বিমান নাথ
উপনিষদের যুগে এক বিতর্কে গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে কিছু আছে কি না। এই ব্রহ্মাণ্ড কীসে ওতপ্রোত? তখন যাজ্ঞবল্ক্য নাজেহাল হয়ে বলেছিলেন যে আর প্রশ্ন করলে গার্গীর মাথা খসে পড়বে।
বর্তমান যুগের এক বিজ্ঞানী এমন এক সাংঘাতিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের সাহায্যে। তাঁর অঙ্কে এমন এক সম্ভাবনার কথা জানা যায় যে আমাদের মহাবিশ্বের মতো অগুনতি মহাবিশ্ব রয়েছে। সদ্যপ্রয়াত এই বিজ্ঞানীর নাম স্টিফেন হকিং।
তাঁর আরেক নাম ছিল চূড়ান্ত প্রতিবন্ধকতাকে তুড়ি মেরে নিজের নিয়মে বাঁচার অদম্য ইচ্ছা।
একুশ বছর বয়সে যখন ধরা পড়ে যে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন, যা ধীরে ধীরে তাঁর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে অকেজো করে দেবে, তখন তিনি সবেমাত্র পি এইচ ডি-র জন্য গবেষণা শুরু করেছেন। ডাক্তাররা নিদান দিয়েছিলেন বেশি হলে দুই থেকে পাঁচ বছর বাঁচবেন তিনি। সেই সময় থেকে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে তিনি আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে একমাত্র মনোবলের জোরে লড়াই করে গিয়েছেন। কোনওরকমে বেঁচে থাকার জন্য নয়। কারও সঙ্গে, কিছুর সঙ্গে আপোষ না করে বাঁচার জন্য।
যখন এক এক করে তাঁর শরীরের ক্ষমতা লোপ পেয়েছে, তাঁর মন যেন আরও মুক্তবিহঙ্গের মতো মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। শুধু বিজ্ঞানের আঙিনায় নয়, পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থার দিকেও তাঁর নজর ছিল। ইসরায়েল-এর প্যালিস্তিনিয়-নীতির সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে তিনি জেরুসালেম-এ বৈজ্ঞানিক সম্মেলন বয়কট করার ডাক দিয়েছেন। তাঁর গবেষণার ফলস্বরূপ চিন্তার যেসব নতুন জানালা খুলে দিয়েছেন সেই সবের জন্য তো বটেই, তাঁর এই অনমনীয় এবং প্রাণবন্ত জীবনযাপনের জন্যও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখবে।
তাঁর গবেষণার দিকে নজর দিলে একটি দিক সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। যে বিষয়কে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হয়, সেখানে তিনি মণিমাণিক্য খুঁজে পেয়েছেন। যেখানে অন্য কেউ ভাববে কোনও সম্পর্ক নেই, সেখানে তিনি দেখেছেন ভাবনার অপূর্ব সম্ভাবনা। ট্রাপিজের খেলার মতো অনায়াসে তিনি পদার্থবিদ্যার এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে লাফ দিয়ে তাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন।
তাঁর গবেষক জীবনের প্রথম দিকে নজরে আসে রজার পেনরোজের কষা ভারী নক্ষত্রের অবশ্যম্ভাবী সঙ্কুচনের অঙ্ক। এই অঙ্কের সাহায্যে বোঝা যায় যে এক সময় এই নক্ষত্রের চারিদিকে দেশ বা স্পেস্ এমনভাবে বেঁকে যাবে যে সেখান থেকে আলোও বেরোতে পারবে না। অর্থাৎ সেটা একটা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। আইনস্টাইনের প্রবর্তিত মহাকর্ষের নিয়মে এটা অবধারিত। কারণ আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে মহাকর্ষ আসলে দেশ-এর জ্যামিতি বদলের যাওয়ার ফল। কোনও ভারী বস্তুর চারিদিকে দেশ বেঁকে যাবে, আর তখন সেই বাঁকা পথে অন্যান্য পদার্থ তার চারিদিকে ঘুরবে। তাহলে যখন বস্তুর ভর খুব বেশি হবে, তখন দেশের এই বেঁকে যাওয়ার মাত্রাও হবে বেশি। পেনরোজের অঙ্কে দেখা গেল যে মহাকর্ষের প্রভাবে নক্ষত্র সঙ্কুচিত হতে হতে যখন এক সময় আসবে যখন দেশ-এর ওই অঞ্চলে পদার্থবিদ্যার নিয়ম খাটবে না। সেখানে অঙ্ক কষে কোনও অর্থপূর্ণ ফল পাওয়া যাবে না।
