Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মরুবিজয়ী

প্রতিভা সরকার

 

হয়তো কারও খুব সঙ্গত কারণে যশাধিকারী হবার কথা ছিল, হয়ে গেল সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ সঙ্গত কারণটিতে না হয়ে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে সে হয়তো বিখ্যাত হয়ে গেল।

এইটুকু বললেই চেঁচিয়ে উঠে বলতে ইচ্ছে করবে সলমন খান আর বিশনই সম্প্রদায়। খুব ন্যায্য চেঁচানি হবে সেটা, কারণ পশ্চিম রাজস্থানের বিশনইদের নিজেদেরই এত তাক লাগানো ঐশ্বর্য আছে, যে এই দেশের নতুন মহারাজা, রুপোলি জগতের পেশীফোলানো নব্য তারকাদের বন্দুকবাজির ছটায় তাদের আলোকিত হবার কোনও দরকারই ছিল না। কিন্তু বাস্তবে হল তাই। যে ফিল্মি সুলতানটি শ্যুটিংয়ের ফাঁকে রাজস্থানের গ্রামে কৃষ্ণসার আর চিঙ্কারা হরিণ মেরে সঙ্গী নায়ক নায়িকাদের আমোদ দিচ্ছিলেন, তার সাজা হবার পর বিশনইদের নিয়ে আলোচনায় আমরা এক একেকজন দুধ উথলানো কড়াই। অর্ধেক জেনে বা অতি অল্প জেনে। কিন্তু বিশনই সম্প্রদায় হল পৃথিবীর প্রথম পরিবেশবাদী ধর্মের অনুসারী। তাদের সম্বন্ধে জানা মানে অচেনা এক ধর্মবিশ্বাসকে জানা, যার শেকড় প্রোথিত রয়েছে সাম্যবাদী সামাজিক ন্যায়ের ধারণায়। এই ধারণার মূল দুই স্তম্ভ হল জীবে দয়া আর বৃক্ষপ্রেম। সে পথে যতই অগ্রসর হওয়া যায়, ততই মনে হয় এই জানা ফুরোবে না।

বিশনইরা বিষ্ণুর উপাসক। তাদের গুরু জাম্ভোশ্বরকেই তারা বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করে। তিনি ভক্তিবাদের অন্যান্য হোতাদের সমসাময়িক হলেও, কবীর, সুরদাস, নানকের সঙ্গে তাঁর প্রচারিত ধর্মবিশ্বাসের মিল অমিল দুটোই আছে। মানুষের যদি প্রকৃতির হাত না ধরে তাহলে তার ধ্বংস অব্শ্যম্ভাবী, বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণেই তার উন্নয়নের বীজ নিহিত এই কথাটি নিজের অনুসারীদের মনে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, যে সেই পরম্পরা আজও বহমান, আজও দোর্দণ্ডপ্রতাপের পরোয়া না করে বিশনইরা কুড়ি বছর ধরে আদালতে কৃষ্ণসার হত্যার বিরুদ্ধতায় লড়ছে, হয়তো আগামী আরও দু দশক ধরে এই লড়াই চালিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্ম। যতবার সলমন খান জামিন পাবে, ততবারই আদালতে নতুন কেস ঠুকবে কোনও না কোনও বিশনই।

জাম্ভোশ্বর নাকি অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার যৌবনে পশ্চিম রাজস্থানে এক রাক্ষসী খরা চলল দশ বছর ধরে। জলের তাল, ছোটবড় উৎসগুলি শুকিয়ে কাঠ। অনেক লোক দেশান্তরী হল। যারা রইল তারা বড় গাছ কেটে লকড়ি বিকোতে লাগল বাজারে। হরিণ ময়ূর মারা পড়তে লাগল মানুষের খিদে মেটাতে। স্বপ্নদর্শী গুরু ঘুম থেকে উঠে এক খেজরালি গাছের নীচে দেখিয়ে দিলেন জলভাণ্ডার। ২৯টি জীবনবীক্ষার কথা লিপিবদ্ধ করে নতুন ধর্মে প্রথম দীক্ষা দিলেন নিজের কাকাকে।

জাম্ভোশ্বর একবার জয়সলমীরের পথে যেতে নান্দেই গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পছন্দ হয়ে গেল একটুকরো সমতলভূমি। সেখানে খোঁড়া হল এক বিশাল তাল — জাম্ভাসর। হিন্দুর কাছে যেমন গঙ্গা, বিশনইদের কাছে তেমনি জাম্ভাসর। নিজের হাতে আজও তারা এই জলাশয়ের উদ্বৃত্ত বালু সরায়, কারণ এই জলসেবা নাকি তাদের অক্ষয় স্বর্গের অধিকারী করবে, একথা গুরুই বলে গিয়েছিলেন। আরও বলেছিলেন পশুপাখি সকলের সমান অধিকার এই সুপেয় জলে। আজও জাম্ভাসরে জল খেতে আসে গবাদিপশু, হরিণ, ময়ূর, পাখপাখালি এবং মানুষও।

