রিমি মুৎসুদ্দি
কাল রাত্রে গরমটা অস্বাভাবিক ছিল। ঘরের মধ্যে দুটো পাখা, একটা সিলিং আর মাথার কাছে রাখা একটা টেবিল ফ্যান। তা সত্ত্বেও কুলকুল করে ঘামছে নীলাঞ্জনা। পাখার হাওয়া যেন গায়ে লাগছেই না। তুষারের হাতখানা যেই গায়ে এসে পড়ল, অসহ্য বিরক্তিতে নীলাঞ্জনা সরিয়ে দেয়। ঘুমের মধ্যেও নীলাঞ্জনার রাগ টের পেয়ে তুষার জেগে ওঠে। আসলে তুষারেরও খুব গরম লাগছিল। কীরকম যেন দম আটকানো ভ্যাপসা একটা গরম। এই গরমে ঘুম আসতেই চায় না।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই জেগে আছে। যে বাড়িতে এই দম্পতি থাকে তার একতলায় ও তিনতলায় যাঁরা থাকেন তাঁদের প্রত্যেকেরই শয়নকক্ষে বাতানুকুলযন্ত্র লাগানো রয়েছে। এবং এই যন্ত্রের উদ্ধত শব্দই দৃপ্তকণ্ঠে গৃহমধ্যস্থ বাসিন্দাদের সুখনিদ্রা যাপনের ঘোষণা করছে। তিনটে ফ্ল্যাটবিশিষ্ট এই বাড়িতে একমাত্র নীলাঞ্জনার ফ্ল্যাটেই এয়ারকন্ডিশনার লাগানো নেই। আপাতত তাদের একটাই নিশ্চিন্ততা। এই প্রবল গরমেও তাদের বছর পাঁচেকের মেয়ে ঋতুন একেবারে ঘুমিয়ে কাদা। টেবিল ফ্যানটা মেয়ের মাথার দিকে রেখে বিছানায় এসে বসে নীলাঞ্জনা।
“সামনের গরমের মধ্যে একটা এসি কিনবই দেখো।’ তুষারের কথা শুনে নীলাঞ্জনা বিরক্ত হয়। “কী করে কিনবে শুনি? ফ্ল্যাটের ইএমআই, এলআইসির প্রিমিয়াম, ঋতুনের স্কুলের এডমিশান, সংসার খরচ — এরপর থাকবে কিছু যে এসি কিনব?” তুষারকে আরও হতোদ্যম কর দিয়ে সে বলে, “আবার প্রতিমাসে তোমার মা’কে টাকা পাঠাতে হয়।” মা’র প্রসঙ্গ ওঠায় তুষার একটু অস্বস্তি বোধ করে। নীলাঞ্জনার রাগ পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই দেখে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
মৌনতাই শান্তির পথ — এ ধারণা ভুল প্রমাণিত করে নীলাঞ্জনা আবার বলে, “একজনের রোজগারে আজকাল সংসার চালানোই দায়! তোমার মা’র জন্যই তো আমাকে চাকরিটা ছাড়তে হল। না’হলে একটা এসি কিনতে দুবার ভাবতে হত?”
