কৌশিক দত্ত
তাহলে ঠিক কেমন চিকিৎসক আমরা চাই? যে চিকিৎসক পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত, ভালো আয় করেন, সুট-টাই পরে বড় গাড়িতে ঘোরেন, তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিদ্বেষ যে জনমানসে প্রবল, তা গত বৎসরাধিক কালে প্রচ্ছন্ন থেকে প্রকট হয়ে উঠেছে। নিয়মিত সেই বর্গের নামী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়ায় বিষোদগার, কোনও রোগীকে বাঁচাতে বা সুস্থ করতে অসমর্থ হলে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তারি, এমনকি গণপ্রহারের দাবি নিয়মিত দেখতে পাই। এই ক্রোধ বা অসূয়ার মানসিক ও সামাজিক ভিত্তি একরকমভাবে বোঝা যায়। তার জন্য ক্রুদ্ধ, আক্রমণাত্মক মানুষদের (আদতে “উপভোক্তা”দের) সর্বদা দোষ দেওয়াও যায় না, কারণ একটি ধনতান্ত্রিক বাজারি চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কে জটিলতা, সন্দেহ, ক্ষমতার টানাপোড়েন, ইত্যাদি প্রত্যাশিত, যদিও তার খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা অবশ্যই চলতে থাকা উচিত। খটকা লাগে অন্যতর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সামাজিক ও সরকারি প্রতিক্রিয়া দেখলে।
সমাজের ঠিক করে দেওয়া অর্থনৈতিক সাফল্যের মাপকাঠি আর জাদুকাঠিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিত্তমুখী উন্নয়নের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন যে কিছু সংখ্যক চিকিৎসক, তাঁদের প্রতি সমাজের তথা রাষ্ট্রের কী মনোভাব? ডাক্তারি পাশ করার পর কেউ যদি বাতানুকূল চেম্বার, পাঁচতারা হাসপাতাল, সম্ভ্রান্ত শ্বশুরকুল, বৎসরান্তে ব্যাংকক পাটায়ার মধ্যবিত্ত স্বপ্ন একেবারে গোড়াতেই বিসর্জন দিয়ে সচেতনভাবে বেছে নেন অরণ্য, নাগরিক বস্তি অঞ্চল বা দুর্যোগে দুর্গত এলাকায় ক্লিষ্ট মানুষের সেবার ব্রত, তাহলে তাঁর সেই প্রচেষ্টাকে আমরা কীভাবে নেব? কেমন আচরণ করব সেই চিকিৎসক বা মানুষটির সঙ্গে? এখনই বড় মুখ করে বলতে যাবেন না, মানুষ তাঁকে মাথায় করে রাখবে বা সরকার তাঁকে সম্মান দেবে। ভুল বলে ফেলবেন। আসলে ঘটবে ঠিক এর বিপরীত। ধরা যাক সেই চিকিৎসকের নাম বিনায়ক সেন বা রাতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাস্তবে এঁদের স্থান হবে কারাগৃহে। সকালের খবরের কাগজে আপনারা তাঁদের বন্দিত্ব বিষয়ক সংবাদ পড়বেন প্রাতরাশ সহযোগে, এবং বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করবেন না। হয়ত টিপ্পনী কেটে বলবেন, “নকশালি করতে গিয়ে ফেঁসেছে শালা।” আদৌ জানার চেষ্টা করবেন না, স্টেথোস্কোপ ছাড়া অন্য কোনও অস্ত্র এঁরা কখনও ধরেছেন কিনা। বোঝার চেষ্টা করবেন না, সমাজ থেকে এইসব মানুষকে সরিয়ে দিলে ব্যক্তি হিসেবে আপনার কী ক্ষতি, গণতন্ত্রের কী ক্ষতি, এমনকি শান্তিরক্ষক এবং প্রশাসকেরও কী ক্ষতি।