স্বর্গের ছলনার আড়ালে মরুভূমির বাস্তুতন্ত্র নিটোল রাখায় যে উপাদানটির ভূমিকা সবচেয়ে বড়, সেই জলের নিশ্চয়তা আদায় করা হল। এবার আর এক বিশ্বাসের কথা এল। গুরু নাকি বলেছিলেন বহু যুগ বাদে জন্মান্তরে তিনি ফিরে আসবেন কৃষ্ণসার মৃগের রূপে। তাই বিশনইদের কাছে যে কোনও প্রজাতির হরিণ অবধ্য। উনত্রিশ দীক্ষার মধ্যে একটি তাদের শিখিয়েছে শুধু হরিণ নয় অহিংস সমস্ত প্রাণীকুলের রক্ষক তারা। আজও বিশনই গ্রামের ছায়ায় গোধুলিতে ভিড় করে অজস্র হরিণ, খরগোশ, ময়ূর ও অন্যান্য পশুপাখি। কারণ রাত নামার আগে বন্য পশুর জলপানের এই সময় শিকারির খুব প্রিয়। বনের পশুরাও জানে এই সময়টাতেই গা ঘেঁষে থাকতে হবে তাদের রক্ষাকর্তাদের।

অন্যান্য লোকায়ত ধর্মকে যেমন গিলে ফেলা প্রতিষ্ঠিত প্রধান ধর্মের দস্তুর, বিশনই ধর্ম তার ব্যতিক্রম নয়। হিন্দুয়ানী তাকে ছেঁকে ধরেছে গাছ বেয়ে ওঠা লতার মতো। কিন্তু জাম্ভোশ্বর নিজেকে হিন্দু অথবা মুসলমান বলতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ ধর্ম বলতে তিনি বুঝতেন আত্মিক, নৈতিক উন্নতি যার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে পরিবেশভাবনা। যে বৃক্ষ ও পশুকুলের রক্ষক সেইই তার আশীর্বাদধন্য। তাঁর প্রসাদধন্য বিশিষ্টদের মধ্যে তাই রয়েছে দিল্লী সুলতানি আমলের সিকান্দার লোধী, নাগপুরের মহম্মদ খান নাগুরি, বিকানীরের রাও বিকাজি, মেবারের রাণা সঙ্গ। মুসলমানকে তিনি রহম বা করুণার কথা মনে করান, হিন্দুকে পাঠ দেন প্রেমের।

বিশনই সম্প্রদায়ের পালিত আচারের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামের ধর্মের পালনীয় প্রথার মিল দেখা যায়।

মৃত বিশনই চিতায় ওঠে না, কবরের গহনে ঘুমোয়। জাম্ভোশ্বরের সমাধি হিন্দুর কাছে সমাধি, মুসলমানের কাছে তা মুকাম। বিশনই বিষ্ণুর উপাসক বটে, কিন্তু সে বিষ্ণু নির্গুণ, অর্থাৎ আকারবিহীন। বিশনই মন্দিরে আগে কোনও বিগ্রহ পূজিত হত না। শুধু এক ঘিয়ের প্রদীপ বেদির ওপর আলো বিলোত। অমাবস্যায় হোমের আগুন প্রজ্জ্বলন ও যজ্ঞ করা হয়। সে আগুন কোনও বৃক্ষবিনাশের ফল নয়, নারকেলের ছিবড়ে জড়ো করে হোমাগ্নির প্রজ্জ্বলন হয়।

মন্দিরে যখনই ঢোকা হোক না কেন, মস্তক আচ্ছাদন করতেই হবে। এইসব কারণেই হয়তো ১৮৯১ সালের মাড়বার রাজ্যের সেন্সাসে বিশনইদের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছিল। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বিশনই সম্প্রদায় এখন হিন্দুধর্মীয় বলে বিবেচিত হলেও, এক সময়ে গুরু জাম্ভোশ্বরের মতোই সে ছিল না হিন্দু, না মুসলমান।

আসলে দেশভাগের পর ধর্মীয় সত্তার যে চূড়ান্ত মেরুকরণ হয়, তার ফলে বিশনই সম্প্রদায় হিন্দুধর্মের সঙ্গে নৈকট্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। গুরুর সমাধির আচ্ছাদনের রঙ সবুজ থেকে পালটে যায় গেরুয়ায়, মুকাম হয় মুক্তিধাম। কিন্তু পাঞ্জাবের একমাত্র মুসলমানপ্রধান এলাকা কোটলাতে মানুষ এখনও জাম্ভোশ্বরকে মুশকিলআসান বলেই মানে। ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা, প্রান্তিকীকরণের বিপরীতে তিনি এক আলোকময় সত্তা।