তুষার বোঝে চারিদিকে সবাই যখন এসির আরামে ঘুমোচ্ছে, নীলাঞ্জনারও ইচ্ছে হয় চল্লিশ ডিগ্রির দাবদাহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘরের তাপমাত্রা অনায়াসে আঠারো থেকে ষোল ডিগ্রিতে রেখে র্যাপার মুড়ে এক অনায়াস সুখনিদ্রা উপভোগ করে। তুষারেরও কি ইচ্ছে করে না এইরকম একটা সুখনিদ্রায় ভেসে যেতে? সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক যত না মনখারাপ করে দিচ্ছে, নীলাঞ্জনার একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান বিশেষ করে তার চাকরি ছাড়ার শোক এই মুহূর্তে একধরণের বিরক্তি উদ্রেক করছে। নীলাঞ্জনার থামার কোনও লক্ষণ নেই। সে ক্রমাগত তার শাশুড়িকে দায়ী করে যায়। তুষারের মা যদি গ্রামের বাড়ি বেচে এই সংসারে থাকতেন তাহলে বাড়ি বেচার টাকায় ব্যাঙ্কের লোন শোধ করা যেত। তাছাড়া, ঋতুনকে তার ঠাকুমার জিম্মায় রেখে নীলাঞ্জনা নিশ্চিন্তে চাকরি করতে পারত।
সারাদিনের অক্লান্ত খাটাখাটনি তারপর এই গরম, যাও বা একটু ঘুম আসছিল রাতবিরেতে এই বিলাপে একেবারেই চটকে গেল। মেজাজটা একটু খিঁচিয়ে গেলে তুষার ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল, “মা এ বাড়িতে এলে তো তোমার রাজ্যের অভিযোগ থাকে তার প্রতি। ঋতুনের বিষয়ও কি তুমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হও মায়ের উপর?” কথাটা বলেই সে বুঝতে পারে ভুল করেছে। এরপর শুরু হবে কথার পৃষ্ঠে কথা, আর সে কথা বাড়তেই থাকবে। চাকরি জীবনের হাজারো চাপের মাঝে দাম্পত্য অশান্তির মেঘও গুরুগুরু রবে গর্জন শুরু করবে।
পিছিয়ে আসার উপায় নেই, তাই নিজের স্ট্যান্ড বজায় রেখেই তুষার ঘরের থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরায়। কোনও কারণে চাপ মনে হলে তুষার রিং পাঁকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ভালবাসে। একনাগাড়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তার চোখ চলে যায় রাস্তার ওপারে ফুটপাথের ওপর শুয়ে থাকা ছেলেটার উপর। বছর ত্রিশের আশেপাশেই হবে ছেলেটার বয়স। খালি গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা লুঙ্গিই তার আবরণ। ছেলেটার পাশে তিনটে বাচ্চা একটা চাদর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছে। বাচ্চাগুলোর বয়স পাঁচ থেকে দশের মধ্যে। তাদের পাশেই একটা পলিথিনের শিট তাবুর মতো করে ঢেকে রয়েছে ফুটপাতের সংসার। পলিথিনের শিটের দিকে তাকিয়ে তুষারের মনে হল এই ছেলেটা তার স্ত্রীর সঙ্গে বা কোনও মেয়েমানুষের সঙ্গে সঙ্গম করে কীভাবে? ঐ পাতলা একটা আবরণ কীভাবে আড়াল করে সঙ্গমরত দুই নরনারীকে? স্ট্রিট লাইটের আলো, মানুষের আনাগোনা — এরপরও কীভাবে এরা মিলনসুখ পায়? ছেলেটার ঘুমানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পরম তৃপ্ত সে। যৌনতৃপ্তি ছাড়া আর কীই বা তৃপ্তি থাকতে পারে ঐ ছেলেটার?
নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে তুষারের। সে কি ইচ্ছে করলেই এরকম একটা তৃপ্তি এই মুহূর্তে পাবে? নীলাঞ্জনাকে থামিয়ে দিয়ে জোর করে কি একবার নিজেকে সঁপে দেবে তার কাছে? ঋতুন হওয়ার আগে কয়েকবার করেছে এরকম। নীলাঞ্জনা প্রথমদিকে আপত্তি করলেও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসা প্রতিরোধ ও ক্রমে তার বন্ধ চোখের পাতায় ফুটে ওঠা একধরণের সন্তোষ প্রতিবারই তুষারের কনফিডেন্স বাড়িয়ে দেয়। তুষার যদিও চায় নীলাঞ্জনা চোখ খুলুক ঐ সময়ে।
ফুটপাথের ছেলেটা পাশ ফিরে শুল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে ছেলেটার মুখ। বাচ্চা তিনটে মনে হয় ছেলেটারই। ঐ ফুটপাথের সংসার সে যাতায়াতের পথে দেখে থাকবে। খুব একটা ভাল করে লক্ষ করেনি কোনওদিন। আজ তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে পলিথিনের তাঁবুর ভেতর কি ছেলেটার স্ত্রী বা তার বাচ্চাগুলোর মা শুয়ে আছে?
