Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফেরেস্তার নিষ্ক্রমণ

সোহরাব হোসেন | সাহিত্যিক

অমর মিত্র

 

অনুজপ্রতিম সোহরাব হোসেন চলে গেলেন। আমাদের পরবর্তী কালের লেখকদের ভিতর সোহরাব ছিল প্রতিভাবান। খুব কম বয়সেই সরম আলির ভুবন, মহারণ-এর মতো উপন্যাস লিখে ফেলেছিল। আমার প্রিয় অনুজ লেখকদের মধ্যে সোহরাব পরম ভালবাসার জন। তাঁকে আমি নিয়মিত পড়েছি এক সময়। অসুস্থ হওয়ার পর সোহরাব লিখতে পারেনি। লিখতে না পেরে প্রায় চোখে না দেখে সোহরাব খুব কষ্ট পেয়েছে। লেখক এবং পড়ুয়া যদি না লিখতে পারেন, না পড়তে পারেন, সে বেদনার সীমা পরিসীমা নেই। শেষ মুহূর্ত অবধি তার ভিতরে লেখা ছিল। আমরা তা হারালাম। তার জন্ম এক সামান্য কৃষক পরিবারে। অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে সে। জীবন কেমন তা তার মতো আর কে-ই বা দেখেছে? কিন্তু সেই জীবন তার কাছে আনন্দের হল না শেষ পর্যন্ত। এত কম বয়সে চলে যাওয়া। সহ্য হয় না যেন।

সোহরাব ছিল কৃতি ছাত্র। কৃতি অধ্যাপক। বছর দুই আগে তার ছাত্র-ছাত্রীরা প্রিয় শিক্ষকের জন্মদিন পালন করেছিল। জন্মদিনকে আনন্দের দিন করে তুলেছিল। সেই সভায় দেবেশ রায় যেমন গিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন অতি তরুণ লেখকরাও। গিয়েছিলেন যেমন দেজ পাবলিশিঙের সুধাংশুবাবু, তেমনি করুণা প্রকাশনীর বামাচরণবাবু। সোহরাবের উপন্যাস গাঙ বাঘিনী প্রকাশিত হয়েছিল সেই সভায়। কত ছাত্র, অনুরাগী পাঠক, অধ্যাপক যে এসেছিলেন! আমি সেইভাবে অধ্যাপক সোহরাব হোসেনকে খুব ভাল চিনতাম না, চিনতাম লেখক সোহরাব হোসেনকে। আবার আমি যে অধ্যাপক সোহরাবকে চিনতাম না, তাও বলতে পারি না, অধ্যাপক সোহরাব হোসেনের সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ পড়ে সমৃদ্ধ হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। আধুনিক ছোটগল্প ও গল্পকার নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ পড়তে পড়তে টের পেয়েছি যে সোহরাব কত লেখকের কথা জানেন। সমকালকে কতভাবে জানেন! এই সমস্ত প্রবন্ধ পরীক্ষা পাশের সাঁকো নয়, সেই অর্থে অ্যাকাডেমিক নয়, বরং সাহিত্যোৎসাহী মানুষের অনেক কৌতূহলকে উসকে দেবে।