গোড়ার প্রশ্নটাই ফিরে আসে। তাহলে ঠিক কোন গোত্রের চিকিৎসক আমরা চাইছি? উপার্জনমনস্ক যান্ত্রিক চিকিৎসক দক্ষ হলেও তাঁকে আমাদের পছন্দ হয় না স্বাভাবিক কারণেই। আবার সেবামনস্ক নিঃস্বার্থ একনিষ্ঠ চিকিৎসক, যিনি রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে জীবাণু থেকে অপুষ্টি, ওষুধের অপ্রতুলতা থেকে সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব, সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত, তাঁকেও আমরা অনায়াসে ত্যাগ করি, সমবেত উদ্যোগে গণশত্রু বানাই। এমন হয় কেন? উত্তর হল, আমরা আদতে নিজেদের প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে সিরিয়াস নই। আমাদের মুখ ঢেকে গেছে বিজ্ঞাপনে। প্রোপাগান্ডার অধীন আমাদের বোধ। আমাদের চাহিদা বলে যা তুলে ধরা হয় এবং আমরাও নিজেদের চাহিদা বলেই বিশ্বাস করি, তাও আদতে পরস্মৈপদী, বাজার নিয়ন্ত্রকের তৈরি করে দেওয়া। বাজার আমাকে যা বেচতে চায়, আমাকে ধরে নিতে শেখানো হয় যে আমি আসলে সেটাই পেতে চাই যেকোনও মূল্যে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার যেহেতু সদাচঞ্চল (ডায়নামিক), বহুস্তরীয় এবং বহুমুখী, তাই এই তৈরি করে দেওয়া চাহিদা বদলাতে থাকে। এসব নিয়ে ভাবার সময় বা উৎসাহ পাই না বলেই জানা হয় না, আসলে আমরা কী চাই। শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, বিনোদন সবকিছুর মতোই স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও এই অব্যবস্থিতচিত্ততা প্রকট এবং প্রত্যাশিত। বিবাহের সিদ্ধান্ত নেবার সময় যে সমাজ বুঝতে পারে না হৃদয়বান জীবনসঙ্গী আর শাঁসালো শ্বশুরের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি যৌতুকে একটা মোটরবাইক পাবার লোভ যেখানে স্ত্রীর জীবনের মূল্যের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, সেই সমাজে সেবাব্রতী চিকিৎসকের পরিণতি করুণ হওয়াই স্বাভাবিক।
এই পর্যায়ে দু’রকম বিতর্ক উঠবে। প্রথমত প্রতিবাদ করে বলা যায়, এদের কয়েদ করা সরকারের সিদ্ধান্ত, সমাজের কোনও ভূমিকা নেই। নীতিগতভাবে এই বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকার জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। বাস্তবেও যাতে সরকার মানুষের সমবেত চাহিদা ও সিদ্ধান্তের প্রতিনিধিত্ব করে, তা নিশ্চিত করার দায় নাগরিক সমাজের ওপর বর্তায়। এক ধাপ এগিয়ে বলা যায় যে চরম স্বৈরাচারী পরিস্থিতি (একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র, ইত্যাদি) বাদ দিলে, একটা মোটামুটি (অন্তত পোশাকি) গণতান্ত্রিক ধাঁচার মধ্যে শিক্ষিত সচেতন নাগরিকবৃন্দের একটা বড় অংশের অনুমোদন (কনসেন্ট) ছাড়া রাষ্ট্র কোনও কোনও তর্কযোগ্য নীতি বা কর্মকাণ্ড খুব জোরের সঙ্গে দীর্ঘকাল চালিয়ে যেতে পারে না। সুতরাং ধরে নিতে হবে, জনগণের সায় আছে, অন্তত খুব বেশি আপত্তি নেই।
হাত ধুয়ে ফেলার দ্বিতীয় যৌক্তিক পদ্ধতিটি হবে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের (অবশ্যই শাসক দলের) দিকে আঙুল তুলে বলা, “ওরা এরকমই ক্ষমতালোভী, অগণতান্ত্রিক, অত্যাচারী।” এরকম ঘটনা ঘটলে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় আমরা এভাবে অভিযোগের আঙুল তুলে থাকি। এই অভিযোগ অবশ্যই ভুল নয়, কিন্তু আদ্যন্ত নির্ভুল এবং সম্পূর্ণও নয়। ডক্টর রাতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারের সময়কাল ২০১৮, স্থান