সিগারেটটা শেষ হলে একটা কিছু সম্ভাবনার আশা নিয়ে সে ঘরের ভেতরে আসে। নীলাঞ্জনা ঋতুনের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঋতুন ঘুমিয়ে কাদা। ইচ্ছেটা অনেকক্ষণ ধরে উঁকি দিলেও এখন যেন চাগাড় দিয়ে উঠছে। স্বামীর ছোঁয়াতেই তার ইচ্ছের কথা টের পায় নীলাঞ্জনা।
আজ দুপুরে সে যখন ঋতুনকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল, উপরের ফ্ল্যাটের মিসেস বোসের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়। ঋতুনের হাত ধরে অটোতে উঠতে যাবে, মিসেস বোস গাড়ি থামিয়ে নীলাঞ্জনাকে ডাকে। তারপর মিসেস বোসের গাড়িতেই সে বাড়ি ফেরে। নীলাঞ্জনা ও ঋতুনের ঘামে জবজবে শরীর দেখেই বোধহয় মিসেস বোস গাড়ির এসিটা একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ‘উফ! কী অসহ্য গরম! এর মধ্যে রাস্তাঘাটে বেরোনই দায়।’ হ্যাঁ গোছের একটা কিছু নীলাঞ্জনা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু মিসেস বোস যখন বললেন, আমি তো বাড়িতে একমুহূর্ত এসি ছাড়া থাকতেই পারি না।’ নীলাঞ্জনার কথা আচমকাই যেন হারিয়ে যায়। যে মধ্যবিত্ত জীবন সে যাপন করে তাতে এসি কেনাই যেখানে সামর্থ্যের বাইরে সারাদিন কৃত্রিম ঠান্ডায় নিজেদের শীতল রাখার মতো কল্পনা বিলাস সে করতেই পারে না। এই বোধ কোথায় যেন তাকে খুব আঘাত করে।
সেই দুপুর থেকেই একটা তপ্ত ক্ষোভ ও হতাশা ঘিরে ধরেছিল তাকে। তুষারের ডাকে সে কিছুতেই সাড়া দেবে না আজ। আর তুষারের জোর করার অভিজ্ঞতা তার আছে তাই তাকে থামানোর জন্যই সে বলে, ‘কেমন মানুষ তুমি? শুধু আমার উপর জোর করে নিজের ইচ্ছে মেটাতে পারো অথচ আমার সুবিধা অসুবিধা, মান-সম্মান সেসব দিকে খেয়াল রাখার কোনও ক্ষমতাই তোমার নেই।’ তুষার এবার সত্যিই অবাক হয়। গরমকালে এসি না থাকায় কষ্ট হচ্ছে, অসুবিধা হচ্ছে এই পর্যন্ত সে বুঝতে পারে, অথচ মান-সম্মানের বিষয়টা সে বুঝতে পারে না। ‘এসি না থাকার সঙ্গে আবার মানসম্মানের কী সম্পর্ক?’ মিসেস বোসের সঙ্গে দুপুরে নীলাঞ্জনার দেখা হওয়ার কথা সে তুষারকে বলে। মিসেস বোস যেন ইচ্ছে করেই বাড়িতে সারাদিন এসির আরামে থাকার কথা শোনালেন। একই বাড়িতে থাকার জন্য উনি তো জানেন দোতলার এই ফ্ল্যাটে কোনও এসি নেই।
নীলাঞ্জনার কথা শুনে তুষারের ভেতরের ইচ্ছেটাই মরে যায়। নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে হতে থাকে তার। একটা অপরাধবোধও গ্রাস করে তাকে। সত্যিই তো সামান্য একটা এসি সে কিনে দিতে পারছে না নীলাঞ্জনাকে। একটা এসিই এই মুহূর্তে তাদের কাছে সুখের নির্ণায়ক। তুষার মনে মনে ঠিক করে নেয়, এইবার ক্রেডিট কার্ডের একটা আবেদন করবেই সে। অফিসেও একটা অ্যাডভান্স লোনের জন্য দরখাস্ত করবে। এইসব পরিকল্পনা করতে করতেই দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের আকাশের শেষ তারাটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে অন্য আরেকটা নতুন রাতের জন্যই অপেক্ষা করবে।
সারাদিন তুষারের আজ অফিসে বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। বিশেষত এই লোনের দরখাস্তের জন্য। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক হওয়ার আবেদনপত্র নিয়ে ব্যাঙ্কেও ছোটাছুটি করতে হয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক হওয়া অফিসের লোন স্যাংশন হওয়া থেকে বরং অনেক বেশি সুবিধাজনক। তিনসপ্তাহের মধ্যে বাড়িতে কার্ড চলে আসবে। তুষার হিসাব করে দেখে নীলাঞ্জনার জন্মদিন এই সপ্তাহের পরের সপ্তাহে। এর মধ্যে যদি ক্রেডিট কার্ড বা ঋণ মঞ্জুর কোনও একটা হয়ে যেত, তাহলে সে নীলাঞ্জনাকে জন্মদিনে এসি উপহার দিতে পারত। তাদের দুজনেরই বড় সাধের হত এই বাতানুকুল যন্ত্রটি।
দেখতে দেখতে নীলাঞ্জনার জন্মদিন এসে গেল। দিল্লি থেকে তুষারের শাশুড়ি এসেছে দিনসাতেক হল। এখনও ক্রেডিট কার্ড ডেলিভারি হয়নি। অফিসে লোন স্যাংশনের দরখাস্তও ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে সম্ভবত। এর মধ্যে নীলাঞ্জনার মা তুষারকে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন করেছেন। মহিলা সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হলেও খবরের কাগজের দৌলতে ও নিজের আগ্রহে অর্থনীতি, রাজনীতি ও আরও অন্যান্য বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন। নিজের অর্জিত জ্ঞান ও সেই বিষয়ে মতামত অন্যদের বিশেষত জামাইকে জানাতে বেশ গর্ব বোধই করেন। তুষার এইজন্য শাশুড়ি মাকে শ্রদ্ধা করে ও কিঞ্চিৎ ভয়ও করে। মতের অমিল হলেও প্রতিবাদ করে না, পাছে উনি আঘাত পান এই ভেবে।
জামাইকে নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াতে পচ্ছন্দ করেন নীলাঞ্জনার মা। তুষারের পাতে ভাত বাড়তে বাড়তে মেয়েকে বলে, “নীলি, তুষারকে বলেছিস আজ দেবার্ক আসছে বিকেলে?” হঠাৎ মনে পড়েছে এইরকমভাবেই নীলাঞ্জনা বলে, “ওহ! জানো তো মায়ের বন্ধু শিবানীমাসির ছেলে দেবার্ক আমেরিকায় থাকে। শিকাগোতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ায়। এই কদিন হল কলকাতায় এসেছে। মায়ের সঙ্গে শিবানীমাসির ফোনে কথা হয়েছে। দেবার্কদা আজ বিকেলে মাকে নিয়ে আসবে আমাদের বাড়িতে।” কথা শেষ হতে না হতেই নীলাঞ্জনার মার গলায় উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে, “কতদিন বাদে দুই বন্ধুর দেখা হবে! শিবানীর বর আর নীলির বাবা সহকর্মী ছিল। আমরা জলপাইগুড়িতে একই জায়গায় থাকতাম। পাশাপাশি বাড়ি। যাতায়াত লেগেই ছিল। নীলি হওয়ার পর শিবানী বলেছিল তোর মেয়ের সঙ্গেই আমার ছেলের বিয়ে দেব। দুই বন্ধু যখন বেয়াই হব বেশ জমবে ব্যাপরটা।” কথাগুলো বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলেন।