আমি সোহরাবকে চিনতাম অনেক বছর। তাঁর বাড়ি আমি গিয়েওছি। আমি ও আমার দাদা। মেটে-আড়বেলে। আর একটু দূরে বসিরহাটের লাগোয়া দণ্ডীরহাট গ্রামে আমার শৈশবের অনেকটা কেটেছে। এ ব্যতীত আমার চাকরি ক্ষেত্রের কয়েকটা বছর ঐ অঞ্চলে কেটেছে। এই অঞ্চলের দরিদ্র, হতদরিদ্র মানুষের জীবন আমি যা দেখেছি শৈশব থেকে, তা প্রতিফলিত সোহরাবের লেখায়। উত্তর চব্বিশ পরগনার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের চাষী-বাসী মানুষের জীবন সোহরাবের লেখায় যেভাবে এসেছে, তা আমি আগে পড়িনি। একজন লেখকের নিজস্ব দর্শন তাঁর সাহিত্যে ছায়া ফেলে রাখে। দর্শনহীন লেখক যখন যা পারেন লেখেন, কী করে দ্রুত বাজারিয়া হয়ে উঠবেন তার কসরত চালিয়ে যান। কিন্তু প্রকৃত লেখক নিভৃতে নিরুপায় মানবজীবনের কথা লিখে যান। তাঁর মূল্যায়নে সময় লাগে। আমাদের ভাষার তিন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শ্রেষ্ঠ লেখকরা সেই পথেই গেছেন। এপার বাংলার সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান জীবনের কথা তেমনভাবে আমরা দেখতে পাই না। স্বাধীনতার পর বিচ্ছিন্ন কিছু লেখা হলেও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের হাত ধরেই হতদরিদ্র মুসলমানের প্রথম প্রবেশ বাংলা সাহিত্যে। আশ্চর্য সব গল্প আর মায়ামৃদঙ্গ, জানমারি, অলীক মানুষের মতো উপন্যাসে সিরাজ আমাদের চিনিয়ে দিয়েছেন এই বিপুল জনজীবনকে। তাঁর পর চিনিয়েছেন আফসার আমেদ, আবুল বাশার, আনসারউদ্দিন। তার পরেও আমরা দেখেছি আরও নবীন লেখক এই ব্রাত্যজীবনের কথা লিখতে এসেছেন। সোহরাব হোসেন এঁদের ভিতরে স্বতন্ত্র এক লেখক। তাঁর লেখায় দর্শন আছে। কী লিখবেন তা জেনেই তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছেন। সরম আলির ভুবন, মহারণ, মাঠ জাদু জানে-র মতো উপন্যাস তিনি লিখেছেন চল্লিশের ভিতরেই। অত কম বয়সে কাউকে অমন বিপুল ক্যানভাসে উপন্যাস লিখতে দেখিনি অনেকদিন। শারদীয় সংখ্যার মাপে উপন্যাস লিখতে লিখতে অনেক শক্তিমান লেখক বড় চালচিত্রে উপন্যাস লিখতে ভুলেই গেছেন। এইটি পরিতাপের বিষয়। আমাদের দেশটা বড়, আমাদের দেশে নানা ভাষা, নানা ধর্ম নিয়ে এক বিপুল জনজীবন ব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই বিপুল জনজীবনের কথা লিখতে হলে উপন্যাস বৃহৎ হবে। সোহরাব লিখেছেন। ঘরে বসে লিখেছেন, তারপর পাণ্ডুলিপি থেকে তা বই হয়েছে। কোথায় ধারাবাহিক লিখবেন, তার জন্য বসে থাকেননি। আমাদের দেশে দিনে দিনে ধনী দরিদ্রের তফাত বাড়ছে। নিরুপায় মানুষ সোহরাবের দোজখের ফেরেস্তা গল্পের সায়েব আলির মতো হেথাহোথা ঘুরে মরছে। আড়বেলে-মেটে, দেগঙ্গা, খোলাপোতা, বসিরহাট, টাকি আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে জড়িয়ে। আমি দেখেছি সায়েব আলি কিংবা রাকাছতুল্লাকে। কিন্তু তা বাইরে থেকে। সোহরাব রক্ত-মাংস সমেত এঁদের চিনিয়েছেন। সোহরাব আরও চেনাতেন। আমরা নিঃস্ব হলাম সত্যই। আমি সোহরাবের কয়েকটি গল্পের কথা বলি।

