অনির্বাণ ভট্টাচার্য
প্রিয় স্টিভ,
নামটা বলতেই তোমাদের দেশের আরেকটা লোকের কথা মাথায় আসে। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড ব্রো। নিরানব্বইের সুপার সিক্স। হেডিংলি। ৫৬ রানে ব্যাট করছে লোকটা। যখন নেমেছিল ৪৮/৩। লোপ্পা ক্যাচ। ল্যান্সের বলে মিড উইকেটে। ধরেও সেলিব্রেট করতে গিয়ে ফসকাল বিশ্বস্ত হার্সেল। মনে মনে বললাম, স্কুটার (হ্যাঁ, ওই নামেই ডাকতাম হার্সেলকে), তুমিও? আর সেই স্টিভ, তোমাদের স্টিভ, কী বলল জানো, ক্যাচ না, তুমি কাপটা ফস্কালে গিবস। পরেরটুকু তুমি জানো স্টিভ। যাই হোক, যেকথা বলছিলাম। কেমন আছ? ওরা বছরখানেক ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে বলেছে। আরও এক বছর নাকি তুমি ব্যাগি গ্রিন পড়তে পারবে না। ক্রিকেট। আঃ। এই শব্দটার থেকে দূরে? থাকা যায়? আমাকে দেখো না! বাবা ইউয়ি। বোন হেস্টার। ওর মেয়ে আলেকসান্দ্রা। আমার বার্থা। ওর ঘরে আসা নতুন এক মানুষ, ডু প্লেসি। ওদের দুই ছেলে। সবাই ক্রিকেটে। আমার ছবি, ট্রফি, ঘরের দেয়ালে দেয়ালে। এখনও ওরা, ওরা সবাই ভীষণভাবে ক্রিকেটের ভেতরই আছে। টিভিতে ক্রিকেট। অস্তিত্বে ক্রিকেট। শুধু খেতে বসলে একটা চেয়ার ফাঁকা রেখে দেয়। স্টিভ, কষ্ট পেও না। যারা নির্বাসন দিয়েছে, তারা তথাকথিত ক্রিকেট মাঠের কথা বলেছে। জীবনে ক্রিকেটের কাছে থাকা দূরে থাকা ওদের হাতে নেই। চালাও মেট। পিটার। তোমার বাবা। প্রেস কনফারেন্সে তোমার পিঠে হাত। ‘দেশকে ডুবিয়েছি, কষ্ট দিয়েছি, বাবা, মা, তোমাদেরও। পারলে ক্ষমা করো।’ জল, তোমার, তোমার জনকের। একদিন শুকোবে স্টিভ। ঠিক যেমন সিডনির গ্যারেজে তোমার ক্রিকেট কিট অসম্ভব এক অনিশ্চিত সময়ের জন্য নির্বাসন দিতে দিতে বৃদ্ধ বলে উঠবেন ‘মাই সন। হি উইল সারভাইভ। হি উইল …।’ প্রিয় স্টিভ, গিলিয়ান। তোমার মা, ব্রিটিশ। একদিন, এরকম এক দোনামোনায় মনে আছে, ভেবেছিলে ইংলন্ডেই শুরু করবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবন? অফার তো ছিলই। সারে কান্টির কাছ থেকে বছরে তিরিশ হাজার পাউন্ড। স্টিভ, তুমি তো আসোনি তাও! হৃদয়, জন্মভূমি, ব্যাগি গ্রিন, অস্ট্রেলিয়া, তোমার ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, যারা হারার আগে হারতে জানে না, তোমাকে আটকে রাখে। কেউ না, আর কেউ না, একদিন তুমি নিজেই ঠিক করলে খেললে এদেশেই খেলবে। মিনাই হাইস্কুল। স্টিভ, মনে আছে? সতেরো বছর। হাই স্কুল সার্টিফিকেটে ফেল মার্ক্স। স্কুল ড্রপআউট। আর তোমার কোচ ট্রেন্ট উডহিল। বললেন, ক্রিকেট, স্টিভ, ওটাই তোমার রক্তে। বই না, হাতে ব্যাট ধরো। তখনই তোমার লড়াইয়ের শুরু। সেই মিনাই। স্কুল। কলেজ। গ্রে কলেজ। আমার গ্রে কলেজ। তুমি যাওনি কোনওদিন মেট। ব্লুমফন্টেন। তোমার যেমন সিডনি। আমার, ব্লুমফন্টেন। আর গ্রে কলেজ। জোহান ভলস্টিড। হেডস্যার। আমার প্রথম কোচ। একদিন খেলা শেষে স্যারকে জড়িয়ে ধরলাম। স্যার, একদিন লর্ডসে খেললে আপনাকে নিয়ে যাব। খেললাম একদিন। তিরিশ বছর পর আমার দেশ প্রথম ইংলন্ড ট্যুর করল। স্যারকে বসালাম। দূর থেকেও দেখেছি চোখে জল চিকচিক করছে। স্টিভ, আমাদের এই মুহূর্তগুলো কেউ মনে রাখল না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর বল টেম্পারিং শুনলে লোকে তোমার মুখ আর নাম বসাবে। ফিক্সিং শুনলেই আমাকে টানবে। মাঝেরগুলো? শুরুগুলো? সেই লড়াই? জন্টি, গ্যারি, অ্যালান, ল্যান্স, হারসেল, মার্ক, জ্যাক, ডারেল — আমার স্বপ্নের কামারাদেরি। অন্য গ্রহের এক দল। কাকে বলব স্টিভ, গোটা কাপটায় এ গ্রহের বাকি কোনও ক্যাপ্টেন একনম্বর জার্সিটা ছাড়েনি, না, তোমার নেমসেক ওই লোকটাও না। আমি ছেড়েছিলাম। নিজে পাঁচ নম্বর পড়ে ওটা দিয়েছিলাম গ্যারিকে। গ্যারি। গ্যারি কার্স্টেন। মাটি আঁকড়ে থাকত। কখনও ঝড় তুলত। সব পারত। কেন দেব না ওকে? ওই তো আমার সেই অপ্রতিরোধ্য কেল্লার পাহারাদার ছিল? আর স্টিভ, তুমি ব্রিটিশ চনমনে রক্ত আর টাকার অঙ্ক ছেড়ে ব্যাগি গ্রিন ধরলে। প্রেস কনফারেন্সে সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে বললে, একা তুমি সব করেছ, আর কেউ না, দায়ী তুমি, শুধু তুমিই। ঘোরানো বল দেখা যায় না এমন ইনকঙ্কারেবল ইন্ডিয়ান সয়েলে একের পর এক ইনিংস। ধরমশালা। ১১১। পুনে। ১০৯। আর সেই রাঁচি। ইনঅগুরাল টেস্ট। তোমার স্বপ্নের ১৭৮। আনবিটেন। অ্যাসেজ, স্টিভ। তুমি নিজে কেন কিছু বলছ না? আমাকে সব বলতে হবে? পার্থে ২৩৯। ওদের লর্ডসে ২১৫। ওভালে মাটি কামড়ে থাকা ১৩৮। আর জামাইকায় সেই ১৯৯। একটা রান, স্টিভ। তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছিল বলো। জামাইকা মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কার্ল। কার্ল হুপার। গ্রে কলেজে এসে ফুল রেখে দিয়েছিল। আর কেউ আসেনি। আমার মেটরা আসে। ল্যান্স অঝোরে কেঁদেছিল। মাখায়াকে সামলানো যাচ্ছিল না। জন্টি এই সেদিনও তো এল। মেমোরিয়ালটা পারলে ঘুরে এসো স্টিভ। ওখানেই আমার ঘর। আমার স্কুল। ক্রিকেট। জীবন। দেয়ালে লেখা ‘Psalm 23, Lord is My Shepherd’। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো স্টিভ? বোলারের হাত থেকে বল বেরিয়ে আসার আগে তোমার ওই আনঅর্থোডক্স এগিয়ে আসা আর পায়ে পা জড়ানো মুভমেন্ট দেখতে দেখতে মনে হয় না ঈশ্বরও আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন? এই ব্যাটিং স্টান্স টিটোয়েন্টির জন্য। কে বা কারা যেন তোমায় বলেছিল? বাকিটুকু তুমি ছুঁড়ে দিয়েছিলে মুখে। রান, রান, রান। বলে, ক্ষিপ্রতায়, দাঁতে দাঁত চেপে দলকে লিড করলে। আমি…। আমিও এমনটাই করিনি কি? তাহলে যে ভারতে খেলতে এত ভালোবাসতাম, সেই ইন্ডিয়ান ট্যুর এতটা অভিশপ্ত হল কেন? তোমারও কেন এমন হল? ক্যামেরন। ব্রাইট ফিউচার। ডেভিড। অনেকটা তোমার দেশের ম্যাথু (হেডেন) ঘরানার ছেলে। আর এদের নিয়েই তোমার সেই ‘লিডারশিপ গ্রুপ’? তোমার ভিসিয়াস ট্রায়ো? আমাদের তো ক্রিকেট উপহার দেওয়ার কথা ছিল। জিতলে শ্যাম্পেন, স্ত্রীকে গভীর চুমু আর দেশের লোকেদের আস্ত একটা স্বপ্নদিন উপহার দেওয়ার কথা ছিল। হারলে ভেঙে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিংবা আবার ফিরে আসার আগুনে চোখের জন্ম নেওয়ার কথা ছিল। জানো স্টিভ, ২০০২-এর শুরুতেই মা সান-মেরি বলেছিল, আমার সেই পুরনো ছেলেটা ফিরে এসেছে। সেই