‘টুমরো মে রেইন সো আই উইল ফলো দা সান’ — মোবাইলের ইয়ারফোনে বিটলস, ভিড় মেট্রোতে কোনওরকমে দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছে তুষার। মনটা কেমন যেন বিষিয়ে রয়েছে সেই সকাল থেকেই। নিউজলেটারে সামান্য একটা টাইপিং এরর হয়েছে। তাও তুষারের দোষ নয়, রঞ্জাকে বারবার বলেছিল ইভেন্টগুলো ক্যাপসে লিখতে। ও বলল, না হাইলাইট করে দিলেই হবে। এই সামান্য ব্যাপারে গুপ্তা প্রায় যাচ্ছেতাই অপমান করেছে তুষারকে। অথচ গুপ্তা এই কদিন হল জয়েন করেছে। বয়সেও জুনিয়ার। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলে যাকে যা ইচ্ছে বলে ছেলেটা। চারিদিকে যেমন লে-অফের হিড়িক তুলেছে কোম্পানিগুলো! সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। একটাই যা সান্ত্বনা বড়, মেজ, ছোট সব সংস্থাগুলোতেই একই ছবি। ছাঁটাইয়ের ভয়ে তটস্থ উপর থেকে নিচুতলার সমস্ত কর্মচারীই।
নীলাঞ্জনার মা সকালবেলা নেহাত মজা করেই বলেছিলেন, নীলির সঙ্গে দেবার্কর বিয়ে হওয়ার কথা হয়েছিল তার জন্মের সময়ে। তুষার ভাল করে লক্ষ করেছিল নীলাঞ্জনার চোখেমুখে কোনও পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায় কি না? একটু কি আপশোস হচ্ছে তার? শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর বেসরকারি সংস্থায় ছাপোষা কেরানি, জীবনসঙ্গী নির্বাচনে কি কোনও ভুল করেছে বলে মনে হয় নীলাঞ্জনার? অফিসে যাওয়ার তাড়াহুড়ায় ভাল করে বুঝতে পারেনি সে। নাকি বুঝতে পেরেছে, মানতে চাইছে না? একটা দীর্ঘশ্বাস যেন কানে এসে লেগেছিল যেই মুহূর্তে কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন শাশুড়িমা। মনের ভুল ভেবেই উড়িয়ে দেওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে উপায় নেই। একটাই স্বস্তি, ব্যাঙ্ক থেকে ফোন এসেছিল, ক্রেডিট কার্ড ডেলিভারি হবে আর দুদিনের মধ্যেই। এরপর আর সময় নষ্ট না করে নীলাঞ্জনাকে সে একটা এসি উপহার দেবেই। যে মেয়ের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে তুষার নামক এক অতি সাধারণ ছাপোষা চাকুরীজীবির ঘরণী হয়ে কষ্টে আছে — এই ভাবনাই তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। চোখের ভেতরটা কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছে।
