সুরজিৎ সেন
‘কাউন্টারকালচার’ শব্দটির জন্ম ১৯৬০-এর দশকে, আমেরিকায়। এর অর্থ এটি এমন একটি দর্শন যা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা, ক্ষমতানকশা, জীবনযাপন ও শিল্পশর্তর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে। আমেরিকায় জন্ম হলেও পরবর্তীকালে এই দর্শনটি এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এই দর্শনটির দ্বারা অনুপ্রাণিত এক নগণ্য বাঙালি হিসেবে আমার মনে হয়েছে, আমাদের বাংলাতেও এই দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে তাদের অঙ্গুঠাছাপ রেখে গেছেন বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে। যাঁরা এই কাজ করেছিলেন তাঁরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই এই কাজ করেছিলেন।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন ‘কাউন্টারকালচার’ শব্দটির জন্মই হয়নি। কিন্তু শব্দটি এই লেখায় ব্যবহার করছি বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করবার জন্য। একদম নিখুঁত ঐতিহাসিক কালক্রম মেনে ঘটনাগুলিকে চিহ্নিত করছি না। একটা মোটামুটি কালক্রম মেনে চলার চেষ্টা করছি।
শুরু করতে চাই চর্যাপদের কবিদের নিয়ে। চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম পদ সংকলন তথা সাহিত্য নিদর্শন। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি-না সে বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীকালে যার অবসান হয়েছে। এটি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপরিণত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। কেউ পূর্ববঙ্গ, কেউ উত্তরবঙ্গ, কেউ বা রাঢ়ের অধিবাসী ছিলেন। চর্যাপদের কবির ছিলেন মূলত শ্রমজীবী সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। এঁরা পেশায় ছিলেন তাঁতি, কুমোর, চামার, ধোপা, দর্জি, কামার। তবে অনেকে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক শ্রেণি থেকেও এসেছিলেন। কেউ কেউ রাজবংশজাতও ছিলেন। এঁরা পূর্বাশ্রমের পিতৃপ্রদত্ত নাম ত্যাগ করেছিলেন বলে নাম দেখে এঁদের জাতি স্থির করা যায় না। এঁরা হিন্দুধর্মের সনাতন শাস্ত্রবিধান মানতেন না বলে এঁদের বেদবিরোধী ও নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত মোট ২৪ জন চর্যাকবির নাম পাওয়া গেছে। এঁরা লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী, লাড়ীডোম্বী। এঁদের নামের শেষে পা, পাদ বা চরণ অভিধা যোগ করা হত। এঁদের বৈশিষ্ট্য ছিল, ১. এঁরা সামাজিক বৈষম্য ও জাতিভেদের বিরোধিতা করতেন। ২. ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন না। ৩. নানা ধরণের মাদক ব্যবহারের সংস্কৃতি ছিল এঁদের। ৪. এঁরা মনে করতেন ঈশ্বর এই শরীরের ভেতরই আছেন, সেই দেহ ঈশ্বরেরই চর্চা করতেন তাঁরা। চর্যাপদের কবিরা যে ভাষায় লিখতেন তাকে বলে সান্ধ্যভাষা। এই সান্ধ্যভাষাকে আমি মনে করি কাউন্টারকালচারের ভাষা।
চতুর্দশ শতকের কবি চণ্ডীদাস, যিনি জাতের বেড়া ভেঙে ধোপার মেয়ে রামীকে সাধনসঙ্গিনী নির্বাচন করে সাধনা করেছেন, লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য ও আরও অনেক পদ। যিনি লিখেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য / তাহার উপরে নাই’। সেই ব্রাহ্মণশাসিত সমাজে কাউন্টারকালচারের এক উজ্জ্বল মুখ কবি চণ্ডীদাস। আরেকজন মানুষ শ্রীনিত্যানন্দ, যিনি শ্রীচৈতন্যর সহযোগী ছিলেন। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক জুড়ে এই মানুষটি বাংলার হাজার হাজার নিম্নবর্গের মানুষদের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ভক্তি আন্দোলনে সামিল করেছিলেন। নিত্যানন্দকে আমি বাংলার ভক্তি আন্দোলনের এক কাউন্টারকালচার চরিত্র বলে মনে করি। অবধূত সন্ন্যাসী হয়েও নবদ্বীপে এসে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে পরিচয় হবার পর নিত্যানন্দ নিজের দণ্ড-কমণ্ডলু ভেঙে ফেলে দিয়েছিলেন। কোনও ভারতীয় সন্ন্যাসী যা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না, এ আচরণ পাপাচার। শুধু তাই নয়, শ্রীচৈতন্য সদ্য সন্ন্যাস নিয়ে পায়ে হেঁটে চলেছেন পুরীতে, সঙ্গে কয়েকজন সহচর, আছেন সর্বক্ষণের সঙ্গী নিত্যানন্দ। কয়েকদিন চলার পর নিত্যানন্দ হঠাৎ শ্রীচৈতন্যের দণ্ড-কমণ্ডলু কেড়ে নিয়ে ভেঙে নদীর জলে ফেলে দিলেন। শ্রীচৈতন্য মেনে নিয়েছিলেন এই ঘটনা। এও সন্ন্যাসধর্মের প্রতি এক বিদ্রোহ। আবার শ্রীচৈতন্যর অনুরোধে তিনি সন্ন্যাস ত্যাগ করে বিয়ে করে গার্হস্থ্য গ্রহণ করেন, এমনকী দুটি বিবাহ করেন। বৈষ্ণব হয়েও তিনি বৈষ্ণবোচিত আচরণ করতেন না। তিনিই প্রথম সংকীর্তনে মেয়েদের অংশ গ্রহণ করতে বলেন, এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। এমনকী নারী যে গুরু মা হতে পারে, দীক্ষা দিতে পারে — এই সবই নিত্যানন্দ শুরু করেন।
এর অনেক কাল পরে যদি আমরা আঠারো শতকের বাংলার কবিদের দেখি, তাহলে গোঁজলা গুঁই, নিত্যানন্দ বৈরাগী, নৃসিংহ রায়, ভবানী বণিক, কৃষ্ণাকান্ত চামার বা কেষ্টা চামার, ভোলা ময়রা, রঘুনাথ দাস, রাম বসু, এইসব কবিয়ালরা যে ভাষায় কবিতা লিখতেন বা তত্ক্ষণাৎ শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে যেভাবে কবিতা রচনা করতেন তা এক কথায় বৈপ্লবিক সাহিত্য প্রচেষ্টা। দাঁড়িয়ে কবিতা পড়বার রেওয়াজ এই কবিরা শুরু করেন বলে এঁদের দাঁড়া কবি বলা হত। এঁদের মধ্যে নিত্যানন্দ ও নৃসিংহ ছিলেন হুগলি জেলার চন্দননগরের বাসিন্দা। শুধু এঁরা নয়, কবিয়ালের সাবঅল্টার্ন ডিসকোর্সটি যাদের আয়ত্তে ছিল সেই নীলমণি পাটনি, জগন্নাথ বেনে, মতি পসারি, ভীমদাস মালাকার, জগা কৈবর্ত — এঁদের সবাইয়ের নাম আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে দিয়েছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা। এর জন্য দায়ী লর্ড মেকলের শিক্ষানীতি আর লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আমরা ভুলে গেছি আমাদের সাহিত্যের অন্য স্বরগুলো, আমরা হারিয়ে ফেলেছি বাংলার কাউন্টারকালচার সাহিত্যের টেক্সট। আমাদের স্মৃতি বিপর্যয় ঘটে গেছে, ঔপনিবেশিক শাসক তাঁর নিজের সাহিত্যের টেক্সট আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে দিয়েছে। তাই ইংলন্ডের জনৈক ছুতোর কবি উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা পড়া আমাদের কাছে গর্বের বিষয়, কিন্তু গোঁজলা গুঁই বা কেষ্টা চামারের কবিতা পড়ার কথা আমরা ভাবতে পারি না, বিষয়টিকে অশিক্ষিতের ব্যাপার বলেই মনে করি। ঔপনিবেশিক শিক্ষার উন্নাসিকতার কারণে আমরা এঁদের টেক্সটগুলো সংরক্ষণযোগ্য মনে করিনি। সেই সব টেক্সট আজ লুপ্ত। আঠারো শতকের আরেক কবি রামপ্রসাদ সেন, যিনি জমিদারি সেরেস্তার চাকরি ছেড়ে মাতৃসাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন, লিখেছেন অনেক গান, যা রামপ্রসাদী গান নামে খ্যাত হয়েছে। এঁর জীবন ও সাহিত্যও বাংলার কাউন্টারকালচারের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
