করে আসছে। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, মইনউদ্দিন চিশতি, শেখ নাসিরুদ্দিনের দরগায় হিন্দুরাও মানত করে। সুন্দরবন অঞ্চলের ‘রক্ষাকালী’ বনবিবি মুসলিম দেবতা হয়েও তাঁর প্রতিকৃতি রয়েছে। অযোধ্যার নবাবরা রামলীলা, কৃষ্ণলীলা উদযাপন করতেন। লখনউ-এর হনুমান উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তাঁরাই। মুসলিম শিল্পীরা দশেরার মুখোশ তৈরি করে বারাণসীতে। ধর্ম এখানে মিশে গেছে দুটো নদীর মতো। হিন্দু ধর্মের এই ইনক্লুসিভনেস তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের নর্দান সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন একজন মুসলিম, আর্মি কমান্ডার ছিলেন একজন পারসি, বাংলাদেশে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন একজন শিখ। এই হচ্ছে ভারত। এই হচ্ছে হিন্দুস্থান।

হিন্দু সংস্কৃতি যখনই জাতীয়তাবাদী রূপ নিয়েছে তখনই তা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ভেঙে পড়েছে দেশের ঐক্যের ভিত। স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশদের প্রতি যে ঘৃণা ছিল, পরে তা সংখ্যালঘুদের দিকে ধেয়ে এসেছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃত হিন্দু ধর্মের সনাতন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে সবাইকে বুকে টেনে নেওয়ার কথাই বলেছেন শশী থারুর। তাতে ধর্মেরই গৌরব। এবং এটাই প্রকৃত ধর্মের পরিচয়। দেশের সকলে সংখ্যাগুরুর ধর্মের অনুসারী হলেই সংহতি আসবে না। এ দেশে এত ভিন্ন ভাষা, ভৌগোলিক অঞ্চল, জাতি যে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু। বরঞ্চ এই বৈচিত্র্য মেনে নিলেই দেশের মানুষের একতার প্রাচীর মজবুত হবে। উপনিষদের সুরে সুর মিলিয়ে শশী থারুর শেষে এই প্রার্থনাই করেছেন,

অসতো মা সদগময়া

তমসো মা জ্যোতির্গময়া।

অসত্য থেকে সত্যের দিকে পথ দেখাও।

অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে চলো।