মেট্রো থেকে নেমেই লেকমার্কেটে গেল সে। সুন্দর একটা গোলাপ ফুলের বোকে কিনল। আজ এটাই হোক নীলাঞ্জনার জন্মদিনের উপহার, দুদিন বাদে ক্রেডিটকার্ড হাতে এলে একটা বাতানুকুল যন্ত্র কিনে সামান্য স্বস্তি সে দিতে পারবে নীলাঞ্জনা নামের তার সেই দুর্লভ ভালবাসার মানুষটাকে। যদিও আজ বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত দশটা বেজে যাবে। কী আর করবে ইয়ার এণ্ডিং, ডেট লাইন এইসব চাপে ইচ্ছে থাকলেও তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোতে পারেনি সে।
ডোরবেলটা বাজলে নীলাঞ্জনাই দরজা খুলেছে। কী অপূর্ব লাগছে আজ তাকে। নতুন একটা শাড়ি পরেছে সে। এই শাড়িটা দিল্লি থেকে তার শাশুড়ি মা এনেছেন। মুখে প্রসাধনের ছাপ লেগে রয়েছে। কোথাও বেরিয়েছিল মনে হয়। ঘরে ঢুকতেই একরাশ খুশিতে ঝলমল করে উঠল ছোট্ট ঋতুন। “বাবা, জানো তো আজ না আমাদের বাড়িতে এসি এসেছে। আমাদের ঘরের মধ্যেই না এবার পাহাড় নেমে আসবে।” একটুখানি থেমে সে আবার বলে, “দেব আঙ্কেল বলেছে ঋতুনকে একটা পাহাড় দিয়ে গেলাম। পাহাড়ে যেরকম সবসময় ঠান্ডা থাকে, ঋতুন চাইলে তার ঘরও সবসময় ঠান্ডা থাকবে। আচ্ছা বলো, জন্মদিন তো মার তাও আঙ্কেল বলেছে গিফটটা ঋতুনের।”
তুষারের অবাক ও জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা দেয় নীলাঞ্জনাই। “আর বোলো না, শিবানীমাসি বিয়ের সময় আসতে পারেননি আমেরিকায় ছিলেন বলে। আজ এসেই আমার হাতে একটা চেক দিলেন। বললেন বিয়েতে আসতে পারিনি খুব আপশোস ছিল। আমি তো লজ্জায় মরে যাই। বললাম, সে ঠিক আছে কিন্তু এসব কেন মাসি? উনি কিছুতেই শুনলেন না। মাকে বললেন, নীলি কিন্তু আমারও মেয়ে এটা ভুলে যাস না কবিতা!” প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শাশুড়িও যোগ দেন, “তুমি অফিস রওনা হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে শিবানী এসেছিল। সেই কবে শেষ দেখেছিলাম ওদের। আমেরিকা যাওয়ার আগে দেব অবশ্য দিল্লিতে একটা রিসার্চ প্রোজেক্টের কাজে জেএনইউ-তে এসেছিল। ওখানে একোমডেশন থাকলেও আমার বাড়িতেই থাকতে বলেছিলাম শিবানীর ছেলেকে। নীলি তখন কলেজে পড়ে। ভালোই হয়েছিল, দেব নীলিকে পড়াও দেখিয়ে দিত। এত ভালো ছেলেটা। আর সবথকে ভালো লাগে খুব অমায়িক সে। সত্যিই গর্ব হয় ওর জন্য।”
এইসব প্রশংসা স্ততি আর অতীতের স্মৃতিচারণের মাঝে যে প্রশ্নটা ঝুলে রয়েছে তা হল, চেক দেওয়া তো হল, তার সঙ্গে এসি কেনার কী সম্পর্ক? দেবার্ক কি নীলাঞ্জনার সংসারে একদিন এসেই বুঝতে পেরেছে কী কষ্টে আছে সে? এই প্রখর গরমের শহরে যেখানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষের বাড়িতেই হয়ত একটা করে এয়ারকণ্ডিশনার রয়েছে সেখানে এই নীলাঞ্জনা নামের মেয়েটিই সে সুখ থেকে বঞ্চিত। আর তার পূর্বপরিচিত উচ্চপ্রতিষ্ঠিত আদ্যোপান্ত সফল এক যুবক একদিন এসেই ঘুচিয়ে দিল তার দুঃখ। এতে কি তুষার আনন্দ পাবে?