পশ্চিমবঙ্গ, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। বর্তমান অভিযোগ সঙ্গত কারণেই রাজ্যের সরকার, পুলিশ ও প্রধান দলটির বিরুদ্ধে। কিন্তু এই যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা কি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার, রাজ্য পুলিশ বা তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও ইউনিক চরিত্রের পরিচায়ক, যা অন্যদের মধ্যে নেই? কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। সময় ২০০৭ এর মে মাস, স্থান বিলাসপুর (ছত্তিসগড়), গ্রেপ্তার হলেন ডক্টর বিনায়ক সেন। অভিযোগ অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ, শাসকগোষ্ঠী বিজেপি। নামগুলো আলাদা, কর্মকাণ্ড একই। ডক্টর সেনের চিকিৎসাগুণ, সেবাব্রত এবং হৃদয়বত্তার কথা সকলে জানা সত্ত্বেও এমনকি রাজ্যের উচ্চ ন্যায়ালয় তাঁর প্রতি সুবিচার করেনি, তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে। বস্তুত দেশ ও পৃথিবী জুড়ে চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এমনকি নোবেল জয়ীদের তরফ থেকে লাগাতার প্রতিবাদের পর ২০০৯ সালে শীর্ষ আদালতে মাননীয় বিচারপতি শ্রী মার্কণ্ডেয় কাটজু ও শ্রী দীপক ভার্মার বেঞ্চ তাঁর জামিন মঞ্জুর করার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের আদালত তাঁর প্রতি বিরূপ থেকেছেন। না, আমি আদৌ বলতে চাইছি না যে কিছু ক্ষেত্রে আদালত একটি দমনযন্ত্রের অংশ বা বিচারপতি স্বয়ং কোনও সরকার বা লবির কর্মচারী হতে পারেন। এমন কথা কখনওই বলব না, কারণ তা বলা বেআইনি ও বিপজ্জনক। বলার কথাটা হল, জামিনে ছাড়া পেয়ে ডক্টর সেন আরও বেশি করে মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন, কিন্তু বন্দুক-বোমা হাতে মানুষ বা সরকারের পক্ষে ক্ষতিকর কিছু করতে দেখা যায়নি তাঁকে এতদিনেও। অর্থাৎ শান্তিপ্রিয় সেবামনস্ক কিন্তু রাজনীতিসচেতন চিকিৎসক সম্বন্ধে শাসকের ভীতি অনেকাংশে অমূলক।
আরও আড়াই দশক পিছিয়ে গেলে সেবাব্রতী চিকিৎসকের “দেশদ্রোহ” এবং শাসকের আতঙ্কের স্বরূপ আরও বেশি স্পষ্ট হবে। ১৯৮৪ সালের ২-৩ ডিসেম্বর রাতে ভূপালে ঘটে গেছে ভয়াবহ গ্যাস দুর্ঘটনা। রাজ্য ও দেশের তৎকালীন শাসকেরা যখন ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তাদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাবার পথ করে দিতে ব্যস্ত, তখন কিছু চিকিৎসক দুর্গতদের যথাসাধ্য চিকিৎসা দেবার চেষ্টা করেন। ক্রমশ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসকেরা সেই উদ্যোগে সামিল হন এবং কারখানা চত্বরে একটি ক্লিনিক স্থাপন করে তাঁরা বিষক্রিয়ার শিকার মানুষদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা পরিষেবা দিতে শুরু করেন। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে তাঁদের ভাড়া বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় পুলিশ। (আশ্চর্যজনকভাবে, খানিক ভূতের গল্পের মতো, এইসব সরকারি আইনরক্ষার কাজ বারবারই হয় মাঝরাতে। তখনও তাই হয়েছিল।) জনসেবা করতে গিয়ে একেবারে পুলিশ ফাটকে সরকারি আতিথ্য পেয়ে অবাক হয়ে যাওয়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জানানো হয় যে তাঁরা দেশদ্রোহী! সেই অসামান্য তথ্যটি জানার মুহূর্তে তাঁদের মাথার ভেতর “দেশ” শব্দটির অর্থ গুলিয়ে গেছিল কিনা আমি জানি না, তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। এখন বুঝি, ইউনিয়ন কার্বাইড যদি দেশ হয় এবং ভূপালের মানুষদের হত্যা করা তাঁদের সচেতন পরিকল্পনা ছিল (দেশের স্বার্থে), এমন কথা (যা বিশ্বাসযোগ্য নয়) যদি ধরে নেওয়া হয়, একমাত্র তাহলেই তাঁদের কোনওভাবে দেশদ্রোহী সাজানো সম্ভব হলেও হতে পারে। নচেৎ মানতে হবে, প্রকৃত দেশপ্রেমী ছিলেন তাঁরাই। নিজের কেরিয়ার এবং সংসারের আগে দেশের দুর্গত মানুষের জীবনকে বসিয়েছিলেন।
এই কাহিনীতে আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক আছে। ভূপালের মানুষ পুলিশের এই অভিযোগ এবং আচরণ মেনে নেননি। তার ফলে আটত্রিশ ঘণ্টা আটকে রাখার পর পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, কারণ জনগণের “কনসেন্ট” না পেলে রাষ্ট্র (একটি আপাত গণতান্ত্রিক পরিসরে) খুব বেশি সময়ের জন্য অযৌক্তিক অবদমন চালিয়ে যেতে পারে না। যখন যেখানে পারে, কোনওভাবে সাধারণ মানুষের বড় অংশের প্রচ্ছন্ন সম্মতি আদায় করতে সফল হয় বলেই পারে।
এই নিদান দেওয়া যেতেই পারে যে চিকিৎসক নিজের কাজটুকুর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেন। সমাজ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কী? প্রশ্ন হল, “নিজের কাজ”-এর সংজ্ঞাটা কী হবে? রোগীকে বাঁচানো আর ভালো রাখা? তা যদি হয় তবে সমাজ রাজনীতি বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। চিকিৎসাকে আলগোছে একটা পেশা এবং পেট চালানোর মাধ্যম হিসেবে নিলেই একমাত্র এসব থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব। যেকোনও নিষ্ঠাবান চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা একটা অ্যাক্টিভিজম। রোগীর সুস্থতার জন্য গায়ে পড়ে তাঁর বাড়ির লোক, অফিসের বস, অনেকের সাথে আলোচনা বা তর্ক করতে হয়। সরকারের কাছে তদ্বির করতে হয়, জনগণের মধ্যে সচেতনতার প্রসার করার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয়। অসুখের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুধুমাত্র রোগজীবাণুর বিরুদ্ধেই নয়, মানুষের ভ্রান্তির বিরুদ্ধে। নিজের অভিজ্ঞতায় সরকারি উদ্যোগে পোলিওর টিকা খাওয়াতে গিয়ে কিছু অঞ্চলে চরম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে এবং সেই বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষার স্বার্থে বেবি ফুড আর ফিডিং বোতল বিক্রেতাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে হয়েছে, সংঘাত হয়েছে। এটা রাজনীতি। আমি দেড় মাস পরিশ্রম করে একজনকে বাঁচিয়ে বাড়ি পাঠানোর পরদিন আপনি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা করে এক মুহূর্তে তাঁকে মেরে ফেলবেন, আমার যাবতীয় প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দেবেন আর প্রত্যাশা করবেন যে আমি সেই মুহূর্তে নির্লিপ্ত অরাজনৈতিক থাকব! এ বড় বাড়াবাড়ি আবদার নয়?