তরুণ স্টিফেন হকিং এই অঙ্কের মধ্যে এমন এক সম্ভাবনা দেখেছিলেন যা পেনরোজেরও নজরে পড়েনি। হকিং এই অঙ্কে সময়ের গতি পালটে দিয়ে দেখলেন যে নক্ষত্রের শেষ মুহূর্তের বদলে মহাবিশ্বের আদি মুহূর্তের কথা ভাবা যেতে পারে। এবং সেখানেও দেখা গেল যে এমন এক মুহূর্ত অবশ্যম্ভাবী যখন পদার্থবিদ্যার নিয়ম কাজ করে না। একে মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্ত ভাবা যেতে পারে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব অনাদি নয়, কোনও এক বিশেষ মুহূর্তে তার জন্ম হয়েছিল। এর জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই, গাণিতিক নিয়মেই এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব।
এমন আরেকটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে ভাবার সময় সাধারণত আমরা মহাকর্ষের নিয়ম ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। কিন্তু এক তরুণ বিজ্ঞানী জেকব বেকেনস্টাইন এই ক্ষেত্রে মহাকর্ষের সঙ্গে তাপবিজ্ঞানের একটি অদ্ভুত সম্পর্কের কথা বলেছিলেন। কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে এক ধরনের দিগন্তের কথা ভাবা যায় যার ভিতর এবং বাইরের অঞ্চলের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল আছে। এই দিগন্ত অতিক্রম করলে পদার্থের সঙ্গে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ থাকবে না। চিরতরে হারিয়ে যাবে।
এবার এই দিগন্তের ক্ষেত্রফলের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। কোনওমতেই এই ক্ষেত্রফল কমার কথা নয়। এই বৈশিষ্ট্য পদার্থবিদ্যার আরেকটি সূত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাপবিজ্ঞানের মতে যে কোনও (বিচ্ছিন্ন) অঞ্চলের বিশৃঙ্খলা কখনওই কমতে পারে না।
তাহলে কি কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে তার মধ্যে নিহিত বিশৃঙ্খলার কোনও সম্পর্ক আছে? এই সম্পর্ক যদি সত্য হয়, তাহলে এর পরিণতি হবে অভাবনীয়। তাপবিজ্ঞানের মতে বিশৃঙ্খলার সঙ্গে তাপমাত্রার সম্বন্ধ আছে। তাহলে কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রার কথাও ভাবতে হয়! কিন্তু যে কোনও উষ্ণ পদার্থ তো তাপ বিকিরণ করে। তাহলে কি কৃষ্ণগহ্বরও বিকিরণ করে?
কৃষ্ণগহ্বর থেকে যদি আলোই না বেরোতে পারে, তাহলে অন্য কিছু বেরোবে কী করে? কারণ তাপ বিকিরণের মাধ্যম হল আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। বেকেনস্টাইনের বক্তব্যে পদার্থবিজ্ঞানীরা এক দুরূহ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
সমস্যাটা দুরূহ কারণ এর সমাধান করতে হলে পদার্থবিদ্যার দুই স্তম্ভ — মহাকর্ষ এবং কোয়ান্টামবিদ্যার সমন্বয় ঘটাতে হবে, যা এখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু স্টিফেন হকিং সত্তরের দশকে অঙ্ক কষে দেখালেন যে এই দুই বিষয়ের পুরোপুরি সমন্বয় না করেও কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ বোঝা সম্ভব। তাঁর অঙ্কে জানা গেল যে সত্যিই কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে বিশৃঙ্খলার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। এই সমীকরণটি হকিং-এর এক বড় আবিষ্কার — যে সমীকরণকে তিনি তাঁর স্মৃতিফলকে খোদিত করার জন্য শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
এর ফলে জানা গেল যে কৃষ্ণগহ্বর ধীরে ধীরে শক্তি (যার আরেক নাম ভর) বিকিরণ করে একদিন মিলিয়ে যাবে। শেষ মুহূর্তে যখন তার ভর খুব কম হয়ে আসবে, তার তাপমাত্রা হবে প্রচণ্ড বেশি। তখন এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সে আত্মাহুতি দেবে। মহাবিশ্বে এমন অনেক জরাগ্রস্ত কৃষ্ণগহ্বর হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো তাদের চিতার শেষ আগুনের ঝলকও বিজ্ঞানীদের যন্ত্রে কোনওদিন ধরা পড়বে।
