Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সুরের বাড়ি সুরের মাঠ

শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

 

গান শোনা এক নিত্যদিনের কাজ, যদিও কোনও কোনও মুহূর্তে এই কাজই হয়ে ওঠে অবশ্য-ধর্ম, হঠাৎ নেমে আসা কোনও অন্ধকারের একমাত্র রশ্মিরেখা। কোনও সময়েই সুরের কাছে যে খুব প্রত্যাশা নিয়ে যাই এমন নয়। সে এক সীমানাহীন মাঠ–- যে কেউই গিয়ে দু’দণ্ড বসতে পারে বিকেলের আলোয় কিংবা সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে। সুর তার নিজের মতো জেগে থাকে, বয়ে যায়। ছোট্ট এক বিন্দু থেকে ক্রমশ বড় হতে হতে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেয় আমাকে। আর যখনই আভাস পাই এই মিশ্রণের, বাকি সমস্ত কিছু থেকে নিই এক মস্ত ছুটি, ওই মাঠের ওপর বসে থাকাই হয়ে ওঠে আমার অদ্বিতীয় কাজ।

সুরকে বোঝবার চেষ্টা করেছি অনেক দিন ধরেই। একেবারেই মূর্খের প্রচেষ্টা, তবু সেই যে গান নিয়ে বলতে গিয়ে রবি ঠাকুর জানিয়ে দিলেন-– ‘আনাড়ির মস্ত সুবিধা এই যে, সানাড়ির চেয়ে তার অভিজ্ঞতার সুযোগ বেশি। কেন না, পথ একটা বৈ নয় কিন্তু অপথের সীমা নাই; সে দিক দিয়া যে চলে সেই বেশি দেখে, বেশি ঠেকে’-– এ থেকেই সাহস পাই। ‘বোঝবার’ চাইতেও ‘খোঁজবার’ কথাটা বেশি যথাযথ আমার ক্ষেত্রে। ‘বোঝা’র মধ্যে একরকম নিশ্চয় আছে, কখনও বা অহং, সন্ধানের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস নেই।

নিছক জৈব-অভ্যাস ও যাপনের বাধ্যতা ছাপিয়ে আমাদের প্রত্যহের কাজকর্ম এক আত্মসন্ধানই। সুরের খোঁজ করতে করতে যেন পৌঁছে যাওয়া এই সন্ধানের একেবারে মূলে। সুরের কোনও দেশ নেই। ভাষার মধ্যে যে ব্যবধান, নিখাদ সুরের রাজ্যে সে ঘুচে যায় অনায়াসেই। এই ব্যবধানের বহু কারণ, অসংখ্য শিকড়। তার মধ্যে একটা হল-– সংস্কার। অস্ট্রেলিয়ান আবোরিজিন্যালদের গ্রুপ ‘ওথু ইন্ডি’র প্রতিষ্ঠাতা মান্ডাউই ইউনুপিঙ্গু বলেছিলেন-– Music is a universal language without prejudice. ‘Prejudice’ একটা শক্ত প্রাকার, তাকে বোঝা, স্বীকার করা বা অতিক্রম করা কঠিন। দেশ, ভাষা বা সংস্কৃতির সীমার চেয়েও সংখ্যায় হাজার গুণ বেশি এই সংস্কারের বেড়া, কেন না সে ভেদ টানে একই ভাষার নানান গোষ্ঠীর ভেতর, এমনকি একটি গোষ্ঠীগত মানুষের মধ্যেও। কিন্তু এই যে সঙ্গীতের সংজ্ঞায় ‘prejudice’ কথাটা ঢুকিয়ে নিলেন মান্ডাউই, পরিধিটা পলকে বেড়ে গেল অনেকখানি। আর রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমি থমকে দাঁড়াতে লাগলাম অচেনা এক চাইনিজ মায়ের সামনে। ঝুপসি গাছের ছায়ায় ছোট্ট বাঁধানো আসনে বসে কোলের শিশুটিকে ঘুম পাড়াতে চাইছে সে। ছুটির দিনগুলোয় বাস চলে আধঘন্টা অন্তর, তাই মধ্যিখানের ফাঁকটুকু ধুধু অপেক্ষার। রাস্তাঘাট জনহীন, মৃদু বাতাসে এদিক-ওদিক দুলছে গাছের পাতা, একলা মা বসে গুনগুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে সন্তানকে। সে সুর কানে যেতেই অদূরে থেমে পড়ছি, কান পেতে শুনছি তার ভাষাহীন গান, ছল করছি যেন তার মতো আমিও অপেক্ষা করছি নীল অর্বিট বাসের। আড়-চাহনিতে মুগ্ধ হয়ে দেখছি গুঞ্জনের তালে তালে দুলছে তার কোল, একটু একটু করে নিভে আসছে শিশুর চোখ। আমি ভাবছি-– ঠিক কী হচ্ছে এখানে?

আসলে যুবতী মায়ের মধুর সুর তার সন্তানকে নিয়ে চলেছে এক নিশ্চিন্তির দেশে। ওই যে বললাম, ছোট থেকে সুরের প্রসারণ-– বাড়তে বাড়তে ক্রমশ গ্রাস করে নেওয়া-– তেমনই সুরের স্বচ্ছ দেওয়াল উঠে ঘিরে নিচ্ছে এক অবোধ প্রাণ, সে ভাবছে-– এইবার চোখ দুটি বুজতে পারি আমি, নির্ভাবনায়। কেন না জেগে থাকার মূলত দুটি কারণ-– জিজ্ঞাসা আর সতর্কতা। মায়ের গান এসে মুছে দিয়েছে এই দুই বোধ। ভেতরে ভেতরে বড় তৃপ্ত হয়ে উঠছে শিশুপ্রাণ। তৃপ্ত আর সুরক্ষিত। তাই সে ভাসতে চাইছে নরম ও বলক-তোলা অন্ধকারের দেশে। সেই দেশের নাম বিশ্রাম। তার নাম স্বপ্ন।

আমি তো একবর্ণও বুঝতে পারছি না ওই অস্ফুট ভাষা, জানতে পারছি না তার জন্মস্থান। হয়তো চীনদেশের কোনও এক প্রত্যন্ত পাহাড়তলি কিংবা শ্রান্ত শ্রমিকপল্লী থেকে ফুটে উঠেছে এই লোকগান। জানি না। তবু বিনা চেষ্টায় কী সুন্দর পড়ে নিতে পারছি অদূর মায়ের আস্যভাষা, পলে পলে বদলে যাওয়া সব রেখা, আলোছায়া; একটু একটু করে যখন গভীর তন্দ্রায় ডুবে যাচ্ছে সন্তান, একই সঙ্গে চিন্তামুক্তি ও একাকীত্বের ছায়া কেমন অধিকার করে নিচ্ছে নম্র মুখ। আর সে জানতেই পারছে না তার শরীরের অল্প দোলা হয়ে উঠছে এক বিপুল সুর, ওই বিন্দু থেকে উৎস পেয়ে সে ছড়িয়ে পড়ছে শহরময়, তার আবেশে কাজ ভুলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে গেছি আমি; হয়তো হাওয়ায় ভেসে যাওয়া চূর্ণ সুরে থেমে গেছে কাছে-দূরের আরও অনেক কাজ। সে জানতে পারছে না কিছুই। টের পাচ্ছে না তার গর্ভজাতর সঙ্গে সঙ্গে এক ছুটির শহর প্রবেশ করছে নিশ্চেতনার দেশে-– একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ছে নিশ্চিন্তে।