ঠিক তেমনি কোনও শিশু চিকিৎসক যদি প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলে সেবামূলক কাজ করতে যান, তবে তিনি অচিরেই বুঝতে পারবেন যে দারিদ্র, অপুষ্টি, অপরিচ্ছন্নতা, অশিক্ষা, ইত্যাদি শিশুমৃত্যুর এবং অস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় কারণ। কঠিন নামওয়ালা জটিল রোগে মারা যায় হাতে গোনা কয়েকজন, যাদের অনেককে হয়ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা করেও বাঁচানো যাবে না। অপরপক্ষে অতি সাধারণ প্রতিরোধযোগ্য রোগে বা অপুষ্টিতে মারা যায় অগুন্তি শিশু। এটা জানার পর সেই চিকিৎসক কী করবেন? মূল সমস্যাটিকে অগ্রাহ্য করে মৃত শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে অরাজনৈতিক থাকবেন আর রবীন্দ্রনাথের কর্ণের মতো বলবেন, “আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে”? নাকি মূল সমস্যাকে সংশোধন করে মৃত্যুর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন? সেই চেষ্টায় চিকিৎসকের প্রথম ভরসা অবশ্যই নির্বাচিত সরকার। তাঁদের কাছেই সর্বপ্রথম সাহায্য চাওয়া হয়। সাহায্য না পেলে অসরকারি সেবামূলক সংস্থা গঠন করে দান সংগ্রহ করে কিছু কাজ করা যায়। তাতে না কুলোলে অথবা কাজে বাধা পেলে ভরসা আদালত। সেখানেও সুরাহা না হলে বাধ্য হয়েই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ নিতে হয়। ডক্টর বিনায়ক সেন যে এই চেষ্টা সঠিক পদ্ধতিতে করেছিলেন, তার স্বীকৃতি ভেলোরের ক্রিস্টিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি জাতীয় প্ল্যানিং কমিশনও দিয়েছেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা স্বীকার করছেন তাঁর নীতি ও রাজনীতি উপকারী ছিল। তাহলে তাঁর কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে কার উপকার করা গেল? তাহলে চিকিৎসককে অরাজনৈতিক হতে বলে কোন রোগীর উপকার করা যাবে? যে চিকিৎসক রোগীর আর্থসামাজিক অবস্থা আদৌ বোঝেন না, শুধু বই মিলিয়ে যান্ত্রিক নিদান দিতে পারেন, তিনি কি আদর্শ চিকিৎসক বিবেচিত হবেন? আজকের চরম যান্ত্রিক, আর্থিক সাফল্য কেন্দ্রিক পরিমণ্ডলেও অধিকাংশ চিকিৎসকের পক্ষে রোগী সম্বন্ধে এই নিরাবেগ নির্লিপ্তি অর্জন করা সম্ভব নয়। রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা আসলে চিকিৎসকের একটা চ্যালেঞ্জ, একটা লড়াই, যে লড়াইতে হেরে যেতে নিদারুণ কষ্ট হয়। চিকিৎসকের পেশা ও জীবন তাই প্রতিদিন যুদ্ধকালীন, প্রতিমুহূর্তে রাজনৈতিক। যাঁরা সারাদিন চেম্বারে ঘাড় গুঁজে রোগী দেখছেন আর সপ্তাহে দুদিন বিবেকের তাড়নায় ভারত সেবাশ্রমে বিনামূল্যে শ্রম দান করছেন, তাঁরাও আসলে নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক। বিনায়ক সেন, পুণ্যব্রত গুণ, রাতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই স্বেচ্ছাশ্রমের পরিমাণটা অনেক বেশি হয়ে যায় আর তার সাথে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কথাবার্তা যুক্ত হয় বলে তাঁদের স্পষ্টত রাজনৈতিক বলে চেনা যায়। আমাদের সঙ্গে ওঁদের এটুকুই তফাৎ। সেই পার্থক্যটুকু এঁদের গৌরবান্বিতই করে। নিঃস্বার্থতা, নিষ্ঠা এবং শ্রমের যে স্তরে আমরা পৌঁছতে পারিনি, এঁরা সেখানে পৌঁছতে পেরেছেন। গণশত্রুর কাঁটার মুকুট তার পুরস্কার হতে পারে না।