কিন্তু একটি সমস্যার সমাধান হলেও এই ‘হকিং বিকিরণ’ আরেকটি সমস্যার মুখে ফেলে দেয় আমাদের। হকিং-এর মতে এই বিকিরণের ধর্ম অন্য তাপ বিকিরণের মতো। তার মধ্যে কোনও সঙ্ঘবদ্ধতা নেই। অর্থাৎ বিশৃঙ্খলতার পরিমাণ বাড়বে বই কমবে না। কিন্তু তাহলে কি মহাবিশ্বে তথ্য একে একে নষ্ট হয়ে যাবে? ধরা যাক কোনও সাহিত্যের বই একটি কৃষ্ণগহ্বরে ফেলে দেওয়া হল। সেই সাহিত্যকর্মের মধ্যে যে সঙ্ঘবদ্ধতা ছিল তা হারিয়ে যাবে। এই তথ্য হারিয়ে যাবে। বা যার কিছু সম্ভাবনা ছিল যে যদি কখনও কৃষ্ণগহ্বরটি থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে সেই তথ্য পুনরায় গুছিয়ে নেওয়া যাবে। হকিং বিকিরণের ফলে সেই সম্ভাবনার গুড়ে বালি।
তাহলে কি আমাদের মহাবিশ্বে তথ্য নশ্বর? এই প্রশ্ন নিয়ে এখনও পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। নানান পদ্ধতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দলের বিজ্ঞানীরা। হয়তো ভবিষ্যতে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে।
স্টিফেন হকিং-এর বিজ্ঞান চর্চার আরেকটি অসামান্য দিক ছিল সাধারণ পাঠকদের জন্য বিজ্ঞানের খবর পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা। নিয়তি তাঁকে চলৎশক্তিহীন করে রেখেছে। এক সময় নিউমোনিয়ায় ভোগার পর তাঁর বাকশক্তিও চলে যায়। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তিকে হারায় কে? তাঁর প্রথম বই ছিল ‘মহাবিশ্বের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এই নামে। এই বইয়ের মধ্যে উল্লিখিত গবেষণার ফলগুলি সাধারণ পাঠকের পুরোপুরি বোধগম্য হওয়ার কথা নয়, কারণ এই ধরনের গবেষণা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য গণিতের অনুশীলন প্রয়োজন। তবু এই বইটি প্রকাশনার জগতে সাড়া জাগিয়েছিল। প্রথমে বোঝা যায়নি। কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু যখন বইয়ে একটি ছবি উল্টো ছাপা হয়েছে ধরা পড়ার পর প্রকাশক বাজার থেকে বই তুলে ফেলতে চেয়েছিলেন, তখন ধরা পড়ল কত হাজার হাজার কপি ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে!
তার পর আরও কয়েকটি বই লিখেছিলেন। সবগুলোই পাঠকরা লুফে নিয়েছেন। কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে। কারণ ততদিনে সাধারণ মনশ্চক্ষে হকিং এক ধরনের সেলিব্রিটি বিজ্ঞানীর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
এমন অবস্থার একটি উল্টোদিকও আছে। তিনি কিছু বললেই সেটা নিয়ে মাতামাতি শুরু হত। কিছুটা বুঝে, বেশিরভাগ না বুঝেই। তার বক্তব্যকে প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যাওয়ার ফলে ভুল বোঝাবুঝিটাই বেশি হত হয়তো।
কিন্তু তিনি তার পরোয়া করেননি। কে কী বুঝল বা না বুঝল তার দুশ্চিন্তায় নিজের নিয়মে বাঁচার ক্ষেত্রে আপোষ করেননি। বিজ্ঞানমনস্কতা তার ধমনীতে বইত। যেহেতু তাঁর অঙ্কে দেখেছিলেন যে বর্তমান থেকে কখনও অতীতে যাওয়া সম্ভব না — কল্পবিজ্ঞানের গল্পে যত উদ্ভট কল্পনাই থাকুক না কেন — তাই তিনি একবার নিজের জন্মদিনে পরীক্ষা করেছিলেন সত্যিই এমনটা সম্ভব কি না। জন্মদিনে কাদের ডাকবেন তার একটি তালিকা বানিয়ে কাউকে না জানিয়ে বাড়িতে অপেক্ষা করেছিলেন কেউ আসে কি না দেখার জন্য। যদি ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে যাওয়া সম্ভব হত তাহলে কেউ হয়ত এই খবর পেয়ে চলে আসত।
এমন একটি জীবন যাপনের কথা ভাবলে সত্যি মনে হয় জীবন হল একটি প্রার্থনার গান। আর স্টিফেন হকিং ছিলেন তার প্রকৃত উপাসক।