হাসি। লোকজনকে দেখে ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া ছেলেটা না। আমার, আমার পুরনো ছেলেটা। তারপর জুন। ১ জুন। তোমার জন্মদিনের আগের দিন। উটানিকা পাহাড়ে আমার প্লেন। জোহানসবার্গ থেকে বোন হেস্টারকে ফোন করলাম। তোদের ম্যান্ডেলা রোড হয়ে ড্রাইভ করছি। ও বলল, ব্রেকফাস্ট করে যা। বললাম, না। জর্জে যাব। বার্থা। আমার বার্থা। ওর সঙ্গে কাটাব উইকএন্ড। ফোন ছাড়ার আগে বললাম, সিসি, আই লাভ ইউ। এয়ারপোর্ট ঢুকল প্লেন। দুজন পাইলট। যাত্রী বলতে আমি। কুয়াশা, মেঘ। আরও কিছু ছিল কি? প্লেন ঘুরিয়ে পাহাড় পেরিয়ে আবার ফিরতে যাবে …। প্রিয় স্টিভ, আমার বাকিটা মনে নেই। কেমন একটা ব্ল্যাক আউট। স্টিভ, তোমার বাকিটা মনে আছে? নিউল্যান্ডস, কেপটাউন। মাইকেল, মাইকেল ক্লার্ক। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া একটা রত্ন পেয়েছিল। খেলা ছেড়েও কী অদ্ভুতভাবে ক্রিকেটের ভেতর রয়েছে। সকালে, বিকেলে, রাতে ওর এখনও শুধুই ক্রিকেট। টুইটে লিখল, ডিভাস্টেটিং। দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম না তো? নিউল্যান্ডস তোমাকে ছিছি করল। সিডনি ফিরে ঘিরে ধরা ব্যাগি গ্রিন, স্যার ডোনাল্ডের দেশের মানুষ তোমাকে অভিশাপ দিল স্টিভ। ৩২২ রানে হার। সিরিজে তোমার সর্বোচ্চ ৫৬। তার দেয়েও বড় ওই হলদে রঙের স্যান্ডপেপারটা। বল ঘষা। সিম ওঠানো। সিরিজ ১-১ ড্র হয়ে যাওয়ার পর যেকোনওভাবে হোক ফিরে আসার বিষাক্ত প্ল্যান। যেটা ধরে নিল ক্যামেরা। ক্যামেরনের মিথ্যে। ব্রেকের পর তোমাদের সেই লিডারশিপ মিটিং। তারপরেরটা তোমারও ব্ল্যাক আউট কি স্টিভ? কেপটাউন। সেই কেপটাউন। দেখো… আরেকবার পা রেখো এখানে। দেখবে, শহরটা অতটা অভিশপ্ত লাগবে না। টেবিল পাহাড়। সবুজ গালিচা। সুগার হিল। কেপ পয়েন্ট। সমুদ্র। কাছেই রবেন আইল্যান্ড। ম্যান্ডেলা। ড্যানিয়েল্লাকে নিয়ে এসো। চ্যাপম্যান্স পিক ধরে ড্রাইভ করে চলে যেও বহু দূর। চোখের সামনে আটলান্টিক। ড্যানিয়েল্লা আর তুমি। তুমি আর ড্যানিয়েল্লা। সেই ড্যানি। তোমার প্রেয়সী। ২৪ মার্চ শনিবারের ওই বীভৎস দুপুরের তিনদিন আগে ও নিউইয়র্ক চলে গেল। তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধবার তোড়জোড়। এ সময়টা তুমি ওকে পেলে না। স্টিভ, তাই কি তুমি এতটা একা, এতটা ভেঙে পড়েছিলে?
আমাদের এসমস্ত প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না স্টিভ। ফিরে এসো একদিন। যেকোনওভাবে হোক জিততে চাওয়া তোমার দুই আইডল তোমাদের পান্টার আর সুইশ ফেডেক্সের রাস্তা ধরে আবার ফিরে আসুক তোমার ব্যাট ছুঁড়ে দেওয়া উল্লাস। তবু, কখনও কখনও হারাটাও মেনে নাও স্টিভ। বারবার, যেভাবে হোক জিততে চাওয়াটা একটা ভুল। তবে আমার মতো মুহূর্তের ভুলে ইচ্ছে করে হারার খেলাটাও ছুঁয়ো না। তোমরা তো তবু জিততে চেয়েছিলে। আমি তো …। যাই হোক, প্রিয় স্টিভ, তোমার ফেলো টিমমেটদের প্রিয় ‘স্মাজি’, ফিরে এসো। একটা বছর, দুটো বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ব্যাগি গ্রিনই তোমাকে মানায়, মানাবেও। তদ্দিন, ভালো থেকো। ক্রিকেটে থেকো। জীবনে থেকো।
ইতি
হ্যান্সি…