উনিশ শতকের বটতলা সাহিত্য সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। বটতলা সাহিত্য ছিল মেনস্ট্রিম সাহিত্যের উল্টোদিকে বয়ে চলা কাউন্টারকালচার সাহিত্য। যার বিষয় ছিল কলকাতা তথা বাংলার ডার্ক, আন্ডারগ্রাউন্ড, আন্ডারবেলি লিটারেচার। শিক্ষিত ভদ্রলোকরা বটতলা সাহিত্যকে নিচু চোখে দেখত, কারণ তার ভাষা ছিল পর্ণগ্রাফি ঘেঁষা, যদিও তা এখন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সমাজেতিহাসের পাঠ। অথচ এই সব সাহিত্য আমরা সংরক্ষণ করিনি, করার যোগ্য বলে মনে করিনি, অশ্লীল বলে। উনিশ শতকের কাউন্টারকালচার সাহিত্যের লেখকরা হলেন টেকচাঁদ ঠাকুর, হুতোম প্যাঁচা, ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের টেক্সটগুলো রয়ে গেছে কারণ এঁরা ছিলেন উচ্চবর্ণের, ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।
পাদ্রি জেমস লং, যিনি ‘নীলদর্পণ’ (দীনবন্ধু মিত্র) ইংরেজিতে অনুবাদ করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তিনি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’কে বলেছিলেন ইতরদের সাহিত্য। দাশরথী রায় ও অন্যান্য পাঁচালিকারদের পাঁচালিগুলোকে বলেছিলেন মোটা দাগের কাজ, লালসাউদ্রেককারী। বাঙালিদের উচিত মিল্টন, চসার ইত্যাদি ব্রিটিশ কবিদের কবিতা পড়া। এরপরই বাঙালির বৌদ্ধিক জীবন থেকে বিতাড়িত হলেন ভারতচন্দ্র ও অন্যান্য পাঁচালিকাররা।
এই প্রসঙ্গে উনিশ শতকের চারণকবি মুকুন্দদাসের কথাও বলতে হবে। মুকুন্দদাসের বাবার মুদির দোকান ছিল বরিশালে। তিনি বৈষ্ণব ছিলেন, কীর্তন গাইতেন। মুকুন্দদাস ক্লাস এইটে স্কুল ছেড়ে দেন। মাস্টারমশাই স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তর প্রভাবে ‘মাতৃপূজা’ নামে দেশাত্মবোধক পালাগান লিখে বাংলার গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়াতেন। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই পালাগান। ‘বন্দেমাতরম’, ‘যুগান্তর’ বা ‘সন্ধ্যা’র মতো বিপ্লবী পত্রিকাগুলো মুকুন্দদাসের পালা সম্পর্কে লিখে তাঁকে আরও জনপ্রিয় করেছিল। ব্রিটিশ শাসক তাঁকে ৩ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল।
লালন ফকির সমাজের মূলস্রোতের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন এক কাউন্টারকালচার জীবনযাপনের সমাজ। লিখেছিলেন কাউন্টারকালচার জীবনবোধের গান, প্রচার করেছিলেন জাতপাত ও সমাজশাসিতযৌনতাবিরোধী এক নতুন মানবধর্ম। যাঁর রচিত অন্তত ৬০০ গান বাংলার ফকিররা গেয়ে আসছেন গত দেড়শো বছর ধরে। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন বা লেখক মীর মোশারফ হোসেনের মতো অভিজাত বিদ্বজনরা লালনের কথা জানলেও তাঁর জীবনী লিখে রাখার কথা ভাবেননি, কারণ লালন ও তাঁর চর্চিত জীবন ও সঙ্গীতকে নিচু সমাজের নোংরা ব্যাপার বলে মনে করেছিলেন তাঁরা।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা কাউন্টারকালচার সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ মুখ। তিনি ছিলেন লেটো গানের দলের ঢোলবাদক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদলের বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার। তাঁর পদ্যে ধ্বনিক্রীড়ার আধিক্য নজরুলকে প্রথম থেকেই বিতর্কিত করে তুলেছিল। নজরুল ব্যক্তিগত জীবনযাপনে ছিলেন উচ্ছৃংখল, বেপরোয়া, ফলত বঙ্গীয় অভিজাত বুদ্ধিজীবিদের সভায় তাঁর স্থান হয়নি। বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম পত্তনকারী মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলেও ‘কবি’ ‘শিল্পী’ এইসব সংজ্ঞার চাপে তিনি ছিলেন বিভ্রান্ত। অবশ্য বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টিটিও