Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অণুনাটক প্রসঙ্গে

অণুনাটক প্রসঙ্গে -- মোহিত চট্টোপাধ্যায়

মোহিত চট্টোপাধ্যায়

 

অণুনাটক: প্রস্তাবনা

 

ইউরোপ আমেরিকায় দশ মিনিটের অণুনাটক বা মাইক্রো প্লে-র জয়জয়কার চলছে। এই ধারার নাটকের তুমুল জনপ্রিয়তার ঐতিহাসিক উৎস একটি নাট্যোৎসব — The Human Festival of New American Plays। ১৯৮০ সালে Actor Theatre of Luisville এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। তার তিন বছরের মধ্যে এই অণুনাটক প্লাবন নিয়ে এল। নাটকের ইতিহাসে সূচিত হল এক নতুন অধ্যায়।

এ নাটকের গতি বহুমুখী। মঞ্চে, স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে, পথে-ঘাটে, ঘরোয়া উৎসবে অণুনাটক ঠাঁই করে নিল। জায়গা করে নিল পাঠক্রমে। দেখা দিল Curtain Raiser হিসেবে বা দীর্ঘকালীন কোনও অনুষ্ঠানের অন্তর্বতী কালের বিরতির সময়, চর্চার বিষয় উঠল নাটকের ওয়ার্কশপে। চার-পাঁচটি অণুনাটক নিয়ে অনুষ্ঠান বিষয় ও প্রয়োগের বৈচিত্র্যে উপাদেয় অভিজ্ঞতার সুযোগ এনে দিল। এই সমস্ত গুণাবলি ও উপযোগিতার কারণে অণুনাটক রচনায় বহু নতুন নাটককারের আবির্ভাব ঘটতে লাগল। একই সঙ্গে মোমেট, ক্রিস্টোফার ডুরাঙ, ক্রেইগ লুকাস, অ্যাঙ্গাস উইলসন প্রমুখ সুবিখ্যাত নাটককার সমাজও এই অণুনাটক রচনার ব্রতী হলেন।

বিদেশে এ জাতীয় নাটক দশ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে, এটাই প্রচলন। তবে পাঁচ, দুই বা এক মিনিটের নাটকও ওদেশে লেখা হচ্ছে। আমরা দশ থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যে অণুনাটকের সময়সীমা রাখলেই ঠিক হবে মনে হয়। কারণ আমরা একঘণ্টা বা দু’ঘণ্টার নাটকে অভ্যস্ত হয়ে আছি, তাই হঠাৎ করে দশ বা পাঁচ মিনিটে চলে এলে দর্শকের উপভোগে অস্বাচ্ছন্দ্য আসতে পারে।

এই ধরণের কম সময়ের নাটককে আমি অণুনাটক বলতে চাই একটা বিশেষ কারণে। যা দু’ঘণ্টা বা একঘণ্টার নাটকে বলা যায় বা দেখানো যায় অণুনাটক তা পনেরো-কুড়ি মিনিটে বলতে বা দেখাতে চায়, ছোট্ট মুঠোর মধ্যে আকাশটা ধরে রাখার আশঙ্কা করে। এটা শক্ত কাজ। এ কারণেই অণুনাটক একটা challenging dramatic format। একটা আদর্শ অণুনাটকের মধ্যে একটা miniature world স্থাপন করা যায়। এক্ষেত্রে এ নাটক atomic expression of a big thing। এই আণবিক গুরুত্বের দিকটা মনে রেখেই এ ধরনের নাটকের অণুনাটক নামটি সঙ্গত হয়ে উঠতে পারে।

অণুনাটকের বৈশিষ্ট্য

 

১। অণুনাটক আয়তনে ছোট হলেও তাকে একটি সম্পূর্ণ নাটক (complete play) হয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ একটি বড় মাপের বা ১ ঘণ্টার স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক যে যে শর্ত মেনে, যে structure অনুসরণ করে রচিত হয় অণুনাটকের সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই নাট্যধর্ম বজায় রেখেই চলতে হবে। তবে গঠনের সব দিকটাতেই একটা দ্রুততা থাকবে। অথচ দর্শক যেন না ভাবেন নাট্যবিষয়কে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।… যা দু’ঘন্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে বলা যায় তা পনেরো মিনিটে বলব — এটাই challenge।… আমাদের অণুনাটক দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যে হলে ভালো হয়।