কী অসামান্য এক গল্প দোজখের ফেরেস্তা। ভূমিহীন ক্ষেতমজুর সায়েব আলি তার ছেলেপুলে নিয়ে অনাহারেই কাটায়। তার বউ এক মোল্লার বাড়িতে ঝিগিরি করে। তা বাদে বাগানে মোল্লার ছেলের সঙ্গে শরীরে মেলে। উপায় নেই সায়েব আলির। ঘরে তার ছেলেপুলে না খেয়ে থাকবে তাহলে। তবুও বউটার জন্য একবেলা খেতে পায় তো। সায়েব আলি আর জন খাটতে পারে না। মাস-আঁশহীন সায়েব আলির শরীর গেছে। তার সঙ্গে কাহিনির কথক মাস্টারের দেখা হয় মেটে হাটখোলায়। মাস্টারের কাছে সায়েব আলি গুড় কেনার জন্য দেড়টা টাকা চায়। এক কেজি আটা কিনতে পেরেছে, গুড় হলে হয়ে যায়। হাটখোলায় মোশারফ সেলাই কল চালায়। তার দোকানে গল্প-গাছা করতে আসে মাস্টার। সায়েব আলি তার পিছু ধরে। অনাহারী ক্ষুধার্ত সায়েব আলি। কাজ করতে পারে না, শুধু কবর কাটে কেউ মরলে। সে কাজ তো সবদিন হয় না। কথায় কথায় বের হয়, সায়েব আলি কবর দেওয়ার সময় একটা গন্ধ পায় মৃতের দেহ থেকে। সেই গন্ধে সে বুঝে যায় মুর্দা বেহেস্তে যাবে না দোজখে যাবে। দোজখে যাবে যে, তার দেহ থেকে পচা গন্ধ বের হয়। সায়েব আলি বলে, সেই গন্ধ যেন, এক বছর ধরে পচতে থাকা মরা ইঁদুরের গন্ধ যেমন হয়, তেমনি। বেহেস্তে যে যায়, তার দেহ থেকে ফুলের গন্ধ আসে সায়েব আলির নাকে। সায়েব আলি জানে সে এইটা পারে, এম,এ-বি,এ, পাশ করা মাস্টারের এই ক্ষমতা নেই। কিন্তু কদিন বাদে সায়েব আলির এই ক্ষমতাই তার বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। মৃতের আত্মীয়-স্বজন সব সময়ই সায়েব আলির কাছে জানতে চায়, কোথায় গেল মুর্দা, বেহেস্তে না দোজখে। সায়েব আলি সব লাশ থেকেই পায় দোজখের পচা ইঁদুরের গন্ধ। মিথ্যে বলতে পারে না। ফলে তার কবর খোঁড়ার কাজও যায়। হাবা হ্যাংলা মানুষ সায়েব আলির ভিতরে মাস্টার দেখতে পায় যেন ফেরেস্তার মুখ, না হলে সে কী করে বেহেস্ত বা দোজখের গন্ধ পায়? এই সময় শোনা যায়, সায়েব আলির বউ পালিয়েছে মোল্লার ছেলের সঙ্গে। মাস্টার সায়েব আলির কাছে যায় সমবেদনা জানাতে। সায়েব আলি বলে, খেতে দিতে পারে না, পরতে দিতে পারে না, বউ তো পালাবেই। মাস্টার দেখে, অনাহারী ছেলেপুলেগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে। সায়েব আলিকে মাস্টার পরামর্শ দেয়, কেন সে বলে না সবাই বেহেস্তে যাবে। সায়েব আলি বলে, শুধু দোজখের গন্ধ পায় সে, দুনিয়ায় বুঝি সব পাপী-তাপী মানুষ, সে মিথ্যে বলবে কী করে? মিথ্যে বলতে নেই তার। মাস্টার মুখ্যু বলেই তাকে মিথ্যে বলার পরামর্শ দিচ্ছে। তারপর সায়েব আলি জিজ্ঞেস করে, পচা গন্ধ পাচ্ছে মাস্টার? মাস্টার না বলতে, সায়েব আলি বলে, তার নিজের মরার সময় ঘনিয়ে এসেছে, বউ চলে গেছে, জন-মজুরি জোটে না, তার দেহ থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে। তার নিজের কপালে দোজখ লেখা আছে……। কোন জায়গায় নিয়ে গেলেন সোহরাব এই গল্প ! বেহেস্তের মানুষের গল্প শোনালেন সোহরাব অনন্য এক কথনশৈলীতে। এই লেখক নিজেই যেন দোজখের ফেরেস্তা। তিনি গন্ধ পেতেন মানুষের ঘাম আর রক্তের। লিখতেন। মহৎ লেখককে আমার ভালবাসা।

