শুভ্রদীপ চৌধুরী
ঘটনা সকালের, হাতের খৈনি ঠোঁটে নেবার মতো মিহি হয়ে এসেছে দেখে সবে মাথাটা উঁচু করতেই বিরজু দেখল তার সামনে একটা চিতাবাঘ! বড়জোর হাত পাঁচেক দূরে। বিরজুর পা যেন পুঁতে দিয়েছে কেউ। ভয়ে সে কাঁপতে লাগল।
চার মিনিট পর
দুটো চকলেট বোম ফাটানো হল। ক্যানেস্তারা পিটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে একটা বড় দল এগিয়ে গেল বাঘটার কাছে। বাঘটা পালিয়ে গেল না দেখে দু একজন ঢিল ছুড়ল। বাঘটা তবু নড়ল না। এবার অনেকের সন্দেহ হল। তবে কী?
যা ভাবা তাই হয়েছে। মরা বাঘ!
সাত ঘণ্টা পর
ময়না তদন্তের জন্য মৃত বাঘটিকে বনবিভাগের কর্মীরা বাঘমারা জাতীয় উদ্যানে নিয়ে গেল। এরপর দুজন এল বাইক নিয়ে। একজনের হাতে বুম, অন্যজনের হাতে ক্যামেরা। ওরা খোঁজখবর নিয়ে বিরজুর বাড়ি গেল। বিরজুকে প্রচণ্ড ভাদ্রের দুপুরে চাদর গায়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করাল তারা। চাদর ছাড়া উপায় ছিল না। বিরজুর বুকের খাঁচাটা বড্ড খারাপ দেখাচ্ছিল। বড়দের খারাপ লাগবে এবং ছোটরা ভয় পেতে পারে বলে এই ব্যবস্থা।
সাক্ষাৎকার পর্ব
সাংবাদিক: আপনিই তো প্রথম বাঘটাকে দ্যাখেন বিরজুবাবু?
বিরজু: হবা পারে, আবার নাও হবা পারে। ধরেন অন্য কেউ দেখিচে তারপর পালাইচে। হবাই পারে!
ক্যামেরা ম্যান: ওহ্!
সাংবাদিক: হ্যাঁ কিংবা না বলুন।
বিরজু: দুটাই! মুই অত ছোট করে কবা পারমু না।
সাংবাদিক বিরক্ত মুখে বলতে লাগল, এই সেই জায়গা বন্ধুরা যেখানে জনৈক বিরজু ওঁরাও বাঘটাকে দ্যাখেন। তারপর বাঘটার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান।
বিরজু: মুই ধুলা ছেঁটাওনি স্যার! সেটা অন্য কেউ দিবা পারে।
ছেলে দুটো অত্যধিক বিরক্ত মুখে চলে যায়।
সন্ধের খবর
বনবিভাগের দুজন অফিসার এল বিরজুর বাড়িতে। বিরজু হাড়িয়া খাচ্ছিল সঙ্গে নুন আর কাঁচা লংকা।
অফিসার: বাঘটাকে তুই প্রথম দেখেছিলি?
বিরজু: হবা পারে আবার নাও হবা পারে। মোর নেশা হয় নাই স্যার।
অফিসার: তোর হাতে কী ছিল? বাঘটাকে কেমন করে মারলি বল?
বিরজু: মোর হাতেত খৈনি ছিল। হামার বন্ধু ছাকলা কচ্ছিল মোর হাতেত থাকা খৈনি বাঘের চোখেত পড়ে…
অফিসার: যা বলছি তার উত্তর দে। তুই পালিয়ে আসার পর কতজন গিয়েছিল বাঘটাকে মারতে? পঞ্চাশ, ষাট জন?
বিরজু: মুই তো গনোনি স্যার তাই কবা পারমু না।
অফিসার দুজন বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।
রাত বারোটা দশ
পুলিশের জিপ থামল বিরজুর দরজায়। তালপাতার ঢেঙ্গা সরিয়ে উঠোনে ঢুকে পড়ল তিনজন পুলিশ। হাঁড়িয়ার ফাঁকা হাঁড়িটা লাথি মেরে ভাঙল একজন।
বিরজু ছুটে এল ঘর থেকে।
পুলিশ (এক): তুই শালা বিরজু আছিস?
বিরজু: মুই বিরজু আছি, মোর শালার নাম জংলু আছে।
পুলিশ (দুই): শালা ঢ্যামনা! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে না থেকে বল কে মেরেছে?