২। কম সময়ের নাটক বলেই শুরুতে exposition ইত্যাদিতে সময় খরচ না করে কাহিনির বা subject-এর crisis থেকেই start করা যেতে পারে। সব ধরনের নাটকেই crisis না থাকলে চলে না। এখানেও তা থাকবে। সব নাটকেই মূল চরিত্রের একটা লক্ষ্যবিন্দু থাকে — সে কিছু করতে, পেতে বা নিজস্ব পথে চলতে চায়। যেখানে যখন বাধা আসে তখনই দেখা যায় crisis বা সংকট। তার থেকে দেখা দেয় tension, conflict। এই পরিস্থিতির  মধ্য দিয়েই নাটকের action চূড়ান্ত পরিণতি বা climactic ending-এ পৌঁছয়। অণুনাটক crisis থেকে শুরু করে এভাবেই চূড়ান্ত পরিণামের দিকে যাবে এবং তাহলেই তা complete play-র মর্যাদা পাবে।

নাটক যেখানে শেষ হবে তা যেন সহজ সমাধান না হয়। সংকটের নিষ্পত্তি শেষে করতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। উপসংহার open রাখাও যেতে পারে — দর্শক বা পাঠক নিজের মতো করে তা ভেবে নেবেন।

৩। এসব কারণেই আদর্শ অণুনাটক লিখতে শক্তিমান নাটককারের প্রয়োজন। ছোট্ট মুঠোর মধ্যে আকাশটা ধরে রাখার মতো প্রতিভার জাদু দরকার। চাই গভীর substance and unique style। নাটকের meaningful journey-র জন্য উপযুক্ত যোগ্যতাটাই অণুনাটকের শ্রেষ্ঠত্ব রচনা করতে পারে। মনে রাখতে হবে অণুনাটক is not easy to write, easy to manage only। বেশিক্ষণের নাটক নয়, তবে বেশিক্ষণ যাতে দর্শকের মনকে আচ্ছন্ন রাখে — তেমন অণুনাটক রচনাতেই সার্থকতা।

৪। ভয় হয়, অল্প সময়ের নাটক বলেই অনেকে জমিয়ে দেওয়ার জন্য লঘু বিষয় নিয়ে দর্শককে হাসাতে না ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দর্শক হাসবেন — এটা বড় কথা। কিন্তু তাঁদের কী দিয়ে হাসালাম, হাসি ছাড়া হাসি থেকে তাঁরা আর কী পেলেন এটাও আমাদের ভাবতে হবে। সরস অণুনাটক যথেষ্ট লেখা হোক, কিন্তু তা যেন সারবান হয়।

৫। অণুনাটকের কোথাও বাহুল্য থাকবে না — না সংলাপে, না চরিত্রের সংখ্যায়, না সেট ও আসবাবে। sub-plot থাকবে না, focus on one action। নাট্যবিষয় কোথাও থেমে থাকবে না — এই গতিশীলতা অণুনাটকের উপভোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়।

অণুনাটক কেন জনপ্রিয় হবে, কেন একটা প্রবল নাট্যান্দোলনের জন্ম দিতে পারে, তা আমরা এর বহুবিধ উপযোগিতার দিকগুলি নিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারি। এই উপযোগিতার কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি সংক্ষিপ্তভাবে:

(ক) একটি অনুষ্ঠানে ছ’টি অণুনাটক পরিবেশিত হতে পারে। এর ফলে নানা ধরনের নাটক তাদের বিভিন্ন theme, form এবং বিচিত্র স্বাদ দর্শকদের উপহার দেয়। এই বৈচিত্র্যের সম্ভার অণুনাটকের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে।

(খ) নাটককার, পরিচালক, অভিনেতা, দর্শক — সকলের কাছেই এ নাটক মূল্যবান। এ ধরনের নাট্যরচনায় নতুন নাটককার উৎসাহিত হয়, নির্দেশক অল্প আয়াসে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পান, অভিনেতার কাছে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের scope থাকে। এসবের যোগফলে দর্শক যে তৃপ্ত হবেন তাতে সন্দেহ নেই।

(গ) অণুনাটক যথার্থই উৎকৃষ্ট নাটক লিখতে শেখায়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবরকমের বাহুল্য বর্জন, বিষয়কে ঘনীভূত করে তোলা, লক্ষ্য বা focus-কে steady রাখা, tight action-এর মধ্য দিয়ে perfect মুহূর্ত রচনা ইত্যাদি নাটকের সৃষ্টিকাণ্ডের অনেক দিক এ ধরনের নাটক লেখার মধ্য দিয়ে উন্নত হয়।

(ঘ) নানা জায়গায় অণুনাটক করার সুযোগ আছে। মঞ্চে, স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, অফিসে-পাড়ায়, পথে, কোনও বড় নাটকের আগে curtain raiser হিসেবে বা দীর্ঘকালীন কোনও অনুষ্ঠানের অন্তর্বর্তীকালের বিরতির সময় এবং আরও বহুক্ষেত্রে এ নাটক পরিবেশিত হতে পারে।

(ঙ) বিভিন্ন নাটকের workshop-এ এই ধারার নাটক নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।