এব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে পারেনি, কারণ তাঁদের চলাফেরা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মুখাপেক্ষী। যদিও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গানটি নজরুল বাংলায় অনুবাদ (জাগো অনশনবন্দী ওঠো রে যত) করেন। শুধু তাই নয় ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা লেখার দায়ে তাঁর এক বছর জেল হয়। আজ আমরা বিদেশের কপিলেফট আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি করি, সেই সময় উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক আধিপত্যটি যখন কপিরাইটের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বাঙালি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীমানস কপিরাইটকেই তাদের আরাধ্য করে তুলেছে, তখন নজরুল তাঁর গানের স্বরলিপির কপিরাইট রাখেননি। তিনি চেয়েছিলেন রামপ্রসাদ আর মীরাবাঈয়ের মতো তাঁর গান ছড়িয়ে পড়ুক মানুষের মধ্যে। তাঁর গানকে কেন্দ্র করে কোনও আধিপত্যবাদী শাসনকাঠামো গড়ে উঠুক এটা তিনি চাননি। নজরুল অনেক শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন এবং সুর দিয়েছেন। জনৈক মুসলমান যুবক শ্যামাসঙ্গীত লিখে, সুর দিয়ে তাকে রামপ্রসাদের গানের চেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছেন, আজকের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ড্রামাবাজির যুগে একটি ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু অভিজাত বুদ্ধিজীবীরা নজরুলকে নিচুতলার কবি করে রেখে দেওয়ায় শিক্ষিত বাঙালি নজরুলকে নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পায়। ভাবে নজরুলের কবিতা ও গান নিয়ে কথা বলা পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ, অশিক্ষিতের চিহ্ন। নজরুলকে শিক্ষিত বাঙালি গ্রহণ করতে পারেনি, তাঁকে রেখে দিয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কোটায় টোকেন কবি হিসেবে।
বাংলা সাহিত্যের যে জঁরটিকে এতক্ষণ চিহ্নিত করলাম, সেই তালিকায় আরও কিছু নাম যোগ করতে চাই: শিবরাম চক্রবর্তী, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, হাসন রাজা, জগদীশ গুপ্ত, বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সরকার, ঋত্বিক ঘটক, বারীন সাহা, চিত্তপ্রসাদ, রামকিঙ্কর, লোকনাথ ভট্টাচার্য, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, দীপক মজুমদার, কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, উদয়ন ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরি, বাসুদেব দাশগুপ্ত, তুষার রায়, ফাল্গুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত, সুবিমল মিশ্র, নবারুণ ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ব্যাপারী। এই তালিকার বাইরে রয়ে গেলেন বাংলাদেশের এই জঁরের লেখক-শিল্পী-চলচ্চিত্রকারা, তাঁদের সম্পর্কে আমার অজ্ঞতাই এর কারণ। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের লেখক-শিল্পীরাও অনেকে রয়ে গেলেন যাঁদের কথা আমি জানি না। এবং এই তালিকায় পাঠক আরও নাম যোগ করতে পারেন।
মনে রাখতে হবে, কাউন্টারকালচার যে কোনও ক্ষমতানক্সাকে অস্বীকার করে, তার সমাজবিপ্লব করার দায় নেই। সে শুধু চায় সমাজে বহুস্বর ধ্বনিত হোক, একটি বা দুটি কি তিনটি স্বরের আধিপত্য যেন না চলে।
কাউন্টারকালচার যে কোনও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এক অহিংস সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।