অন্যদিকে বিশনইদেরকে নিয়ে হিন্দুধর্মের খুব মাথাব্যথা কখনও দেখা যায়নি। পরিবেশের রক্ষা যে ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ সে কথা বিশনইদের মতো করে কেউ ভাবেনি। এমনকি খুব হালে ছাড়া বিশ্বের এই সম্ভাব্য পরিবেশবাদী ধর্মের কথা নিয়ে কোথাও খুব আলোচনাও হয়নি। অথচ সুন্দরলাল বহুগুণার চিপকো আন্দোলনের বহু আগে অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় ঘটে গেছিল খেজারলি গণহত্যা। বিশনইদের বনভূমিতে রাজপ্রাসাদ তৈরি হবে বলে পবিত্র খেজারলি গাছ কাটা হচ্ছিল। গাছ জড়িয়ে ধরে অস্ত্রের বলি হন এক বিশনই মহিলা, অমৃতা দেবী। তখন ইকোফেমিনিজম শব্দটির উদ্ভব ঘটেনি। মেধা পাটেকর, অরুন্ধতী রায়, বন্দনা শিবার সার্থক পূর্বজা অমৃতার দেখাদেখি প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন বিশনই গ্রামের নারীপুরুষ। ৩৬৩ জন কচুকাটা হবার পর অনুতপ্ত রাজার আদেশে প্রাসাদ পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং তখন থেকেই বিশনই ভূমিতে পশুহত্যা, বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর থেকে বিশনই নারী বার বার অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে পরিবেশরক্ষার আন্দোলনে। তিলাসানি গ্রামেও প্রাণ দিয়েছিল দুই বীরাঙ্গনা — খিবানী আর নেতু। পুরুষদের অকুণ্ঠ সমর্থন সবসময় পেয়েছে তারা। এখনও অনেক বিশনই পুরুষ আছেন যারা পশুপাখি আহত হবার খবর শুনলেই ছুটে যান। সেবা করে স্বধর্ম পালন করেন। সলমনের অনাচারের প্রতিবাদ একমাত্র নয়। বরং ধারাবাহিকতার পরিচায়ক। ২০০৭ সালে বিশনইরা মামলা ঠুকেছিল এক ফিল্ম প্রডিউসারের বিরুদ্ধে, কারণ তার সেটে একটি ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছিল। আবোহার ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে বিশনইদের দায়িত্ব চোরাশিকারি ধরা। ইউটিউবে ধরা আছে বিশনই নারীর হরিণশিশুকে স্তন্যপানে বাঁচানোর স্বাভাবিক অকুণ্ঠ স্বীকারোক্তি (ভিডিও নিচে)।

বিশনই নিজের পরম্পরা সম্বন্ধে অতি সচেতন। খেজারলি গণহত্যায় যারা মারা গিয়েছিল তাদের নাম ও ধাম অতি সযত্নে রক্ষিত হয়েছে ঘরে ঘরে। এই সেদিন ১৯৭৬-৭৭-এ মাঙ্গিলাল এবং ভাগীরথরাই রাও সেগুলো একত্রিত করেন। এদের দুজনেরই পেশা হচ্ছে ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জী সংগ্রহ করা। এদের সংগৃহীত একটি বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। খেজারলি গণহত্যা চলাকালীন ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এক নববর ও বধূ। নিহত ২৯৪ জন পুরুষ, ৬৯ নারী ও ৩৬ জোড়া স্বামীস্ত্রীর মধ্যে এই জুটিও ছিল। কি সেই আবেগ ও বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা যা সদ্যবিবাহিত স্বপ্নদেখা যুবকযুবতীকে আত্মদানে প্ররোচিত করে বিশনই ছাড়া তার খবর কে রাখে।

ফলে সলমন খানের মতো হিংস্র মদগর্বী ও চোরাশিকারিদের যম হচ্ছে বিশনই সম্প্রদায়। এই পরিবেশবাদী ধার্মিক মানুষগুলি রাজস্থানে যথেষ্ট সম্পন্ন। কোনও শুখা মরশুমেই তাদের দেশান্তরী হতে হয় না। তাদের কাছে পরিবেশ প্রতিবেশের হিতসাধন নিজের দেহ ও আত্মার উপকারসাধন। গোটা সম্প্রদায় যেন মরুবিজয়ের কেতন ওড়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাজস্থানে কর্ণিসেনা আছে যারা নিরীহ মানুষকে ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় দুর্গপ্রাকারে এক অনৈতিহাসিক নারীসম্মান রক্ষার দায়ে। আবার রাজস্থানে বিশনই সম্প্রদায় আছে যাদের দৃঢ় সংকল্পের কাছে হার মানে পেশী ও অর্থশক্তি।

আমার দেশ কোনদিনও যদি সার্বিক মৃত্যু উপত্যকা না হয়, তার কৃতিত্ব বর্তাবে এই মানুষগুলিতে। শুধু ধার্মিক বলে এদের নস্যাৎ করব এমন সংহারী ঝাঁজ আমার নেই।

আকর

  1. The Bishnois by M.S.chandla
  2. Bishnoi : An Ecotheological New Religious Movement in the Indian Desert by Pankaj Jain.
  3. Excerpt from Pankaj Jain’s Tales of Bishnois : India’s Original Ecological Warriors.