তাহলে এদের কারারুদ্ধ করে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়? সাম্প্রতিক হবার কারণে রাতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (উনি বন্দ্যোপাধ্যায় পদবির ব্যবহার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন) ঘটনাটার কথাই ধরা যাক। আমি আলাদা করে রাতুলের কথাই বলব, কারণ সেটুকুই আমি বলতে সক্ষম। অনেকের অভিমত যে বলতে গেলে সার্বিকভাবে ভাঙড় আন্দোলন এবং বর্তমান সরকারের অবদমন বিষয়ে বলা উচিত। কথাটি যুক্তিযুক্ত, কিন্তু আমি সেই বিষয়ে কথা বলার যোগ্য ব্যক্তি নই, কারণ সরাসরি যুক্ত না থাকার ফলে এই আন্দোলনের খুঁটিনাটি ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমি বিশদ জানি না। সংবাদপত্র বা সোশাল মিডিয়ার লেখা পড়ে যেটুকু জানি, তার ভিত্তিতে লিখে ফেলার চেষ্টা সৌখিন মজদুরি হবে। স্বীকার করি যে এই আন্দোলনের সূচনাকালের নীতিগত এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বুঝতে পারার ক্ষেত্রেও আমার ঘাটতি আছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে যেটুকু সহজে বোঝা গেছে, সেটুকুই বলতে পারি। প্রথমত, সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে এই আন্দোলনটির চরিত্রগত মিল প্রচুর, অমিল সম্ভবত কম। তাই এসবের মধ্যে একটির প্রশংসা আর অপরটির নিন্দা একসঙ্গে করা বেশ কঠিন কাজ। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভুল-শুদ্ধ অনেক কিছুর মিশেল থাকে। এই সবকিছু সমেত একটি গণতান্ত্রিক পরিসর তার প্রাপ্য এবং আলোচনা সুস্থভাবে এগোনো উচিত। “নেগোসিয়েশন”-এর কণ্ঠরোধ বহুক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় “ভায়োলেন্স”-এর জন্মদাতা বলে আমার বিশ্বাস। এটুকুর চেয়ে বেশি কিছু বলার যোগ্যতা না থাকায় ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আমি বরং রাতুলের গ্রেপ্তার হওয়ার প্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট আন্দোলনের পরিসর পেরিয়ে ভাবছি। সেই ভাবনায় অবশ্যই রাজনৈতিক বোধে খানিক রঙ মিশিয়ে থাকতে পারে ব্যক্তিগত প্রীতি। সেই সম্পর্কের কথাটাও অতএব এই জায়গায় স্বীকার করে নেওয়া উচিত। আমি যে কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেছিলাম, রাতুল সেই কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকেই ডাক্তারি পাশ করেছে কয়েক বছর পর। আমাদের “মাটিয়া” কলেজের ঐতিহ্য হল, কলেজের জুনিয়রদের অনুজপ্রতিম ভাবা। অতএব আমি দুর্বল অনস্বীকার্যভাবে। রাতুলের সাথে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সাক্ষাৎ সেই কলেজের ক্যান্টিনেই। যেহেতু কলেজ পাশ করার পর সে যে রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিল, সেই দলের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না, সেহেতু নিজেদের সব কথা সে আমার সাথে আলোচনা করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু নিজের বোধ আর বিশ্বাসের কথা বলত। তা নিয়ে আলোচনা করত। তা থেকে এবং নিজের চার দশকের জীবনে মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমি মোটামুটি বুঝি রাতুলের পক্ষে কী করা সম্ভব আর কী সম্ভব নয়। যেমন নাশকতা বা ভায়োলেন্স তার চরিত্রবিরুদ্ধ বলেই আমার বিশ্বাস। যে মনোভাব নিয়ে যে ধরণের কাজ সে করছে, তার জন্য সেসবের কোনও প্রয়োজনীয় ভূমিকাও নেই। সংবাদপত্রে জানতে পারলাম, সে নাকি ফেরার ছিল। কিন্তু তাকে আমি দিব্বি বিনা ছদ্মবেশে শহরের রাস্তায় স্বাভাবিকভাবেই ঘুরতে দেখেছি। হিসেবমতো যে সময় থেকে সে ফেরার বলে শোনা যাচ্ছে, তার পরবর্তীকালে একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে সম্ভবত এক উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তার পাশে তাকে দেখা গেছে আলোচনাচক্রে। অর্থাৎ পুলিশের হাত থেকে আত্মগোপন করার কোনও উদ্দেশ্য তার ছিল বলে মনে হয় না।