“দেখো না শিবানীমাসি আমেরিকা যাওয়ার আগে কিছু কেনাকাটি করবেন বলে আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সাউথসিটি মলে পাই ইন্টারন্যাশনালের একটা ইলেকট্রনিক্স আউটলেটের আজ উদ্বোধন হল, ১০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টও দিচ্ছে বিভিন্ন প্রোডাক্টে। মা বললেন, কিনেই ফেল আজ। ভাবলাম জন্মদিন আমার হলেও উপহারটা আমাদের দুজনেরই হোক। তারপর থেকে সারাদিন যা হ্যাপা গেল! এসি কিনলেই তো হল না, তাকে ইনস্টল করাও আরেক ঝামেলা। মিসেস বোস বলছিল কম্প্রেসারটা বারান্দায় লাগাতে। আমি অবশ্য ছাদেই লাগিয়েছি। পাইপটা একটু বেশি লম্বা লেগেছে এই যা। একটা কভার দিয়ে দিতে হবে যেমন রয়েছে মিসেস বোসদের।”
কথার পিঠে কথা চলতেই থাকে। তুষারের স্ত্রী, শাশুড়ি, তার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে ঋতুন তিনজনেই একটা বাতানুকুল যন্ত্র ঘিরে কত কথাই বলে চলেছে। তার খুব ক্লান্ত লাগছে এখন। সে ধীরে ধীরে শোবার ঘরে চলে আসে। এদের থেকে কিছুক্ষণ দূরে থাকার জন্যই এ ঘরে এসেছে সে। সবে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে, নীলাঞ্জনা এসে অতি উৎসাহে সদ্য কেনা এসিটা অন করে। কৃত্রিম ঠান্ডায় ঢাকুরিয়ার এই ফ্ল্যাটই যেন পাহাড়ি গ্রাম কল্পা। কল্পাতেই তো তারা মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিল।
নীলাঞ্জনা খাবার গরম করছে। ঋতুন ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ শীত করে উঠল তার। ঋতুনের গায়ে একটা চাদর চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল সে। আজ ছেলেটার বদলে দুটো বাচ্চা একাই শুয়ে আছে ফুটপাথের এক ধারে। প্লাস্টিকের শিটের ভিতর বোধহয় আলো জ্বলছে মনে হল তুষারের। ছেলেটা কি ভেতরে? না, ছেড়ে চলে গেছে তার ফুটপাথের সংসার? নীলাঞ্জনা টেবিলে খাবার বেড়ে ডাকতে এসেছে। পিঠের উপর তার হাতের স্পর্শ। না, ছেলেটা ছেড়ে চলে যায়নি। পলিথিনের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল এইমাত্র। লুঙ্গির খুটটা বাঁধতে বাঁধতে বাচ্চাদুটোর পাশে এসে শুয়ে পড়ল।
আজ রাতে খাওয়ার ইচ্ছে একদমই ছিল না তুষারের। তবু সে কোনও কথা না বলেই চুপচাপ খেয়ে নেয়। শরীর নয়, ক্লান্ত মনটাকেই বিছানায় ফেলে দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আজ নীলাঞ্জনা নিজে থেকেই খুব নিবিড় হয়ে আসে তার কাছে। নীলাঞ্জনার ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাস টের পায় তুষার। এই প্রথম তার মনে হল শরীরী ছোঁয়া শুধুই একটা মাংসের স্পর্শ! যেন কোনও উন্মাদ ছুরির ফলায় টুকরো হয়ে পড়ে আছে নিঃশ্বাসহীন প্রাণ। রাস্তায় শুয়ে থাকা ছেলেটার হা’মুখ মনে পড়ছে তুষারের। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে না, তবু জলের শব্দ শুনতে পায় সে। আর চাইলেও বোধহয় জেগে উঠবে না কোনও দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা। একটা কৃত্রিম ঠান্ডা যন্ত্র তার ভিতরের সমস্ত উষ্ণতাটুকু নিয়ে চলে গেল বোধহয়।