আর এক গল্প, ছায়া প্রলম্বিত। এই গল্পটি দাঙ্গার পটভূমিতে লিখেছিলেন সোহরাব। এই গল্প বছর সত্তরের বুড়ো চাষা রাকাছতুল্লার। সে প্রায় চালচুলোহীন, সামান্য জমির চাষা রাকাছতুল্লা পাকা ধান পাহারা দিতে জমির ধারে টং ঘরে এসে উঠেছে কারফিউয়ের রাতে। দূরে আগুন জ্বলছে। আল্লা হো আকবর, নারায়ে তকদীর আর জয় শ্রীরাম ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই কারফিউয়ের সময়ও রাকাছতুল্লাকে আসতে হয়েছে ধান পাহারা দিতে। নইলে পেকে ওঠা ধান রাতারাতি কেটে নিয়ে যাবে চোরে। রাকাছতুল্লা দাঙ্গাকে ভয় করে। চাষা রাকাছতুল্লা গাঁয়ের মিটিঙে বসে দাঙ্গা বাঁধানোর বিপক্ষে কথা বলে। এতকাল হিন্দু মোছলমান এক সঙ্গে বাস করছে, এখন এসব বললে হবে কেন? কিন্তু জোয়ান, মাথা গরম ছেলেরা তো পারলে তখনি ছুটে যায় কিছু একটা করে ফেলতে। রাত দুপুরে অন্ধকারে দাঙ্গার আগুন দেখে ভয় হয় বুড়োর। সেই সময়ই সে টং ঘর থেকে দেখে কেউ একজন এসেছে অস্ত্র হাতে। তাকে মারতেই এসেছে নিশ্চিত। দাঙ্গার সময় এমন ঘটে থাকে। ভয় অবিশ্বাস সব জাঁকিয়ে বসে মানুষের ভিতর। সেই গল্পই লিখেছেন সোহরাব অসম্ভব এক মুন্সিয়ানায়। ভয় থেকে জন্মায় বিভ্রম। বিভ্রমে পড়ে রাকাছতুল্লা নিজের হাতের অস্ত্রে নিজেই হত হয়। ছায়ার সঙ্গে ছিল তার যুদ্ধ। দাঙ্গা নিয়ে লেখা আমার পড়া শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির সঙ্গে একাসনে বসতে পারে এই গল্প। সোহরাবের গদ্যের ভিতরে ছিল এক লৌকিক উচ্চারণ। লিখিত ভাষা আর কথ্য ভাষার মিশ্রণে সোহরাব খুবই সাবলীল। পড়তে পড়তে চরিত্রগুলিকে ভাল চেনা গেছে।  আর এক গল্পের কথা বলি।

বায়ুতরঙ্গের বাজনা। এই গল্প এক প্রহরীর। রাতে ডিউটি করে সে বড় পুলিশ কর্তার বাড়িতে। কিন্তু অতবড় রাত তার কাটে কী করে? অদ্ভুত এই গল্পের ভাবনা। কিছুটা অলীক এই কাহিনি। রূপকাশ্রয়ী। এই গল্পে সোহরাবের চরিত্র প্রেমহরি এক জায়গায় বলছে, “… আসলে ছার এটা তো ইন্টারনেট আর কেবল লাইনের যুগ। দিনরাত্তির সব-সময় বিদেশ থেকে কত কিসিমের ছবি সব আমাদের বাতাসে ভেসে আসছে।…..আর তাই উড়ে যেতে যেতে বাইচান্স আমাদের বাড়ির বাতাসে ভেসে উঠেছে। আপনার ঘরে তো ছার অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। বিজ্ঞানের যুগ ছার, কোন মেসিন কোন সংকেত যে ধরে ফেলে তা বলা যায় নাকি? আসলে কমিউনিকেশন টেকনোলজি যেমন মানুষকে দিয়েছে অনেক নৈকট্য, তা ঘরে ঘরে বিষের ধোঁয়াও ঢুকিয়েছে। বিশ্বায়ন আমাদের সমস্ত দুয়ার আলগা করে দিয়ে অনিষ্ঠকারী ভোগবাদে জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেই কথাই কি বিচিত্রভাবে বলেছেন সোহরাব। পড়তে পড়তে মুগ্ধ হতে হয় কাহিনির নানা আশ্চর্য ঘটনায়। একটি কথা বলার জন্য কত কথার আশ্রয়ে না যেতে হয় লেখককে। আর তাহলেই লেখা মর্মমূলে প্রবেশ করে।

কত অসামান্য সব গল্প আছে সদাহাস্যময় সোহরাবের। ভালোবাসা সোহরাব। অনেক ভালোবাসা। লেখক তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা। তুমি বেহেস্তেও যাবে না, দোজখেও নয়। মাটিতে মাটি হয়ে যাবে। হ্যাঁ, যদি বেহেস্তেই যাবে তার জন্য মারণ ব্যাধি কেন? বেঁচে থাকতে এত কষ্ট কেন? অন্ধ ঈশ্বর দেখেন না কিছুই।  দেখলে কি এমন বয়সে চলে যেতে হয় এমন দেবদূতের মতো লেখককে। সোহরাবের পুত্র সোহমের সঙ্গে বইমেলায় দেখা হয়েছিল। অনেক বড় হয়ে গেছে। কী কথা হয়েছিল মনে পড়েও পড়ছে না। সোহম মায়ের পাশে থেকো। বাবা তোমাদের পাশে আছেন। সোহরাব আছে। তার লেখা নিয়ে আছে। কোনও মৃত্যুদূত লেখককে নিয়ে যেতে পারে না। আর কী লিখব? অনুজের মৃত্যু-শোকগাথা অগ্রজ কতটাই বা লিখতে পারেন?