বিরজু: মুই জানো না।
একটা চড় কষাল বিরজুর গালে। পুলিশ অফিসার এতেই শান্ত না হয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন উঠোনে।
পুলিশ (দুই): ছাড়ুন স্যার! এই শরীর নিয়ে বাঘমারা সম্ভব না। এদিকে আসুন কথা আছে।
পুলিশ (এক): কী?
পুলিশ (দুই): চোরাশিকারি নয়তো?
পুলিশ (তিন): ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত!
পুলিশ (দুই): দু চারজন জোয়ান তুলে নিয়ে যাই এই পাড়া থেকে।
রবীন্দ্র সঙ্গীত বেজে উঠল। কানে মোবাইল নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পুলিশ অফিসার টু, বাঁচলাম।
অন্য দুজন বলল, কী খবর?
–একটা লেপার্ড ঢুকে পড়েছে শহরে। এই কেসটা চাপা পড়ে যাবে। এক্ষুণি সমাধান সংবাদপত্রের পবিত্র ভড়কে খবরটা দিই।
পরদিনের সংবাদপত্র
এক লেপার্ডের আতঙ্কে শোরগোল পড়ে গেল জেলা শহরে। বুধবার রাত দশটা নাগাদ পুরসভার গান্ধীমূর্তির পাদদেশে জনবহুল রাস্তায় একটি লেপার্ড দেখা যায়। এলাকায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা ছড়ায়। আতঙ্কিত জনতার দাবি অনুযায়ী ছাগলের টোপ সমেত খাঁচা বসায় বন দপ্তর। প্রসঙ্গত এক সপ্তাহ আগেই এক মাস যাবত কার্যত লুকোচুরির পর শহরের এক শিশু পার্ক থেকে খাঁচা বন্দি করা হয় এক পূর্ণ বয়স্ক লেপার্ড। বন্দি সেই পুরুষ লেপার্ডের সঙ্গিনী শহরেই কোথাও লুকিয়ে আছে বলে ফিসফাস শুরু হয়। বুধবার রাতের ঘটনা তারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন ওয়াকিবহল মহল।
থানা এবং একটি গনগনে দুপুর
পুলিশ অফিসার আর সমাধান সংবাদপত্রের সাংবাদিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করছেন।
টিভি থেকে ভেসে আসছে, প্রিয়তমের খোঁজে শহরে ঢুকে পড়েছে প্রিয়তমা লেপার্ড।
পবিত্র ভড়: বাঘের খবরটা বেশ করে করেছিলাম। বনবিভাগের এ ডি এফ ও বিজন মুন্সির কাছ থেকে জেনেছিলাম বাঘটির মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল।
পুলিশ অফিসার: ছাড়ুন তো। ওসব একটু আধটু চোট সব্বার লাগে। কেউ মরে যায় কেউ মরে না। ছোটবেলায় আমি একবার খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।
পবিত্র ভড়: খবর অন্যরকম ছিল স্যার, আমার সোর্স বলছিল চা বাগানে গত কয়েকদিন ধরে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। না খেতে পাওয়া মানুষের মাঝে একটা মরা বাঘ!
পুলিশ অফিসার: ঐ বাঘের গল্প ছাড়ুন। লেপার্ড নিয়ে ফলো আপ করুন। আমার মিসেস আপনার লেখার ভক্ত।
পবিত্র ভড়: হা, হা, হা।
তিন দিন পর
তিনটে রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে বিরজু। যতবার চোখবন্ধ করেছে তার চোখের সামনে চিতা বাঘটা এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিন হলে সে কী করত কে জানে। সে দিনটা ছিল ভয়ঙ্কর দিন। ষোলজন ছাঁটাইয়ের লিস্টে তার নাম ছিল। কোথা থেকে সাহস এসেছিল কে জানে? চাঁই পাথরটা তুলে নিয়েছিল সে। নিজের কাজে এতটাই চমকে গিয়েছিল যে প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি নিজেকেই। পাথরটা আবার দূরে ফেলে দিয়ে ছুটে এসেছিল ঘরে। এখনও তার বিশ্বাস হয় না। সে একজন হাড় জিরজিরে দুর্বল মানুষ একটা বাঘ মেরে দিল!
বিরজু জানে কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। তবু সে তার শালাকে বলল। সব শুনে ওর শালা বলল, নেশা তোকে পাগল করে দিচে, তুই ঘুমা।
বিরজু হাসতে হাসতে বলল, যে দিন তোর নাম ছাঁটাই লিস্টে উঠবে সেদিন বুঝবু বাঘ মারা এমন কিছু কঠিন কাম না!