ভাঙড় আন্দোলনের প্রতি রাতুলের সক্রিয় সমর্থন ছিল বা আছে, তা জানি। আমার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে তার অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক বিধিসম্মতই ছিল, এবং সে নিজে যে কাজটুকু করতে গিয়েছিল, তা চিকিৎসক হিসেবেই। তাছাড়া এই আন্দোলন তার কাজের অংশ হলেও তাকে সামগ্রিকভাবে ডিফাইন করে না। অনেকদিন কথাবার্তা না হবার পর গত দুমাসে কয়েকবার কথা হয়েছিল তার সাথে। যে দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে ভাঙড় ছিল না। সম্ভবত সেখানকার পরিস্থিতিতে একটি স্থিতাবস্থা চলছে বলে এবং রাতুল বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশি করে ভাবছে বলেই তার কথাবার্তা অন্যান্য বিষয়েই। গৃহপরিচারিকার কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা রোজ অনেকক্ষণ ঝুঁকে কাজ করার ফলে অল্প বয়সে মেরুদণ্ড এবং হাঁটুর সমস্যায় আক্রান্ত হন। চিকিৎসক হিসেবে আমারও তাই অভিজ্ঞতা। রাতুল জানতে চাইছিল নিউরোলজিক্যাল দৃষ্টি থেকে এই ক্ষয়, ব্যথা-বেদনা, ইত্যাদির কোনও প্রতিষেধক সম্ভব কিনা। আমরা আলোচনা করছিলাম আর্গোনমিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ঘর ঝাড়মোছ করার মতো কাজগুলিতে কীভাবে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা যায়, যাতে হাঁটু বা মেরুদণ্ডে কম চোট লাগে। একদিন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে বক্তৃতা করতে গিয়ে সেখানকার এক অধ্যাপকের সঙ্গেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলাম, একথা জানতে পেরে যে তিনি আর্গোনমিক্সে রীতিমত প্রশিক্ষিত। এসব প্রচেষ্টা রাজনৈতিক তো বটেই, কিন্তু দস্তুরমতো ডাক্তারিও তো! আসলে এরা তো কিছু মহৎহৃদয় তরুণ, যারা অপরের দুঃখে দুখী হয় আর সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে। সেলাম ছাড়া আর কী দিতে পারি এদের?
এছাড়া আরেকটি বিষয়ে কথা হত। তা হল, তার নিজের স্বাস্থ্য। স্পষ্ট করে বললে ঘাড়। ঘাড়ের কশেরুকা সরে গিয়ে অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা পাচ্ছে ছেলেটা। শক্ত কলার লাগিয়েও কাজ হচ্ছে না। স্নায়ুমূল পিষ্ট হয়ে হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। হয়তো অপারেশনের প্রয়োজন পড়বে কোনওদিন। যেদিন দেখাতে আসবে বলেছিল, সেদিনই খবর পেলাম যে তাকে মাঝরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কেন রাতুলকে এই সময় গ্রেপ্তার করতে হল, তা আমি এখনও বুঝিনি। শান্তি বিঘ্নিত করার লোক সে নয়। ভাঙড় আন্দোলনও ক্রমশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার দিকে এগোচ্ছে শুনে অনেকের মতোই আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কেউ কেউ বলছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে শাসক দলের সুবিধার্থে এইসব গ্রেপ্তার। সেই সুবিধাটাই বা কী? আসন্ন নির্বাচনে শাসক দলের জয় প্রায় নিশ্চিত। সেখানে এই ধরপাকড় সেই দলকে কী বাড়তি সুবিধা দান করবে? অথচ এইসব সরকারি পদক্ষেপের মধ্যে একটা গূঢ় বার্তা তো থাকেই, যা শিক্ষণীয়। কী সেই বার্তা? আপাতত চিকিৎসক হিসেবে সামান্য বুদ্ধিতে মনে হচ্ছে যেন বলা হল, “ডাক্তার, নিজের যত্ন নাও, করে কম্মে খাও, আখের গোছাও, মানুষের কথা একদম ভাবতে যেও না। খবরদার! ভাবলেই কান মলে দেব।” স্বাস্থ্য পরিষেবার বর্তমান টালমাটাল অবস্থায় এ জাতীয় বার্তা কি অসম্ভব ক্ষতিকারক নয়? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী চিকিসকদের কাছে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, ঠিক তার বিপরীত বার্তা হয়ে গেল না? এখন তো রাতুলের মতোই অজস্র চিকিৎসক, অজস্র মানুষ প্রয়োজন, যাঁরা অন্ধকূপ থেকে মানুষকে টেনে তুলবেন আলোয়। সেসব প্রচেষ্টার সুফল তো সরকারও পেয়ে থাকেন পরোক্ষভাবে। প্রজা সুস্থ থাকলে, খুশি থাকলে তো রাজার মঙ্গলকামনাই করে থাকেন। প্রজা নিদারুণ কষ্টে থাকলে, তাঁদের রোষ বাড়ে আর সম্মিলিত রোষের বহ্নি ধাবিত হয় শাসকের দিকেই। ইতিহাসের এই শিক্ষাটাকে অস্বীকার করে আদৌ শাসকের উপকার করা হচ্ছে বলে মনে হয় না।
স্বাস্থ্য আর চিকিৎসার ক্ষেত্র পেরিয়ে শেষ দু’কথা বলি। বিনায়ক সেন বন্দি হবার সময় এই কথাটা মনে হয়েছিল। ছত্তিশগড়ের “মাওবাদী সমস্যা” নিয়ে বন্ধুরা যখন কথা বলছিলেন এবং সেই কারণে ডক্টর সেনের বন্দিত্বকে সমর্থন করছিলেন, তখন এই প্রতিতর্ক মনে এসেছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করলে আদতে বন্দুকের রাজনীতিকে সাহায্য করা হয়। ডক্টর সেনের মতো যাঁরা আদিবাসীদের মধ্যে গঠনমূলক কাজ করছিলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথে হাঁটতেন, তাঁদের যদি একে একে কয়েদ করে ফেলা যায়, তাহলে নেতৃত্ব দেবার জন্য বাকি থাকেন কারা? যাঁরা বন্দুক হাতে নিজেদের রক্ষা করতে পারছেন তাঁরাই। তাঁরা তখন খুব সহজেই বলার সুযোগ পান যে আলোচনার মাধ্যমে কিছুই হবে না, কথাবার্তা শেষ হয় জেলের কালো কুঠুরিতে, অতএব বন্দুকের নলই শেষ কথা। তাঁদের একথা বলার জন্য জমি তৈরি করে দেওয়াই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয় তবে রাজ্যে, দেশে এবং বিশ্বজুড়ে এই পদ্ধতির প্রয়োগ চলতে থাকুক। (অস্ত্র বিক্রেতা ব্যবসায়ীরা খুশি হবেন।) কিন্তু শান্তি যদি লক্ষ্য হয়, রক্তক্ষয় রোধ যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে পদ্ধতি বদলানো আশু প্রয়োজন।
শুধু রাজ্যের নয়, শুধু দেশের নয়, সমগ্র পৃথিবীর ঘোর দুঃসময় এখন। মানুষের লোভে প্রকৃতি ধ্বংসের মুখে। প্রকৃতির রোষেই মানুষ সহ দুনিয়ার তিন চতুর্থাংশ প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সম্ভবত আর দুশো বছরের মধ্যে। মানুষের অসহিষ্ণুতা আর হিংস্রতা এমনভাবে বাড়ছে, যে হানাহানি করে সমূলে ধ্বংস হতে লাগবে পাঁচ দশকের চেয়েও কম সময়। তখন আর কেউ কারও জমি দখল করে কোটি টাকায় বিক্রি করতে পারবে না, কারণ জীবিত কোনও ক্রেতা থাকবে না। সব ভোটার মরে গেলে কেউ কোনও পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভা বা সেনেটের গদি দখল করতে পারবে না। সেই মহাশ্মশানে শূন্য সিংহাসনে বসে তখন কী করবেন রাজা ইদিপাস?
বাঁচতে গেলে অতএব এই লোভ আর হিংস্রতাসর্বস্ব যুদ্ধবাজ পুরুষ পুরুষ পদ্ধতি ত্যাগ করে ভালোবাসার আশ্রয়ে যেতেই হবে। এখন তো আসলে প্রয়োজন লক্ষ লক্ষ এমন মহৎমনা তরুণের, যারা নিজের শারীরিক ক্লেশকেও অগ্রাহ্য করবে মানুষের প্রতি ভালোবাসায়। পৃথিবী ডুবছে। ভেসে থাকার জন্য এই শেষ আশার খড়কুটোটুকু আঁকড়ে ধরা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মানুষ মানুষের পাশে থাকুন। বিশ্ব জুড়ে মানুষের নির্বাচিত প্রশাসকেরাও এইসব সেবাব্রতী তরুণদের পাশে দাঁড়ান। কারাগারের বদলে আলোচনার মঞ্চে এঁদের স্থান দিন। নইলে আমাদের সন্তানেরা তাদের পূর্ণ আয়ুষ্কাল বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে না।